কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

তৃষ্ণা বসাক

 

সমকালীন ছোটগল্প


পাপী জিসম

(শ্রীদাস একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। আজ তাদের পূর্ণিমার চড়ুইভাতি। প্রতিমাসে বাঁধা। বড়বটতলা ব্যবসায়ী সমিতি করে এটা। কোন চাঁদা লাগে না। বড় বড় ব্যবসায়ীরা কেউ চাল দেয়, কেউ ডাল, কেউ মাছ কেউ মাংস। মেনু প্রায় এক থাকে। পোলোয়া আর মাংস। চিকেন হলে বেশিরভাগ লোকের মুখ ভার হয়। শ্রীদাস বলে, বিনেপয়সায় যা পাচ্ছিস, সোনামুখ করে খাবি। ঘরে মুরগিই কবে খেয়েছিস, হিসেব আছে? ছেঁড়া জালে যে মাছ আসে, সেই দেবতা। এই যে আজ ট্রেনের ভিড় ঠেলে বাড়ি ছুটতে হল না, বউ-র রান্না কুমড়োর ঘ্যাঁট আর রুটি খেতে হল না, সমিতির ঘরে ঢালাও বিছানা পড়বে, দেওয়াল জোড়া টিভি, বড় বড় পাখা, একটু আধটু গলায় পড়বে, মেজাজটা শরিফ হয়ে যায়,   তবু কিছু লোক মুখ তোলো হাঁড়ির মতো করে রাখে।)

(১)

ইজাত্তুল্লা ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি সিগনাল খেল। এই ব্রিজটা পেরোবার সময় আমি বরাবর নারকেল আর নতুন গুড়ের গন্ধ পাই। এমনকি সেই আয়লার দিন, যখন তিনটের সময় অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম, আর ভাগ্যক্রমে একটা ওয়ান বি পেয়ে গিয়ে উল্লসিত হয়ে উঠে পড়েছিলাম,  আর সেই বাস যে রাস্তাতেই যাচ্ছিল, সেই রাস্তায় বিশাল বিশাল প্রাচীন মহীরূহের কাটা ডাল মহাযুদ্ধের মহাবীরদের মতো পড়ে ছিল, সেদিন, এই রাস্তায় না ঢুকেও আমি নারকেল কোরা আর নতুন গুড়ের গন্ধ পাচ্ছিলাম, অত ভয়ানক বিপদের মধ্যেও আমার মন ভালো হয়ে গেছিল, মনে হচ্ছিল খুব শুভ কিছু আছে, খুব কাছেই, আর ভয় নেই, বিপদ কেটে যাবে।

সেই ব্রিজের ওপর আজ সন্ধেয় গাড়ির মধ্যে বসে ডানদিকে তাকাতেই দেখলাম, ফুটপাথে বসা ফুলের দোকানের পেছনে একটা টিকিট কাউন্টার। দীপক সিনেমা হল। কী অদ্ভুত যে লাগল। সিনেমা হল নেই নিশ্চয়, কিন্তু টিকিট কাউন্টারটা র‍য়ে গেছে। পরে গাড়ি এগোতে দেখলাম, হলটা চালু। কয়েকটা টাটকা পোস্টার । পোড়ো নয়, জ্যান্ত একটা সিনেমা হল। জিসম কি পিয়াস, শীলা কি জওয়ানি টাইপের সি গ্রেডের সেমি পর্নো ফিল্মের। সেইসব নিয়ে সিনেমা হলটা বেঁচে আছে।

একটু এগোলেই টিপু সুলতানের মসজিদ, প্রিন্স আনোয়ার শা রোড। কে এই রাজকুমার আনোয়ার, কেউ জানে না। তেমনি জানে না ইজাত্তুল্লা কে ছিল। এই ব্রিজের পাশে এই দীপক সিনেমা, একসময় খুব উজ্জ্বল ছিল নিশ্চয়,  যেমন সিনেমা চালাচ্ছে, সেই রকমই চালাত, আর সেসবের একটা ভাল বাজার ছিল। রিক্সাওলা, ঠেলাওলা, সব্জিবিক্রেতা সবাই সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর একটু বিনোদন খুঁজত, এখনকার ভাষায় যাকে বলে চিল করা। তেমনি  স্কুলের ছেলেরা, যারা টেক্সট বইয়ের ভাঁজে লুকনো বটতলার পত্রিকায়   যথেষ্ট জানকারি পেত না, তারাও চলে আসত দীপকে।  তাদের জন্যে ইস্কুল কেটে নুন শোটাই সবচে ভালো ছিল। রিক্সাওলারাও নুন শো টাই পছন্দ করত। আর সব্জিওলা, মাছওলা সারাদিন পচা পাতা, মাছের রক্ত ঘাঁটার পর স্নান টান করে ধোপদুরস্ত হয়ে রাতের শেষ শোটায় আসত। আমি কল্পনা করতে পারছি কী গমগমে ছিল জায়গাটা, কত জনকল্যাণ হত, এই গোটা তল্লাটের লোকজন উপকৃত হত এই একটা ছোট্ট হল থেকে। হলের মালিক কে, কেউ জানত না, তেমনি যে সিনেমা গুলো চলত, তাদের হিরো হিরোইন কারা  তা জানারও দরকার ছিল না কারো। দর্শকরাও নিজেদের গোপনে রাখা পছন্দ করত।  স্কুলের ছেলেরা ব্যাগে লুকিয়ে আনা অন্য জামা প্যান্ট পরে, ব্যাগটা কোন পানের দোকানের সহৃদয় কাকুর কাছে রেখে, রুমাল দিয়ে মুখ আড়াল করে ঢুকে যেত।     এই এক প্রদর্শন, যেখানে সবাই অন্ধকারে, আলোয় শুধু মাংস।

দীপক সিনেমাকে সমাজের সুশীলরা ঘৃণা করত, বাড়ির বউ ঝিরা কৌতূহল দেখাত, কিন্তু হাসে নি কেউ। কোনদিন না। এই দীপক এবং দীপকের সামাজিক অবদান নিয়ে সবার মনেই ভাল হোক, মন্দ হোক একটা মতামত ছিল। হাসি বা উপেক্ষা নয়। আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখলাম দুটো ছেলে এর পাশ দিয়ে যেতে যেতে একজন আর একজনকে  কী একটা ইশারা করল, তারপর হেসে গড়িয়ে পড়ল প্রায়। হাসি টাসি থামলে ওরা আবার যে যার হাতের মোবাইলে মন দিল। দীপকের সামনে ফুটপাথে বসে একজন দাদ হাজা খুজলি মলম বিক্রেতাও থেকে থেকে হাতের মোবাইল দেখছিল, আর তার মুখে ফুটে উঠছিল তৃপ্তির হাসি।

এই লোকটা, ধরা যাক শ্রীদাস, ওর বাবা রুইদাস এখানেই বসত, অর খুজলি দাদ চুলকানির ওষুধের সঙ্গে নিরীহভাবে মিশে থাকত, শিলাজিত ও নানা অজানা জড়িবুটি মেশানো সন্দেহজনক চেহারার তেল, শিশি ভর্তি। শিশির গায়ে হলদে কাগজে কালো ধ্যাবড়া ছবি থাকত, মন দিয়ে দেখলে বোঝা যেত একজোড়া নারী আর পুরুষ পরস্পরকে পাকে পাকে জড়িয়ে আছে। দক্ষ শিল্পীর হাতে পড়লে মনে হতে পারত সমুদ্রগর্ভ থেকে উত্থিত লাট্টুর মতো এক ঘূর্ণি, কিংবা দ্বিসর্পিল ডি এন এ সিঁড়ি, যা ধরে উঠলে বা নামলে মানুষের জন্ম রহস্যের একদম আদিতে পৌঁছে যাওয়া যায়।

কিন্তু যে ছবি এঁকেছিল, মানে কালির মধ্যে একটা গুবরে পোকা চুবিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল যে, তাকে এত কম পয়সা দেওয়া হয়েছিল, কিংবা বছর ঘুরে গেলেও সে কোন পয়সা পায়নি, যার ফলে সে হলদে কাগজে কালো একটা ছোপ ফুটিয়েই দায় ঝেড়ে ফেলেছিল, যা দেখে মনে হত একটা মৎসকন্যা, যার দুটো মাথা, কিংবা আসলে এটা একটা থাম্বা, যার মাথার কাছে ইঁট ভেঙ্গে গেছে।

ওই লেবেলে যেটা খুব ভালো ভাবে পড়া যেত, তা হচ্ছে দুটো শব্দ- পিয়াসী  যৌবন। এই নামে একটা সিনেমা রমরম করে চলেছিল দীপক সিনেমা হলে , সেই নাম থেকেই প্রেরণা পেয়েছিল রুইদাস। নাহলে আগে নাম ছিল মরদ মালিশ। পুলিশ সেই নাম দেখেই ওকে বেশ কিছুদিন মালিশ করে ছেড়েছিল থানায় ডেকে। তিনমাস উঠে যেতে হয়েছিল এখান থেকে, চারু মার্কেটে আঁটি আঁটি কলমি শাক নিয়ে বসত সে, কিন্তু মন পড়ে থাকত দীপক সিনেমার সামনের ফুটপাথে। দুপুরে  উদাসী মুখে, কিংবা সন্তর্পণে  এদিক ওদিক তাকিয়ে যারা সিনেমা দেখতে ঢুকত, তারা সবসময় পিয়াসী যৌবনের প্রকৃত গ্রাহক ছিল না।  এর আসল বাজার শুরু হয় সন্ধের ঝোঁকে, চলে রাত অব্দি।  দীপকের শেষ শো ভাঙ্গে রাত বারোটায়, সেই সময়েও সেখানে থাকত রুইদাস। মাঝে গিয়ে সে খেয়ে আসত কিছু।

তিনমাস কলমি শাক বেচার তারপর বড়বাবুকে বত্রিশ শিশি মরদ মালিশ দিয়ে আবার বসার পারমিশন। এবার নতুন নাম পিয়াসী যৌবন। রুইদাসের শালা বলেছিল জীবন যৌবন রাখো, তাহলে পুলিশের বাপেও কিছু করতে পারবে না। কিন্তু জীবন যৌবন নামটা কেমন ধকহীন তামাকপাতার মতো মনে হয়েছিল রুইদাসের। এই নামে বহু আগে একটা প্যানপেনে বাংলা ছবি এসেছিল মনে পড়ছিল যেন। সেই ছবির আগাগোড়া কেবল কান্না আর কান্না। সে খেপে গিয়ে বলেছিল, ‘তার চে  গয়া কাশী বৃন্দাবন রাখলেই হয়, শিবের বাবাও টের পাবেনি’ মোট কথা পিয়াসী যৌবন নামটা তার মনে এমন দাগ কেটেছিল, যে পুলিশের ডান্ডার ভয়ও তাকে নাম বদলাতে পারেনি। শীত গ্রীষ্ম বরষা, বারো মাস, দিনের আলো থেকে রাতের আঁধার অব্দি ইজাত্তুল্লা ব্রিজের এক পাশে বসে থেকেও তার মনে ছিল দুর্জয় সাহস। এই সাহস তাকে যুগিয়েছিল দীপক সিনেমা। পুলিশের মাসকাবারি দেবার পরেও মাঝে মাঝেই বেমক্কা বাবুদের খেয়াল মতো হঠাৎ হঠাৎ রেড করে এই হল উঠিয়ে দেবার কত চেষ্টা করেছে মামারা। কিন্তু তাতে মালিক উত্তম সিং একদম টলে নি। হল থেকেছে, হলের সামনে রুইদাস, যেন দীপক সিনেমারই একটা এক্সটেনশন।  উত্তম সিং রুইদাসের জন্য বারোমাসের একটা ফ্রি পাসই দিয়েছিল, যেটা মাঝে মাঝেই শালা বা ভাই বেরাদরকে দিয়ে রুইদাস নিজের বৃত্তে বেশ নাম কিনেছিল। আর কোন ঝামেলা হয়নি, শুধু মাসে চার শিশি বড়বাবুকে ঠেকানো। ব্যস।

রুইদাসের বাড়ি ছিল পিয়ালি। ক্যানিং লাইনে। প্রপার পিয়ালি নয়, নেমে আবার ভ্যানে যেতে হত। সাতপুকুর বলে একটা গ্রামে। আগে আগে সে সকালে এখানে আসত বারোটা নাগাদ, তারপর রাতের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে যেত। কিন্তু দীপকের লেট নাইট শো এবং এর সমান্তরালে  মরদ মালিশ বা পরে পিয়াসী যৌবন  সুপার ডুপার হিট হয়ে গেলে ওর আর বাড়ি ফেরা হয় না। ওখানেই  কয়েকজন বিহারী রিকশাওলার সঙ্গে থেকে যায় রাতে একটা ঝুপড়িতে। সেখানে প্রথম প্রথম রামশরণ যাদব বলে একজন ঘুমের মধ্যে ওর পেছনে  নিজের পুরুষাংগ চেপে ধরত। রুইদাসের এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। ওর সমস্ত জ্ঞানের উৎস যে দীপক সিনেমা, সেখানে পুরুষ যে পুরুষকে চাইতে পারে, এমন কোন খবর দেওয়া হয়নি কক্ষনো। তাই ঘটনাটি ওকে বিবশ করে দিয়েছিল। সে মাঝরাতে বিছানায় বসে কাঁদতে শুরু করে দিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। সারাদিন সবাই খাটে খুটে। ঘুমটুকু দফা গয়া হয়ে পরের দিন কামাই বন্ধ। সবাই রামশরণকে যারপারনাই ঝাড় দিল। রামশরণও খুব মরিয়া টাইপ নয়। আসলে নতুন চিড়িয়া  রুইদাসকে  একটু বাজিয়ে দেখছিল মাত্র। বাধা পেয়ে সে কেন্নোর মতো গুটিয়ে গেল।

একদিন বাবার দোকান আর কলকাতা দেখার বায়না করে শ্রীদাস মার সঙ্গে এসেছিল। রুইদাস ওদের ডিম টোস্ট খাওয়াল, রাস্তার ধারের হোটেলে মাংস পরোটা, মোট কথা যত্নের কোন ত্রুটি রাখল না, ফুটপাথের আর এক দোকান থেকে একটা খেলনা গাড়িও কিনে দিল, কিন্তু শ্রীদাস যখন দীপকে সিনেমা দেখার বায়না করল, তখন ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিল সে। বউ অষ্টুমিকে বলল ‘ছেলেকে নাই দিয়ে মাথায় তুলেচিস? সিনেমা দেখবে? যা যা বাড়ি যা। এখন গেলে সন্ধের আগে বাড়ি পৌঁছে যাবি’

সেদিন বুকে প্লাস্টিকের গাড়িটা চেপে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল শ্রীদাস। ক্যানিং লাইনের ট্রেনের ঠাসা ভিড়ে তার গাড়িটা একেবারে তুবড়ে গেছিল। তার জন্যেও তার মন খারাপ হয়নি। কিন্তু সিনেমা হলের একদম সামনের ফুটপাথে দোকান, তবু বাবা তাকে সিনেমা দেখাল না, এই আঘাত থেকে সে বেরোতে পারছিল না। তার ওপর মা বিড়বিড় করে বলছিল ‘জানতুম পয়সা লাগবে, তাও না, ফ্রি পাশ, কত লোক গিয়ে দেখে আসছে, জানি না নাকি? আর নিজের ছেলেকে দেখাল না!’

এ কথা শুনে তার ছোট্ট বুকে উথালপাথাল করছিল কান্না।

(২)

দীপক সিনেমার সামনেই বসে শ্রীদাস। সিনেমা চলছে। এই তো একজোড়া ছেলেমেয়ে ঢুকে গেল। ওরা এই কাচ্চি কলি দেখবে না একটুও। ওসব এখন মোবাইলেই দেখা যায়। ওদের জন্যেই তবু হলটা চলছে। পুলিশ এই হলকে ভুলে গেছে। ইজাত্তুল্লা কে? জানে না শ্রীদাস। হারিয়ে গেছে লোকটা। যেমন হারিয়ে গেছে রুইদাস। লোকটার ওপর রাগ হয়েছিল বলে খুব দুঃখ হয় তার। তার কাছে এখন শুধু দাদ হাজা খুজলিই থাকে। পিয়াসী যৌবন থাকে না। এখন বিদেশি তেলের ছড়াছড়ি। সিনেমা চিরতরে বন্ধ হবার আগে তবু সে বসে থাকে এখানে।

দাদ হাজা চুলকানির এইসব মলম বড় দোকানে মেলে না, এখানে দাম শুধু কম নয়, পথ চলতি কাজের মাসি বা সব্জিউলি মাসী বড় দোকানে ঢুকতে ভয় পায়। তারা ফুটপাথে শ্রীদাসের দোকান থেকে কিনতে খুব স্বচ্ছন্দ। তাই বিক্রি তার খারাপ হয় না। সে তার বাবার মতো অবশ্য এখানে পড়ে থাকে না। রোজ  সকালে আসে, সন্ধের ট্রেন ধরে চলে যায়, সন্ধের পর এ জায়গার আর রৌনক নেই আগের মতো। তাই সন্ধের পরে থেকেও লাভ নেই। ওকে এখন অতটা পথ যেতেও হয় না। দীপক সিনেমার রমরমার যুগে রুইদাস দু পয়সা জমিয়েছিল, সোনারপুরের চাঁদমারির মাঠ ছাড়িয়ে দুকাঠা জমি কিনেছিল সেই পয়সায়। শ্রীদাসের বউ লড়াকু মেয়ে, সেখানে দুখানা ঘর, কলঘর তুলেছে, শ্রীদাস  এখন সেখানেই ফেরে। সোনারপুর লোকাল চালু হয়েছে, সেটা ধরতে পারলে তো আর কোন কথাই নেই।

(৩)

অনেকক্ষণ থেকেই হালুক চালুক করছিল মেয়েছেলেটা। মেঘের মতো রঙে লাল ফিনফিনে শাড়ি, তার ওপর চুমকি বসানো। অস্ত মেঘের গায়ে অমন রাঙ্গা রক্তের ছিটে থাকে, আর তার ওপর যখন বিদ্যুৎ চমকায়, অদ্ভুত লাগে দেখতে। এই রকম মেয়েছেলে, গায়ের রঙ যেমনি হোক, ধামসাতে সুখ। ভাবছিল কিশোরীলাল। বঙ্গালি মেয়েরা, খারাপ পাড়ার হলেও,  তেতেপুড়ে গেলে মানুষকে প্রথমে মদ না খাইয়ে তারা জলের গেলাস বাড়িয়ে দেয়। কাজ হয়ে গেলেই বিদেয় করে না দিয়ে, রয়ে বসে দুটো কথা বলে। ভারি ভালো লাগে কিশোরীলালের। আজকাল কে কার সঙ্গে বসে দুটো কথা বলে? সময় নেই কথাটা ভারি ভুল।সময় করার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে গেছে।

এ মেয়েছেলে দেখে মনে হল না খারাপ পাড়ার।   ও পাড়ায় ঘর সবাই নেয় না, কতজন আজকাল ঘুষকি, ঘরে বসেই কামকারবার চালায়। আর কিছু আছে ফ্লাইং, রাস্তার ধারে, অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে ইশারা ছোঁড়ে। লাইনের লোক যারা, তারা ঠিকই বুঝে যায় ইশারা। ওখানেই চাপা গলায় রেট ঠিক করে কোথাও গিয়ে ওঠে। কোথাও মানে, বন্দোবস্ত থাকে,  শস্তা হোটেল কিংবা গেরস্ত বাড়ির একটা বাড়তি ঘরে। ঘণ্টা হিসেবে রেট। কিশোরীলাল একবার ভাবল আজ থাক, ঘরবালি বহোত চেল্লামিল্লি করছে রূপোর পাঁয়জোরের জন্যে। ফোন করলেই পাঁয়জোর আর পাঁয়জোর। কিশোরীলাল কি জানে না ওর চাচাতো ভাই আনোখিলাল রুক্মিনির বুকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে, তিনটে বাচ্চার শেষ দুটো যে আনোখিলালের, তা সে একেবারে নিশ্চিত। এই কারণে মধুবনী জেলার আইনাসরাই গাঁও, সেখানে ওর ঘর আছে, খেতি আছে, কুয়ার পানি কি মিস্টি- সেখানে যেতে ওর মন ওঠে না, তবু খেতিকাজের জন্য বছরে একবার যেতেই হয়। এমন হারামি অউরত, দশেরা কি ছট পূজার সময়েও একবার বলে না ‘ঘর আও জি। তুম বিন বহোত খালি খালি লাগে এই চবুতরা। পিপ্পল কি পেড় আর ছাও দেয় না। অম্বা  তলে কোন শান্তি নেই। ঘর আ যা পরদেশি’।

রুক্মিনির শরীরে আর রুচি নেই, এই কলকাত্তা শহরে পয়সা ফেললে শের কা দুধ ভি মিলে তো, অউরত কা জিসম! অমন কত শরীর সে ছেনে ঘেঁটে দেখল, এপাশ থেকে ওপাশ, উলটে পালটে, ওপর নিচ, তন্ন তন্ন করে ছানবিন করেও সে তবু শান্তি পেল না। এই পিয়াস বুঝাবে কে? তার ঘরবালি , ওই রেন্ডি রুক্মিনি, সে ফি সন্ধেয় ভিডিও কল করে, তখন সে ওই রেন্ডির রুপিয়া ভেজো, পাঁয়জোর খরিদনা হ্যায়, এইসব কথার মাঝে ফোন কাটে না, সে ধীরয রাখে, ইন্তেজার করে, সেটা যে কীসের, তা সে নিজেও জানে না। সে হাঁ করে দেখে রুক্মিনিকে, দেখে তার আঙনের চারপাই,  দেখে পেছনের ইন্দারা, ইন্দারার জলে আসমানের ছায়া, তাতে তারা ভাসছে, দেখে দূরে পাহাড়ের সারি, সেই পাহাড়ের উঁচাই, তার ওপর বর্ফ, তাদের গাঁয়ের উত্তরে, অনেক উত্তরে হিমালয় আছে। রুক্মিনি শাদির পর, বলেছিল একদিন বর্ফ দেখাতে নিয়ে যাবে? বর্ফ দেখেনি সে। কিশোরীলাল বলেছিল নিয়ে যাবে, অমনি ওর সিঁথিমউর দুলে উঠেছিল। কিশোরীলাল সেই কথা রাখতে পারেনি, তাই কি ও আনোখির কাছে গেল?  পিয়াসি চোখ, পিয়াসি কান নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে  কিশোরী। রুক্মিনি যদি একবার বলে ‘এই মাহিনায় ঘর লৌট আও মরদ’

(৪)

বেশিক্ষণ মেঘের ইশারা সামলাতে পারল না কিশোরী। একখানা একশ টাকার নোট নিয়ে মাগির সামনে দুলিয়ে বলল ‘কাঁহা?’ মেঘের আড়াল থেকে অমনি চিক্কুর হেনে গেল নীল বিজলি। মেয়েটার চোখে ঠোঁটে এত ঝলকানি যে কিশোরীলালের মনে হল ও অন্ধ হয়ে যাবে।

‘কাঁহা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না হে, নাম বলো আর আধার কার্ড আছে তো?’

আধার কার্ডের নামে পিলে চমকে যায় কিশোরীর। এই জিনিসটা চাইলেই সে একদম গুটিয়ে যায়।  সে শুনেছে বড় বড় হোটেলে এক বেলার এমন ঘর নিতে গেলেও আধার কার্ড জমা রেখে দেয়। এই একটা কার্ডে নাকি তার বেবাক খবর ভরা আছে, সে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে শুচ্ছে –সব উঠে যাচ্ছে নজরদারি ক্যামেরায়। নাহ পনেরো মিনিটের কারবারের জন্যে এত রিস্ক নেবে না সে।

কিশোরীলাল পাত্তিটা পকেটে ঢুকিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, অমনি মাগিটা ওর হাত টেনে ধরে বলল ‘খোট্টাগুলোর একটুও রসকস নেই। আরে আধার কার্ড মানে কী?’

কিশোরীলাল হতভম্বের মতো বলল ‘কী?’

‘পরিচয়পত্র। তা তুমি যে পুরুষ মানে মরদ, সেই মরদ হিসেবে তোমার প্রমাণ দেবে- সেই জিনিস আছে তো? ডেট ফেল হয়ে যায়নি তো? ‘বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে।

সেই হাসির ছররা এসে দিমাকে ঘুসে যায় সোজা। অমনি ওর দিমাকের বাত্তি জ্বলে ওঠে। আচমকা এই কলকাত্তা শহরটা ভালো লাগে কিশোরীলালের। এই অচেনা, নষ্ট মেয়েটার হাসির মধ্যে ওর আইনাসরাই গ্রামের আশমান তার খচাখচ তারা নিয়ে ফুটে ওঠে। ওর কথার মধ্যে যেন হিমালয়ের সেই না দেখা বরফের ঠান্ডা ছোঁয়া, ইন্দারার জলের মেহক।

রুক্মিনি খুব ফরসা, একেবারে চিকনি চামেলি। কিন্তু এই কালো মেয়েটার মধ্যে কীসের যে টান ধরতে পারল না কিশোরীলাল। খেতিবাড়ি করে সারাবছর পেট চলে না। তাই সে কলকাতায় এসে ফুচকা বেচে। সিনেমা হলের সামনে বেচে লাল হয়ে যেত আগে, এখন তেমন বাজার নেই। একেকদিন তাই দেশোয়ালি একটা বাচ্চা ছেলেকে স্টলে বসিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায় কিশোরী। সে আসলে একটা ডাক শুনতে চায়। ‘ওয়াপস আ যা’। এই পরায়া শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে সে একটা নিজের স্বর হাতড়ে বেড়ায় আসলে।

হাতড়াতে হাতড়াতে আজ একটা আওয়াজ শুনতে পেল কিশোরী। যে আওয়াজে মছলির খলবল, পিপ্পল গাছের ছায়া আর বর্ফ ঢাকা হিমালয়ের হাতছানি।

সে বলল ‘কিতনি দূর?’

-কাছেই। দূর কোথায়!

(৫)

ওর পেছন পেছন অনেক রাস্তা চলতে হল কিশোরীকে। কত দূর রে বাবা! মনে হচ্ছিল জন্মের ঠিকানায় পৌঁছে গেছে যেন।এবার জন্ম পেরিয়ে ক্রমে আরও অন্ধকার, মায়ের গর্ভের অন্ধকার ক্রমে তাকে ঘিরে ধরে। রাস্তার ক্ষয়া হ্লুদ আলো, তার ওপর কী আশ্চর্য, আস্ত একটা ফুচকার মতো সোনালি চাঁদ, এইরকম রাতে ওরা আখ খেতে গিয়ে খেলত। একবার রুক্মিনিকে… কাজ মিটে গেলে রুক্মিনি গেয়েছিল, ‘আজ তো জুনলি রাত মা, ধরতি পর হ্যায় আশমা।‘

এমনিতে রুক্মিনি সারাক্ষণ লাফাছে ঝাঁপাচ্ছে। প্রাণ ভরপুর মেয়ে একটা। আর ওর সিঁথিমউর দুলছে। কিন্তু এই গানটা গাওয়ার সময় ওর সিঁথিমউর একবারও নড়েনি। সেই স্থির সিঁথিমউরের দিকে তাকিয়ে কিশোরীলালের গলার কাছে একটা পুটলি পাকিয়েছিল। মনে হয়েছিল ওই গয়নাটার মতো সময়ও থেমে গেছে। ওদের দুজনের সময়। এই দুনিয়া বনবন করে ঘুরছে। কিন্তু তার মধ্যে ওদের ছোট্ট পৃথিবী সবসময় এক থাকবে, স্থির, পালটাবে না।

আজ এই মেয়েটার পেছনে যেতে যেতে ও সেই স্থির সিঁথিমউর খুঁজছিল। তার বদলে দেখল পিঠে লটকন। ও জিজ্ঞেস করল

- তোমার নাম কী আছে?

-বিজোলি

-বিজলি!

থমকে গেল কিশোরী। নামের সঙ্গে চেহারার কি মিল। আজ সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। এই পূর্ণিমার রাতে সেদিনের রুক্মিনির ছায়া বারবার এসে পড়ছে গলিতে, চুরমার হচ্ছে জোছনায় আর সেই চূর্ণের মধ্যে এসে দাঁড়াচ্ছে বিজলি। হাহা বিজোলি! বঙ্গালিদের কথায় খালি গোল।

-আরে খোট্টা, বিজলি না রে বিজোলি।

-হাঁ হাঁ মুঝে মালুম হ্যায়। বঙ্গালিদের মুখের জুবান রসগুল্লার মতো গোল গোল।

এই কথায় আরও হেসে লুটিয়ে পড়ল বিজলি। ওর হাসি যেন ভাঙ্গা চুড়ির নানা রঙ্গের কাচের মতো অন্ধকার গলির নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছিল। কিশোরীলাল ভাবছিল যদি এই চুড়ির টুকরোগুলো সে জমিয়ে রাখতে পারত!  খোপরিতে আরও দশ জনের সঙ্গে ঠাসাঠাসি শুয়ে থাকতে থাকতে এগুলো নাড়াচাড়া করে  তার রাত বেশ কেটে যেত।

কিন্তু সে হঠাৎ মেজাজ গরম করে বলল ‘আরে অউর কিতনি দূর? সারি দুনিয়া সফর করা দিয়া, এয়সি মালুম হোতা হ্যায়।‘

বিজলি আবার হাসির পিচকারি খুলে বলল ‘দেখলে হবে? খরচা আছে। আমি যে সেই কত ভোরে উঠে রান্নাবান্না, ছেলের ইস্কুল, বরের ভাত করে ঘর…’

আচমকা থেমে গেল বিজলি আর সেই থেমে যাওয়া কথা যেন বিছনো চারপাইয়ের মতো পড়ে রইল কিশোরীর সামনে, যেখানে শুয়ে কত আগড়ম বাগড়ম ভাবতে পারে কিশোরী। ঘর। রান্না। ছেলে। বর। ভাত। হঠাৎ চারপাইটা উলটে গেল। সে নিচে আর তার বুকের ওপর চারপাই। তার দম আটকে আসছিল। তার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। খেলা শুরুর আগেই সে থকে গেছিল।

বিজলি তার হাত ধরে টানল, বলল ‘এসো, এই যে দাঁড়াও আমিই টিকিট কাটছি।‘ দীপক সিনেমা হলের দুটো টিকিট কাটল সে।

(৬)

আর শ্রীদাস স্বপ্নের মধ্যে দেখছিল এই দৃশ্যটাই। সে স্বপ্ন দেখছিল পিলপিল করে লোক ঢুকছে দীপকে। এই দৃশ্য কত বছর দেখেনি সে। বাবার সঙ্গে যখন দু একদিন আসত, তখন দেখেছিল। কিন্তু দেখলেও সেটা তার মনে কোন ছাপ ফেলেনি। সে অনেক বেশি উত্তেজিত ছিল, ব্রিজের নিচে বয়ে যাওয়া কালো জলের ধারাটা নিয়ে, কোণের দোকানের মোগলাই পরোটা নিয়ে, দম  দেওয়া গাড়ি নিয়ে। তাদের বারুনির মেলাতে এরকম গাড়ি পাওয়া যায় না। বাবা তাকে, সে যা চেয়েছিল, সব দিয়েছিল। শুধু সিনেমা দেখায়নি। এখন মনে হয় বাবার নিশ্চয় খুব কষ্ট হয়েছিল দিতে। ওর ছেলেকে তো সে কিছুই দিতে পারে না। সে মায়ের কাছে চায়। বউ সব আব্দার মেটায়। কলকাতার রাস্তায় ঝিংচ্যাক বাচ্চাদের গায়ে যেমন জামা থাকে, বুকে কীসব লেখা, সেইরকম জামা তার ছেলের গায়ে, সেইরকম জুতো। বউ ক বাড়ি কাজ করে ঠিক জানে না শ্রীদাস। কিন্তু তার এলেম দেখে ওর ভক্তি হয়। এতটাই ভক্তি যে কোনদিন ইচ্ছে হলেও গায়ের কাছে যায় না শ্রীদাস। কাঁঠালগাছে টুপ্টুপে জ্যোৎস্না ফোটে, চাঁদ ওঠে, সে শরীরে তালা মেরে ঘুমিয়ে থাকে। তার ইচ্ছে হয় অনেক অনেক দিন ধরে পয়সা জমিয়ে ছেলেকে একটা গেঞ্জি কিনে দেবে।

শ্রীদাস স্বপ্নে দেখল ভিড়ের মধ্যে তার বউ ফুচকাওলার হাত ধরে হলে ঢুকছে। নাহ ভিড় নেই। শুধু দুজন ঢুকে গেল।

শো মাস্ট গো অন। জিও কাকা। বউয়ের এলেম আছে। একটা ঘুমন্ত হলে ঢুকে পড়েছে। নিচে যে জলের নোংরা রেখা, ওটা তো একসময় গংগাই ছিল। স্থানমাহাত্ম্য বলে একটা কথা আছে। শ্রীদাস টলমলে পায়ে বিরিজের ওপরে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখে চাঁদ ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে জলের ওপর। ও কাঁদে। আর কাঁদে।

হঠাৎ একজন এসে ফিসফিস করে বলে ‘পিয়াসী যৌবন আছে? আর সেই বই? ‘ শ্রীদাস উঠে দেখে সিনেমা হল থেকে পরিতৃপ্ত মুখে পিলপিল করে লোক বেরোচ্ছে। তাদের অনেকেই এসে ভিড় করছে শ্রীদাসের দোকানে। শ্রীদাস ঘুম ভাঙ্গা চোখ কচলে উঠে বসে।এই লোকগুলোকে সে অনেক অনেক বছর আগে দেখেছে। এরা কীভাবে একইরকম থেকে গেল!  শুধু এই পুরনো লোকের ভিড়ে দুটো একদম টাটকা শরীর, চাঁদের ভাঙ্গা টুকরোর মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল কখন যে, বুঝতে পারল না শ্রীদাস!

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন