![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
যে খেলার শেষ নেই
বাবা চাষ করত। বাড়ির পাশের পুকুরে অজস্র মাছ। ছোটবড় লাল নীল মাছ। তারপর রুইয়ের চারাও ছেড়েছিল। মা তাঁত বুনত ঘরে। মাটির ঘরে সোঁদা গন্ধ। মায়ের পায়ের ছাপ নিচু সিঁড়ির দিকে নেমে যায়। ঘটাং ঘট শব্দ করে তাঁত চলে। মাকু টানে মা। পাতলা মিহিন সুতির কাপড়ে ফুটে ওঠে মন্দির মোটিফ। পাড় জুড়ে। ইন্নাফি তৈরি হয়। ফানেকের সঙ্গে পরবে মা, দিদি, চানু নিজেও।
বাবা চাষ করে। কত কিছু জানে বাবা। ফসলের, ফলের, সব্জির নাম, তাদের বেড়ে ওঠার সময়, তাদের জল ও সার দেবার তরিকা। চানু শুধু স্কুলে যায়। শুধু গাছে চড়ে, ছেলেদের সঙ্গে। প্যারেড করে পিটি ক্লাসে। ইংরেজি ইশকুল, খ্রীষ্টের গান গায়। বাবা নজরে রাখে ওকে। ইশকুলে হিন্দি গান গাওয়া বারণ। খ্রীষ্ট ছাড়া কারুর গান গাওয়া বারণ। বাবা তবু চায়, মৈতেই সংস্কৃতি ওদের রক্তে যেন থাকে। বাবা বলে, মিথ্যে বলবি না কখনো। কার্যসিদ্ধির জন্যও না। এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করিস।
প্রতিদিন চানু আর বাবা রাতে দাবা খেলতে বসে। রাত ঘন হতে থাকে। মা আলো জ্বললে, এমনকি পাশের ঘরেও, ঘুমোতে পারে না। একেবারে অসহ্য লাগে মায়ের। সারাদিনের রাঁধাবাড়া, হাড়ভাঙা খাটুনি। তাঁত বোনা। তারপর এই বাবা মেয়ের অত্যাচার। বাকি ছেলেগুলো ঘুমিয়ে কাদা। বড় মেয়েটা তাঁত বোনায় হাত লাগায়।
বাবা, মেয়েকে সরাসরি কথা বলে না। বললেও বাঁকা কথা। শ্লেষ দিয়ে টান দেওয়া সে কথা। মেয়েও সরাসরি উত্তর দেয় না। বার বার ফস্কে বেরিয়ে যায়। বাবা বলে, সেই গল্পটা জানিস, স্বধর্ম ছেড়েছিল বলে গাধাটার কী অবস্থা হয়েছিল?
মেয়ে বলে, চেন্নাইতে টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়া কোন বাঘের চামড়া পরা নয়। বাঘের পিঠেও চড়া নয়। এমনিই একটা টুর্নামেন্ট।
এখনো ফসল ওঠেনি। হাতে টাকা নেই। ওখানে সবাই কেনাকাটি করবে। তোর হাতে পয়সা থাকবে না। তুই ফুঁসবি। ভাববি আমার বাবা মা গরিব।
আমার বাবা মা আমাকে টাকা না দিলেও সংস্কৃতি দিয়েছে। আমার মায়ের বোনা ইন্নাফি দেখে আগের টুর্নামেন্টে, কলকাতায় একটা আন্টি কিনে নিয়ে নিতে চেয়েছিল।
তোদের প্রজন্ম তো সব বিক্রি করেই রেখে দেবে। চেন্নাই যেতে দেব। যদি তিনটে খেলার দুটোতে জিতিস।
প্রথম খেলায় বাবা জিতল। দ্বিতীয় খেলা ড্র হল। এবার আরো দুটো না খেললে তো চানুর শান্তি নেই। রাত বাড়ছে।
মা হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে এল। দুমদাম পা ফেলে। দাবার বোর্ড, তৃতীয় খেলার মাঝখানে, তুলে, সামনের পুকুরে ফেলে দিয়ে এল। মা সাঙ্ঘাতিক মহিলা। ঘুমাতে না পারলে বাঘিনী।
চানুরা পেঁপে গাছের ফল চিরে তার ভেতরে মার্বেলগুলি লুকিয়ে রেখে এসেছিল। প্রত্যেকের আলাদা গাছ। ভাইদুটোর, চানুর। তিনটে পেঁপের ভেতরে তিনজনের মার্বেলের ভাঁড়ার। একদিন ঝড়ে একটা পেঁপে গাছ এমন দুলে উঠল, ঝরঝর ঠং ঠং করে মার্বেল গুলি পড়ল সামনের টালিবসানো উঠোনে। তিন ভাইবোন ছুট্টে গেল দেখতে, কারটা গেল, কারটা গেল?
মা ঘর থেকে বলল, চানুর গেল। ওই পেঁপে পাকতে চলল তাও আমি পাড়িনি। তোদের জ্বালায়।
অ্যাঁ, সেকি! মা জানত সব এতদিন ধরে? ওরা বাবা মা যাতে মার্বেল গুলির কথা জানতে না পারে তাই লুকিয়ে রেখেছিল সব।
ভাই এখন পিস্তল এনে লুকিয়ে রাখে ঘরে। ভাইয়ের ঘর। বাবা মার ঘর গত বছরের রায়টে পুড়ে ছাই। বাবা নেই। মায়ের তাঁতঘর পুড়ে গেছে। পেঁপের ভেতরে মার্বেলের মত লুকিয়ে রেখেছে ভাই গ্রেনেড। ভাইটা চলে গেছে অনেক দূরে, অনেক অনেক দূরে। বোনেরা জানে, ভাই আর ফিরবে না। কুকিদের মারবে বলে ভাই একেবারে খেপে উঠেছে। খুনেদের সাথে মেশে এখন।
দিদি ভিন শহরে পাঁচজন মণিপুরি আর্টিসানকে নিয়ে একটা তাঁতবোনার প্রজেক্ট করেছে। দিদি সফল হয়েছে। চানুও। অনেক দূরে চাকরি নিয়ে চলে এসেছে চানু।
মাঝে মাঝে মধ্য রাতে সেই শেষ না হওয়া দাবার ম্যাচটার দানগুলো, গুটিগুলো চোখে ভেসে ওঠে। দ্য গেম দ্যাট ওয়াজ নেভার প্লেড।
যদিও বাবা ওকে চেন্নাই যেতে দিয়েছিল শেষ অব্দি। বাবা জানত, চানু নিজেদের সবটুকু বেচে দেবে না। ছেলেকে আজো মণিপুরি গান শোনায়, শেখায়। ছেলের সাথে দাবা খেলে। ছেলেকে কোনদিন মিথ্যে বলে রূপকথা শুনিয়ে ভুলিয়ে খাওয়ায়নি এমনকি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন