কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


পটাশপুরের রতন

রতনে রতন চেনে কথাটা ভয়ানকভাবে সত্য। অন্তত পটাশপুর ৪নং গ্রাম পঞ্চায়েত-এর শিখণ্ডিপাড়ায় ত বটেই। এ হেন নামই বা এলাকাটির কে রেখেছিলো আজ আর জানার উপায় নেই, তবে কার্যকারণে যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়।

রতন সেন শক্তিশালী নেতা। তার অট্টালিকার বারান্দায় বসে দার্জিলিং চায়ের সঙ্গে ফুলকো লুচিসহ আলুরদম খেতে খেতে একথাই ভাবছিল। এমনিতে গ্রামটা বেশ সুন্দর। ছোটো ছোটো বাড়ি, মাটির বা টালির একটা দুটো একতলা পাকাঘর, মাটির রাস্তা এবড়োখেবড়ো, কাঁচা নয়ানজুলি আর বট অশত্থ সজনে আরো কত গাছ। একটা গ্রাম ত এমনই হবার কথা।

পয়সা নষ্ট সে হতে দেয়নি। পাকা সরক, ড্রেন, ইত্যাদি গ্রামের সৌন্দর্য নষ্ট করে। বাড়িটা তাই আড়ে বহরে বেড়েছে। বছর বছর রং। ঝকঝকে। শুধু ওই পথের বাঁকে রতন কামারের দোকানটা। সবসময় ভিড়। আড্ডা। আলোচনা। শুনেছে রতন হরেক রকম আরো কাজ করে।

এ গ্রামে তাই রতন বলতে কামারকে বোঝে প্রথমত লোকে, তারপর রতনবাবুর খোঁজ মানে রতন সেন। ব্যাপারটা যারপরনাই বিশ্রী।

হাঘরের বেটা। ছোটোলোক যেমন হয়। করিস ত কামারের কাজ। বামন হয়ে চাঁদে হাত।

___"দাদা নীচে লোক অপেক্ষা করছে। আজ আপনার কান্তাচরণ উচ্চবিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির বৈঠক"।

__" তারপর?"

__"দাদা ওটা যেতে আসতে তিনটে হয়ে যাবে। বিকেলে মাঠে যেমন বসেন। দু চারটে কেস আছে ওগুলো..."

__"আচ্ছা যা আসছি"।

__"কি গা, উটবে নাকো, ভাত বইসে দিচি তুমি নাইমে নিও চা রইলো বাসি রুটি আচে। খুকী ইসকুল গেচে"।

__" হুম,"।

রতন জেগেছে অনেক্ষণ। ভাবছে। অনেক কিছু ভাবছে। কুলকিনারা নেই তার। বাইরের কুয়াশা মনে ছেয়ে আছে। পুকুর থেকে স্নান করে সব সেরে দোকান খোলে। তার দোকান সবার আগে খোলে। তারপর হাপরে পিটতেই থাকে। আগুনটা জ্বলে ধিকি ধিকি। হাতুড়ির ঘা। কাস্তে কুড়ুল দা পড়ে আছে। সকালের খদ্দেরের চেয়ে রাতের খদ্দের বেশি ইদানিং।

মাঠের পাড়ে সালিশি সভা। ভিড় যেন পাতলা? লোকের কি সমস্যা কমে গেলো? ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ, স্বামী স্ত্রী ঝগড়া, জমি দখলের লড়াই এসবের বিচার করে রতন। তার সাকরেদ রা কড়া নজর রাখে।

আজ মোটে দুটো ঘর এলো। কর্মীদের কিছু জ্ঞান দিয়ে রতন নন্দার বাড়ির দিকে পা চালায়। ওরা কি রতনের দোকানে গেলো?

রতনের হাত শক্ত হয়ে গেছে। দাগ আর ফোস্কা। বচ্ছরকার দিনে বউ আর খুকীটার কিছু ত দিতে হয়। মা’টা মরে একদিকে তার ভার কমেছে। কামারপাড়ার দিকে যেতে যেতে সে মুখোমুখি হয় অন্ধকারে রতনবাবুর। পাশ দিয়ে চলে যান হন হন করে। আজো বলা হলো না বন্ধকের জমিটার কত দেনা আর বাকী। পেছন পেছন কিছুটা ফিরে যায় লোকটাকে ধরার জন্য।

রতনের হঠাত বুকটা ধরাস। ছোটোলোকটার চোখ দুটো কেমন জ্বলছিলো। নাকি তার মনের ভুল। পেছনে পায়ের শব্দ। ওই ত আসছে রতন কামার। পেছু নিয়েছে। এদিকটা ঝোপঝাড় বিশেষ বসতি নেই। যদি হাতে দা থাকে আর ... ছুটতে থাকে রতন বিপুল শরীর নিয়ে।

এসি চলছে। ডাক্তার এসেছে। কদিন শরীরটা ভালো নেই। চোখ লাল। প্রেশার বেড়েছে।

ঠং ঠং ঠং ...রাতে ভোরে ঘুম ভেঙে গেলেই শব্দটা

তাঁর বুকেই যেন হাতুড়ি পেটে। বারান্দায় যাওয়া বন্ধ। গেলেই মনে হয় পথের বাঁকে দু জোড়া জ্বলন্ত চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে।

ও কি জেনে ফেলেছে জমিটার দেনা কবেই শোধ হয়ে গেছে, নিজের নামে বেদখল হয়ে গেছে অথবা ১৫বছর  আগের সেই আত্মহত্যা রতনের বোন রত্নার। পেটে তারই... নিজেকেই বিড় বিড় করেন সামনে নির্বাচন, কিবা করার ছিলো। কামার বস্তির ছোটোলোকের মেয়ে... পাবলিক নিত না।

ক্রমশ কৃশ হতে থাকেন রতন। ক্রমশ আরো জোরে পড়ে আগুনে হাপর।

পুজো আসছে।

রতনবাবুর বড়ো পুত্র তৈরী হয়। সিটটা তার ন্যয্য দাবী। রতন কাউকে বলতে পারেন না এ আতঙ্কের কথা।

দিনরাত রাতদিন। আজকাল স্বপ্ন দেখেন অট্টালিকা নেই তিনি কামার হয়ে গেছেন, জমিহীন। মহালয়ার পরদিন হাতুড়ির চরম ঘা পড়লো অবশেষে।

দুই ছেলে আর দুই জামাইয়ের কাঁধে চড়ে অগস্ত্য যাত্রায় চললেন এলাকার নেতা ও সমাজসেবী। বিরাট মিছিল।

পাথরে কোঁদা কালো শরীরে পেশিগুলো ওঠে নামে। মুখে কপালে ঘাম। ঘাম গড়িয়ে পড়ে নগ্ন লোমশ বুকটা বেয়ে।

ঠং ঠং ঠং ঠং... নিরলস। শব্দটা বন্ধ হয় না।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন