![]() |
কবিতার কালিমাটি ১৪৬ |
জুন আখ্যান
চেতনার ভেতর অস্ফুট ধ্বনির সাথে জেগে থাকে জুন। সাতবছর আগের স্পন্দিত অব্যয় ঘরের সমস্ত আসবাবে প্রলিপ্ত। সোফার হাতলে সামান্য কুঞ্চন দৃশ্যমান হলেও তা জীর্ণতা আক্রান্ত নয় — পদ্মস্মৃতির আভায় প্রোজ্জ্বল। কুশনে জেগে আছে গ্রীষ্মের শ্বাসপ্রকৃতি, ফুলের চেতনা থেকে যে ধ্বনি উদ্গত হয়েছিল তার অর্থ আকাশের সমস্ত পথে প্রতিসরিত।
লনের ধারে দীর্ঘ শরীর নিয়ে একটি বৃক্ষ অন্তর্গত কম্পনের কথা ভেবে বাতাসকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলে। সে মহাশূন্যে দৃকপাত করে পদ্মধ্বনির রহস্য অনুসন্ধান করে; নৈঃশব্দ্যে কীভাবে সুর প্রস্ফুরিত হয়, কীভাবে পত্ররাজি বসন্ত মুখারি পরিবেশন করে তার অন্ধিসন্ধি পেতে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে।
তারপর ফিরে আসে বৃষ্টি — তার তাল দ্রুত নয়, দীর্ঘ আলোচনার পর সজল ভাষার প্রত্যাবর্তন। জলবিন্দু বৃক্ষের বাকল ও পত্রে টেক্সট রেখে যায় — স্পর্শময় হাইরোগ্লিফে উৎকীর্ণ আখ্যান; স্পষ্ট হয়ে থাকে আলো ও ছায়ার প্যাটার্ন।
শাটারটানা ঘরে একটি সত্তা বৃষ্টির প্রতিধ্বনি শোনে। কাঠের দরজা-জানালা, সিঁড়ি ও প্লাস্টারবোর্ডের দেয়ালের ভেতর উচ্চারিত অব্যয়ের আশ্রয়ে শ্রুত হয় আখ্যান। আখ্যান কণ্ঠস্বর-নির্ভর নয়, বিরতির ভেতর তার অস্তিত্ব পল্লবিত হতে থাকে; যেখানে শব্দ বাতাসকে আলোড়িত করেছিল, সেখানে সে চিরকম্পমান।
জুন সর্বত্রগামী — বর্ষপঞ্জির পৃষ্ঠা থেকে আসবাব, আকাশে উড্ডীন প্রতিধ্বনি, ও সঙ্গীতসন্ধানী বৃক্ষে প্রতিনিয়ত সে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করে। সে এমন নির্জনতায় প্রতীক্ষা করে যেখানে রয়েছে বৃষ্টির সম্ভাবনা, যেখানে বিস্তীর্ণ মাঠের রং গাঢ় হয়ে ওঠে আর আখ্যানের প্রতিধ্বনি পদ্মদলকে আকাশে উড্ডয়নের জাদু শেখায়।
ভাস্কর
বাতাসের আলো প্রাকবৃষ্টির গন্ধ নিয়ে আসে। জুনের জারুলপত্র গন্ধদীপ্ত হলে ভাস্করের চিন্তা জারুল অরণ্যে দোল খেতে থাকে; তার এক তাল কাদামাটির ভেতর অনাগত দেহশ্রী দৃষ্টির প্রার্থনায় বিনত হয়ে ওঠে।
স্যাডল ঝিনুকের ভালব আঁকড়ে ধরে আছে সময়। বিগত দিনে নির্মিত ভাস্কর্য ফার্ন ফ্রন্ডের আড়াল থেকে ফিসফিসিয়ে ওঠে। খোদাইকৃত পাথরে স্মৃতিহীন বাতাসের প্রলাপ ভেঙে পড়ে; বিস্মৃত মুখচ্ছবি ক্রন্দিত বৃক্ষের শাখায় ঝুলে থাকে।
অকস্মাৎ জানালায় প্রতিধ্বনিত হয় কুবোর কণ্ঠরব। কোথাও বেজে চলে মাটির মৃদঙ্গ। ভাস্কর পৌরাণিক নগরের নির্জন পথের দিকে দৃকপাত করে। মিনার্ভার ইশারায় চালতা বনে উড়ে যায় নক্তচারী। অগ্নির বরাভয় থেকে মানুষকে বিমুক্ত করতে চায়নি বলে প্রমিথিউস শৃঙ্খলিত।
ঝড়ে ধুলো ওড়ে। ধুলোর নিচে একটি পৌরাণিক মূর্তির রেখা অদৃশ্য হয়ে পড়ে। ভাস্করের মগ্নতা কাদামাটিকে কোমলতর করে তোলে; একটি অবয়ব কেঁপে উঠতে থাকে। ভাস্কর থমকে দাঁড়ায়, তার মুক্তিশিখা নীল বর্ণে দীপ্ত হয়ে ওঠে।
স্থিরতার বেদনা থেকে সঙ্গীত স্ফুরিত হয়। ভাস্করের যন্ত্রপাতির ভেতর রূপকড়া তালের প্রচ্ছায়া দৃশ্যমান হয়। তার নীরবতার ভেতর সে প্রচ্ছায়া বিস্তৃত হতে থাকে। হাতুড়ির শব্দে শূন্যে ভেসে ওঠে রামকিঙ্করের মুখ। ছেনির দংশনে ক্রমে পাথরের সংবেদনা ফিরে আসে।
প্রাথমিকভাবে প্রস্তুত শ্বেতস্ফটিকের সৌন্দর্যে দীপ্তির সাথে বিচ্যুতি লক্ষণীয়। গলনাধারে সুবর্ণ নিখাদ হয়ে ওঠে কিন্তু ছেনির ভেতর এমন অগ্নি নেই যা শ্বেতস্ফটিকের অপূর্ণতা দূর করে। তার নিশ্বাস তৃষিত পানপাত্রে আধৃত — তার দৃষ্টির ভেতর বিশ্বাসভঙ্গের বিষাদ।
ব্রহ্মাণ্ডের কোনো সমুদ্র কালির বিপুলতা নিয়ে অহংকৃত। রাত কালিরঞ্জিত হলে ভাস্কর খোদাইকর্মে মগ্ন হয়। রাতে তার নৈঃসঙ্গ্য দুর্নিরীক্ষ্য, লি বাইয়ের শব্দদেবতা তার ছায়াকে সংবেদী করে তোলে। বাতাসে পদ্মসংকেত সুস্পষ্ট হলে তারা উদ্দীপ্ত হয়, স্ট্যাচুর শরীর ক্রমে ছন্দস্কৃত হয়ে ওঠে।
সমস্ত ক্লান্তি নিয়ে পৃথিবী ভোরের মুখোমুখি দাঁড়ায়; তার মন্থর হৃৎস্পন্দন অসমাপ্ত স্ট্যাচুর বক্ষে প্রতিধ্বনি তোলে। প্রায় নিশ্চল বাতাসের ভেতর সুরক্ষিত হতে থাকে ভাস্করের ভাষা।
ভাস্কর অবিন্যস্ত শয্যায় শুয়ে খণ্ডিত পাথরের কথা ভাবে। পাথর থেকে মূর্তির পরিবর্তে বেরিয়ে আসে পেগাসাস। অনেক দিন পর ভাস্কর উড়তে থাকে — বিস্মৃত পথ উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে এবং ধ্বংসস্তূপের ভেতর দৃশ্যমান হতে থাকে অবিনাশী সৌধ।
ভাস্কর দ্রুত কাজে ফিরে আসে। তার পৃথিবী ধ্বংসশীল নয়। নির্মাণের বন্দিশ সেখানে সমুদ্গীত হতে থাকে। ভাস্করের ছেনি স্ট্যাচুকে দীপকের উজ্জ্বলতম আরোহের দিকে নিয়ে যায়।
অন্ধকার ও রেকুইয়েম
কিছুই নিজের বলে মনে হয় না। যে মৃত্তিকার ওপর দাঁড়িয়ে থাকি তার সংকেত দুর্বোধ্য। সুপুরি বাগানের ওপর কালো মেঘ জানাতে পারে না তার বিষণ্ণতার কারণ। বৃক্ষগুলো সূর্যের সাহচর্যে ছিল ঊর্ধ্বমুখ, রোগাক্রান্ত শ্রমণের পাশে তারা এখন হেঁটমুণ্ড। সঙ্গীতের সমস্ত অনুরণন ভস্মাচ্ছাদিত জেনে পাখিরা সরগম বিসর্জন দিয়েছে।
এখানে আলোর প্রবেশাধিকার নেই। সূর্যদেব গুহায় আত্মগোপন করার পর নেকড়ের আহার্যে পরিণত হয়েছে। সুপুরি পত্রে ঝুলিয়ে রাখা বনদুর্গার ঝকমকে আয়না ভুলে গেছে আলোর আলকেমি। নিক্সের কৃষ্ণ কুয়াশা প্রকট করে তুলেছে সমস্ত বৃক্ষের স্মৃতিবিভ্রম।
আমাদের উৎসবে কোনো প্রদীপ জ্বলে না। অন্ধকারে আমাদের মন প্রশান্ত থাকে বলে নৃত্যগীতের প্রয়োজন হয় না। মাঝে মাঝে অন্ধকারে বসে আমরা রেকুইয়েম রচনা করি। হেফাইসটিয়ানের অলঙ্কৃত চিতার আদলে প্রিয়জনের শেষযাত্রাকে আমরা শোভমান করে তুলি না। আমাদের আলোক-ঐশ্বর্য নেই বলে আলেকজান্ডারের বিচ্ছেদ-ভাবনা আমাদের প্রভাবিত করে না।
আমরা নিস্তব্ধতার ভেতর ক্ষয়িষ্ণু রিবনের ওপর হেঁটে চলি। দূর পাহাড়ে কোথাও ফ্লেইম অ্যাজেলিয়া ফোটে, কোথাও পল্লব রঞ্জিত হয়ে ওঠে। আমাদের বৃক্ষে উজ্জ্বল পত্র নেই; মানুষের সাথে বৃক্ষও কৃষ্ণত্ব সাঙ্গীকরণে সচেষ্ট। আমাদের শব্দসম্ভার ভূদৃশ্য চিত্রণ ও বিলাপের জন্য উপযোগী, পর্বত কাঁপানো বজ্রধ্বনির শক্তি প্রকাশে অকার্যকর।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন