কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

দ্য ক্লাউড

 


(দ্বাদশ পর্ব)      

এই আগুন, সেই অগ্নি, যা দেহান্তরের শেষ বাহক। আবার এই আগুন সেই সামাজিক অসহিষ্ণুতা ও কর্তৃত্ববাদীদের স্বার্থপর মনোভঙ্গি, যা দীর্ঘদিনের বিবর্তনিক সাফল্যমন্ডিত সমাজব্যবস্থাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।

উৎপল চিত্রকর থামার পাত্র নয়। কবরখানার মাঠে সহাবস্থানের সাথে সুন্দর করে বেড়ে ওঠা গাছগুলোর ওপরে বয়ে যাওয়া বাতাসের ঝাপটায় গাছেদের পাতা নড়ছে। প্রকৃতির দাক্ষিণ্যের এমন নির্মল নিষ্পাপ শীতলতায় উৎপল চিত্রকর তার জলরঙে আঁকা প্রাকৃতিক পরিবেশকে হিংসা ও স্বার্থান্বেষী মহলের নজর থেকে বিশেষ একটি রং-এর কারুকার্যে পৃথকভাবে ফুটিয়ে তুলতে লাগলো।

নিমচাঁদ দাগার শরীরবিহীন শরীরের নাম আজ আর নেই। এক-এক সময় যেমন বহু পুরনো বন্ধুরা একজায়গায় হলে ভীষণ আনন্দ হয়, ঠিক তেমনই আজ নিমচাঁদের মন-এর ব্যবস্থাপনায় তার অন্যান্য ইন্দ্রিয়সকল ফিরে এসেছে। অর্থাৎ, এই মুহূর্তে নিমচাঁদ এখন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। সে এখন পূর্ণ পঁচিশের একজন যুবক।

হস্টেল ছেড়ে তখন সে পিতৃপ্রদত্ত দাগা অয়েল মিলের মালিক হবে কি হবে না, এই নিয়ে পিতাপুত্রের মধ্যে তীব্র বচসা চলছে। নিমচাঁদের বাবার মতে - পারিবারিক আয়ের ও সামাজিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে এই তেলমিল থেকে। যত গরিবগুরবো আশপাশের, তারা দাগাবাবু বলে সমীহ করে দূর থেকে কথা বলে। এছাড়াও আর্থিক ক্রমান্নতি ও কয়েক প্রজন্মের নিশ্চিত নিরাপত্তার কারণ-ও এই তেলমিল। অতএব একমাত্র পুত্র হিসেবে এর দেখভাল করার দায়িত্ব নিমচাঁদের-ই।

আর নিমচাঁদের মতে - এই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে তার দায়িত্ব, এই স্বাধীনতার মূলে যে নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধানের মধ্যে বিবিধের মিলন আছে, তাকে রক্ষা করা।

একসময়ে মনসুরের আবদারে তাদের মীরপুরের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল নিমচাঁদ। আর সেইসময়-ই সে মনসুরের খালাতো বোন রেবেকার প্রেমে পড়ে যায়।

মনসুর বলেছিলো, দোস্ত, আমাদের সমাজের একজন নারী হিন্দুকে বিয়ে করলে সামাজিকভাবে সেই পরিবারকে সকলে বয়কট করে এ-ই কারণেই যে, তাদের জন্য সমগ্র জাতির থেকে একটি অংশ বিয়োজিত হলো। অর্থাৎ তারা সংখ্যায় কমে গেলো। আর অপরদিকে হিন্দুদের সংখ্যা বাড়লো। কিন্তু আমি তোর দোস্ত হিসেবে চাই যে, তোদের ভালোবাসা চিরঞ্জীবী হোক। তোরা পালিয়ে যা।

রেবেকা উযোয়ার ভালোবাসার বন্ধনে তার স্বজাতিয় সকল সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে নিজেকে তৈরি করতে থাকে সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার এক সংস্কৃতি পাঠের সাথে। রেবেকা সন্ধ্যাবেলা শঙ্খে ফুঁ দেয়। সকালে বাসাবাড়ির উঠোনে গোবর-গঙ্গাজল ছিটায়। যদিও এইসব আচার-আচরণে নিমচাঁদের বড় আপত্তি ছিলো। সে সবসময় সম্রাট আকবরের উদাহরণ দিয়ে বলত, সম্রাট যদি মান সিংহের বোনকে বিয়ে করে তাকে তুলসীবেদী নির্মাণ করে দিয়ে স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ করতে উৎসাহিত করেন, তবে আমিও বলি, তুমি কলমা  পড়। তুমি নমাজপাঠ করো।

রেবেকাকে আদর করে রেবা বলে ডাকে নিমচাঁদ। সেইসময় প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা মানে বিরাট অপরাধ করা। তার ওপর ভিন জাতিকে বিয়ে করা। কিন্তু স্বদেশীয়ানায় শিক্ষিত নিমচাঁদের কাছে তখন দাদাভাই নৌরজীর সাথে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নামাঙ্কিত আদর্শের একটি ফ্রেম। ব্রিটিশ তাড়িয়ে স্বাধীন ভারতবর্ষের বুকে তেরঙ্গা পতাকা উত্তলন করতে সে জিন্নার সাথে জহরলাল নেহেরুর অবদানের আবেগময় অনুরাগের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। আর এইসব চর্চার অভ্যাস নিয়েই ধর্মনিরপেক্ষ দেশের পথের সন্ধান করে বেড়ায় নিমচাঁদ দাগা। সঙ্গীনি তার স্ত্রী রেবেকা উযোয়ার।

(ক্রমশঃ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন