কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

স্মৃতিকণা সামন্ত

 

হেমন্তের দিনরাত্রি




বাহাদুরের মত লোকের যে দু দুটো বউ থাকতে পারে সেকথা শুনে পুরো তাজ্জব বনে গেছে নাচকু পাসি। ছোটখাট, নরম চেহারার বাহাদুর। রোজ সকালে বাঁশের বাঁকে দুটো টিনা ঝুলিয়ে বাবুদের ঘরে ঘরে জল দেওয়া বাহাদুর। বাবু প্রতি বারা টিনা জল, মানে হল গে ছয় বাঁক। সারাদিনে কুড়িটা ঘরে জল দেওয়ার 'ডিপটি' করা বাহাদুর দুটো শাদি করে ফেলল অথচ নাচকু অভি তক কুঁয়ারা বৈঠল রহ্ত!

নিভু নিভু বিকেলের মুখে হরিহরের বিবি তাকে সেইসব কাহানি শোনায়। দিওয়ালির মরশুমে ধাঁ করে ফুরিয়ে আসে বিকেল। জানলায় মুখ রাখলেই হাওয়ার শিরশিরানি টের পায় বিন্দিয়া। খাটালের একপাশে খড়কুটো জড়ো করে আগুন জ্বালায় হরিয়া। ধিকধিক আগুন ঘুরে ঘিরে নাচতে নাচতে সন্ধ্যা নামে।

শীত এখনো পড়েনি। ওই যে কোম্পানির আমবাগান, আমবাগান ছুঁয়ে মোরামের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টগুলোয় হলুদ আলো জ্বলে উঠলেই ভিড় করে আসে পোকারা। বন জঙ্গল, মাঠ বাদাড় ঝেঁটিয়ে ছুটতে ছুটতে আসে ওরা। আলোটা রাস্তায় এসে থিতিয়ে থাকে, আশপাশের ঝোপে জঙ্গলে ছড়াতে ভয় পায়। পাঁশুটে রঙের অন্ধকার জড়ো হয় বাগানের গাছগুলোর মাথায়।

বিন্দিয়ার দেশোয়ালি ভাই নাচকু। তাদের গাঁও দিহাতে হলে নাচকুর সাথে বিন্দিয়া কভি বাতচিতই করতো না। জাতপাতের হাজার ফের। কিন্তু ওই যেবার বিন্দিয়া তার লেড়কির বুখার নিয়ে জেরবার, হাতে টাকাপয়সার টান সেবারই না নাচকু এসে বলল "কোই ফিকর নহি বহেনা, ম্যা হুঁ না! একই গাঁওকে আদমি কব কাম অ্যায়েগা বোলো? "

ব্যস, তখন থেকেই হরিহরের উঠোনের খাটিয়ায় নাচকুর আসা যাওয়া। দিওয়ালির মিঠাই হোক বা ছটের ঠেকুয়া, নাচকুর জন্য গামছায় বেঁধে রাখতে কক্ষনো ভুল হয় না ওর।

ছট আর দিওয়ালি আসে গায়ে গা লাগিয়ে। খাদানের শিফট শেষের হুইসল ফাঁকা মাঠের মাঝে এসে খানখান হয়ে যায়। সামনের মাঠ ছাড়িয়ে দূরে তাকালেই নজরে আসে মরা খালটা। একচিলতে জলের রেখা তখনও চিকচিক করে। তারই গায়ে রেশমি চাদরের মতো কুয়াশার ধোঁয়া ধোঁয়া সাদাটে পরত। বিন্দিয়ার ভারী মনকেমন করে এসময়। গাঁয়ের কথা মনে পড়ে, চাচা চাচী আর বুড়ি আম্মির কথা মনে পড়ে। আবার কবে গাঁয়ে যাবে কে জানে!

তামাম কুলি ধাওড়া, মজদুর কলোনি, বাবুদের মেস আর ম্যানেজার বাংলোর খবর রাখে ঈশ্বর মুদি। চায়েওয়ালা মন্টু সিংয়ের সাথে তার ভারী খাতির। ঘুপচি দোকানের ভেতর চটের গদিতে ভুঁড়ি ঝুলিয়ে বসে থাকে ঈশ্বর। কপালে চন্দনের ফোঁটা। দোকানের ভেতর চাল, ডাল, চিটেগুড়, বাটি সাবানের গন্ধের সাথে ধূপের খুশবু মিলেমিশে অন্ধকারটা কেমন আদুরে হয়ে থাকে সবসময়। ঈশ্বরের দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিটায় কোলিয়ারির তামাম খবর লেনদেন হয়। বোমা, পেটো, লাইসেন্সবিহীন বন্দুক কিম্বা বোনাসের আগাম খবর আসে ওই বেঞ্চেই। এসব খবরের মাঝে কোন কথা বলে না ঈশ্বর। মন দিয়ে চাল ডাল ওজন করে। তারপর রাত বাড়লে মন্টু সিং যখন আসে দোকানের ঝাঁপ ফেলে তখন দুই জিগরি দোস্ত ওই বেঞ্চে বসে সারাদিনের খবর বিনিময় করে। বাহাদুরের কিসসাটাও মন্টুর কাছেই শুনল ঈশ্বর।

টায়ারের চটি, স্যান্ডো গেঞ্জি আর ফেত্তা দিয়ে লুঙ্গি পরা বাহাদুরের জিভ বেরিয়ে যায় জল বইতে বইতে। হাতে পায়ে চাক চাক দাগ। দাল চাওল আর আলুচোখা খেয়ে, খাপরার চালের ঘরে ঘুমিয়ে খাসা ছিল বাহাদুর। তার দুঃখে মুখ দিয়ে চুক চুক আওয়াজ বেরিয়ে আসে দুজনেরই।

দিওয়ালির ঠিক আগে আগে হরেক কিসিমের খবর উড়ে আসে এ তল্লাটে। সেবার বিজ বাজারে খুন হয়ে গেল পাশের কোলিয়ারির ভগীরথ সাউ। আগুনের মতো সে খবর উড়তে লাগল এক দোকান থেকে আরেক দোকানে। গুমটিগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হল হুশহাস। ঘরের দরজায় খিল পড়ল, আর রাস্তায় পড়ল বোমা। মন্টু আর ঈশ্বর সে রাতে বেঞ্চে বসল না।

শীত আসার ঠিক আগের রাতগুলো কেমন যেন ধুন্ধলা লাগে ওদের, বিন্দিয়ারও। গাঁ গঞ্জের রাতের মতো নয়। বিন্দিয়ার গাঁয়ে এসময় মাথার ওপর ডেকে যায় লক্ষ্মীপেঁচা, মাঠ থেকে পাকা ধানের গন্ধ আসে। শিশির ঘন হয় যত ধানের বুক ততই পুরু হয়ে ওঠে। কার্তিকের ঝুরো ঝুরো ঠান্ডায় বুড়ি নানি গায়ের মোটা চাদরটা টেনে দেয় মাঝরাতে আর দূরে শেয়াল ডেকে ওঠে থেকে থেকে।

কার্তিকের সন্ধ্যাগুলোয় কোলিয়ারিটাকে কেমন যেন যাদুগরনি'র মতো মনে হয় তার। ওই অন্ধকারের কাছে  গেলে যেন আর ফিরতে পারবে না ঘরে, শনশন চুলের বুড়ি ভরে নিয়ে যাবে অন্ধকার ঝোলায়। অনেক রাতে কুকুরের ডাক শুনে ঘুম ভেঙে যায়। কোয়াটার্সগুলোর চৌহদ্দি পেরিয়ে, ওদের খাটালের বেড়া ছাড়িয়ে দূরে, আরও দূরে ভেসে যায় সেই ডাক। ধু ধূ ডাঙা, মরা খাল, খাদানের হুইল টপকে শব্দটা চলে যায় জিটি রোডের দিকে। কালীপুজো যত এগিয়ে আসে ততই গাছে গাছে ঝিকমিক করে ওঠে জোনাকির ঝাঁক। ওদের ঘরের উল্টোদিকে আব্দুর আর তার বউ আমিনার ঘর। কুলিপাড়া, মজদুর কলোনির কেউ নয় ওরা, যেমন  নয় বিন্দিয়ারাও। কয়লার সাথে কোন লেনদেন নেই ওদের, শুধু মাসে হপ্তায় রান্নার জন্য দুয়েক বস্তা কয়লা জোগাড় করা ছাড়া। এ তল্লাটে ঘরে ঘরে কয়লা। গরুর গাড়ি ভরে মাসে মাসে বাবুদের ঘরে কয়লা পাঠায় কোম্পানি, মজদুররা ঘরে ফেরার সময় দুয়েক চ্যাঙরি কয়লা মাথায় নিয়ে ফেরে। খাদান থেকে বোঝাই হয়ে যে ডাম্পারগুলো চলে যায় স্টেশনের ডক সাইডে, সেসব ডাম্পার থেকে পড়তে পড়তে যায় কয়লা। কালো হয়ে থাকে রাস্তার ধুলো ।

দিওয়ালির আগে দের অব্দি রাত জাগে আব্দুর আর তার বউ। ঘরের সামনে ধিকধিক জ্বলে ভাঁটি। রাতভর পুড়তে থাকে ঘরোন্দা, মিটটি কি বর্ত্তন আর দিয়া। সকালে ঠান্ডা ছাইয়ের ভেতর থেকে ওরা তুলে আনে সেসব। আর ক'দিন পর কোলিয়ারির কোয়ার্টার্সগুলোতে ঝিকিয়ে উঠবে এইসব দিয়াবাত্তি। গাঢ় কালো রাতে হাজার হাজার জোনাক পোকার মতো সার সার বাত্তি। দিওয়ালির সময় আব্দুরের দিয়া ছাড়া সব শুনশান, বিলকুল অন্ধেরা।

কালীপুজো এলে অফিসপাড়ায় একটা আলসে রোদ এসে বসে। কাগজফুলের গাছটা ঢেকে যায় নরম আলোয়। বানারসি চাচার ঘরের পাঁচিলে চাচী আর তার মেয়েরা রোদে দেয় নিম্বু কি আচার, মির্চ কি আচার, কাঁঠাল কি আচার। বড়ি আর পাঁপড়ের খুশবু ভরে থাকে ওদের উঠোনে।

এই দুপুরগুলোর রোদে কোন জ্বালাপোড়া নেই। ইএমইউ ট্রেনগুলো চলে যায় দূরে। খালের ওপারে সাঁওতাল পাড়াটা পড়ে থাকে একপাশে। সন্নাটা ঘিরে ধরে নাচকুকে, হুহু করে ওঠে মন। শীত আসছে। আসার আগে এত আয়োজন মনকেমন করে দেয়। হাওয়ায় একটা শিরশিরে ছোঁয়া, গায়ে খড়ি ওঠে। কুলি বস্তির ঘরগুলোয় রঙ পড়ে। নীল মেশানো চুনজলে পাটের গুছি ডুবিয়ে দেওয়াল রাঙায় বাহাদুরও। নাচকু থেমে যায়। বাহাদুরের সাথে দুয়েকটা কথা বলে টুকটাক। কিন্তু সেদিন বাহাদুরের ঘরের সামনে তুলকালাম। দিওয়ালির সময় ওর বিবি আসে কদিনের জন্য। সেবার কোত্থেকে আরেক বিবি এসে হাজির, বলে থাকবে! গোলমাল গিয়ে থামল পঞ্চায়েতে। রতন বাউরি, পঞ্চায়েত প্রধান ব্যাপারটার কী হিল্লে করবে ভেবে পায় না। অনেক ভেবে বিধান দেয় পরবের দিন কটা কাটুক, একসাথেই থাক দুজনে। তারপর একটা ফয়সালা হবে না হয়!

দেখতে দেখতে দিওয়ালি আসে। আব্দুরের প্রদীপগুলো দুপুর দুপুর বালতির জলে চুবিয়ে রাখে বিন্দিয়া। মন্টু সিংয়ের চায় কি দুকান এখন একটু ফাঁকা। যেসব মাইনিং সর্দার আর মজদুররা শিফট শুরুর আগে পরে এসে থেকে জমাত তারা এসময়টা দেশে চলে যায় অনেকেই। খাদানের দুটো শিফট কম হয়। ডাম্পারগুলোও  একটু জিরোয় ওই দুটোদিন। ঈশ্বরমুদির দোকানের সামনে ফুলপাত্তির নকশাদার কাগজ, রঙিন চালের রঙ্গোলি। বাজারে আজ উপচে পড়ছে ভিড়। আখ, পানিফল আর বাতাবি লেবুর সামনে থৈথৈ লোক। সারা কোলিয়ারির একটাই পুজো, ওই অফিসপাড়া। ঠাকুর আসার আগেই নিকানো মাটির ওপর বিকেল বিকেল আল্পনা দিয়ে যায় কেউ। ভাঙ্গা দেয়ালটার উল্টোদিকে দুটো বাঁশ দিয়ে মাথার ওপর ত্রিপলের ছাদ। কনকনে শীত পড়ে কালীপুজোর রাতে। বিন্দিয়া গায়ের ওপর পাতলা চাদর জড়িয়ে নেয়। বাচ্চাগুলো হইহই করে সারা ঘর। হরিহর আজ নতুন ধুতি চাদর, গায়ের বোঁটকা গন্ধটাও আজ নেই। বাবুদের কোয়ার্টার্সে এক এক করে জ্বলে ওঠে দিয়া। বাহাদুরের দুই বিবি মিলেমিশে লছমি পুজোর জোগাড় করে ঘরে, মাটির দেওয়ালের গায়ে গায়ে দিয়া

জরি পাড় আসমানী শাড়িতে ঝিকমিক করে আব্দুরের বউ। মেয়েদুটোর সাথে হাতে হাতে প্রদীপ সাজায় কালীঠাকুরের বেদিতে। অনেক রাতে পুজো। বিন্দিয়া আসে পুজো নিয়ে। ওদের ঘর থেকে পায়ে চলা সরু রাস্তাটার দুপাশের পুটুসের ঝোপ। একটা দুটো শেয়াল চলে যায় এপার ওপার। রাত এখন কেমন গাঢ় যেন, আঙ্গুল ছোঁয়ানো যায় অন্ধকারের গায়ে, হিমহিম চারপাশ। হলুদ ছোপ ছোপ রাস্তার ওমাথায় আলো জ্বলে টিমটিম। একগাদা লোক বসে থাকে গোল হয়ে। ঝাঁক ঝাঁক তারা থমকে থাকে আকাশের এপার ওপার, হু হু শীত বয়ে যায় কোলিয়ারির অফিসের গেট ছুঁয়ে, ঈশ্বরমুদির দোকান পেরিয়ে, মন্টু সিংয়ের চুলা টপকে ভসকার দিকে।

সারাবছর কালিঝুলি মেখে থাকা মানুষগুলো যেন উৎসবের ফেরে পড়ে যায়। রাত বাড়লে দূর গ্রামের মাইক বেজে ওঠে। যাত্রার আসর বসে কালাগ্নি মন্দিরের চাতালের সামনে, হাটতলায়। টর্চ হাতে পিলপিল হেঁটে যায় মানুষ। আর তখনই গুনগুন সুর জেগে ওঠে কুলিবস্তি, মজদুর কলোনির ঘরে ঘরে। একটানা, দুঃখী, বিনবিনে একটা সুর। বিন্দিয়া ঘরের ভেতর কয়লার উনুনটা ঢুকিয়ে নেয়। বুড়ি শাশুড়ি এসে বসে তখন আঁচলের খুঁট জড়িয়ে। আসে সুখিয়া আর জেঠানি জানকি...

"নারিয়েল কে পাত পর উগলেন সুরুযমল ঝাঁকে ঝুঁকে

এ করেলু ছট বরতিয়া ঝাঁকে ঝুঁকে..."

ছট আসে ঘাসের আগায়, উগতা হুয়া সুরজ কে রোশনি কে সাথ। নীলচে আলোয় ভসকার জলে পাক দেয় আবছা কুয়াশা। হাত কয়েক দূরে ধানজমির গায়ে থিতিয়ে থাকে মখমলি চাদরের মতো। রাস্তায় ভেজা পায়ের ছাপ। মেটেরঙ সিঁদুরের আগা ছুঁয়ে ভোর আসে। খাদনের চাকাটা কেমন রাক্ষুসে মুখে তাকিয়ে থাকে গুমসুম।

শ মিল কে দুরি মে বিন্দিয়ার গাঁও। তাদের মেটেঘর, খড় পাতার ছাউনী। জানলা খুললেই গন্নে কি খেত। আখের পাতার ওপর বড় বড় শিশিরের ফোঁটা। আলো পড়ে জ্বলজ্বল করে উ রামখিলাওন সিংয়ের বিবির আঙ্গুলের হীরা কি মাফিক। ধুন্ধলা ভোরের কী যেন এক সুখ। বিন্দিয়া চোখ বন্ধ করে। ওর গালে, নাকে ফোঁটা ফোঁটা হিম শিশির। কালো, রুখু কোলিয়ারিটা বড্ড নিজের মনে হয় তার, ঠিক সেই বচপনে ছেড়ে আসা দাদির আঁচলের মতো, গুঁড়ো গুঁড়ো, উষ্ণ, মিহিন আদরের মতো।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন