ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি
… বিনোদের খেরোর খাতা থেকে
প্রতি,
হে দর্শক! আপনি আপনারাই সমাজ...!
আপনাদের দিয়েই আমাদের নাটকের সার্থকতা...। বিনোদ গড়িয়ে হেসে পড়ল। আর পাশ থেকে কে যেন
বললে, সমাজ বলে, নাটক করিস না। অথচ দ্যাকো, নাটুকেপনায় ভরপুর ইত্যাদি বাহুল্যময় শব্দ
দিয়ে আমার সংলাপের ভার এমন করে তুলেছেন নাট্যকারমশাই যে গরমিল হবেই।
বিনোদ বলে, নাটক মানে একপ্রকারের
কথা বলা শেখা, ধরন-ভঙ্গিতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিক্ষা, যা শিখন পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ করতে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসহ নিয়মিত অনুশীলনের
প্রয়োজন দ্বারা সাধিত একপ্রকারের বৌদ্ধিক, শারীরিক, মানসিক গুণসমন্বয়ের শৈলি, যা পরিস্ফুটিত
হয় ন¨নতত্ত্ব দ্বারা। এতদ্বগুণাবলীর সম্পৃক্ততাকে নাটক
বলা যায়। কিন্তু এসব বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ হতে পারবে না, যতক্ষণ না মঞ্চের সামনে দর্শক
শ্রেণির উপস্থিতি।
সবমিলে নাটকের এক ধাপ।
পাশে যে অভিনেত্রী বসে, সে-ই বললে,
সোজা কথায়, নাটুকে হওয়া তত সোজা নয়। যতটা নাটক নিয়ে লঘু করে সমাজ কথা বলে। এটা হল নাটকের
সেই দিকটা যেটা সময়-ঘণ্টা নিরিখে অভিনয় হয়। কিন্তু, এই অভিনয় হতে আসার জন্যে লাগে একটা
লেখা, যেটার ভিত্তিতে নাট্যরূপ ধরে সংলাপ বলা চরিত্র, ঘটনার প্রবাহ থাকবে। ঘটনার শুরু,
মধ্য, শেষ থাকবে। ঘটনাহল আসলে গল্প, যা বিশেষ করে লেখা হয়। অভিনয়ের জন্যে। সঙ্গে পরিবাহিত হবে আলো, গান, বাজনা, পোশাক, সাজ-মেকআপ
ইত্যাদির কুশলীয়ানা। সব মিলে এক তারে চললেই -- নাটক হবে।
বাহ, বিনি তুই বুঝি নাটক লিখবি?
নাহলে এত বড় পার্টগুলো মুকুস্ত বলছিস কি করে?
এসব করার পরও বাকি থাকে আরেকটা বড় ধাপ। সেটা হল -- নাটক কে দেখবে।
দর্শক।
দর্শক জানবে কি করে?
বিজ্ঞাপন, টিকিট বিক্রি ইত্যাদি
অর্থাৎ প্রচার।
দর্শক কি দেখবে সেটাও ভাবতে হয়।
কেননা, টাকা খরচ করে, সময় হাতে নিয়ে যারা আসবেন, তারা তো আর এমনি এমনি আসবেন কেন, তাদের
কিছু ফিরিয়ে নিয়ে যেতে দিতে হবে। ফলে, সেটাও একটা চ্যালেঞ্জ।
তামাদি ব্যাপার একযোগে হলেও, নাটক
অসফল হতে পারে। তেমন দর্শক না নিলে। অর্থাৎ, গল্পটা দর্শকের চেনা-জানা, চরিত্রের সঙ্গে
হলে ভাল হয়। তাতে দর্শক সহজে মিশতে পারে। সেকথা আগেই মাস্টারমশাই নাট্যকারের সঙ্গে
আলোচনা হয়েছে।
এই দর্শক হল সমাজের অংশ। যারা শিল্প,
সংস্কৃতির রুচি নির্ধারণ করে থাকে। এজন্যেই চলা, না-চলা নির্ভর করে। আর নাটক তো দেখাতে
চায় দর্শককেই। দেখানোতেই সার্থকতা। কারণ, যে
যা নয়, সেরকম চরিত্রের সাজ-পোশাকে সেজে নড়া-চড়া করা, সংলাপ বলা, আলো, বাজনায় ছাপিয়ে
উঠেই তো অভিনয়। অভিনয় বড় সহজ ব্যাপার যেমন, তেমন আবার নয়ও। নাটকও তাই। সহজ, কঠিন। সমাজের
কাছে প্রতিফলিত কোনও বিষয় না ধরতে পারলে, তা ব্যর্থ বলে ধরা হবে।
নাটকের কৌলিন্য একপ্রকার উচ্চশিক্ষাগত
শিল্পধারা হিসেবে। কিন্তু, তার বিস্তার তো সমাজ ছাড়া সম্ভবপর নয়। তাই, নাটকের সমাজ।
আর সমাজের নাটক নিয়ে আলোচনা বুঝে নেওয়া।
কিন্তু, নাটক তেমন কঠিনও নয়, অনুশীলন একাগ্রতা দ্বারা সম্ভবপর।
হ্যাঁ, তাতে ব্যাকরণ না থাকলে শুদ্ধতা
আসে না। বিনি বলে।
বিনি লেখে, আর বলে যায়, কিন্তু,
ব্যাকরণও তো নাটকের প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে। অভিনয় কোথাও থেমে থাকেনি তার
ছ¨-পদ-আঙ্গিক ইত্যাদি মানে সোজা কথায় স্টাইল-এ বারবার
পরিবর্তন এসেছে। সময় অনুযায়ী সেই পরিবর্তিত আঙ্গিককে বর্তমান সময়ের আধুনিক বলে ধরে
নেওয়া হয়েছে। নানা ভাষা নানা মতের এই সমাজে নানা পরিধানের মতদানকারীরা নাটকের অভিনয়কে
নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে দিতে --- ব্যবহারিক এক ব্যাকরণ তৈরি করেছেন। আগে অভিনয়ের ইচ্ছে
জাগে। তারপর নাটকের দিকে আসে। পরিশেষে, টিকে গেলে মঞ্চ-নাটক-অভিনেতার সমাজ সংগ্রামে
ব্যাকরণ কাজে আসে। তবে, ব্যাকরণই তো শেষ কথা নয়।
হ্যাঁ, তার প্রমাণ মিলেছিল নাটকে অভিনেত্রী নেওয়ার শুরু হতেই। যেমন সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই বিনোদিনী দাসী বা নটী বিনোদিনী, বা গোলাপদিদিরা। যিনি নাটকের দুনিয়ার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ না হন, কিন্তু শ্রেষ্ঠ হওয়ার জন্য কসুর করেননি। যতই সমাজ টেনে নামিয়ে খর্ব করুক তবুও, তাঁর নাট্যাভিনয়ের আলোচনা করার জন্যে একজন গিরিশকে লিখতেই হয়।
বাহ, বিনি, বাহ রে... এজন্যেই তুই
ওজস্বী। এজন্যেই তুই নাটকের প্রাণ... তোর মতনই কাউকে চাই অভিনয়ের জন্য, যেখানে ব্যাকরণ
একটু একটু করে মিশে যাবে শৈলিতে, আর ভাবখানাই উঠবে ফুটে।
বটেই তো ... ব্যাকরণ ভাষার সৃষ্টির
আগে যেমন সৃষ্টি হয়নি। সেকথার ভাব ধার করে বলা যেতেই পারে, নাট্যাভিনয়ের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়ায়
শেষমাত্রায় বিশেষ করে তুলতে নাট্য-ব্যাকরণ প্রয়োগ করা যায়। নইলে এত যে মেনে মেপে আলো
বুঝে, কিউ-মাথায় রেখে, কথার মধ্যে মধ্যে কথা বলতে থাকা, যেন ওভার ল্যাপ না করে, যেন
টেইল-ড্রপ না হয়ে যায়। যেন স-শ -এর দোষ বেশি বেশি কানে শোনা না যায়। যেন সবের পর সংলাপ
বলার সময় কণ্ঠস্বর শুনে না মনেহয় যে --- চেঁচাচ্ছে। এতকিছুর পরও আবেগের প্র্যাকটিস।
তারপর সংলাপের সেইটুকু জুড়ে অন্যদের সঙ্গে মেলবন্ধন। সব মিলিয়ে একশোতে কতটা হওয়া যায়---
সেটাই তো অভিনেতার চ্যালেঞ্জ। নাটকেরও।
ততক্ষণে চরম গরমে পোশাক পরতে হতে
পারে রাজা-উজিরের। উফ্, কি কুটকুট করছে ভেবে একটু অন্যমনস্ক হলেই, সংলাপ চলে যাবে সময়ের
মতন। কিউ -মিস করা অভিনেতার কপালে সে বড় দুঃখের সময়।
অন্য অভিনেতা যারা মঞ্চে উপস্থিত
তাদেরও অনেকটাই সচেতন থাকতে হয়। তাদের মধ্যে কেউ নবিশ হলে, হয়ে গেল। শো মাটি হতে এরকম
সময় প্রায় লাগবেই না।
একজন নতুন অভিনেতার কটা কথা লিখলাম, পড়ে জানিও... কেমন লাগছে, এটুক বুঝে পড়ো যে এও --- সে নতুন অভিনয় করছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
এসব প্রকারের প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে
নাটক, নাটুকে, নাটুকেপনা ইত্যাদি শব্দ নিয়েই চলমান এদশকের নাটক। নাট্যকলা। থিয়েটার।
ভূমিকায় যা ব্যাখ্যা করা হল, অনেক
পাঠকই তা জানেন। কিন্তু, একসঙ্গে করে লিখে দিলে নতুন প্রজন্মের নাট্যপ্রেমীদের সুবিধে
হতে পারে। কঠিন নাট্যশাস্ত্র ভরতমুনির লেখা থেকে সময়ে সময়ে সরলীকরণ করা হয়েছে। সেরকমই
প্রয়াস যে, নাটকের মূল ব্যাপারটা যে মোটেই ভয়ের নয়, অন্যান্য অঙ্ক বিজ্ঞান দর্শনের
মতনই। কিছুটা ইতিহাস, কিছুটা প্রায়োগিক, কিছুটা আবার ব্যাকরণসম্মত। সবটা মিলেই জীবন্ত
এক আর্ট ফর্ম -- যা সমাজের সর্বত্র পরিবাহিত। এই বিস্তারের উদ্দেশ্য -- নাটকের সঙ্গে
সমাজ, সমাজ নাটকের পরিপূরক সম্পর্ক জ্ঞাপন করা। এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে বাংলা থিয়েটারের
শুরুর দিকে নারীর ক্ষমতায়ন তুলে আনা।
_ ইতি
একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক স্বত্বাধিকারী…
অনবদ্যভাবে প্রকাশ পেয়েছে, বিনদের মুখে এই দশকে নাটক শব্দের প্রকৃত অর্থ।
উত্তরমুছুন