কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন

 


(পর্ব ২৫)

বাসা ভাঙে। পাখি উড়ে যায়। নারীজন্ম বেদুইন। মনের ঘর পাল্টায়, বাসের ঘর পাল্টায়। বাইরের ইঁট, কাঠামো, দেওয়াল, ইমারত বদলে যায় জীবনের ঘর। শেষবারের মতো দেখে নিই উঁচু কড়িবর্গাগুলো। জানলার সামনে নিমগাছ। লাল মেঝের ওপর ঘর জোড়া পালঙ্ক। যাবার দিন এগিয়ে এলো। আবার বাড়ি ছাড়া। মধ্য কলকাতার জন্মভিটে সবুজ ঘেরা বাবার তৈরি বাড়ি থেকে এসে বিশাল প্রাচীনতার গন্ধওয়ালা বাড়িকে ভাবলাম এতো আমারই। এখন আবার দক্ষিণ কোণে ছোট্ট পায়রার খোপে থাকতে হবে।

যা চেয়েছি তা পাইনি জীবনভর। কেন পাইনি সেই প্রশ্ন অবাস্তব। শুধু ছেড়ে যাবার কষ্টটুকু তীব্র হয়ে বাজে।  এইখানে এই বাড়িতে প্রায় কিশোরী থেকে পূর্ণ নারীত্বে উত্তরণ। যেদিন চলে যাচ্ছি চিরদিনের মত সেদিনও অবিরাম ছিল বারিধারা। গাড়ির ভেতরে বসে দেখি ক্রমাগত ওয়াইপার মোছার চেষ্টা করছে শহরের চোখের জল। আমার সামনে থেকে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের পাড়া আমার সেই প্রিয় বাড়িটা, চিলেকোঠার ঘর, ঘুলঘুলিতে চড়াইয়ের গুবগুব, লাল মেঝে আর কুয়োতলার সবুজ শ্যাওলা... মানুষের আবেগ আছে তাই সে মানুষ মনুষ্যতরের থেকে পৃথক।

"আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে।

তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।।"

মানুষ কোনো একটা ধারণা নিয়ে বাঁচে, বিশ্বাস নিয়ে বাঁচে। জীবন তবু স্থবির নয়, জঙ্গম। তাই ধারণা পাল্টায়, বিশ্বাস পরিবর্তন হয়। কেউ আস্তিক কেউ সাত্ত্বিক কেউ নাস্তিক। যতদিন ঈশ্বর বিশ্বাস ততদিন কোনও অদৃশ্য অস্তিত্বের ঘাড়ে অভাব অভিযোগ কৃতকর্মর ভার তার ওপর ন্যস্ত করে মনে শান্তি পায় মানুষ। যাঁরা কর্মফলে বিশ্বাস করেন তাঁরা ভালো কাজ করলে ভালো হবে এমন আশা করেন, তার চেয়েও বেশি তাঁরা বিশ্বাস করে শান্তি পান তাঁদের প্রতি যারা অবিচার করলেন তাদের শাস্তি হবেই। কিন্তু জীবন তো নদীর স্রোত। রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য প্রদীপ অনির্বাণ শিখা, তিনি লিখেছিলেন তাই,

"ওগো নদী আপন বেগে পাগল-পারা,

আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধভরে তন্দ্রাহারা।।…

পথে পথে বাহির হয়ে আপন-হারা__

আমার চলা যায় না বলা আলোর পানে প্রাণের চলা"

এভাবে প্রতি নিয়ত আলো আঁধারের সংঘাতে ভাবনার বদল হয়, বিশ্বাস ভেঙে ফের অন্য কোনো আশ্বাস আসে জীবনের। আমি ব্যতিক্রম নয়। প্রচণ্ড ধার্মিক পরিবারের শুদ্ধ ধর্মাচারণ পুজোপাঠ বংশের প্রাচীন নারায়ণ শিলা আরতি উপোস রামকৃষ্ণ মিশন সবই গেঁথেছিল জীবনের প্রারম্ভিক পর্বে। তারপর স্খলন। পুতুলপুজো এবং মানুষের অসীম চাওয়ার প্রার্থনা সম্বলিত পুজোপাঠ থেকে মন সরে নিরাকার, রাজযোগ কর্মযোগ জ্ঞানযোগ সমস্তর ভেতর দিয়ে ভাঙা আর গড়া। সব বিশ্বাসই ঠিক অথবা কোনোটাই অচল সত্য নয়, ধর্মের আপডেশনের কথা বারবার ভেবেছি, কেন হয় না। মিথ ভেঙে আসলের অমৃতসন্ধান আমরা করিনি। ধর্মগ্রন্থ গুলি যখন লেখা হয় তখন বিশ্বের ভৌগলিক অবস্থা অন্য ছিল। সমাজ সামন্ত্রচতান্ত্রিক ছিল। এখন এই তথ্য প্রযুক্তির জগতে যখন মহাবিশ্বে রয়েছে প্রায় দেশের ভাসমান আস্তানা থাকছে, দেশে দেশে স্থাপিত হয়েছে গণতন্ত্র, তখন খুবই জরুরি ছিল ধর্মগ্রন্থগুলির আমূল পরিবর্তন। পৃথিবী বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তন হয়ে গেছে মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার। বালিগঞ্জ বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো স্বরস্বতীপুজো জন্মাষ্টমী সব করতে শুরু করেছিলাম যা বাসা বদল করে ফ্ল্যাট বাড়ির বাসায় কিছু বছর অবধিও জারি ছিল স্বতঃপ্রণোদিতভাবে। সেটা খুব যে ভক্তি প্রাবল্যে তা নয় গৃহে পুজো একটি উৎসব ডেকে আনে, বিশেষ হয় দিনটা তাই।

এরকমই এক প্রখর সময়ে আমরা গেলাম পুরীতে। বিষাদ প্রতিমা হয়ে। সে সময় উল্টোরথ। জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা বাইরে রথে। শত সহস্র মানুষ, দেশী বিদেশী সবাই। রসগোল্লা কিনে চললাম দিতে। কিছুদূর গিয়ে আর এগোনো অসম্ভব। সন্তান হারানোর জ্বালা অভিমান নিয়ে মনে মনে সমস্ত অভিমান উজাড় করে দিচ্ছি। রসগোল্লা হাতে ফিরছি। দু পা যেতে অন্ধকার সরু গলি থেকে এক বালক উদয় হলো, সামনে এসে হাত পেতে বলল রসগোল্লা দিতে। এ রসগোল্লা জগন্নাথের জন্য একটু দ্বিধা, ছেলেটি জ্বলজ্বলে মুখে তাকিয়ে চোখের দিকে। ওর হাতে দিলাম। হাসল। স্বামী ডাকলো, এক মুহূর্তে পেছন ফিরে আর দেখতে পেলাম না,  যেন গায়েব বাতাসে। পুরো রাস্তা গলিগুলো সব খুঁজলাম আর  দেখতে পেলাম না। ঘটনাটি বলার উদ্দেশ্য,  মানুষ যখন দেহে মনে বিবশ, অনেক কিছুই তার মনে উপলব্ধি হয়, যা অযৌক্তিক তবু সত্য। কলকাতা ফেরার পর কিছুদিন পরে পুত্র জন্মের উপসর্গ টের পেলাম। তার আগে এসেছি বেনারস। মণিকর্ণিকার ঘাট।

বালিগঞ্জ বাড়িতে মন ভোলানোর জন্য হয়ত শুরু হলো পাখিপোষা। লাভবার্ড, স্ফিন্ঞ, বদরী রং বেরঙের পাখির কিচির মিচির ভরিয়ে রাখত মন। নতুন বাড়িতেও তারা ছিল অনেকদিন। ক্যাপটিভ বার্ড এরা। আমরাও। পিঞ্জরবদ্ধ হয়েও যেন কত সুখী। মনে পড়ে ঝাপসা লেভেল ক্রসিং বালিগঞ্জ স্টেশনের। মনে পড়ে  এমন এক রৌদ্রজ্জ্বল দিন। বিজন সেতুতে, ১৯৮২, ৩০ এপ্রিল প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো, জলন্ত পুড়িয়ে মারা হলো ১৭জন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীদের। তাঁরা সিপিএম-কে দায়ী করেছিলেন এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডর জন্য। তদন্ত কমিশন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে সাক্ষ্য দিতে ডেকেছিল, পরে জ্যোতি বসু দত্ত কমিশন গঠন করেছিলেন তদন্তের জন্য সেখানেও কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে তলব করা হয়। তখন বিরোধী দল প্রায় নেই। যারা ছিল তারা তরমুজ আখ্যা পেত। মনে পড়ে অস্পষ্ট ভাবে, ১৯৯০ সালের ৩০ মে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দুই আধিকারিক ও একজন ইউনিসেফের আধিকারিক ধর্ষিত হলেন বানতলায়। গাড়ির চালক নিহত। এই দুটি ঘটনায় বাম সমর্থক জনগম নিঃসন্দেহে ধাক্কা খেয়েছিল, পূর্বের বিতর্কিত মরিচঝাঁপি পর্ব বিস্মৃত হলেও।

বড় হবার পর অনেক বছরে অনেক অত্যাচার অন্যায়ের সাক্ষী হতে হতে আমার মনে হয়েছে সিলেবাসে যেমন পরিবর্তন হয়েছে, আমাদের নীতিশিক্ষাগুলোও পাল্টানো উচিত ছিল, আমাদের মা বাবারা যে শিক্ষা দিয়েছেন বড় হয়ে এই পরিবর্তীত সমাজে তা অনেক সময় ভুল প্রমাণিত হয়েছে। "অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে" এই কথা বিশ্বাস করে পালন করতে গিয়ে, অপরাধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কত নিষ্পাপ প্রাণ বলি হয়ে গেল। শুধু দুঃখিত বললে কটা টাকা দিলেই কি ফিরে আসবে কারো স্বামী, পিতা বা সন্তান? আমাদের শেখানো হয়েছিল সদা সত্য কথা বলবে। এমন কেউ কি জীবন ধারণ করতে পারল একটাও মিথ্যা কথা না বলে? যুদ্ধক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ ছদ্ম মিথ্যা বলার পরামর্শ দিলেন, অশ্বত্থামা ইতি গজ।

শেখানো হয়েছিল বড়দের শ্রদ্ধা করবে, তর্ক করবে না। একজন অগ্রজকে যদি দিনের পর দিন নীতি ভ্রষ্ট হতে দেখি তাকে কি শ্রদ্ধেয় বলা যায়? বয়স যখন ছোটো এসবই ভেবে মনে বিদ্রোহ হতো। আমরা আদতেই স্বার্থপর চিরকাল চেয়েছি আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে, ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের অন্নদামঙ্গলে যেমনটা বলেছে ঈশ্বর পাটনি ছদ্মবেশী দেবী অন্নপূর্ণাকে। পরের ঘর অন্ধকার হোক আমার ঘরটি আলো হলেই হলো।

দ্বিতীয় সন্তানের বিয়োগ এবং বাসাবদল, কর্মহীন সোসিওপ্যাথ স্বামী আর চরম অশান্তির ক্রমান্বয়ে বিষাদ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে পুরী থেকে ফিরে অশান্ত মনে ফের গেলাম বেনারস। ঘরে ছোট্ট শিশুকন্যার কলকল আর পোষা পাখিদের দিনরাত  পিকপিক  নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে বাজত।

কলকাতা ফেরার পর কিছুদিন পরে পুত্র জন্মের উপসর্গ টের পেলাম। তার আগে এসেছি বেনারস। মণিকর্ণিকার ঘাট। ঘরে থাকতে পারছিলাম না ক্ষত বিক্ষত মনে। একবার এরকম বাইরে গেলাম। ফিরে এসে দেখলাম যেখানে রেখে গেছিলাম আমার পাখিদের সেখানে বাইরে উঠোনে তারা অনাদরে পড়ে রোদে বৃষ্টিতে ভিজে অনেকে মরে পড়ে আছে। দু একটির পেটে ডিম ছিল দু একটি সদ্যজাত। জীবন কত ভাবেই যে ক্ষত  বিক্ষত করে তার ইয়ত্তা নেই। মানুষ এবং লোহা আগুনে পুড়ে ইস্পাত হয়। সকলে হয় না। অত্যন্ত সংবেদনশীল ও আবেগপ্রবণ হওয়ার দরুন তারা মায়াময় হয়ে থাকে ফলে চিরজীবন কেউ না থাকলেও বিষাদপ্রতিমা ধরে থাকে হাত। দূর থেকে হাতছানি দেয় নষ্ট হবার প্রলোভন।

নতুন ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটে এসে পুরনোকে ভুলে নতুন উদ্যমে ফের সংসার সাজাতে ব্যস্ত হলাম। সরকারি চাকরি পাওয়ার কিছু বছর পর থেকে সংসারের কিছু সুরাহা হলো। এই দ্বিতীয় পর্বের সংসারে আমার মাতৃদেবী সক্রিয় দৃঢ়তা নিয়ে পাশে দাঁড়ালেন। বাবা আশ্বাসের হাত রাখলেন মাথায়। সম্পর্কিত দেওর, ননদ ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার পাশে দাঁড়ালেন। ক্রমশ ঘনিষ্ঠতম মানুষটি আমার মন থেকে আবছা অস্পষ্ট হয়ে গেলেন। দূরতর দুটি ভিন্ন গ্রহের মতো একই ছাদের তলায় বসবাস,পরিপাটি দাম্পত্য ছবি, সবই থাকল।

এই দীনতা এই ভণ্ডামি পূর্ব প্রজন্মের উত্তরাধিকার, আশার কথা নতুন প্রজন্ম এইসব ছেঁদো নৈতিকতা এবং ভণ্ডামি থেকে মুক্ত হতে পেরেছে।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন