কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

               

হে নেপথ্যচারিণী

 


(২৪)      

 

নিদ্রা

সন্ধ্যার অন্ধকারে আশুদা ডিমার দিয়ে রঙের গোলকের রঙ নিয়ন্ত্রণ করছে। আশুদার নিয়ন্ত্রণে বর্ণালীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বদলে যাচ্ছে গোলকের রঙ। আমি ফোটোমিটারে চোখ রেখে বসেছি। আমার চোখের সামনে রঙের গোলকের রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ফুটে উঠছে মনিটরে। আশুদার পরীক্ষা শেষ হতে আমি বললাম, "এবার বলো অত্রির নেপথ্যচারিণী কে?"

আশুদা ঘরের আলো জ্বালিয়ে সোফায় বসে বলল,"বেশ।শোন তবে। সেদিন নীচের কফিশপে তুই আমাকে একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিস। অধীর আগ্রহ সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করতে পারিসনি কে ও।মেয়েটিকে তুই চিনতি না। আমিও চিনতাম না।মেয়েটাই আমার সন্ধান নিয়ে ছুটে এসেছে কলকাতায়। ও কে জানিস?

-কে?

-জগদলপুরের তরুণী আদিবাসী নেত্রী লক্ষ্মী সিং।

-যার বাবা পরশুরাম সিং জগদলপুরের সেলে বন্দী ছিলেন?

-ঠিক তাই। জগদলপুরে অত্রি গিয়েছিল আর আমরা ওর পুরনো বাড়ি গিয়েছিলাম শুনে মেয়েটি আমাদের সন্ধান জেনে কলকাতা আসে। ওই লক্ষ্মীই একমাত্র অত্রির জগদলপুরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। শুধু অত্রি নয়, অত্রির পরিবারেরও সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বলা চলে।মেয়েটি আমাকে এক অদ্ভুত তথ্য দিয়ে গেল।

-কী তথ্য?

-এটাই যে একবার নাকি পাড়া থেকে কুটুম্বেশ্বর গুহায় গিয়েছিল অত্রি আর লক্ষ্মী। সেখানে গুহার ভিতর অত্রি হঠাৎ জ্ঞান হারায়। লক্ষ্মী বুঝতে পারছিল না কী করা উচিত। তখন অত্রি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় 'অনুসূয়া অনুসূয়া' বলে উঠেছিল।খানিক পরে আপনা থেকে অত্রির জ্ঞান ফিরে আসে। অত্রি আর লক্ষ্মীর সম্পর্ক নির্ভেজাল বন্ধুত্বর। লক্ষ্মী পরে অত্রিকে জিজ্ঞেস করেছিল এ বিষয়টা।অত্রি তখন বলেছিল এক রহস্যময়ীর কথা যে তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। স্নানরতা সেই রহস্যময়ী তাকে ঘুমোতে দেয় না। মেয়েটি কোনওভাবে জানতে পেরেছে আমার পরিচয়। ও অত্রিকে সত্যিই ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই অত্রির বৈবাহিক জীবনে জটিলতা সৃষ্টি করতে চায়নি। চুপিচুপি দেখা করেছে আমার সঙ্গে। তোর মেডিকেল কলেজে অত্রির সেই মৃতদেহর ওপর চড়ে বসার কথা ও কোনও ভাবে জানতে পেরেছে। ও চাইছিল অত্রি সেরে উঠুক। আমি ওকে সারিয়ে দিই।

-অত্রির নেপথ্যচারিণী অনুসূয়ামাসি! তা কী করে সম্ভব। অনুসূয়ামাসি তো অত্রির মায়ের মতো!

আশুদা হেসে বলে,"মানুষের মনের ভয়ানক কালবৈশাখী ঝড়ের সময় কোনটা জানিস? তার বয়োঃসন্ধি! এই সময়ে তার ভিতর  যৌনঅবচেতন তৈরী হয়। ভেবে দেখ। অত্রিদের কৈশোর ও প্রাকযৌবনে অনুসূয়া পূর্ণযুবতী। তা ছাড়া তিরদগড়ে অত্রি তাকে স্নানরতা দেখেছিল। অনুসূয়ামাসির প্রতি অবচেতনে তার যৌনাকাঙ্ক্ষা জন্ম নেওয়া অসম্ভব নয়। তার উপর এমনিতেই মাতৃসমর প্রতি পুত্রের ইদিপাস কমপ্লেক্স নিয়ে ফ্রয়েডের গোটা একটা তত্ত্ব তো রয়েছেই। তাই না?

-তুমি কি সেই অবচেতনের আকর্ষণ সবিতা আগরওয়ালের যন্ত্র দিয়ে অত্রির স্মৃতি থেকে মুছতে পারলে?

-পারলাম। ওই যন্ত্রটা তথাগতকে বলেছিলাম বেশি নাড়াচাড়া না করতে। ওটা একদিন এই রঙগোলকের মতোই ছুঁয়ে দেখার লোভ আমার ছিল। অত্রির মন থেকে ওই নেপথ্যচারিণীর স্মৃতি মুছে না ফেললে ওর আর সুচন্দ্রার দাম্পত্যে রাহুগ্রাস কাটত না। এমুহূর্তে সেটি জরুরি ছিল।

আমি হতাশ হয়ে বললাম,"বুঝলাম। আমার রয়ালের বিরিয়ানি হাতছাড়া হলো।"

আশুদা হেসে বলল,"হয়নি। একটা আর্টিকাল দিচ্ছি। পড়।সূত্র।"

আশুদা টেবিলের নীচে রাখা ফোল্ডার থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল,"আজ রাতে মন দিয়ে পড়ে রাখিস এগুলো। ওর ভিতর উত্তরটা আছে।"

পেনসিলভানিয়ার এক কোটিপতির অকালমৃত্যুর টর তার  সম্পত্তির উত্তরাধিকার দাবী করেছে একটি ছেলে। অথচ সেই লোকটির জীবিত স্ত্রী ছেলেটির উত্তরাধিকার মানছে না। অবশেষে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে সেই কোটিপতির প্রথমা স্ত্রীর সন্তান ছেলেটি। অনেকগুলি সূত্রর ভিতর সেই জীনগত উত্তরাধিকার চিহ্নর একটি অন্যতম হয়ে উঠেছে একটি রোগ।হানটিংটন কোরিয়া। সেই কোটিপতি মানুষটি ও সম্পত্তির দাবীদার ছেলেটি, উভয়েরই শরীরে একই রোগ ছিল। কোর্ট সেই ব্যাধিচিহ্নকেও জন্মচিহ্নর মান্যতা দিয়েছে। সারারাত ধরে ভাবলাম। কী সংকেত লুকিয়ে আছে এই নিবন্ধে। হঠাৎ প্রায় মাঝ রাতে লাফিয়ে উঠলাম। দৌড়ে বসার ঘরে এসে দেখি আশুদা তার রঙের গোলকের সাজ সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখছে। আমাকে দেখে বলল,"কী হলো?"

আমি সোৎসাহে বললাম,"পেয়েছি।"

-বল।

-পেনসিলভানিয়ায় বাবা আর ছেলের উত্তরাধিকার চিহ্ন হানটিংটন রোগ। ঠিক তেমনই শারকট মেরি টুথ সিণ্ড্রোম। একটা জীনগত রোগ। তা ডাক্তার মুরারী পালচৌধুরীর শরীরে ছিল আবার সুচন্দ্রার শরীরেও আছে। এর অর্থ...

-এর অর্থ?

-সুচন্দ্রা ডাক্তার মুরারী পালচৌধুরীর সন্তান। অলোককৃষ্ণর নয়।

-ব্রাভো অর্ক। এবার বুঝলি কেন তোকে আমি আমার তদন্তের সঙ্গী করি?

-কিন্তু তাহলে তো অত্রি আর সুচন্দ্রা...

-তাহলে কী অর্ক? জিউস আর হেরা, ওসিরিস আর আইসিস, আমাদের ব্রহ্মপুরাণের দেবী শতরূপা আর মণু, এরা কী সত্য নয়?

আমি ঘাড় নাড়ি। আশুদা বলে চলে,"মিছেই বাঙালি এক নিরপরাধ কবিকে এতো দুঃখ অপমান আর উপেক্ষা দিল। আসল হলো মন। বুঝলি অর্ক। স্বয়ম্ভুর হরতিম মানঃ/আকামাম চকামে ক্ষতঃ/সাকাম ইতি না শ্রুতম।

বিচিত্র মানুষের মন। মন আর শরীর। শরীর আর মন। তার চলাচল মানচিত্রর ভিতর এমন কতো নেপথ্যচারিণী চিরকাল আমাদের বারবার বিভ্রান্ত করবে কে জানে। পুরামতে মনু তার ভগিনী শতরূপাকে বিবাহ করে জন্ম দিলেন প্রিয়ব্রত, উত্থানপদ, আকুতি, দেবহুতি ও প্রসূতিকে। এই জীবপ্রদীপ থেকেই ব্রহ্মপুরাণ মতে মনুষ্যজাতির সৃষ্টি। সেই সৃষ্টির উৎসে রয়েছে এক সৃষ্টিশীল যোগনিদ্রা। সেখানে মাতা পিতা সহোদর সহোদরা অনুজ অগ্রজ তুচ্ছাতিতুচ্ছ। আশুদা মৃদু স্বরে চালিয়ে দিল তার প্রিয় গানটি আবার। "যে ছিল আমার স্বপনচারিণী। তারে ভুলিতে পারিনি তারে ভুলিতে পারিনি।"

(সমাপ্ত)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন