কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

মধুবন চক্রবর্তী

 

বৈষ্ণব কবিতার প্রতি গভীর অনুরাগের ফলশ্রুতি ভানুসিংহের পদাবলী

 


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম দিবসটিকে দেশ গন্ডির সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ নিজেদের মত করে পালন করেন। আসলে এতগুলো বছর পেরিয়ে পঁচিশে বৈশাখ এক অনুভূতির জন্ম দেয়। হৃদয়ের একুল ওকূল দুকূল জুড়ে এক কবির বাস। যেখানে চারিদিকে খেলা করে মেঘ বালিকা, সবুজের সমাহার। মনের ছয় ঋতুর অন্তঃস্থলে আনন্দ বিরহের বিবিধ স্তর। এই বিরহ আনন্দ দুঃখ যন্ত্রণা গভীর জীবন রস ও বোধের মধ্যে দিয়ে শ্রুতির মত বয়ে গেছে যা সংগীতে মানবিক ও আত্মিক চেতনার এক পূর্ণ রূপ দিয়েছে যা চিরপ্রবসমান। অনন্ত প্রেমের পথে নিয়ে চলে। সে প্রেম কখনও মানবিক। কখনোও ঐশ্বরিক। যেন স্বর্গীয় অনুভুতি। আবার কখনোও রক্ত মাংসের। সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কবি সীমার মাঝে অসীমের কথা বলেছেন বারবার। আবার অসীমও চায় সীমার মধ্যে  দিয়ে আত্মচেতনা আত্ম অনুভূতির কথা বলতে। এখানেই রবীন্দ্রনাথের বৈষ্ণবতার জন্ম। জগতের আনন্দ যজ্ঞে যেখানে সবার নিমন্ত্রন সেই পঁচিশে বৈশাখ উদযাপন শুধু কবির জন্মের কথা বলে না। এই জন্মের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা সেই ভানুসিংহের বীজকে লালন করার কথাও বলে। মাত্র ষোলো বছর বয়সে ভানুসিংহ নামে তাঁর জন্ম। অর্থাৎ চেতনার জন্ম। সেই চেতনার নাম বৈষ্ণবীয় চেতনা যার প্রকাশ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী।

ভানুসিংহ ছদ্মনামে সেইসময় বৈষ্ণব পদকর্তাদের লিখে ফেলেছিলেন একের পর এক গীতিকবিতা। ১৮৮৪ সালে সেই কবিতাগুলি ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে বিভিন্ন সময় ভারতী পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। কবি বলেছেন। "অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্রের সংকলিত প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ আমি বিশেষ আগ্রহের সহিত পড়িতাম। তার মৈথিল মিশ্রিত ভাষা আমার পক্ষে দুর্বোধ্য ছিল। সেই জন্যই এত অধ্যাবস্যায়ের সঙ্গে আমি তাহার মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করিয়াছিলাম".. প্রাচীন পদকর্তাদের অনুকরণে ব্রজবুলিতে রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহের পদাবলী রচনা করেছিলেন তাই বৈষ্ণব পদাবলীর খানিকটা প্রভাব তো পাওয়াই যায় তার রচিত পদাবলীতে ভানুসিংহের পদাবলীর প্রথম পদে হল গাহানা কুসুম কুঞ্জ মাঝে এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ হলো.. সেই মেঘলা দিনের ছায়াঘন অবকাশে আনন্দে বাড়ির ভিতরে এক ঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা শ্লেট লইয়া লিখিলাম "গাহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে" (জীবনস্মৃতি)।

জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ পত্র থেকে জানা যায় নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী তাকে ভানু সিংহের কবিতাগুলি ছাপাতে অনুরোধ করেছিলেন। কবিতাগুলির মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলীর মত পালাবদ্ধ ক্রমপরিনতি ছিল না। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত ছিল এই কবিতা। কখনো বংশীধ্বনি রস পর্যায়ে আবার রস পর্যায়ের মধ্যে রাধাবিরহ বিষয়ক কবিতা মিলন বিষয়ক কবিতা ও পড়ে। বাল্যকাল থেকে জয়দেব বিদ্যাপতি পদাবলী নান্দনিক চেতনায় মগ্ন ছিলেন। 'গীতগোবিন্দম' তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে বারবার আবৃত্তি করা সত্ত্বেও, তা অণুলিপি করেছিলেন। ভানুসিংহের পদাবলী রাধাকৃষ্ণ প্রেম বিষয়ক তথা রাধা কৃষ্ণ লীলার পটভূমিতে স্পষ্ট হলেও শুধুমাত্র রাধা কৃষ্ণ লীলার পদাবলী নয় এবং কীর্তনের শুরুতে একমাত্র বাহন নয় তার পদাবলীর মাধ্যমে ভক্তি রস ও ভগবত প্রেম ছাপিয়ে লৌকিক প্রেম জায়গা করে নিল যেখানে যেখানে সুখ দুঃখ রসিকতা স্থান পেল নির্ভুলভাবে রাধিকার মধ্যে মানবপ্রেম ও তার চির আকুলতাই আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই পদাবলীতে।

বৈষ্ণব কবিদের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ শৈশবেই হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র এক গীতিকবি। মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা যেমন অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তেমনি প্রভাবিত হয়েছিলেন টমাস চ্যাটারটন নামক এক ইউরোপীয় কিশোর কবির দ্বারা। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছ থেকে জেনেছিলেন, টমাস চ্যাটারটন নামক এই বালক কবির কথা। যিনি প্রাচীন কবিদের অনুকরণে কবিতা লিখতেন। আর এই জায়গাতেই ভানুসিংহের সঙ্গে কবি চ্যাটরটনের অসম্ভব মিল।

পদাবলী অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একাধিক বৈষ্ণব কবি ও কাব্য প্রবাহের সম্মেলন ঘটেছে। যেমন উদ্ধব দাসের 'আষাঢ় গত পুণ্য মাহ শাভান সুখদ যমুনাক তীর...' এবং গোবিন্দ দাসের 'মন্দির বাহির কঠিন করাট চলোইতে শঙ্কিত পঙ্কিল বাট' রবীন্দ্রনাথ বললেন, শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথযামিনী রে...

ব্রজবুলিতে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর সংখ্যা রবীন্দ্রকাব্যে এবং সংগীতের অন্যতম দিকচিহ্ন। কাব্যের ধ্বনিমাধুর্যে, রস নির্মাণেও এক নতুন দিক। যেখানে বৈষ্ণবীর রাধার প্রশ্ন অপার অতৃপ্তির, ঠিক সে রকম জায়গাতেই ভানুসিংহের রাধার প্রশ্ন অজানা বিস্ময়ের। বৈষ্ণব পদাবলীর স্বভাবকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন একান্তভাবে।

কিশোর বয়সের রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ভানু সিংহের পদাবলী কিশোর রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করলেন এই পদাবলী যেখানে তার চিন্তার মৌলিকতা যেরকম রক্ষা পেল পাশাপাশি বয়স্ক প্রাজ্ঞ আরও এক রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট ছাপ প্রকাশ পেল। যেমন মরণ ঋতুহু মম শ্যামো সমান এই পথটিতে ভানুসিংহের কিশোরত্ব লোভ পেয়েছিল যেখানে জন্ম নিয়েছিল ভানু সিংহ ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার অভিন্ন রূপ। মৃত্যু মহা জীবনের রূপান্তর মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই জীবনের প্রকাশ কিশোর বয়সেই সেই মহানুভবতার কথা তিনি প্রকাশ করেছিলেন যা আমাদের এক প্রাপ্য রবীন্দ্রনাথকেই চিনতে সাহায্য করে। তার চিন্তায় জীবন মৃত্যু চলমান সৃষ্টির নিরন্তর আবর্তন। মৃত্যুর যে সুন্দর রূপ ভানু সিংহের চিন্তায় প্রকাশ পেয়েছে যেখানে নেই মৃত্যুর ভয়াবহতার কথা দুশ্চিন্তার কথা মৃত্যুর সুন্দর মোহন রূপ ভানু সিংহের চিন্তায় যেন নব ঘন স্বামীর সুন্দর মূর্তি। এই বলা যেতেই পারে, ভানুসিংহ পদাবলী শুধু বাংলার ঐকান্তিক সম্পদ নয়,।আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ইতিহাস এক আধ্যাত্মিক ঐশ্বরিক প্রেম বিষয়ক সাহিত্যের নব দিগন্তের সূচনা করে। তার পদের ভাব ও গভীরতা প্রাচীন পদকর্তাদের রচনা থেকে কোন অংশেই কম ছিল না। পদ গুলির মধ্যে ছিল স্বকীয়তা, স্বতন্ত্রতা প্রত্যেকটি পদ যেন স্ব মহিমায় উজ্জ্বল।

কবি সীমার মাঝে অসীমের কথা বলেছেন বারবার। আবার অসীমও চায় সীমার মধ্যে  দিয়ে আত্মচেতনা আত্ম অনুভূতির কথা বলতে। এখানেই রবীন্দ্রনাথের বৈষ্ণবতার জন্ম। জগতের আনন্দ যজ্ঞে যেখানে সবার নিমন্ত্রন, সেই পঁচিশে বৈশাখ উদযাপন শুধু কবির জন্মের কথা বলে না। এই জন্মের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা সেই ভানুসিংহের বীজকে লালন করার কথাও বলে। মাত্র ষোলো বছর বয়সে ভানুসিংহ নামে তাঁর জন্ম। অর্থাৎ চেতনার জন্ম। সেই চেতনার নাম বৈষ্ণবীয় চেতনা যার প্রকাশ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী। ভানুসিংহ ছদ্মনামে সেইসময় বৈষ্ণব পদকর্তাদের অনুপ্রেরণায় লিখে ফেলেছিলেন একের পর এক গীতিকবিতা। ১৮৮৪ সালে সেই কবিতাগুলি ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে বিভিন্ন সময় ভারতী পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। কবি বলেছেন। "অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্রের সংকলিত প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ আমি বিশেষ আগ্রহের সহিত পড়িতাম। তার মৈথিল মিশ্রিত ভাষা আমার পক্ষে দুর্বোধ্য ছিল। সেই জন্যই এত অধ্যাবস্যায়ের সঙ্গে আমি তাহার মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করিয়াছিলাম".. প্রাচীন পদকর্তাদের অনুকরণে ব্রজবুলিতে রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহের পদাবলী রচনা করেছিলেন। তাই বৈষ্ণব পদাবলীর খানিকটা প্রভাব তো পাওয়াই যায় তার রচিত পদাবলীতে। ভানুসিংহের পদাবলীর প্রথম পদ হল " গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে"..

এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ হলো.. সেই মেঘলা দিনের ছায়াঘন অবকাশে আনন্দে বাড়ির ভিতরে এক ঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা শ্লেট লইয়া লিখিলাম "গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে" (জীবনস্মৃতি)।

জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ পত্র থেকে জানা যায়, নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী, তাঁকে ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাতে অনুরোধ করেছিলেন। কবিতাগুলির মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলীর মত পালাবদ্ধ ক্রম-পরিণতি ছিল না। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত ছিল এই কবিতা। কখনোও বংশীধ্বনি রস পর্যায়ে, আবার রসপর্যায়ের মধ্যে রাধাবিরহ বিষয়ক কবিতা মিলন বিষয়ক কবিতাও আছে। বাল্যকাল থেকে জয়দেব, বিদ্যাপতি, পদাবলী নান্দনিক চেতনায় মগ্ন ছিলেন। 'গীতগোবিন্দম' তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে বারবার আবৃত্তি করা সত্ত্বেও, তা অণুলিপি করেছিলেন। ভানুসিংহের পদাবলী রাধাকৃষ্ণ প্রেম বিষয়ক তথা রাধাকৃষ্ণ লীলার পটভূমিতে স্পষ্ট হলেও, শুধুমাত্র রাধাকৃষ্ণ লীলার পদাবলী নয় এবং কীর্তনের শুরুতে একমাত্র বাহন নয়। তাঁর পদাবলীর মাধ্যমে ভক্তিরস ও ভগবত প্রেম ছাপিয়ে লৌকিক প্রেম জায়গা করে নিয়েছে, যেখানে সুখ দুঃখ রসিকতা স্থান পেয়েছে নির্ভুলভাবে। রাধিকার মধ্যে মানবপ্রেম ও তার চির আকুলতার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই পদাবলীতে। বৈষ্ণব কবিদের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ শৈশবেই হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র এক গীতিকবি।

বৈষ্ণব কবিতার প্রতি কবির গভীর অনুরাগের ফলশ্রুতি ভানুসিংহের পদাবলী নয়, শুধুমাত্র নিছক অনুকরণ নয়, বৈষ্ণব কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কাব্যরসের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ থেকেই তরুণ কবির ভালোবাসার আত্ম মুক্তি বলা যায়।

ছন্দ ভাষায় এবং কাব্য প্রসাদের উপরে কবির জন্মগত প্রতিভার অভিজ্ঞান। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে জগবন্ধু ভদ্র মহাজনপদাবলী

করেছিলেন। আর সেসব জ্যোতোরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সংকলন করতেন। তাঁর একমাত্র পাঠক ছিলেন বারো বছরের রবীন্দ্রনাথ। পদাবলীর কাব্য ছন্দ ও ভাবের প্রভাব পড়েছিল বালক কবির ওপরে।

কবি নিজে বলছেন--

"What give me boltness when I was young was my early acquaintance with old vaishnava poems of Bengal.

Full of freedom of metre and courage of expression. I think I was only 12 when these poems we can to be reprinted. I surreptitiously got hold of copies from the desk of my elders.

I must also admit that the greater part of these lyrics was erotic and not quit suited to a boy just about to reach his teens. But my imagination was fully occupied with the beauty of their forms and the music of their words'...

বৈষ্ণব কবিদের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ শৈশবেই হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র এক গীতিকবি। মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা যেমন অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তেমনি প্রভাবিত হয়েছিলেন টমাস চ্যাটারটন নামক এক ইউরোপীয় কিশোর কবির দ্বারা। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছ থেকে জেনেছিলেন, টমাস চ্যাটারটন নামক এই বালক কবির কথা। যিনি প্রাচীন কবিদের অনুকরণে কবিতা লিখতেন। পদাবলী অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একাধিক বৈষ্ণব কবি ও কাব্য প্রবাহের সম্মেলন ঘটেছে। যেমন উদ্ধব দাসের 'আষাঢ় গত পুণ্য মাহ শাভান সুখদ যমুনাক তীর...' এবং গোবিন্দ দাসের 'মন্দির বাহির কঠিন করাট চলোইতে শঙ্কিত পঙ্কিল বাট' রবীন্দ্রনাথ বললেন, শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথযামিনী রে...

ব্রজবুলিতে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর সংখ্যা রবীন্দ্রকাব্যে এবং সংগীতের অন্যতম দিকচিহ্ন। কাব্যের ধ্বনিমাধুর্যে, রস নির্মাণেও এক নতুন দিক। যেখানে বৈষ্ণব পদাবলীর রাধার প্রশ্ন অপার অতৃপ্তির, ঠিক সে রকম জায়গাতেই ভানুসিংহের রাধার প্রশ্ন অজানা বিস্ময়ের। বৈষ্ণব পদাবলীর স্বভাবকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন একান্তভাবে। কিশোর বয়সের রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ‘ভানু সিংহের পদাবলী’। নির্মাণ করলেন এমন এক পদাবলী, যেখানে তাঁর চিন্তার মৌলিকতা যেরকম রক্ষা পেল। পাশাপাশি বয়স্ক, প্রাজ্ঞ আরও এক রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট ছাপ প্রকাশ পেল। যেমন "মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান" এই পদটিতে ভানুসিংহের কিশোরত্ব লোভ পেয়েছিল, যেখানে জন্ম নিয়েছিল ভানুসিংহ ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার অভিন্ন রূপ।

মৃত্যু মহা-জীবনের রূপান্তর। মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই যে জীবনের প্রকাশ, কিশোর বয়সেই সেই মহানুভবতার  কথা প্রকাশ করেছিলেন, যা আমাদের এক প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকেই চিনতে সাহায্য করে। তাঁর চিন্তায় জীবন মৃত্যু চলমান সৃষ্টির নিরন্তর আবর্তন। মৃত্যুর যে সুন্দর রূপ ভানু সিংহের চিন্তায় প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে নেই মৃত্যুর ভয়াবহতার কথা, দুশ্চিন্তার কথা মৃত্যুর সুন্দর মোহন রূপ ভানু সিংহের চিন্তায় যেন নব ঘন স্বামীর সুন্দর মূর্তি। এভাবে বলা যেতেই পারে, ভানুসিংহ পদাবলী শুধু বাংলার ঐকান্তিক সম্পদ নয়, আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ইতিহাসে এক আধ্যাত্মিক ঐশ্বরিক প্রেম বিষয়ক সাহিত্যের নব দিগন্তের সূচনা করে। তাঁর পদের ভাব ও গভীরতা প্রাচীন পদকর্তাদের রচনা থেকে কোন অংশেই কম ছিল না।

পদ গুলির মধ্যে ছিল স্বকীয়তা, স্বতন্ত্রতা প্রত্যেকটি পদ যেন স্ব মহিমায় উজ্জ্বল। সত্যি ভাবতে অবাক লাগে, মাত্র বারো বছর বয়সে বৈষ্ণব কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে লিখতে শুরু করলেন। বয়স যতই বারো বছর হোক, অথবা ষোলো, বালক বয়সেই হয়ে উঠেছিলেন পরিণত মনের কবি। পদাবলী সাহিত্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ভাবের রাজপ্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন। যদিও ভানুসিংহের পদাবলী সম্পর্কে পরিণত বয়সের রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-- "তাহাদের ভাবের মধ্যে কৃত্রিমতা ছিল না ভানুসিংহের কবিতা একটু বাজাইয়া বা কুশিয়া দেখলেই মেকি বাহির হইয়া পড়ে” (জীবনস্মৃতি)। অর্থাৎ বৈষ্ণব দর্শনের সঙ্গে কবির দর্শনের মিল অনেকটাই কম ছিল বলে তিনি নিজেই দাবি করছেন। কিন্তু কাব্য দর্শনের মিল খুঁজলে সেভাবে পাওয়া না গেলেও, কবির অভিনব দর্শন এখানে অভূতপূর্ব ভাবে ধরা দিয়েছে। বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা যেরকম প্রভাবিত হয়েছিলেন তেমনি প্রভাবিত হয়েছিলেন টমাস চ্যাটারটন নামক এক ইউরোপীয় কিশোর কবির দ্বারা। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছ থেকে জেনেছিলেন, টমাস চ্যাটারটন নামক এই বালক কবি সম্পর্কে, যিনি প্রাচীন কবিদের অনুকরণে কবিতা লিখতেন। এই জায়গাতেই ভানুসিংহের সঙ্গে কবি চ্যাটরটনের অসম্ভব মিল। পদাবলী অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একাধিক বৈষ্ণব কবি ও কাব্য প্রবাহের সম্মেলন ঘটেছে। যেমন গোবিন্দ দাসের

'মন্দির বাহির কঠিন করাট চলোইতে শঙ্কিত পঙ্কিল বাট' রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথযামিনী রে.."....

ব্রজবুলিতে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর সংখ্যা রবীন্দ্রকাব্যে এবং সংগীতের অন্যতম দিকচিহ্ন। কাব্যের ধ্বনিমাধুর্যে, রস নির্মাণেও এক নতুন দিগন্ত নির্মাণ করছিলেন তিনি।যেখানে বৈষ্ণব কবির কল্পনায় রাধার প্রশ্ন অপার অতৃপ্তির, ঠিক সে রকম জায়গাতেই ভানুসিংহের রাধার প্রশ্ন অজানা বিস্ময়ের। বৈষ্ণব পদাবলীর স্বভাবকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন একান্তভাবে। কিশোর বয়সের সৃষ্টি ভানুসিংহের পদাবলী হলেও, বাঙালির কাব্য চেতনায় চিন্তার জাগরণ যেরকম ঘটিয়েছিল, সেরকম প্রেমের জোয়ার এনেছিল সাহিত্য ভাবনায়। এই পদাবলীসাহিত্যে তাঁর চিন্তার মৌলিকতা যেরকম রক্ষা পেল, পাশাপাশি পরিণত প্রাজ্ঞ আরও এক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিতি ঘটল বিশ্ব সাহিত্যের। সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট ছাপ প্রকাশ পেল।

যেমন "মরণ রে তুহু হু মম শ্যাম সমান'…

এই পদটিতে ভানুসিংহের কিশোরত্ব লোপ পেয়েছিল। সেখানে  জন্ম নিয়েছিলেন ভানুসিংহ ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার অভিন্ন রূপ। কবি মরণের মাধ্যমে শ্যামের অভাব পূর্ণ করতে চেয়েছেন অর্থাৎ মরণকে শ্যামের আসনে বসিয়ে। কিন্তু বৈষ্ণব বা বৈষ্ণব কবিরা কোন কিছুকেই শ্যামের বিকল্প মানতে পারেন না। সমস্ত বিশ্ব এমনকি নিজের প্রাণও। এখানেই কবি হয়ত মেকিত্ব বলতে চেয়েছেন। মৃত্যু এখানে মহাজীবনের রূপান্তর। মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই জীবনের প্রকাশ। কিশোর বয়সেই সেই মহানুভবতার কথা তিনি প্রকাশ করেছিলেন যা আমাদের এক প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকেই চিনতে সাহায্য করে। তাঁর চিন্তায় জীবন মৃত্যু চলমান সৃষ্টির নিরন্তর আবর্তন। মৃত্যুর যে সুন্দর রূপ ভানুসিংহের চিন্তায় প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে নেই মৃত্যুর ভয়াবহতার কথা, দুশ্চিন্তার কথা, রয়েছে মৃত্যুর সুন্দর মোহন রূপ। ভানুসিংহের চিন্তায় যেন নব ঘন শ্যামের সুন্দর মূর্তি। বলা যেতেই পারে, ভানুসিংহের পদাবলী শুধু বাংলার ঐকান্তিক সম্পদ নয়, আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ইতিহাসে এক আধ্যাত্মিক ঐশ্বরিক প্রেম বিষয়ক সাহিত্যের নব দিগন্তের সূচনা করে। তাঁর পদের ভাব ও গভীরতা প্রাচীন পদকর্তাদের রচনা থেকে কোন অংশেই কম ছিল না। ব্রজবুলিতে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর সংখ্যা মাত্র কুড়িটি হলেও রবীন্দ্র কাব্য এবং সংগীতের অন্যতম দিক চিহ্ন বলা যায়। বৈষ্ণব পদাবলীর ভাষার সঙ্গে অনেকটাই তফাৎ থাকলেও, পদাবলী সাহিত্যের মতোই উজ্জ্বল এবং ভাবরসসমৃদ্ধ। কাব্যের ধ্বনিমাধুর্য, রস নির্মাণে এক নতুন দিগন্ত তৈরি করেছিলেন ভানুসিংহ।

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজেই মন্তব্য করেছিলেন "পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষভাবে সীমানার দ্বারা বেষ্টিত। নেই-সীমানার মধ্যে আমার মন স্বাভাবিক স্বাধীনতার সঙ্গে বিচরণ করতে পারে না। তাই ভানুসংহের সঙ্গে বৈষ্ণব চিত্রে অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা নেই'। পদগুলির মধ্যে ছিল স্বকীয়তা, স্বতন্ত্রতা। গবেষকরা মনে করেন, ভানুসিংহের পদাবলীতে রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণবকবিদের নিছক অনুকরণ না করে, যথার্থ অনুসরণ করেছেন।  প্রত্যেকটি পদ যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভাবের গভীরতায়, ব্যঞ্জনার মাধুর্যে, ভাস্বর। পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতায় শেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত।

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন