পত্রিকা সমালোচনা / পাঠ প্রতিক্রিয়া
‘কালিমাটি’ / সংখ্যা ১১১ / বিষয়: সত্তর দশক / পৌষ ১৪৩১ / সম্পাদক: কাজল সেন ও পূর্ণেন্দুশেখর মিত্র
(সম্পাদকীয়
বক্তব্যঃ ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১১১তম সংখ্যার আলোচ্য বিষয় ছিল সত্তর দশক। মোট কুড়িটি
প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনে প্রকাশিত
লেখাগুলির আলোচনার জন্য আলোচক প্রথম কিস্তিতে বেছে নিয়েছিলেন প্রথম সাতটি প্রবন্ধ ও
নিবন্ধ। বর্তমান কিস্তিতে তিনি আলোচনা করেছেন পরবর্তী পাঁচটি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। বাকি
আটটি প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিষয়ে আলোচনা প্রকাশিত হবে আগামী জুলাই সংখ্যায়।)
বিশুদ্ধ রাজনীতির বৃত্তের বাইরে এসে এবার পা ফেলা যাক সংস্কৃতির আঙিনায়। জয়িতা ভট্টাচার্যর প্রবন্ধ ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সাহিত্য : নকশালবাড়ি আন্দোলনের আলোকে’। অত্যন্ত আবেগদীপ্র লেখাটি শুরুই হচ্ছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে। প্রবন্ধটির দু’টি প্রধান ভরকেন্দ্র --- রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নকশালবাড়ি আন্দোলন। প্রবন্ধটির প্রথম অনেকখানি অংশ জুড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া অনেকানেক গণহত্যার নামাবলি, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুমিছিল। এসব সন্ত্রাসের কোন নির্দিষ্ট অভিমুখ নেই। কখনো জাপানি সৈন্যের অনপনেয় নিষ্ঠুরতার বলি হয়েছে চীন। আবার কখনো চীনের যুথবদ্ধ আক্রমণের সামনে ধ্বস্ত হয়েছে তিব্বত। তবে নির্দিষ্ট সময় ও প্রেক্ষাপটের উল্লেখ না থাকায় ‘কামচাৎকায় কসাক হত্যা’ এবং ‘জাপানে, লেনা নদীতে (বয়ে যাওয়া) ইয়াকুটদের রক্ত’ --- এই দুটি ঘটনায় ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাদের আশঙ্কা রয়েছে। যদিও তাতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়াবহতা হ্রাস পায় না। ক্রমশ গণহত্যার পাশাপাশি জায়গা করে নেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিহত্যাও। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারীও রেহাই পান না সন্ত্রাসের ছোবল থেকে। লেখিকার কথায় ‘সন্ত্রাস ও গণহত্যা’ অব্যাহত থেকে যায় ‘বিকেন্দ্রিতভাবে’। গণহত্যায় লক্ষ লক্ষ মৃত মানুষের কথা ইতিহাস মনে রাখেনি। তবু সেই “...ইতিহাস লেখা হয় সাহিত্যে। গল্পে, কবিতায়, নভেল ও ম্যানিফেস্টোতে”। দমন পীড়নের মধ্য থেকে জন্ম নেয় গণসংগ্রাম। “একটি গণসংগ্রামে সাহিত্য ও শিল্প হাতিয়ার হয়ে ওঠে, বিপ্লবে আসে গতি। আবার বিপ্লবের ম্যানিফেস্টো হয়ে ওঠে সাহিত্য তথা সাহিত্যের দলিল”। এইভাবেই লেখিকা পৌঁছে যান তাঁর বেছে নেওয়া দ্বিতীয় ভরকেন্দ্র, নকশালবাড়ি আন্দোলনের রূপরেখায়। এই অতি-বাম রাজনীতির তাত্ত্বিকতার আদল তৈরি হয়েছিল বিপ্লবে বিশ্বাসী, বামপন্থী কিছু বিদেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বীক্ষণের ছায়ায়। তবুও লেখিকার মতে নকশাল আন্দোলনের মূল শিকড় ছিল তেভাগার কৃষি আন্দোলনে। অর্থাৎ তাঁর মতে মূল পরিচয়ে নকশালবাড়ির আন্দোলন একান্তই দেশজ কৃষি আন্দোলন। এই কারণে লেখিকা তেভাগা আন্দোলনকে অনেকটাই জায়গা দিয়েছেন তাঁর লেখায়। স্বীকার করে নেওয়া ভালো, অনেক বছর আগের ‘শিশুতোষ’পাঠক্রমে যে ‘সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস’ (শব্দবন্ধটি নাট্যকার বাদল সরকারের, সম্ভবত ‘ভোমা’ নাটকের সংলাপ) আমরা পড়েছিলাম তাতে আদৌ তেভাগা আন্দোলনের কোন কথা ছিল বলে মনে পড়ে না! যেটুকু জেনেছি তার সবটাই গল্প, উপন্যাস আর গণসঙ্গীতের দৌলতে জানা, ভাসা ভাসা কিছু ধারণা মাত্র। অথচ তেভাগার ঐ সময়কাল নিঃসন্দেহে এক যুগসন্ধি। কিছুদিন আগেই বাংলার বুকে ঘটে গেছে মন্বন্তরের প্রেতনৃত্য। তেভাগা আন্দোলনের ওইটুকু সময়কালের মধ্যে ঘটেছে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা আর ছিন্নমূল শরণার্থীর ঢল। এই সমস্ত ঘটনা আর তেভাগা আন্দোলন, দুই পরস্পর বিচ্ছিন্ন সমান্তরাল সরলরেখা, একথা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। অথচ তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আমাদের মত অজ্ঞ পাঠকেরা রয়ে গেছি নিতান্ত অন্ধকারে। সেইখানে এই লেখিকার রচনা কিছুটা আলো ফেলে বই কি। জেনে আশ্বস্ত হই, “তেভাগা আন্দোলনের তিনটে বছর অনেক বিভাজন মুছে দিয়েছিল। না-খেতে পাওয়া মুসলিম কৃষকের সাথে না-খেতে পাওয়া হিন্দু কৃষকের ভাগাভাগি দূর হয়েছিল। ছেলেদের ও মেয়েদের কাজের ভাগাভাগি মুছে গেছিল”। তবুও খটকা লাগে, নোয়াখালির ঐ গণহত্যা, লেখিকা নিজেই যার উল্লেখ করেছেন প্রবন্ধের শুরুতে, তা তাহলে ঘটল কী করে? সেখানে কি তেভাগা আন্দোলন পৌঁছয়নি? অথচ সীমান্তের ওপারে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে তেভাগা আন্দোলনের কথা লেখিকা নিজেই বলেছেন স্পষ্ট করে, যা জারি ছিল স্বাধীনতার পরেও, এপারের মতই। জানতে ইচ্ছে করে কী ছিল সেই আন্দোলনের রূপরেখা? কতখানি প্রভাব ফেলেছিল তা ওপারের জনজীবনে? কেমন করেই বা তা মুখোমুখি হয়েছিল সদ্যোজাত পাকিস্তানী রাষ্ট্রযন্ত্রের? এপার বাংলায় আমরা অবশ্য জানি, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তেভাগার অবদান বড় কম নয়। এই আন্দোলনকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য, গান বেঁধেছেন সলিল চৌধুরি, কৃষক নেতা কালী সরকার। তবে সবচেয়ে নজর কাড়ে তেভাগা আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক মহিলার উপস্থিতি। যেমন কাকদ্বীপে পুলিশের গুলিতে নিহত অহল্যা, যাঁকে নিয়ে গান বাঁধা হয়েছে, তৈরি হয়েছে গণসঙ্গীত। পাতার পর পাতা ভারি হয়ে ওঠে মহিলা শহিদদের নামের তালিকায়। শুধু লড়াকু সৈন্য হিসাবেই নয়, সংগঠক ও নেত্রী হিসাবেও তাঁরা ছিলেন সামনের সারিতে। যেমন ইলা মিত্র, মণিকুন্তলা সেন, যাঁরা প্রাথমিকভাবে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আরও ছিলেন হাজি মহম্মদ, নিয়ামত আলি, যতীন মাইতি, গুণধর মাইতি, কংসারি হালদার, দানেশের মত কৃষক নেতারা। ছিলেন মুজফ্ফর আহমেদের মত প্রথম সারির পার্টি নেতাও। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে ভূমিজ আন্দোলনের বিরোধ প্রকট হয়েছে লেখিকার জবানীতে, “এভাবেই যখন তুঙ্গে ঊঠেছে আন্দোলন, পেছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা করেছে নেতৃত্ব”।
তেভাগা ও নকশালবাড়ির মধ্যে প্রায়
দুই দশকের ব্যবধান। তবু তাদের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে ধরে নেওয়া যায় ষাটের দশকের খাদ্য
আন্দোলন। সে আন্দোলনও বাংলা কবিতায় যথেষ্ট ছাপ ফেলেছিল। আর তারপরেই আসে নকশাল আন্দোলনের
কথা। এই আন্দোলন যে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য, শিল্প, নাটক, চলচ্চিত্র সব কিছুকেই গভীরভাবে
প্রভাবিত করেছিল, এখনও করে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখিকা নিজেও এই অতি বিস্তৃত
বিষয়ের গভীরে যাননি, শুধু প্রতিনিধিত্বমূলক কিছু আভাস দিয়েছেন। তবে বিশেষভাবে উল্লেখ
করেছেন “প্রায় বিস্মৃত লেখক স্বর্ণ মিত্রর ‘গ্রামে চলো’ উপন্যাসটি”, লেখিকার বয়ানে
যেটি “এক অনবদ্য দলিল কৃষক আন্দোলনের”। তবে এ রচনার আসল সম্পদ, ভারতবর্ষের অন্য সব
ভাষায় ও সাহিত্যে নকশাল আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব
ও উপস্থিতির খতিয়ান। অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানা, তামিলনাডু, কেরল, মরাঠা, পঞ্জাব, হিন্দি
ও উর্দুবলয় --- বস্তুত নকশাল সাহিত্যের পরিধির বিপুল বিস্তার আমাদের অবাক করে দেয়। গড়ে উঠেছে ‘সাহিত্য মিত্রালু’, ‘বিরাসম’, বা ‘জন-নাট্য
মণ্ডলী’র মত প্রতিষ্ঠান, তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র ‘থান্নির থান্নি’র বা ‘আম্মা আরিয়েল’। অবাক লাগে জেনে সীমান্তের
ওপারেও পৌঁছে গিয়েছিল নকশাল আন্দোলনের প্রভাব।
লেখিকা আমাদের জানাচ্ছেন যে চারু মজুমদারের আটদফা দলিল বিরাট আলোড়ন তুলেছিল ওপার বাংলায়।
অন্তত চারটি ধারায় চলেছিল সেই আন্দোলন। অথচ তখন সেখানে চলছে খান সেনাদের বিপুল তাণ্ডব।
মুক্তিযুদ্ধের সেই জটিল দিনগুলিতে কেমন ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও বিপ্লবীদের পারস্পরিক সমীকরণ?
কেমন ছিল তাঁদের নিজস্ব বিভিন্ন ধারার মধ্যেকার যোগাযোগ বা সমঝোতা? কেমন ছিল সদ্যোজাত
এক রাষ্ট্রের সাথে বিপ্লবে বিশ্বাসী এইসব মানুষের শত্রুতা বা মিত্রতার উপাখ্যান? প্রশ্ন
অনেক, অথচ উত্তর অল্প। লেখিকা শুধু এটুকু জানাচ্ছেন যে ’৭৪ সালের পর এই আন্দোলনের ধারা
স্তিমিত হয়ে এলেও ’৮৬ সাল থেকে চারু মজুমদারের আদর্শকে সামনে রেখে আবার নতুন করে এই
আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে এবং তা জারি ছিল ২০০৪ সাল পর্যন্ত।
খোদ পশ্চিমবঙ্গে স্বভাবতই এই আন্দোলনের
প্রভাব ছিল বিপুল। সমকালীন তো বটেই, তার পরেও লেখা হয়েছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক
--- তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। নকশাল আন্দোলনকে নিয়ে লেখা উপন্যাসের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে
উঠে এসেছে জয়া মিত্রর ‘হন্যমান’ আর মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’। গল্প লিখেছেন
শৈবাল মিত্র, বিমল কর, সমরেশ বসু। শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়দের পাশাপাশি রাজবংশী ভাষায় কবিতা লিখেছেন
দিলীপ বাগচি। কবিতা লিখেছেন বিপুল চট্টোপাধ্যায়, দুর্গা মজুমদার, মুরারি মুখোপাধ্যায়,
সমকালীন বিস্মৃত কবি কৃষ্ণা ধর বা সমীর রায়-রা। উৎপল দত্ত নিয়ে এলেন নাটক ‘তীর’। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালদের
হাত ধরে তৈরি হতে লাগল নতুন সিনেমা। ‘ম্যানিফেস্টো’, ‘ব্যারিকেড’ বা ‘স্পন্দন’এর মত
নকশালপন্থী পত্রিকারা হয়ে উঠল বাংলার সংস্কৃতির অন্যতম অংশ। এই আন্দোলন প্রভাবিত করেছে পরবর্তীকালের সাহিত্যকেও,
যেমন হাসান আজিজুল হকের ‘আমরা অপেক্ষা করছি’, বা দীপঙ্কর মিত্রের ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী
১৯৭১’।
তেভাগা যদি নকশালবাড়ির পূর্বসূরি
হয়, তবে একুশ শতকের মাওবাদী জনযুদ্ধগোষ্ঠীকে ধরেই নেওয়া যায় তাঁদের উত্তরসূরি। পরিসংখ্যান
দিয়ে লেখিকা দেখিয়ে দেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতা। উল্লেখ করেন মরিচঝাঁপির।
আর এইভাবেই কিষেনজির মৃত্যু হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এক জঘন্য প্রতীক। লেখিকার
আবেগ তাঁকে বসিয়ে দেয় বীরের আসনে। আর তখনই ধাক্কা লাগে বুকের পাঁজরে। কারণ সেই সময়ের
মাওবাদী আন্দোলনের সাফল্যের অন্যতম নিদর্শন, রেললাইনের ওপর উলটে পড়ে থাকা ‘জ্ঞানেশ্বরীর’
বগিতে বগিতে অজস্র মৃতদেহ। তার যে কোনোটা আমিও হতে পারতাম, অথবা আমারই কোন প্রিয়জন।
“We are alive by chance” --- ২০০৫ সালে দিল্লীর
দেওয়ালির রাতে আমার বন্ধুর করা আলটপকা এই মন্তব্য নাছোড় ভোমরার মত গুণগুণ করতে থাকে
মগজের কোণায়। কারণ ২১ শতকে পৌঁছতে পৌঁছতে আমরা জেনে গেছি সম্পূর্ণ রাষ্ট্রহীন সন্ত্রাস
কতখানি ভয়ঙ্কর। এও জানি দুনিয়া জোড়া সমান্তরাল অর্থনীতির বাজারে ‘সন্ত্রাস’ কত লাভজনক
পণ্য। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘সংবর্ত’ কবিতার একটি পংক্তিকেই তাই কিছুটা বদলে নিয়ে বলতে
ইচ্ছে করে, “একা রাষ্ট্রের নিন্দা সাধে আর বাধে কি বিবেকে?”
নজর কাড়ে নকশাল আমলে নিহত কবিদের
সাথে এক বন্ধনীতে ‘সাম্যবাদী দার্শনিক’ শ্রীচৈতন্যদেবের উল্লেখ, লেখিকার মতে যাঁকে খুন হয়ে যেতে হয়েছিল
“স্রোতের বিপরীতে কথা বলার জন্য”। তাঁর বক্তব্য মনে করিয়ে দেয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের
‘কবির মৃত্যু’ কবিতাটি। প্রবন্ধটি শেষ হয়েছে লেখিকার প্রিয় নেতা ‘সি. এম.’ অর্থাৎ চারু
মজুমদারের উদ্ধৃতি দিয়ে। সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি তাঁর নিষ্ঠা ও আবেগের পরিচয় বহন করে। তাঁর
সেই সংগ্রামী আবেগকে কুর্ণিশ। কিন্তু সাধারণ পাঠক হিসাবে আমাদের মনে হয়, যে কোন সন্ত্রাসবাদী
আন্দোলনই ‘ক্ষুরস্য ধারা’। কঠোর আত্মসমীক্ষা না থাকলে, আবেগকে যুক্তির নিগড়ে না বাঁধতে
পারলে, ধ্বংসই তার স্বাভাবিক ভবিতব্য। রবীন্দ্রনাথ
যেমন বারবার বলেছিলেন --- মানুষকে মাতিয়ে তোলার বদলে পাকিয়ে তোলার কথা। যদিও আমরা প্রায়ই
তাঁর অনেক আপাত-অস্বস্তিকর বক্তব্যকে নিছক কবিকল্পনা বলে পাশ কাটিয়ে যেতে অভ্যস্ত।
পরের প্রবন্ধ তপোধীর ভট্টাচার্যর ‘সত্তর দশক ও বাংলা কবিতা : দ্বিরালাপের সূত্র-সন্ধান’। প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, কবিতার তাত্ত্বিক আলোচনায় আমি একেবারেই অপারগ। ফলে এই প্রবন্ধের সঠিক পর্যালোচনা করা আমার সাধ্যের বাইরে। নিছক উপর উপর কিছু সাধারণ ধারণার কথাই বলা চলে। প্রবন্ধের ভাষা সঙ্কেতময়, বক্তব্য দার্শনিকতায় জারিত। এটুকু মনে হয়েছে লেখকের মনোজগতে কবিতার ধ্রুবপদ জীবনানন্দের সুরে বাঁধা। সত্তর দশকের কবিদের সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক যেন বারে বারেই দ্বিধাগ্রস্ত, সংশয়ী। যেন স্বীকৃতির শিরোপা দেওয়ার মুখে জড়ো হয়ে ওঠে হাজার একটা প্রশ্ন। তবু তারই মধ্যে লেখক আশাবাদী, কারণ “…এই জীবনের মাঝখানে কোন কোন কবি জেগে থাকতে জানেন”। আর এইভাবেই লেখকের আলোচনা একসময়ে পৌঁছে যায় একুশ শতকে, এখনকার সময়ে। তিনি লক্ষ্য করেন, “কবিতার বয়ানের জন্য কোন কিছুই অগ্রহণীয় নয়”। তাত্ত্বিকতার গণ্ডী পেরিয়ে প্রবন্ধটি শেষ হয় ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদ জাগিয়েই।
কবিতার কথা বলেছেন যশোধরা রায়চৌধুরীও। তবে তাঁর ভাষ্য আলাদা। পঞ্চাশের পৃথিবীজোড়া ‘তীব্র প্রতিবাদঘূর্ণি’, ষাট দশকে বাংলা কবিতার ‘হাংরি আন্দোলন’ পার হয়ে, ‘চূড়ান্ত ব্যক্তিমুখীনতা’ থেকে ‘দোলকের মত’ বিপরীত মুখে যাত্রাকারী, রাজনৈতিক আলোড়নে জারিত, সত্তরের বাংলা কবিতা --- এক নতুন পালাবদল; যেখানে কবিতা কখনও শ্লোগান, কখনও পোস্টার, কখনও অন্য কিছু। নিজের জন্য তিনি কিন্তু বেছে নিয়েছেন কিছু নৈরাজ্যবাদী কবিতা যা, তাঁর মতে, এই দশকের কবিতার ‘প্রাণ ভোমরা’। তাঁর রচনার শিরোনাম ‘তিন পৌরুষের প্রখরতা আর দুই নারীর সুবাসিত ভাষাবলয়’। পাঠককে হাত ধরে তিনি তাঁকে নিয়ে চলেন তাঁর প্রিয় কবিদের দুনিয়ায়। সেখানে তিনি মিশিয়ে দেন তাঁর নিজের কিছু অনুভব, কবির কিছু আত্মপরিচয়। আর লেখক ও তাঁর প্রিয় কবিতার পারস্পরিক রসায়নে জারিত হতে থাকে পাঠক নিজেও। এইভাবে তুষার চৌধুরী, ফাল্গুনী রায় আর শামশের আনোয়ারের মত তিন প্রখর পুরুষের জ্বলন্ত অস্থিরতা পেরিয়ে এসে পৌঁছই দুই নারীর পেলব রাজ্যে। গীতা চট্টোপাধ্যায় আর রমা ঘোষ --- একজন খুঁজে আনেন প্রাচীন সুবাস, অন্যজন নিজেকে বিলীন করে দেন প্রকৃতির স্বাদুতায়। পেলব হওয়া কি সত্যই সহজ? হয়তো নয়। কবিতাগুলো শুধু ঘুরে ঘুরে ঘাই মারতে থাকে, ফিরে ফিরে আসে। আপাত-নম্র অথচ সাহসী কিছু উচ্চারণ বিঁধে থাকে মর্মের ভিতরে। ধন্যবাদ যশোধরাকে, এমন একটি পাঠ-অভিজ্ঞতার শরিক করার জন্য।
কবিতার পর উপন্যাস। এই ভার নিয়েছেন রাহুল দাশগুপ্ত। শিরোনাম ‘সত্তর দশক : নকশাল আন্দোলন নিয়ে লেখা উপন্যাস’। শুরুতেই চমক। সন্দেশে প্রকাশিত হয়েছিল ‘রক্তকমল’ নামে একটি কিশোর উপন্যাস। রচয়িতা ‘বৌদ্ধিক গায়ক রঞ্জনপ্রসাদ’। উপন্যাসটি রূপকের আড়ালে নকশাল আন্দোলনের ‘রূপকথা’, সেই সাথে সেই আন্দোলনের একটি যথাযথ মূল্যায়নও বটে। গল্পের অছিলায় সেখানে অদূর ভবিষ্যতে বিপ্লবী আন্দোলন ফিরে আসার আশা দেখানো হয়েছিল। লেখক নিজে না বললেও, নকশাল আন্দোলন নিয়ে ছোটদের জন্য লেখা উপন্যাস আপাতত এই একটিই ধরে নেওয়া যায়। এই উপন্যাসটির সূত্র ধরে লেখক প্রথমেই নকশাল আন্দোলনের একটি মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর অবলম্বন সুনীতিকুমার ঘোষের লেখা ‘নকশালবাড়ি : একটি মূল্যায়ন’, লেখকের মতে যে বইটি ‘সবচেয়ে প্রামাণ্য’। নকশাল আন্দোলনের উৎস খুঁজতে তিনি পিছিয়ে গিয়েছেন বিশ শতকের গোড়ায়, যখন অরবিন্দ ঘোষের হাত ধরে রোমাণ্টিক বাঙালি প্রথম বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। রোমাণ্টিক বিপ্লবের ধারায় বাঙালির দ্বিতীয় প্রচেষ্টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, যার নেতৃত্বে ছিলেন রাসবিহারী বসু, বাঘা যতীনরা, আর তৃতীয় প্রচেষ্টা ত্রিশ দশকের গোড়ায় মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে। অবধারিতভাবে চতুর্থ প্রচেষ্টার নায়ক সুভাষচন্দ্র বসু, সময়কাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সে হিসাবে নকশাল আন্দোলন এই ধারায় বাঙালির পঞ্চম বিপ্লব প্রচেষ্টা। সে অর্থে নকশাল আন্দোলন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী ধারার উত্তরসূরি। ইতিহাস বলে, একেবারে শুরুতে যে ‘হিন্দু’ জাতীয়তাবাদ ও আধ্যাত্মিকতা ছিল তা থেকে সরে এসে পরবর্তীকালে বিপ্লবীদের স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষাই প্রধান হয়ে উঠেছিল। ত্রিশের দশক থেকে বিপ্লবীদের মধ্যে কমিউনিজমের প্রভাব লক্ষ্য করার মত। মাস্টারদার অনুগামী অনেকেই পরবর্তীকালে কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। অর্থাৎ নকশালরা ছিলেন একই সাথে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির রোমাণ্টিক এবং বামপন্থী বিপ্লবী ধারার অনুবর্তী। এই আন্দোলনের যথার্থ মূল্যায়ন করতে গেলে তাঁদের নেতা, অর্থাৎ চারু মযুমদারের একটি সার্বিক মূল্যায়ন জরুরি। এখনো পর্যন্ত এই সংকলনের কোন রচনায় তাঁকে নিয়ে এমন কোন লেখা আমরা পাইনি। জয়িতা ভট্টাচার্যের লেখায় একাধিকবার সি এম, তথা চারু মজুমদারের কথা বলা হয়েছে, তাঁর একাধিক উক্তিও উদ্ধৃত হয়েছে, বলা হয়েছে তাঁর আটদফা দলিলের কথাও। কিন্তু তার সবটাই তাঁকে অবিসম্বাদী নেতৃত্বের জায়গাতে রেখেই। এই অভাবটি পূরণ করেছেন বর্তমান লেখক। এবং সেই মূল্যায়নে তিনি যথেষ্ট নির্মম। সুনীতিকুমার ঘোষকে উদ্ধৃত করে চাঁচাছোলা ভাষায় তিনি জানিয়েছেন, চারু মজুমদার ছিলেন বাস্তববোধহীন এবং তাত্ত্বিক দিক দিয়ে দুর্বল এক নেতা। তিনি যে শুধু নিজে তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল ছিলেন তাই নয়, তিনি অন্যদেরও নিরুৎসাহিত করতেন বই পড়তে বা বই সঙ্গে রাখতে। সামগ্রিকভাবে তাঁদের কারুরই নিজের দেশ সম্বন্ধে সত্যিকারের কোন ধারণা ছিল না, খামতি ছিল ইতিহাস বোধেও। যে মাও জে দঙের আদর্শ অনুসরণ করে তাঁরা বিপ্লবের পথে এসেছিলেন তাঁর সম্বন্ধেও তাঁদের গভীর কোন বোধ ছিল না। মুখে তাঁকে অনুসরণ করার কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে প্রায়ই তিনি তার বিপরীত আচরণ করতেন। শেষের কয়েকটি কথার কিছুটা আভাস অবশ্য আমরা আগেও পেয়েছি নন্দন রায়ের প্রবন্ধে, যদিও তা ছিল অনেক বেশি সংক্ষিপ্ত এবং নৈর্ব্যক্তিক। পাশাপাশি তিনি কুর্ণিশ জানিয়েছেন বিপ্লবের প্রতি চারু মজুমদারের অবিচল নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের সংকল্পকে। তাঁর থেকে আমরা বুঝে যাই চারু মজুমদার এমন একজন ‘অতি হঠকারী’ রোমান্টিক বিপ্লবী যিনি যে কোনো মূল্যে বিপ্লব ঘটিয়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। সেই স্বপ্ন সফল করতে কোনো আত্মত্যাগেই তিনি পিছপা নন, কিন্তু একই সাথে কোন রকম সুবিধাবাদকে প্রশ্রয় দিতেও একান্তই নারাজ। বস্তুত বিপ্লবের প্রতি তাঁর সততা ও নিষ্ঠা এতটাই যে লেখক তাঁকে তুলনা করেছেন প্রবাদ-প্রতিম বিপ্লবী চে গুয়েভারার সাথে। সামগ্রিকভাবে নকশাল আন্দোলনের মূল্যায়নেও লেখক একই রকম স্পষ্টবাক্। তাত্ত্বিক দুর্বলতা, ইতিহাসবোধে খামতি, বাস্তব পরিস্থিতি সম্বন্ধে ধারণার অভাব, এই সব কিছুকেই তিনি চিহ্নিত করেছেন নকশাল আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ বলে। একই সাথে, লেখকের মতে, এগুলি বাঙালি মধ্যবিত্তের নিজস্ব চরিত্রলক্ষণও বটে। কিন্তু তাবৎ সমালোচনা সত্ত্বেও, প্রকৃত প্রস্তাবে লেখক কিন্তু নকশালদের বিপ্লবী চেতনার সমর্থক। সেই সাথে যাবতীয় ব্যর্থতার পরেও তাঁর মতে চারু মজুমদার ও তাঁর নকশাল আন্দোলনের “সবচেয়ে বড় অবদান বোধহয়, মধ্যবিত্তের বিপ্লব এবং কৃষি-মজুরের বিপ্লবকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া”। মনে রাখতে হবে, অন্যায় ও অপশাসনের বিরুদ্ধে বাংলার ভূমিজ মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস সুপ্রাচীন। এই প্রসঙ্গে এগারোশ শতকের কৈবর্ত বিদ্রোহ ও তার নায়ক দিব্যোকের কথা মনে পড়তে পারে। ঔপনিবেশিক শাসনকালেও এই বিদ্রোহের ধারা অব্যাহত ছিল, যদিও পরিশীলিত নাগরিক সমাজে তা কখনই সেভাবে স্বীকৃতি পায়নি। অন্যদিকে শিক্ষিত বাঙালির প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পিছনে ছিল ঊনিশ শতকীয় ‘রেনেঁসা’, যা সরাসরি ইউরোপীয় মুক্তচিন্তার নায়কদের দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই দুই আপাত বিচ্ছিন্ন সমান্তরাল ধারাকে কখনই মেলানো যায়নি, সম্ভবত মেলানোর তত উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। “...চীনের আদলে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে কৃষি-মজুরের বিপ্লবের কথা” ভাবতে গিয়ে চারু মজুমদার সেই চেষ্টাই করেছেন এবং তাতে তিনি ও তাঁর বিপ্লবী আন্দোলন অনেকটাই সফল। তাঁদের সেই সাফল্য ও ব্যর্থতার ছাপই এসে পড়েছে নকশাল আন্দোলনকে উপজীব্য করে লেখা সত্তর দশকের উপন্যাসগুলিতে। এদের মধ্যে প্রথমেই জায়গা করে নিয়েছে মহাশ্বেতা দেবীর দুটি উপন্যাস, ‘অপারেশান ? বসাই টুডু ?’ ও ‘হাজার চুরাশির মা’। এছাড়াও উল্লেখ রয়েছে আরও দুটি উপন্যাসের, যথাক্রমে ‘অক্লান্ত কৌরব’ ও ‘মাস্টার সাব’। তাঁকে ছাড়াও আরো কুড়িজনেরও বেশি ঔপন্যাসিকের লেখা বিভিন্ন উপন্যাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তিনি। তাঁদের কেউ বেছে নিয়েছেন ‘নকশাল আন্দোলনের আদর্শ ও স্বপ্ন’, কেউ তার ‘ব্যর্থতার দিক’। ‘বিষণ্ণ নস্টালজিয়া’, ‘সমকালীন হিংসা’ অথবা ‘নিরপেক্ষ সময়ের সাক্ষী’, এক একজনের কলমে ফুটে উঠেছে এক এক দৃষ্টিভঙ্গী। কারুর কারুর উপন্যাসে সরাসরি উঠে এসেছে চারু মজুমদার ও আন্দোলনের সাথে যুক্ত অন্যান্য বাস্তব চরিত্ররা, যেমন অভিজিৎ সেনের ‘স্বপ্ন এবং অন্যান্য নীলিমা’ (২০০০), উদয়ন ঘোষের ‘আমি এখন আণ্ডারগ্রাউণ্ডে’ (১৯৯৫), বাসুদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘দুরন্ত’ (২০০৩), অথবা অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আটটা-ন’টার সূর্য’ (২০১৩)। শেষ দুটি উপন্যাসই তথ্যভিত্তিক, যেখানে দেখা মেলে অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রের। এদেরই পাশাপাশি রয়েছে তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীমূলক ট্রিলজি ‘শংখচিলের ডানা’, ‘ডানার দু-পাশে সমুদ্র’, ‘শংখসমুদ্র’ (২০০৩-২০০৭)। এইসব ঔপন্যাসিকদের অনেকেই নিজেরা সরাসরি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ইতিপূর্বে জয়িতা ভট্টাচার্য উল্লিখিত স্বর্ণ মিত্রের (উৎপলেন্দু চক্রবর্তী) ‘গ্রামে চলো’ উপন্যাসটির পাশাপাশি রয়েছে রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কমুনিস’ (১৯৭৬), জয়ন্ত জোয়ারদার ও শৈবাল মিত্রের উপন্যাসগুলি। বিশেষ করে শৈবাল মিত্রের একগুচ্ছ উপন্যাস লেখকের আলোচনায় অনেকখানি জায়গা করে নিয়েছে। উল্লেখযোগ্য লেখা ও লেখকদের মধ্যে রয়েছেন গুণময় মান্না (‘শালবনী’, ১৯৭৮), নবারুণ ভট্টাচার্য (‘হারবার্ট’, ১৯৯২; ‘কাঙাল মালসাট’, ২০০৩), রবীন্দ্র গুহ (‘উজান ডহর’, ১৯৭৯), ভগীরথ মিশ্র (মৃগয়া, ১৯৯৮), আবুল বাশার (‘অগ্নিবলাকা’, ১৯৯৩), কাশীপুর-বরানগর হত্যাকাণ্ডকে নিয়ে লেখা কিন্নর রায়ের ‘যে লেখার সিরিয়াল হয় না’, অথবা বিপ্লবী শঙ্কর গুহনিয়োগীকে নিয়ে লেখা বাসুদেব রায়ের আর একটি তথ্যভিত্তিক উপন্যাস ‘অন্য মানুষ’। তালিকাটি অনায়াসেই আরো দীর্ঘ করা যেত। তবে লক্ষ্যণীয় ভাবে অনুপস্থিত ইতিপূর্বে জয়িতা ভট্টাচার্যের প্রবন্ধে উল্লিখিত জয়া মিত্রের ‘হন্যমান’। সামগ্রিকভাবে লেখকের ধারণা, তাবৎ ব্যাপ্তি এবং গভীরতা সত্ত্বেও কোন ঔপন্যাসিকই “... বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণে ঢোকেননি, সম্ভবত তাঁদের মতাদর্শগত বাধ্যবাধকতার কারণে। এরই পাশাপাশি তিনি সমালোচনায় মুখর হয়েছেন তাঁদের প্রতি, যাঁদের তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘জনপ্রিয় ধারার’... ‘বাণিজ্যিক উপন্যাস লেখক’ হিসাবে। দিব্যেন্দু পালিতের ‘সহযোদ্ধা’ বাণিজ্যধারার হলেও লেখক স্বীকার করে নিয়েছেন উপন্যাসটি ‘দায়বদ্ধ’, যদিও তাঁর মতে এই ‘মানবিক মুখ’ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেরই স্বার্থে। প্রবল সমালোচিত হয়েছে সমরেশ বসুর ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ এবং সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’। প্রথমটি এক শূন্যতার কথা বলে, যেখানে আন্দোলনের পর কোথাও আর তার কোন স্মৃতি বা অবশেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। আর দ্বিতীয় উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক পঙ্গু, বিধ্বস্ত মানুষ এবং প্রাক্তন নকশাল --- যার করুণ অবস্থা পরবর্তী মধ্যবিত্ত বাঙালি প্রজন্মকে এই ধরনের যে কোন আন্দোলন সম্বন্ধে সমানেই সাবধান করে দিতে থাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘একজন রোমাণ্টিক, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় লেখক’ হিসাবে যাঁর ‘সেই সময়’ ও ‘পূর্ব-পশ্চিম’ এই দুটি উপন্যাসে “এই আন্দোলন ও তাঁর কেন্দ্রীয় চরিত্রের নিরালম্ব বায়ুভূত অবস্থাই উঠে এসেছে”। অবশ্য তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে তাঁর এই মূল্যায়ন নকশাল আন্দোলনের সাপেক্ষে, নচেৎ উপন্যাসদুটি “ধ্রুপদী সৃষ্টির মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য”। লেখকের মতে বাণিজ্যিক ধারার এই সাহিত্যিকেরা সব সময়েই “স্থিতাবস্থার সমর্থক” আর নকশাল আন্দোলনের লড়াইটা ছিল ঠিক এই স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে। ফলে তাঁরা এই আন্দোলনকে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসাবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছেন। লেখক তীব্র সমালোচনা করেছেন তাঁদের, যাঁরা সচেতনভাবে এই আন্দোলন সম্বন্ধে বিভ্রান্তি ছড়াতে চেয়েছেন এবং যাঁরা ‘নকশাল’ নামক ‘ব্র্যান্ড’টি ব্যবহার করে যৌনতার মোড়কে বা থ্রিলারের আদলে নিজেদের ‘রগরগে’উপন্যাসের বিপণন চেয়েছেন। এই অভিযোগে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন শীর্ষেন্দু, সঞ্জীব, তিলোত্তমা মজুমদার, বাণী বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মত প্রতিষ্ঠিত, জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের। মূল ধারার এই সম্মিলিত ‘প্রোপাগাণ্ডা’র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি আরো একবার বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন নকশাল আন্দোলনের কার্য-কারণ সম্পর্ক। মনে করিয়ে দিয়েছেন কী বিপুল হতাশা ও অবক্ষয় সে সময়ের তরুণ সমাজকে ঠেলে দিয়েছিল এই পথে। বাণিজ্যিক ধারার সাহিত্যিকদের প্রতি লেখকের অভিযোগ ও উষ্মা যথেষ্ট সঙ্গত। কিন্তু তাঁদের সবাইকে একই নিক্তিতে বিচার করার অভ্যাসটাও বোধহয় নিতান্ত একপেশে। এক সময়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে অজস্র তরুণের ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসা যেমন সত্য ছিল, তেমনি বাস্তব সত্তর দশক পার হয়ে আসার অব্যবহিত পরের এক ব্যাপক শূন্যতা ও হতাশার বোধ। লেখকদের দায়বদ্ধতা রয়েছে তাকেও যথাযথ ভাবে ফুটিয়ে তোলার। সমস্ত ভ্রান্তি ও হঠকারিতার পরেও যে বিপ্লবী চেতনাকে লেখক সোচ্চারে সমর্থন জানিয়েছেন তারই স্ফুলিঙ্গ কি আমরা দেখতে পাই না সমরেশ মজুমদারের ট্রিলজি উপন্যাস ‘কালপুরুষ’-এ? পাঠক হিসাবে এরকম এক মূল্যায়ন তো করাই যায়!
এই সংকলনের পরের বিষয় ছোটগল্প। শিরোনাম ‘সত্তর দশকের ছোটোগল্প : একটি রূপরেখা’, লেখক বাসব দাশগুপ্ত। প্রথমেই লেখক স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে “কবি-লেখকদের মনোজগত ও শিল্পীর সৃষ্টি” নির্ভর করে পরিপ্রেক্ষিত, অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্র, এবং তখনকার সমাজবাস্তবতার উপর। তিনটি প্রধান ঘটনাকে তিনি সত্তর দশকের নির্ণায়ক হিসাবে উল্লেখ করেছেন --- ১) নকশাল আন্দোলন, ২) মুক্তিযুদ্ধ ও ৩) জরুরি অবস্থা। তবে ছোটগল্পের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি মূলত দুটি ঘটনাকেই মান্যতা দিয়েছেন, যার একটি অবশ্যই নকশাল আন্দোলন এবং অন্যটি এখনো পর্যন্ত অনুল্লেখিত হিপিতন্ত্র। অর্থাৎ এই সময়েই বিদেশ, মূলত পাশ্চাত্ত্য থেকে প্রচুর হিপি ভারতে এসে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্য একভাবে এও ছিল এক ছক ভাঙার চেষ্টা। হিপিদের নেশাগ্রস্ততা, ছন্নছাড়া জীবন ও অবাধ যৌনতা প্রভাবিত করেছিল সেই সময়ের সমাজভাবনা ও কথাসাহিত্যকে। লেখকের মতে বহুচর্চিত ‘হাংরি জেনারেশন আন্দোলন’ পুরোটা না যদি বা হয় তবু অনেকটাই এই হিপিতন্ত্রের প্রভাব। সত্তর দশকের বাংলা ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই তার পূর্ববর্তী ছোটগল্প ও গল্প লেখকদের সম্বন্ধে একটি ধারণা করা প্রয়োজন। বাংলাভাষায় ছোটগল্পের শুরু রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরীদের হাত ধরে এবং তাকে পুষ্ট করেছেন বিভূতিভূষণ, মাণিক, তারাশঙ্কর, এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরো অনেক দিক্পাল লেখকেরা। ত্রিশ কি চল্লিশ দশকের সে সব প্রাপ্তি বাংলা ছোটগল্পের এক উজ্জ্বল উদ্ধার। সত্তর দশকের শুরুতে এঁদের উত্তরসূরি, চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের অগ্রণী পাঠকপ্রিয় গল্পকাররা, তখন “স্বমহিমায় বিরাজমান”। এঁদের মধ্যে ছিলেন সুবোধ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নন্দী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সমরেশ বসুর মত প্রথিতযশা লেখকেরা। সেই সময়ে বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলিতেই সমস্ত গল্প ছাপা হত। এসব বাণিজ্য পত্রিকাগুলির মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য দেশ-আনন্দবাজার গোষ্ঠীর সর্বপ্রধান নীতিই ছিল বিপণন। আর সেইজন্যই গল্পের চেয়ে উপন্যাসের কদর ছিল বেশি। গল্পেও যথেষ্ট পরিমাণে বিনোদনের চাহিদা ছিল, হয়তো দাবীও। ফলে পঞ্চাশের দশকের ছোটগল্প ক্রমশই ব্যক্তিসর্বস্ব আর্দ্র আবেগের কানগলিতে আটকে পড়তে লাগল। প্রধান হয়ে উঠল বিদেশি প্রভাব ও নরনারীর প্রেম। বাংলা ছোটগল্পের শুরুতে মাটির সাথে তার যে যোগ ছিল, তার সাথে বিচ্যুতি ঘটতে লাগল। ষাটের দশকে এসে শুরু হল অস্থিরতা, ছক ভাঙার চেষ্টা। এই প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই হাংরি জেনারেশনের আন্দোলনের কথা এসে পড়ে। এই আন্দোলন ক্রমশ গল্পের মধ্য থেকে কাহিনীর অংশটিকেই অপ্রয়োজনীয়বোধে বাদ দিতে শুরু করল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পুরো ঝোঁকটাই এসে পড়ল আঙ্গিকের ওপর। এই ঘরানার লেখকদের মধ্যে ছিলেন রমানাথ রায়, বলরাম বসাক, আশীষ ঘোষ প্রমুখরা। হাংরিদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য বাসুদেব দাশগুপ্ত। এছাড়াও অমল চন্দ, সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, সুবিমল বসাকের মত লেখকেরা নতুন আঙ্গিকে এখনো পর্যন্ত না লেখা বিষয় নিয়ে গল্প লিখতে শুরু করলেন। ফলে বাংলাগল্পের দিগন্ত অনেকটাই প্রসারিত হল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ষাটের দশকের বাংলাগল্পের ভঙ্গীসর্বস্ব হয়ে ওঠা এড়ানো যায়নি। সত্তর দশকে এসে দেখা গেল সেই সময়ের মনন, জীবন, অভিজ্ঞতা, কোন কিছুই পঞ্চাশ বা ষাট দশকের লেখকদের লেখায় প্রকাশ পাচ্ছে না। ফলে বেরিয়ে এলেন “একঝাঁক নতুন কথাকার”। এঁদের মধ্যে লেখক তিনটি মূল প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন। প্রথমত তাঁরা, যাঁরা লেখালেখির জন্য বাণিজ্যিক পত্রিকা বেছে নিয়েছিলেন। যেমন আবুল বাশার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, রতন ভট্টাচার্য। এঁদের লেখার মূল উপজীব্য ছিল ব্যক্তিমানুষের প্রেম, হতাশা, সুখ-দুঃখ --- যা বাণিজ্য পত্রিকার চাহিদার প্রতি মানানসই। যেহেতু ছোটগল্পের চাইতে উপন্যাসের বিপণন বেশি, তাই বাণিজ্যিক পত্রিকার চাপে আবুল বাশারের মত ছোটগল্পের একজন প্রতিশ্রুতিবান লেখক পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেলেন না, এই বলে লেখক আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয়ত ছিলেন তাঁরা, যাঁরা সরাসরি নকশাল আন্দোলনের সাথে যুক্ত। যেমন স্বর্ণ মিত্র, জয়ন্ত জোয়ারদার, তিমিরবরণ, প্রদীপ দে, প্রমুখ। এঁদের অনেকের উল্লেখ এর আগের দুটি প্রবন্ধে পেয়েছি (দ্র. জয়িতা ভট্টাচার্য ও রাহুল দাশগুপ্ত)। পরবর্তীকালে এই ধারায় গল্প লিখেছেন মণি মুখোপাধ্যায় (‘গণতন্ত্র ও গোপাল কাহার’), ব্রজেন মজুমদার (‘খোদাহাটির ডাক’)। প্রকাশিত হয়েছে গল্পসংকলন। সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মতি নন্দী বা অসীম রায়ের মত মূল ধারার প্রতিষ্ঠিত লেখকেরাও এই প্রবণতাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু লেখকের মতে সত্তর দশকের এই সব নতুন গল্পকারদের মধ্যে “যতটা আবেগ ছিল ততটা কালোত্তীর্ণ লেখালেখির ক্ষমতা ছিল না”। সত্তর দশকের মূল প্রতিনিধি হিসাবে লেখক মান্যতা দিয়েছেন তৃতীয় প্রবণতাটিকে, যার পুরোধা ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। ইনি নিজে সক্রিয়ভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে কাজ করেছেন। সাহিত্যের মধ্যে তুলে ধরেছেন তাঁদের কথা। ইনি দিশা দেখালেন নতুন গল্পকারদের। পাশাপাশি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন দেবেশ রায় ও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। এঁদের অনুসরণ করে সত্তরের গল্পকাররা ফিরে গেলেন মাটির উৎসে। বর্গা অপারেশনের ফলে গ্রাম বদলে যাচ্ছিল। বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্করের গ্রামের আর কোন অস্তিত্ব ছিল না। নতুন যুগের গ্রামের কথা লিখলেন অভিজিৎ সেন (‘কাক’), অমর মিত্র (‘বছিরদ্দি ভূমি ধরতে যায়’), ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, কিন্নর রায়, ভগীরথ মিশ্র, নলিনী বেরা, সাধন চট্টোপাধ্যায়, রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের মত আরো অনেক লেখক তাঁদের অসংখ্য ছোটগল্পে। ইউরোপের চাইতে লাতিন আমেরিকার যাদু বাস্তবতা এঁদের অনুপ্রাণিত করেছিল বেশি, যার সাথে মিল ছিল আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের। লেখা হল ‘অষ্টচরণ ষোলো হাঁটু’ (স্বপ্নময় চক্রবর্তী), ’মহাজাগতিক’ (কিন্নর রায়), ‘ভূতজ্যোৎস্না’ (নলিনী বেরা), ‘তৃণভূমি’-র (সাধন চট্টোপাধ্যায়) মত সার্থক ছোটগল্প। বিষয়ের ব্যাপারে নতুন সংযোজন হল ক্ষুদ্র (‘মাইক্রো’) ইতিহাস, আর সেইসাথে আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন, বিশ্বায়ন ও নগরায়নের ফলে ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া উত্তরাধিকারের অনুসন্ধান, পরিবেশ সচেতনতা। যেমন ভগীরথ মিশ্রর ‘বানের জল’, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাঙাঘোড়া’, রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘গোষ্ঠ’, সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘শহরে বৃষ্টি হয়’। শেষোক্ত গল্পটি হারিয়ে যাওয়া এক নদীর অনুসন্ধান। সেই সময়ের আরো অনেক লেখক পুষ্ট করেছিলেন এই ধারাটিকে। সত্তর দশক অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের জোয়ার এনেছিল। বাদ যায়নি বাংলা প্রকাশনাও। বাণিজ্যিক প্রকাশনা-গোষ্ঠীর বাইরে এসে প্রকাশিত হতে থাকে অনেক ছোট ছোট পত্র-পত্রিকা, গড়ে ওঠে বেশ কিছু অ-বাণিজ্যিক ছোট ছোট প্রকাশনা সংস্থা ---- আর এইভাবেই জন্ম নেয় বর্তমান বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ‘লিটল ম্যাগাজিন’। ‘অনুষ্টুপ’, ‘লাল নক্ষত্র’, ‘অনীক’, ‘সত্তর দশক’, ‘পূর্ব দেশ’, জরুরি অবস্থার সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘লেখা ও রেখা’--- এই সাহিত্যপত্রিকাগুলি সেই সময়ের ছোটগল্পকে তার প্রয়োজনীয় লালন ও ধারণ দিয়েছিল। বই প্রকাশে সাহায্য করেছিল জয়ন্ত জোয়ারদারের ‘বুকমার্ক’। লেখকের মতে পঞ্চাশ-ষাট দশকের ‘আর্টস ফর আর্টস সেক’ বাংলা গল্পকে যে কানাগলির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তার থেকে মুক্তির হাওয়া এনে দিয়েছিলেন এই সত্তর দশকের গল্পকাররা। গল্পকে তাঁরা ফিরিয়ে এনেছিলেন মানুষের কাছে। সেদিক দিয়ে এঁরা ছিলেন ত্রিশ আর চল্লিশ দশকের পথিকৃৎদের সার্থক উত্তরসূরী, আবার তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন পরবর্তী বাংলাগল্পের পথ প্রদর্শক, যা এখনও প্রাসঙ্গিক। প্রতিষ্ঠিত, প্রতিভাবান এবং বিপুল জনপ্রিয় লেখকদের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে কাজটা সেদিন সহজ ছিল না। পঞ্চাশের সাহিত্যিকরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতেন। ষাটের ‘হাংরি লেখা’ শুরু থেকেই ছিল একটি গোষ্ঠীবদ্ধ প্রক্রিয়া। সেখানে সত্তর দশকের লেখকেরা ছিলেন পরস্পর বিচ্ছিন্ন, একক। অথচ আশ্চর্যভাবে তাঁদের ভাবনাবিশ্ব ছিল একই রকম, জারিত হচ্ছিলেন একই রকমের সমস্যা ও সংকল্পে। এঁদের মধ্যে কিন্নর রায় ছাড়া অন্যরা সরাসরি কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা ছিলেন প্রখর রাজনীতি সচেতন। ফলে তাঁদের গল্প ‘প্রোপাগাণ্ডা’ না হয়ে যথার্থ বিশ্লেষণধর্মী হয়ে উঠতে পেরেছিল। লেখক উল্লেখ করেছেন যে অনেকের ‘মারাত্মক অভিযোগ’ এই যে এঁদের লেখা একই রকম, যা তাঁর মতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং “পাঠক্রিয়ায় ঘাটতির ফল”। উদাহরণ দিয়ে লেখক খণ্ডন করেছেন এই অভিযোগ। কারণ সৈকত রক্ষিত (পুরুলিয়া), ভগীরথ মিশ্র (মেদিনীপুর), শচীন দাশ (সুন্দরবন), ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায় (দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা), নলিনী বেরা (উড়িষ্যা লাগোয়া পূর্ব মেদিনীপুর) --- এঁদের গল্পের পটভূমি আলাদা। তফাৎ রয়েছে প্রকাশভঙ্গীতেও। কারুর লেখায় শ্লেষ বা স্যাটায়ার (রামকুমার মুখোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী), কোথাও ন্যারেটিভ স্টাইল (ভগীরথ মিশ্র), মিথ ভাঙচুর করার প্রবণতা (অমর মিত্র), উপভাষা বা ডায়ালেক্টের ব্যবহার (নলিনী বেরা) অথবা সংবাদ প্রতিবেদন বা রিপোর্টাজের ভঙ্গি (কিন্নর রায়) এঁদের আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। সত্তর দশকের কিছু শক্তিশালী লেখক পরবর্তীকালে লেখালেখির জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন --- যেমন শঙ্কর বসু, বিষ্ণু চক্রবর্তী, শৈলেন চৌধুরী, চন্দন ঘোষ। এঁদের নিয়ে লেখক আক্ষেপ করেছেন। উল্লেখ করেছেন তাঁদেরও যে কয়েকজন রয়ে গেছেন এই তিন প্রবণতার বাইরে। যেমন বারীন ঘোষাল, কমল চক্রবর্তীর মত লেখকরা, যাঁরা বাংলার বাইরে থেকে বাণিজ্যিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখে গেছেন, দেবেশ রায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত লেখক, যাঁরা বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখলেও বাণিজ্যিক লেখা লেখেননি আর সুবিমল মিশ্র, যিনি বাণিজ্যিক ধারাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলেন। অত্যন্ত পরিশ্রমী ও বিস্তারিত এই আলোচনায় পাঠক পেয়ে যাচ্ছেন সত্তর দশকের এগুচ্ছ গল্পকারের নাম, পরিচয়, গল্প লেখার ভঙ্গি ও বিষয়, এবং বেশ কিছু গল্পের তালিকা, যা এখনকার অনেক পাঠকের পক্ষে এক পরম প্রাপ্তি। তবে পুরো রচনাটিতে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের নাম দু’বার উল্লিখিত হলেও তাঁর সম্বন্ধে লেখকের অবস্থান স্পষ্ট নয়। পাওয়া গেল না তাঁর লেখা কোন গল্পের উল্লেখ বা আলোচনা। পাঠক হিসাবে এটুকু অতৃপ্তি থেকেই গেল।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন