বড় পর্দায় দেখা হিন্দী ছায়াছবি (পর্ব ছয়, ১৯৮৮-২০০০)
১৯৯৯-এ মুক্তিপ্রাপ্ত কিন্তু তার
কিছু পরে পুনর্মুক্তির সময় দেখা সূর্যবংশম ছবির পর দীর্ঘ পাঁচ-ছ’ বছর কোন হিন্দী ছবি
বড় পর্দায় দেখিনি। ২০০৫ সাল থেকে স্থানীয় মাল্টিপ্লেক্সে অমিতাভ বচ্চন-রাণী মুখোপাধ্যায়-ধৃতিমান
চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ব্ল্যাক দিয়ে আবার হলে গিয়ে হিন্দী ছবি দেখা শুরু হয়। মাল্টিপ্লেক্সে
দেখা উল্লেখযোগ্য ছবির প্রসঙ্গে আসার আগে পুরনো দিনের ‘সিঙ্গলপ্লেক্স’ বা ‘ইউনিপ্লেক্স’-এ
হাতে গোণা যে ক’টি ছবি দেখেছি সেগুলির কথা বলব।
সবচেয়ে বেশী বার গেছি সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের
‘মেনকা’ সিনেমায়, সেই ১৯৬৫/৬৬ সালের পর আবার। ২০১৩-য় এখানে দেখি ধুম সিরিজের তৃতীয়
– এবং অদ্যাবধি শেষ – ছবি ধুম ৩। অভিষেক বচ্চন, উদয় চোপড়া, আমির খান ছাড়াও আমার কাছে
মুখ্য আকর্ষণ ছিল সে সময়ে আমার অতি-প্রিয় মিষ্টি-সুন্দরী নায়িকা ক্যাট্রিনা কাইফের
উপস্থিতি, যদিও মূল কাহিনীতে তাঁর ভূমিকা নেহাৎই নগণ্য! ২০১৪-তে মেনকায় দেখলাম আমার
তৎকালীন আরেক প্রিয় নায়িকা আলিয়া ভট্টের উপস্থিতি-সম্বলিত হাম্পটি শর্মা কী দুলহানিয়া।
শাহরুখ খানের মেগা-হিট দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে-র (যা নিয়ে ভবিষ্যতের পর্বে
আলোচনা থাকবে) একাধিক নকলের এটি এক নিদর্শন। এতই ক্লান্তিকর ছবি যে আলিয়ার একাধারে
মিষ্টি এবং অভিনয়-নিপুণ উপস্থিতি সত্ত্বেও মাঝে-মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম, আর জেগে উঠে
সহ-দর্শক বন্ধুপ্রতীম ছাত্র অভিরূপ মাশ্চরককে বার বার প্রশ্ন করছিলাম, “হ্যাঁ, তা এতক্ষণ
কী হলো?” মেনকায় এই সময়ে দেখা সেরা ছবি ২০১৭ সালে টাইগার সিরিজের দ্বিতীয় ছবি টাইগার
জিন্দা হ্যায়। এখানেও প্রিয় ক্যাট্রিনা ছিলেন, তবে সলমন খান যে ছবির নায়ক তাতে নায়িকা
মূলত গৌণ। আর ছবির বক্তব্য প্রশংসার্হঃ যদি একে অপরের প্রতি বৈরিতা ভুলে ভারত আর পাকিস্তানের
গুপ্তচর সংস্থা একযোগে, দুই দেশেরই শত্রু ইসলামী মৌলবাদীদের, মোকাবিলা করে, তাহলে দুই
দেশই লাভবান হবে।
মেনকা ছাড়া লেক টাউনের জয়া-মিনি-জয়াতেও
একাধিক ছবি দেখেছিঃ ২০১৪-তে দেখি আমার কন্যার ইচ্ছানুসারে ভোপাল – এ প্রেয়ার ফর রেন।
ছবিটি ইংরেজীতে তৈরি হলেও, জয়া বা মিনি-জয়ায় এর হিন্দী সংলাপ সম্বলিত রূপই দেখানো হয়েছিল।
১৯৮৪ সালে ভোপালে অবস্থিত মার্কিনী সংস্থা ইউনিয়ন কার্বাইডের কারখানা থেকে বিষাক্ত
গ্যাস নির্গত হয়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটায়, অনেকে চিরতরে ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে যান।
ছবিতে সংস্থার মার্কিনী প্রধান ওয়ারেন অ্যান্ডারসনের ভূমিকায় অভিনয় করেন হলিউডের মার্টিন
শীন, আর ভারতীয় শ্রমিক এবং তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় ছিলেন রাজপাল যাদব এবং তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়।
মূল দুর্ঘটনার চিত্রায়ন যথেষ্ট উৎকণ্ঠা উদ্রেক করেছিল, তবে অ্যান্ডারসনের চরিত্রটি
একটু বেশী সহানুভূতির সঙ্গে দেখানো হয়েছিল, এবং তাঁকে যেভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
নিরাপদে দেশ থেকে পালাতে সহযোগিতা করেন, সে প্রসঙ্গ প্রায় এড়িয়েই যাওয়া হয়েছিল, সম্ভবত
সরকারের কোপ এবং সেন্সর বোর্ডের কাঁচি এবং/অথবা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে।
২০১৬-তে জয়ায় দেখি অনুরাগ কশ্যপ
পরিচালিত, নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী এবং ভিকি কৌশল অভিনীত শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে
দেওয়া হত্যাকাহিনী রমন রাঘব ২.০। ‘২.০’ কারণ রমন রাঘব নামে ষাটের দশকের এক বাস্তব সিরিয়াল
কিলারকে নিয়ে পরিচালক শ্রীরাম রাঘবন ১৯৯১ সালেই একটি ছবি করে ফেলেছিলেন। কশ্যপ ছবিতে
দুটি কেন্দ্রীয় চরিত্র রেখেছেনঃ নওয়াজুদ্দিন-রূপায়িত রমন্না যে একের পর এক হত্যা করে
চলেছে, কোন কারণ ছাড়াই, শুধু ‘নিধনলীলার উল্লাসে’, যার শিকারের মধ্যে তার সম্পূর্ণ
অপরিচিত মানুষ আছে, আবার আছে রমনের বোন, ভগ্নীপতি ও তাদের শিশুপুত্র। রমন্নার কীর্তিকলাপের
জন্য তার পেছনে লেগেছে মাদকাসক্ত পুলিশ অফিসার রাঘবন অমরেন্দ্র সিং উম্বি (ভিকি কৌশল)।
কিন্তু অপরাধী এবং আইনরক্ষক তো আসলে একে-অপরের পরিপুরক! ছবি শুরু হচ্ছে রাঘব মুম্বাইয়ের
এক মাদক-ব্যবসায়ীর কাছে মাদক কিনতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া নিয়ে, কারণ ব্যবসায়ী এবং অকুস্থলে
আরেক ব্যক্তি খুন হয়ে গেছে। ছবির শেষে রমন রাঘবকে জানাবে যে দুটো খুনের একটা সে নিজে
করেছিল বটে কিন্তু সে অপর খুনটি রাঘবকে করতে দেখে ফেলেছিল। সেই মুহূর্ত থেকে রমন রাঘবের
সঙ্গে নিজের আত্মিক যোগ অনুভব করে। রমনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাঘবও একাধিক প্রাণনাশ
করবেঃ এক আফ্রিকী মাদক-ব্যবসায়ীর, নিজের বান্ধবী স্ম্রুতিকার (শোভিতা ধুলিপালা), যাকে
রাঘব তিনবার গর্ভপাত করিয়েছে, এবং সবশেষে,
রমনের আবেদনে সাড়া দিয়ে নিজের একরাতের শয্যাসঙ্গিনী অঙ্কিতার (অনুষ্কা সাহনী)। এর বিনিময়ে
রমন প্রতিশ্রুতি দেয় যে স্ম্রুতির মৃত্যুর দায় রমন নেবে – কারণ রমন-রাঘবের পারষ্পরিক
সম্পর্ক যে ‘ওপরওয়ালা’ নির্ধারণ করে দিয়েছেন! এখানে প্রায় বীভৎসভাবে আমার মনে পড়েছিল
১৯৯৭ সালের ‘রোমান্টিক’ প্রেমগাথা, শাহরুখ খান-মাধুরী দীক্ষিত-করিশ্মা কাপুর অভিনীত
দিল তো পাগল হ্যায়-এর শীর্ষোক্তিঃ ‘someone … somewhere … is made for us’!
প্রত্যুত্তরে হিরল আদালতে বলে যে
রোহন-অঞ্জলির সম্পর্ক এককালে সম্মতিসূচক হয়ে থাকলেও পরবর্তীকালে কোনও যৌনসম্পর্ক নারীর
সম্মতি ছাড়া হয়ে থাকলে, তা ধর্ষণই। দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় কোন কোন অবস্থায় যৌন অপরাধ
ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে তা বলা আছে। এই ধারা থেকেই ছবির নামকরণ।
মামলার দুই বিচারক বুঝতে পারেন
যে অঞ্জলির অভিযোগ মিথ্যা কিন্তু অপরদিকে তাঁরা জনমতের ভয় করেন – বিত্ত ও ক্ষমতা যাদের
আছে, তারা ক্ষমতাহীনদের ওপর অত্যাচার করে পার পেয়ে যায়, যা জন্ম দেয় জনরোষের। রোহনের
বিরুদ্ধে গণ প্রতিবাদ দেখে ভয় পেয়ে, পরিস্থিতিগত প্রমাণ অগ্রাহ্য করে, বিচারকদ্বয় দায়রা
আদালতের রায়ই বহাল রাখেনঃ যেহেতু সম্মতির কোন প্রমাণ নেই, অভিযোগকারিণীর কথাই সত্য
বলে মেনে নিয়ে তাঁরা রোহনকে দোষী সাব্যস্ত করেন। রোহনের স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করার
সিদ্ধান্ত নেন। রোহনকে কারাগারে ফিরে যেতে হয়। কিন্তু অঞ্জলি হিরলের কাছে গোপনে স্বীকার
করে যে তরুণের আন্দাজই ঠিক ছিলঃ অঞ্জলি প্রতিশোধ নিতে রোহনের নামে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ
করেছে!
ছবিটি আরও বলিষ্ঠ হতো যদি অভিযোগকারিণী
হতো কোন ধর্ষকাম নামী, ক্ষমতাবতী প্রযোজিকা, পরিচালিকা বা অভিনেত্রী, যে, কোনও এক উঠতি
অভিনেতা বা ছবির পার্শ্বকর্মীকে যৌন সম্পর্কে আহ্বান ক’রে, প্রত্যাখ্যাতা হয়ে, সেই
হতভাগ্য পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনত, এবং নিজের ক্ষমতা, এবং তারও ওপরে নিজের
লিঙ্গের দৌলতে সত্যবাদিনী সাব্যস্ত হতো।
নারীদের সুরক্ষার জন্য করা আইনের
অন্যায় সুযোগ যে একাধিক মহিলা অপরাধী কিভাবে নেন তা সিনেমা এবং সংবাদপত্রের কল্যাণে
সর্বজনবিদিত। ২০২২ সালের তেলেগু রহস্য ছবি হিটঃ দ্য সেকেন্ড কেস-এর শুরুতেই দেখা যায়
স্বামী বাড়ী ফিরে আলমারি খুলে দেখে স্ত্রীর নাগর সেখানে ঘাপটি মেরে আছে। স্ত্রী পত্রপাঠ
স্থানীয় মহিলা সমিতিতে গিয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে বৈবাহিক ধর্ষণের অভিযোগ জানায়। এই স্বৈরিণীর
মুখের কথায় বাড়িতে পুলিশ এসে স্বামীকে গ্রেপ্তার করে আর থানায় যাবার পথে মহিলা সমিতি
মিছিল বের করে স্বামীর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়, তার গায়ে পচা সব্জি ছুঁড়ে মারে। অবশেষে
হতভাগ্য স্বামী করে আত্মহত্যা।
বাস্তবজীবনে মধ্যপ্রদেশের পান্না
অঞ্চলে লোকেশ মাঞ্ঝি নিজের বাড়ীতে গোপনে ক্যামেরা লাগিয়ে তারপর পুলিশের কাছে নিজের
স্ত্রী হর্ষিতা কিভাবে স্বামীকে শারীরিক নিগ্রহ করে তার প্রমাণ দাখিল করে আকুতি জানিয়েছেন,
“আমার স্ত্রী আমায় প্রহার করে! দয়া করে আমায় বাঁচান!” ভিডিওতে দেখা গেছে যে হর্ষিতা
লোকেশের মুখে লাথি মারছে। আর পাশ্চাত্য দুনিয়ায় প্রাক্তন অভিনেত্রী অ্যাম্বার হার্ড
স্বামী জনি ডেপকে কী কী করত তা এখন সবাই জানেন।
২০১৫ সালে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে
অবস্থিত ‘নবীনা’ সিনেমায় দেখা একটি ছবির প্রসঙ্গ বিশেষ কারণে ভবিষ্যৎ পর্বের জন্য তোলা
রইলো।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন