ধারাবাহিক
উপন্যাস
ছেঁড়া শেকড়ের অন্তরাখ্যান
(৩)
অদূরে মোরগের ডাকে শেফালীর ঘুম ভাঙল। অন্ধকার কেটেছে বটে, ভোর হয়নি। জানালার পাশে বিরাট নিমগাছটায় কাকের ছানাগুলো চেঁচাচ্ছে। আদুরে ডাক, বুঝি খিদে পেয়েছে। সে বিছানায় শোওয়া মানুষটার দিকে তাকাল। বিশ্বনাথ উপুড় হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। পইতে লেপ্টে আছে পিঠে। শেফালী একটু ঠেলে সরিয়ে উঠে-যাওয়া লুঙ্গি টেনেটুনে হাঁটুর নীচে নামিয়ে দিল। মোটা সুতির মশারির মধ্যে ভ্যাপসা গরম। ঘাম জ্যাবজ্যাব বিছানা। হাতপাখা নেড়ে নেড়ে হাতব্যথা। ঘামাচিতে গা কুটকুট করে। কিন্তু মশারি না টাঙালে মশা থেকে সাপখোপের ভয়। সে শুতে যাওয়ার আগে জামা, পেটিকোট ছেড়ে রেখে শাড়ি জড়িয়ে শোয়। কন্ট্রোল-রেটের শাড়ি ন্যাতানো হলেও বেজায় মোটা। মাথার চুলও তার একবোঝা। কাপড়-চোপড় সামলে খোঁপা পেঁচিয়ে বিছানা থেকে নামল শেফালী। সকলের আগে কলতলা সেরে না নিলে খুব অসুবিধা। শাশুড়ি যোগমায়া অন্ধকারে উঠে পড়েন। আপনমনে বিড়বিড় করেন আর বাড়িময় গোবরজল ছেটান। ঠাকুরঘর লেপেন। কাপড় ছেড়ে ঠাকুর জাগান। বয়স পঞ্চান্ন পেরিয়েছে। দেহ শক্তপোক্ত আঁটসাঁট। রোগবালাই তেমন নেই। তবে কেমন যেন মানসিক বিকার দেখা যাচ্ছে। সাত-সকালে বউয়ের আলুথালু, সিঁদুর-ধ্যাবড়ানো, বাসী চেহারা দেখলে মাথা গরম হবে। শাশুড়ি বকাবকি করলে শেফালী মুখ বন্ধ রাখে। সব সংসারে বউমানুষের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। সেগুলো মেনে চলতেই হয়। বছরদুই এসংসারে এসেছে। বড়োবউ সে, কিন্তু বয়সে সকলের ছোটো। প্রথমদিকে খুব ভয় পেত। স্বামী বিশ্বনাথ বারো বছরের বড়ো। এবাড়ির ছেলেরাও তাবৎ পুরুষপ্রজাতির মতো বদরাগী ও গোঁয়ার। ছোটো দেওর দেবনাথ সমবয়সী, কিছুটা বন্ধুর মতো।
কাচা শাড়িজামা নিয়ে তাড়াতাড়ি স্নানের ঘরে ঢুকল শেফালী। স্নানঘরে
এখন টিনের চাল, দেওয়াল ও মেঝে সিমেন্টের। ভেতরে ছোটো চৌবাচ্চা। বাইরে চাপাকলের মুখ
থেকে দেওয়ালে গর্ত করে ডোঙার মতো টিনের পাত চৌবাচ্চায় লাগানো। রাতে শোওয়ার আগে বিশ্বনাথ
পাম্প করে চৌবাচ্চা ভরে রাখে। এই নীরব যত্নটুকু শেফালীকে খুশি করে। ছাড়া কাপড় ধুয়ে,
আরামে ক-মগ জল ঢালল গায়ে-পায়ে। পুরুষেরা অবশ্য বাইরে স্নান সারে। চাপাকল পাম্প করে
বালতি-বালতি জল না ঢাললে আরাম হয় না। নতুন স্নানঘর শেফালীর বাবার টাকায় তৈরি। খাট-পালঙ্ক
দিতে পারেন নি। বিছানা-বালিশ-মশারি, সামান্য গয়না আর নগদ টাকা।
বড়ো উনান ধরাল সে। লোহার বালতিকাটা তোলা উনানেও আঁচ দিল। কয়লা
ভেঙে দিয়ে যায় বুধনের বউ। ঘুঁটে দিয়ে যায়। আগুন ধরে উঠতে শুকনো ডালপাতা উনানের হাঁ-মুখে
গুঁজে দিল। ভাঙা-পাখার বাতাস পেয়ে গলগলিয়ে উঠল কালো মেঘের মতো ধোঁয়া। জ্বালাধরা লালচোখে
বেরিয়ে সে রান্নাঘরের দরজায় শেকল তুলে দিল। দেখল শম্ভুনাথ স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। শম্ভুনাথ বিশ্বনাথের পরের ভাই, সম্পর্কে দেওর। বয়সে ন-দশ বছরের বড়ো। শেফালীর
গলা শুকিয়ে কাঠ। শ্বাস চেপে ঘোমটা টানল বড়ো করে। শম্ভুনাথ কিছু না বলে ভারী পায়ে কলতলার
দিকে গেল। মানুষটির আচরণে গা ছমছম করে। কাউকে বলতে পারেনা, স্বামীকেও না। যখন চারপাশ
নিরিবিলি, শেফালী স্নানে ঢুকছে কিম্বা সবে স্নান সেরে বেরিয়েছে ভেজা চুল, ভেজা মুখে,
বা রান্নাঘরে ভীষণ ব্যস্ত, ঘোমটা নেমেছে পিঠে, বা আনমনে দড়ি খুলে চুল আঁচড়াচ্ছে টেনে-টেনে,
অথবা রাতে শোবার ঘরে ঢোকার মুখে – সবার অলক্ষে অশরীরীর মতো শম্ভুনাথ অদূরে এসে দাঁড়ায়। দীঘল দুচোখে
তীব্র রাগ না আর কিছু, সরল মেয়ে ধরতে পারেনা। বুক কাঁপে, পেটে মোচড় দেয়। সাহস করে জিজ্ঞেস
করেছিল একবার,
“কী হইছে ঠাকুরপো? খাড়াইয়া আছেন?”
গনগনে রাগীস্বর জবাব দিয়েছিল,
“আশ্চইর্য! জবাবদিহি করন লাগব? আমগ বাড়ি, আমগ উঠান – ব’মু না খাড়ামু আপনের অনুমতি
নেওন লাগব?”
প্রায়ই গভীর রাতে বিছানায় উঠে বসে বিনবিন করে কাঁদতে থাকেন যোগমায়া। ফলে বাসন্তীরও ঘুম ভাঙে। সে বিরক্ত হয়। প্রথমে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। তারপর চাপা গলায় বকতে থাকে,
“রোজই রাইতে কী আরম্ভ করছ? উঠলা ক্যান? প্যাচ্ছাপ পাইছে?”
যোগমায়া জবাব দেবেন না বাসন্তী জানে। ধপ করে শুয়ে পড়বেন আবার।
ছোট্ট ঘরে পায়া উঁচু-করা একফালি তক্তপোশ। তার নীচে সংসার। জানালার ঝাঁপ বন্ধ। দমবন্ধ
করা অন্ধকার। কেমন মাটি-মাটি গন্ধ ভাসে। জ্যোৎস্নার আলো ঢোকে বেড়ার দেওয়ালের ছিদ্র
বেয়ে। ধীরে-ধীরে চোখ সয়ে যায়। ঘরের মেঝেয় ঠাকুরের আসন, পেতলের থালাবাসন, প্রদীপ, শঙ্খ।
যোগমায়ার আলাদা থালা-গেলাসও এঘরে থাকে। কেরাসিন-ডিবে, দেশলাই রেখেছে বাসন্তী, যদি দরকার
হয়। যোগমায়া শুয়ে-শুয়ে উসখুস করেন। বাসন্তী অভ্যাসের হাত বোলায় তাঁর পিঠে। ঘুম-জড়ানো
গলায় বলে,
“ঘুমাও, ঘুমাইয়া পড়। কয়বচ্ছর কাইট্যা গেল গিয়া, অহনও ক্যান মান
না? যা ফিরনের নাই হেইডা ভাইব না।”
“গোরের তলে থো আমারে—।”
“সময় হইলেই যাইবা। অহন আমারে না জালাইয়া ঘুমাইয়া পড়।”
হয়ত তন্দ্রা আসে যোগমায়ার অথবা এমনিই নীরব হয়ে যান। বাসন্তীর
ঘুম কেটে গিয়ে চোখ জ্বলে। টালির চালে টিকটিকির টকটক শব্দ হয়। তক্তাপোশের পায়ের দিকে
গুঁতোগুঁতি রাখা দুটো টিনের বাক্স, তার আর যোগমায়ার। তার বাক্সে লুকোনো খাতা, ইস্কুলের
প্রাইজের মেডেল, বই, শাড়ি-জামা ক-খানা। মনে-মনে চিঠি লেখে ফেলে-আসা প্রাণের সইকে।
‘ভাই বুলবুল,
ছয় বচ্ছর হইল তোমার সহিত দেখা হয় না। কেমন আছ জানিনা। কতবার
ভেবেছি পত্র দিব। লিখিয়াও রেখেছি। পোস্ট করি নাই। কত কথা যে মনে উঠে পড়ে। সাক্ষাৎ হইলে
সাতদিন-সাতরাত্রি ধরিয়াও ফুরাত না। লিখতে বসিলে অক্ষরগুলা নৃত্য করে। আমি খাতা-কলম
বন্ধ করিয়া তুলে রাখি। বাক্সের মধ্যে টকর-টকর শব্দ হয়। বৎসরদুই আগে বড়দাদার বিবাহ দিয়েছি।
উহার বাড়িও আমদের ওইবঙ্গে।
নাসিরভাই কেমন আছেন? তোমারে ভালোবাসেন? যত্ন করেন? এতদিনে নিশ্চই
তোমার কোলে দুইতিনটা সোনার চাঁদ আসিয়াছে! জানিনা, আর কোনদিন আমাদের সাক্ষাৎ হইবে কিনা!
আমি এখন এইখানের ভাষা আয়ত্ব করেছি। চিঠিখানা পড়লেই তুমি তা বুঝতে পারিবে। কুলসুমআপা
কি আমারে মনে করেন? জান কী, চারবচ্ছর আগে দিদি, জামাইবাবু, খোকন পৃথিবী থেকে হারাইয়া
গিয়াছে!’
বাসন্তীর বন্ধ চোখ হঠাৎ জলে ভরে ওঠে। স্বপ্নের ধোঁয়া-কলম থেমে
যায়। দাউদাউ আগুন জ্বলে। পোড়া গন্ধ আসে। আগুন যদিও সত্যিকারের দেখতে হয়নি তাকে। সে
বছর সেপ্টেম্বরের গোড়ায় কলকাতা থেকে বীভৎস দাঙ্গার খবর নিয়ে দাদামণির চিঠি এল। দাদামণি
জ্যাঠামশায়ের ছেলে, কলকাতায় চাকরি করত। আতঙ্ক ছড়াল,
‘এই সকল কী ঘটতাছে? কী অইব? কী অইব? অহনে কী অইব?’ ঘাটে-পথে বাজারে
একই আলোচনা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বদোলা। এতযুগের পরিচিত, এত কাছের মানুষদেরও
পরস্পরের চোখে তাকাতে অস্বস্তি।
বাসন্তীরা কখনও কলকাতায় আসেনি। বিশ্বনাথ শুধু দু-একবার দাদামণির
মেসে কাটিয়ে এসেছে। দাদামণির দায়হীন, স্বাধীন, স্পন্দিত জীবন। দশটা-পাঁচটার দৌড়াদৌড়ি,
বন্ধুদের আড্ডা, সিগারেটের ধোঁয়া। এই যাপন পেয়ে বসেছিল বিশ্বনাথকে। যেতে চেয়েছিল কলকাতা।
মা-র কাছে মনের ইচ্ছা জানিয়েছিল। যোগমায়া ভবতারণকে অনুনয় করলেন,
“অমত কইরেন না—। হে যাইতে চায়—।”
ভবতারণ উড়িয়ে দিলেন,
“কলিকাতা যাইব? ক্যান? তাগ খাওন-পরণ অভাব রাখছি? না এই জাগাত
কালেজ নাই? কইয়া দিঅ বড় পোলারে, অঋণী ও অপ্রবাসী হইয়া যে ব্যক্তি নিজগৃহে শাকান্ন পাক
কইরা খায়, সেই সুখী। হেইডা আমার উক্তি না, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির স্বয়ং কইছেন।”
পাতলা, লম্বা চেহারার ভবতারণ তেজী মানুষ। বাবার অমতে বিশ্বনাথের
আসা হয়নি। তার পরিচিত কেউ চাকরি নিয়ে গেছে বিহারে, কেউ বারানসীতে। কিছু জমিজমা ছিল
ভবতারণের। ছোটো পাকাবাড়ি, মাথায় টিনের চাল। বাগান, পুকুর নিয়ে গৃহস্থালী। কয়েকঘর যজমান,
হস্তরেখা, কোষ্ঠীবিচার করে আয় মন্দ নয়। খেতের ফসল, বাগানের ফল, শাকসবজি, পুকুরের মাছ।
অভাব ছিল না, সঞ্চয়ও না। সঞ্চয়ের প্রয়োজন অনুভব করেন নি। দুই মেয়ে পরপর ভালোভাবে ইস্কুল
পাশ করল। হেমন্তীর আর পড়ার অনুমতি হল না। এর দু-বছর পর বাসন্তী বাবার সামনে দাঁড়িয়ে
বলেছিল,
“বাবা, আমি কালেজে ভর্তি হ’মু। আমার পরীক্ষার ফল ভালো হইছে—।”
ভবতারণ হেসেছিলেন। পুঁথিপত্র থেকে মাথা তুলে নরম গলায় বলেছিলেন,
“তুমার পরীক্ষার ফল দ্যাইখ্যা সুখী হইছি মা। এইই যথেষ্ট হইছে।
অহন মা-র থে’ সংসারের কার্য শিখবা, সিলাই-ফুরাই
শিখবা। হেমুর বিয়ার পর তুমারেও দেইখ্যা-শুইন্যা ভালো ঘরে-বরে দিমু।”
“আমি বিয়া করতে চাই না বাবা—!”
“তয় কী করবা মা? উকিল অইবা? সরকারি করনিক অইবা? আপিস যাইবা নি?”
হা-হা করে হাসছিলেন ভবতারণ চক্রবর্তী। একফোঁটা মেয়ে, ওরকম কত
আবদার করে। মেয়েকে দেখলেন বুঝি মন দিয়ে। ষোলো পেরিয়ে সতেরোতে। অকালপক্ব? আড়ে-দৈর্ঘে
প্রশস্ত। পলিমাটির মতো শ্যামল ত্বক। বড়ো মেয়ে হেমন্তীর মতো ক্ষীণতনু, নতমুখী নয়। বাসন্তীর
ভঙ্গীতে, নীচু দৃঢ়স্বরে যেন ব্যক্তিত্বের আভাস। ভবতারণ খানিক ভাবলেন। মেয়ের ইচ্ছাতে
সম্মান দিয়ে বললেন,
“তুমি পড়বা? আইচ্ছা। কালেজ যাওন লাগব না। বইপত্রের ব্যবস্থা দিমু।
প্রাইভেট পরীক্ষা দিবানে।”
এদিকে কলকাতার দাঙ্গার মাসদুই পর আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে এপারেও
ভয়ঙ্কর আগুন জ্বলল। সেই আগুন নেবাতে এলেন মহাত্মাজী। রইলেন ক-মাস, বোঝালেন। মিটিং হল।
কিন্তু ইতিমধ্যে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে দেশের শরীর। তীব্র সন্দেহ, অবিশ্বাস, হানাহানি কর্কট
রোগ হয়ে কোষে-কোষে শিকড় ছড়িয়েছে। একমাত্র উপায় নাকি ব্যবচ্ছেদ – কেটে ফেলা। তাই নিয়ে
গভীর আলোচনা চলছে নেতাদের মধ্যে। সামান্য অংশ খবর হয়ে এসে পৌঁছায়। ঘাটে-পথে মানুষের
মনে অদৃশ্য ভয়, বড় দুশ্চিন্তা। ভবতারণের কানে খবর আসে, মানতে চান না।
“যা মন লয় কইলেই অইল? দ্যাশের আবার ভাগাভাগি কী? মায়েরে কেডা
কাইট্যা ফালায়? বাপ-ঠাকুদ্দার জমি থুইয়া অন্যখানে কেডা যায়? ন্যাতারা কিয়ের লাইগ্যা
আছে?”
বছর ঘুরল। অগাস্টমাসে কলকাতায় দাঙ্গা লাগার বছরই ফাল্গুনমাসে
বড়ো মেয়ে হেমন্তীর বিয়ে দিয়েছিলেন ভবতারণ। জামাতা সুখেন্দুবিকাশের চাকরি চা-বাগানে।
বিয়ের পর হেমন্তীকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল। পরের মার্চে সুসংবাদ জানিয়ে পত্র এল, হেমন্তী
গর্ভবতী। যোগমায়া হিসাব করে বললেন,
“পূজার সময় অইব। আপনে শ্রাবণমাসে গিয়া তাইরে লইয়া আইবেন।”
সেই মার্চে খবর আসতে লাগল দেশের সুদূর পশ্চিমাঞ্চল দাঙ্গায় পুড়ছে।
মানুষ মরছে। যেভাবে হোক পালিয়ে আসছে প্রাণে বাঁচতে। ফেলে আসছে খেত-খামার, ঘরবাড়ি। এপারে
বসেও ভবতারণ অবাক হয়ে দেখেন এতবছরের প্রতিবেশী, জ্ঞাতিদের অনেকেই দরজায় তালা ঝুলিয়ে,
বাক্স-প্যাঁটরা কাঁখে, সজল চোখে ছেলে-বউয়ের হাত ধরে চলে যাচ্ছে ওপারে। জানতে চান,
“কই যান? ক্যান যান?”
“দিনকাল ভালা না, কোন সুময় কী ঘটব কওন যায়! যা বুঝি, দেশভাগ ঠ্যাকান
যাইব না। আপনেও আইস্যা পড়েন, দেরি কইরেন না।”
“ফিরত আইবেন না?”
“হেই আশা লইয়া যাইতাছি—।”
দেশভাগ! শব্দটা বারবার মুগুরের বাড়ি মারে ভবতারণ চক্রবর্তীর
মাথায়। চোখের সামনে দেখেন কালো ঝুল-কালি, ধোঁয়া-ধোঁয়া। পোড়া গন্ধ পান। ক্রমে ঘর আঁকড়ে
পড়ে থাকেন, এক-পা বেরোতে চান না। প্রায় সারাদিন বিছানায় শোওয়া। যোগমায়া উদ্বিগ্ন হন।
তিনি ব্যক্তিত্বহীন, সম্পূর্ণভাবে স্বামীনির্ভর। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন,
“শ্রাবণমাসে খুকীরে আনবেন না?”
চোখ বন্ধ করে প্রবলভাবে বালিশে মাথা নাড়তে থাকেন ভবতারণ। চোখ
থেকে জল গড়ায়।
“ভাগ অইব ভাগ! শুনছ নি? কোন ভাগে তাই আইব? কোন ভাগে? তার পোলা
কোন ভাগে আইব?”
কতদিন গভীর রাতে এমন করে বাবার কথা মনে পড়ে বাসন্তীর। দিদির
কথা মনে পড়ে। গ্রামের খুঁটিনাটি মনে পড়ে। দিদি অনেক শান্ত, বাধ্য, নরম ছিল। মনে পড়ে
দিদির বান্ধবী চম্পাদিদিকে লেখা দিদির একখানা কবিতা। দিদির হাতের অক্ষরমালা কেমন সুন্দর
ছিল।
“চম্পারাণি চম্পারাণি মজা হবে ভারী
কালেজে ছুটি হলে তুমি আইস মোদের বাড়ি।
যদিও তোমরা শহরবাসী, মোরা পাড়াগেঁয়ে
বুড়িগঙ্গার মুক্ত হাওয়া লাগেনা ত গায়ে।
তবু এলে দেখতে পাবে, কুঁড়েঘরের পাশে
ধানের শিসে ঢেউ খেলে যায় বাতাস সুখে হাসে।”
উষ্ণ চোখের জলে অজান্তে বালিশ ভেজে বাসন্তীর। কেউ টের পায় না।
দুপুরবেলা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল অমলা। বি-এ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বাংলা ছাড়া কোনও বিষয়ই ভালো হয়নি। ফিলোসফি, ইংরাজির কঠিন গদ্য-পদ্য – নাকের জলে চোখের জলে অবস্থা। ভবিষ্যৎ ভাবার দায় তার নেই। আপাতত বাংলা গল্প-উপন্যাস গেলা আর তারাসুন্দরীর মুখঝামটা খাওয়া ছাড়া বিশেষ কাজ নেই। অমলার মাথার কাছে শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ। নেশার মতো শেষ করেছে বইটা। ঘুমে চোখ জুড়ে গেলেও বন্ধ করতে পারছিল না। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল অচলাকে। মুখ অস্পষ্ট, বাকি আদল প্রায় তার নিজের মতো। কিন্তু গৃহদাহর জটিলতা, অচলার তীব্র টানাপড়েন তাকে নাড়া দিয়েছে খুব। কিছুদিন আগে দেবদাস পড়েও ঘোরের মধ্যে কেটেছে। তার আধবোজা চোখের পাতায় দেবদাস, মহিম, সুরেশের মুখ মিলে স্বপ্ন, অস্পষ্ট কোন প্রেমিক মুখ। জোর করে সে উঠে বসল। বেলা পড়ে এসেছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে কুচি-কুচি সোনার দানা রোদ। বেড়া কেটে কাঠের ফ্রেম-বসানো জানালা। তারের জালি। বাইরে পেঁপে গাছদুটোর মাথায় পাকাপেঁপে রঙের সূর্য চোখ পিটপিট করছে। সেদিকে তাকিয়েছিল, তারাসুন্দরীর গলা পেল,
“অ অমু—, উঠস নাই?”
“হ্যা উঠছি।”
“চোখে জল দিয়া পাকঘরে আয়।”
“ক্যান? আমি অহন চা করন পারুম না।”
মা’র ওপর হম্বিতম্বি করে বটে অমলা, কিন্তু মা ছাড়া পৃথিবী অন্ধকার।
ঘ্যানঘ্যান করতে করতে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াল। তারাসুন্দরী মুখ তুলে মেয়েকে দেখলেন।
“এমুন কামচোর হইছ! ল্যাখাপড়া ত পাকছে। ঘরের কাম নাই, সেলাই-ফুরাই
নাই! কামের নামে ডর? অ্যা? শাশুড়ির ছ্যাচা খাঅন কপালে আছে।”
“যেমন তুমি ছিলা—! তমার মত হইছি।”
“থাবরাইয়া তর চোপা বাইর করমু। যা অহন বাসন্তীগ ঘরে দিয়া আয়। শিগগীরো
আইবা, বইয়া পরবা না।”
তারাসুন্দরী ছোটো কাঁসার বাটি-ভরা চিনি দিলেন অমলাকে। পাশের
বাড়ি থেকে ধার নিয়েছিলেন। ওবাড়িতে মেয়ের যাওয়া বিশেষ পছন্দ করেন না, ছেলের গুষ্টি।
নিরুপায় হলে পাঠাতে হয়। অমলা আঁচল গুছিয়ে বের হল। মাঝে খানিকটা খালি জমি, বেশ নীচু।
বর্ষাকালে জল জমে পুকুর। বর্ষার পর জল শুকোলেও সারাবছর কাদা-কাদা থাকে। এদিকের সব ঘর
থেকে এঁটো-কাঁটা, আবর্জনা ফেলে ওখানে। সর্বক্ষণ পচা গন্ধ, পোকামাকড়, মশা। গাছ-গাছালির
ঘন জঙ্গল। মাঝরাতে কতদিন শেয়ালের ডাক শোনা যায়। সাপ, গুইল, ভামবিড়াল আসে। সন্ধের পর
ঘরে-ঘরে প্রদীপ, লম্ফ, হ্যারিকেন জ্বলে উঠলে জায়গাটা আরও নির্জন, ভূতুড়ে। কমলার ভয়-ভয়
করে।
বাটি হাতে মিনিটদুয়ের পথ একদৌড়ে পার হয়ে পাশের বাড়ির বাঁশের
গেটের হুড়কো খুলে ডাকল,
“জ্যাঠাইমা—, বাসন্দিদি--।”
“কে রে? অমলা? আস রান্নাঘরে। তমার দিদি এইখেনে।”
রান্নাঘর তাদের মতোই বেড়ার দেওয়াল, মেঝে সিমেন্টে ঢালাই করা।
উনানের সামনে বাসন্তীর বউদি শেফালী। বাসন্তী চা ছাঁকছে। চিনির বাটি হাতে নিল। বলল,
“আয় অমলি বয়। চা খা।”
“না না। জ্যাঠাইমা কই?”
“সন্ধা দেয়। বস না!”
কমলা বসতে চাইল না। শেফালী চোখ সরু করে হাসল,
“ক্যান গ সুন্দরী ননদিনী? তমারে বুঝি বাইন্দ্যা রাখুম?”
“দুৎ, বউদি যে কী কন! খালি ফাইজলামি।”
“ফাইজলামির কইটুকু দ্যাখলা তুমি?”
শেফালীর হাসিতে কমলার গাল লাল-লাল। রান্নাঘরের দরজায় এসে গলাখাঁকারি
দিল শিবনাথ। যোগমায়ার তৃতীয় পুত্র, সবচেয়ে সুদর্শন।
“চা চা কইরা গলা শুকনা—। আইজ আর চা পাব না বউদি?”
“এইত দেই। তুমি ঘুমাইতাছিলা দেইখ্যা—।”
শিবনাথের দিকে তাকিয়েই চোখ নামাল অমলা। অকারণে রক্ত ছলকে উঠল,
কান গরম। পাছে কেউ দেখতে পায় তাই তাড়াতাড়ি গায়ের কাপড় টেনে জড়াল,
“আমি তাইলে যাই বউদি। মায়ে রাগারাগি করবে।”
শিবনাথ সরে দাঁড়ালে ছুটে বের হল অমলা। পেছন পেছন দ্রুতপায়ে গিয়ে
ধরল বাসন্তী,
“দারা না, দৌর দিস কেন? শোন একখান কথা—।”
“কী কথা?”
“নতুন একখান বই আইছে – সারে চুয়াত্তর না কি য্যান নাম কইতাছিল
শিবু। যাবি তুই, আমি, বউদি? বেশী দূর ত না। ট্রামে কালীঘাট যামু ... অবশ্যি এট্টু হাটন
লাগব।”
“মায়েরে জিগ্যেস করে বলব। অহন যাইগা”।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন