প্রতিবেশী সাহিত্য
ম্রিলের কাহিনী (A tale of Mrile: Africa)
মূলগ্রন্থঃ রূপকথায় পুরাবিন্যাসের ধাঁচেরা (Archetypal patterns in fairy tales)
ডঃ মারী লুই ফন ফ্রানৎস
(অনুবাদঃ মৌমিতা ঘোষ)
আর সব মায়েদের মতো
ইয়ুং জননী মোটেই কোনও ঐন্দ্রজালিক শিশুকে হত্যা করেননি ঠিকই কিন্তু তার বাক্যগুলি তারই
অজান্তে, তার পুত্রের সৃজনশীলতাকে আহত করেছিল। যে কোনো সৃজনশীল ব্যক্তি যাঁর
ন্যূনতম বোধ আছে, অনেক ছোটবেলা থেকেই তাঁদের সৃজনী সত্ত্বাকে আড়াল করে রাখেন এমনকি
তাদের অতি প্রিয় বন্ধুটির কাছ থেকেও যেন তা এক বহু মূল্যবান সম্পদ কারণ সামান্য কোনও
অপ্রশংসাযুক্ত মন্তব্যও তাঁদের সৃজনী সাধনা ব্যাহত করতে পারে।
নব সৃজনকারী কর্ম বা
প্রকল্প একবার পূর্ণরূপ পাওয়ার পর সমালোচনার মুখোমুখি হলে তত ক্ষতি হয় না যতটা ক্ষতি
হয় সৃজন কর্ম চলাকালীন বা শুরুতে নঞর্থক মানসিকতার মুখোমুখি হলে। সৃজনশীল ব্যক্তি
প্রশংসা বা নিন্দায় বিচলিত হতেই পারেন কিন্তু পূর্ণতাপ্রাপ্ত সৃজনকর্ম অবিকৃত থেকেই
যায়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সৃজন প্রকল্প একেবারে আবরণহীন ডিমের মতই স্পর্শকাতর। এটিকে
গোপনে সযত্নে রক্ষা করতে হয়।
শুভীন আর ম্রিলের প্রধান পার্থক্য হল এই গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে। ম্রিলের ট্রাজেডির কারণ হল ম্রিলে তার গোপনীয়তা শেষপর্যন্ত ঠিকঠাক রক্ষা করতে পারেনি যা শুভীন দীর্ঘকাল ধরে করতে সক্ষম হয়—অনেক যত্নে, অনেক সতর্কতায়।
শুভীন তার ঐন্দ্রজালিক প্রকৃতি লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু ম্রিলে এ ব্যাপারে বুদ্ধিহীনের মতো কাজ করেছে। তার ছোট ভাইরা গুপ্তচরের মতো তার গোপনীয়তার সন্ধান পেয়ে গেছে। আর তার মা বীজ শিশুটিকে মেরে ফেলেছে। তারপর ভয়ঙ্কর শোকে ম্রিলে শুধু কেঁদে গেছে আর কেঁদে গেছে। কিন্তু তখনও সে আশ্চর্যজনকভাবে কাঁদার আসল কারণটা গোপন করে যাচ্ছিল – বলছিল রান্নাঘরের ধোঁয়া তার চোখে জল এনে দিচ্ছে। যেন কোনটা প্রকাশযোগ্য আর কোনটা গোপনীয় – এ বোঝার অভাব রয়েছে তার মধ্যে। কোনটা গোপন রাখার প্রয়োজন পড়ে না আর কোনটা যে কোনও মূল্যে অন্তরালে রাখতে হয় এই বোধ, এই প্রবণতা ছেলেবেলা থেকেই তৈরি হতে থাকে। কিন্তু ম্রিলে এখনও সেই বিষয়টিকে লুকিয়ে যাচ্ছে যেটাকে আর গোপন রাখার দরকার নেই।
একটি চিঠিতে ইয়ুং এই মত ব্যক্ত করেছেন যে কোনও মনোস্নায়বিক অসুস্থতাগ্রস্ত মানুষকে খুব গভীরভাবে বোঝা দরকার এবং অসুস্থতার বিশ্লেষণ খুব হার্দিকভাবে গভীরতার সঙ্গে করা উচিৎ। নয়তো দেখা গেল প্রথামাফিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সেই ব্যক্তির সূক্ষ্ম মানসিক বৃত্তিগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়া হল, নষ্ট করে দেওয়া হল তার একান্ত নির্জন বোধময় দিকটিকে। এক্ষেত্রে সবচাইতে ভালো উপায় হল ব্যক্তির স্নায়বিক অসুস্থতাকে তারই চেতনে জ্ঞান ও বোধের আলোর মধ্যে এনে ফেলা যাতে নিজেই তিনি সেই দুর্বলতাগুলোকে শেষ করে দিতে পারেন। অসুস্থ ব্যক্তির মানসিক সূক্ষ্ম অবস্থাগুলোকে বুঝতে বা খুঁজতে না যাওয়াটাই মঙ্গল। বরঞ্চ এগুলিকে সম্মান জানানো উচিত।
যখন ব্যক্তি তার দেখা স্বপ্নের কথা বলতে আসেন, তখন আমাদের সেই স্বপ্নের অর্থ ব্যাখা না করতে যাওয়াই উচিত হবে। সেই ব্যক্তিকে বলতে হবে এ বিষয়ে কোনও মতামত বা বিশ্লেষণ না করতে কারণ যদি এই স্বপ্ন ব্যক্তির মূল সত্ত্বার সাথে বা ভাগ্যের সাথে জড়িত থাকে তবে আগামী ১৫ বা ২০ বছরের মধ্যেই এর অর্থ ঐ ব্যক্তির কাছে আপনিই প্রকাশ পাবে। কারণ এই স্বপ্নগুলিকে নিয়েই একজন বাড়তে থাকে, চলতে থাকে, বিরত হতে থাকে আর ক্রমাগত একাত্ম বোধ করতে থাকে। ঐ স্বপ্নগুলির সঙ্গেই সে বাঁচে আর তারপর সে তার অর্থ বোধগম্য করে। এমনকি যদি সেই ব্যক্তি খুবই চিন্তাশীল, বৌদ্ধিক প্রবণতাসম্পন্ন হন তবে তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন স্বপ্নের অর্থের নাগাল পেতে। তাকেও বারণ করতে হবে এই অর্থগুলিকে স্পর্শ করতে। কারণ এসব বিষয়ে আলোকপাত করা একপ্রকার ভুলই হবে। এভাবেই ম্রিলের বীজশিশু—ম্রিলের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা গাছের কোটরে গোপন থাকলেই ভালো হত। তাই যদি কোনও ব্যক্তি মনোসংযোগের মাধ্যমে অপর কোনও ব্যক্তির গোপন কিছু টেরও পায় তবে কিছু না বোঝার ভান করাই উচিৎ। অন্যের গোপনীয়তা খণ্ডানো মারাত্মক ভুল।
আসলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ম্রিলে। সব কিছু প্রকাশিত হয়ে যাবার পরও সে অদ্ভুত ভাবে তার কান্নার কারণ গোপন রাখতে চাইছে যখন আর কিছু লুকিয়ে রাখার দরকারই নেই। অথচ পূর্বে সে’ই যথেষ্ট যত্নশীল পদক্ষেপ নেয়নি এই বীজশিশুটিকে গোপন রাখার বিষয়ে।
এবার তার পরিবারের সকলে তাকে তার বাবার চেয়ার পেতে উঠানে গিয়ে বসতে বললে। হয়তো উঠানে প্রচুর পরিমাণে মেষ, ছাগ প্রভৃতির মল ছড়িয়ে ছিল যেখানে চেয়ার ছাড়া বসা যেত না। কুঁড়ে ঘরের মধ্যকার উনানের ধোঁয়ার হাত থেকে চোখ দুটোকে বাঁচানোর জন্যই তাকে তা বলা হয়। কিন্তু এই চেয়ারে বসার ব্যাপারটি মোটেই এত সরল নয়। কারণ, পরক্ষণেই ম্রিলে চেয়ারের উদ্দেশ্যে বলবে চেয়ার তুমি উঠে যাও দড়ির মতো, যে দড়ি ঝুলিয়ে তার বাবা গাছে মধুভাণ্ড টাঙায়। এই ভাবে আমরা বলতেই পারি যে যখন ম্রিলে তার বাবার চেয়ারে বসছে তখনই সে নিজেকে নিজের পিতার সাথে একাত্ম ভাবছে। এইভাবেই ম্রিলে তার মায়ের স্বামীর সঙ্গে একাত্ম বোধ করে। সে অতিমাত্রায় তার মায়ের প্রতি আসক্ত, আর এই হিসেবেই সে যেন পরোক্ষে তার মায়ের বর হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ ফ্রয়েড মহাশয় হয়তো ভীষণ খুশী হবেন এটা জেনে যে আমরা তার এই ইদিপাস কমপ্লেক্সকে মেনে নিচ্ছি। ম্রিলের এই ইদিপাস কমপ্লেক্স তাকে সংসারে থেকে পার্থিব ভোগ্য ভোগ করা থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বর্গে যাবার প্রেরণা দেয়। সে যেন পলায়নবাদী হয়ে উঠে।
ম্রিলে এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারলো না। পৃথিবীর বাইরে অতি-জগতে সে সক্ষম – সে সেখানে কঠিন কাজ সাধন করতে পারে—কারও জন্য সে কাঠ জোগাড় করে, কারও জন্য খনন করে—এটা আসলে তার অবচেতনের কর্ম উদ্দীপনা। সে মোটেই বাস্তব থেকে ভেসে যেতে পারে না। বাস্তব জগতে সে যে সমস্ত কাজ করে উঠতে পারত তা সে তার কল্পনার অতি-জগতে সম্পন্ন করে। এটাই দেখাচ্ছে যে ম্রিলে একজন ওঝাজাতীয় ব্যক্তিত্ব অথবা একজন সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব। পরিস্থিতির জন্য সে কর্ম বিমুখ হয়ে পড়েনি আদৌ। বহির্জাগতিক কর্মকান্ড থেকে ব্যক্তির মা তাকে প্রতিরোধ করলেও যে কর্মচঞ্চল, সে কাজের মুখোমুখি হয় কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে এবং তা সম্পন্ন করে—যে কাজগুলি অবচেতনার স্তর থেকে উঠে আসে। তার উদ্দেশ্যে স্থির থাকে–চাঁদের দেশে যাওয়া।
গ্রীক রোমান বা অন্যান্য ইউরোপিয়ান পুরাকথায় চাঁদ হল মৃত আত্মাদের গন্তব্যস্থল। প্রাচীন পিতৃপুরুষগণ সেখানে রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, চাঁদরাজা ও অন্যান্য সকল দেবতাগণের সঙ্গে তারা বাস করেন। এই অতিজগতে পিতৃগণ, দেবগণ ও চন্দ্ররাজা বাস করেন। এই সকল প্রাচীন পিতৃপুরুষগণের আত্মাকে বলে zauna aume ইয়ুনা অউম্য বা সংক্ষপে অউমু। চাঁদের দেশে চাঁদের রাজার সঙ্গে এরা বসবাস করেন, তারা অমর ও পৃথিবীকে সুজলা সুফলা করে তোলেন ঐ সকল উপজাতির রক্ষক দেবতার মত। আফ্রিকান উপজাতীয়রা এদের পূজা করেন, এঁদের কাছে প্রার্থনা করেন, এদের উদ্দেশ্যে বলি দেন। এবার আশ্চর্যজনক বিষয়টি হল যে চাঁদের দেশের বাসিন্দাগণ আগুন সম্পর্কে কিছুই জানে না। স্থানীয় এক প্রতিবেশী উপজাতির মধ্যে একরকমের প্রমিথিউস মিথ প্রচলিত থাকার নজির পাওয়া গেছে । সেখানে কাহিনীটা অনেকটাই এইরূপ যে, মানুষরা সকলে অমর ছিল, মৃত্যু কি তারা তা জানত না, অন্য সব পশুপাখিদের মতোই তাদের জীবনযাপন সরল ছিল। তারা আগুনের সম্বন্ধে অনবগতির জন্য কাঁচা খাদ্য গ্রহণ করত। তারপর একজন অতি চালাক মানুষ ও তার বউ অউমুদের আগুন চুরি করে আনল। মানুষরা এবার খাবার রান্না করা শুরু করল। তারা লোহা গলিয়ে ফেলল, অস্ত্র নির্মাণ করল। এতে অউমুগণ এবং দেবতাগণ ক্রুদ্ধ হয়ে মানবজাতিকে মৃত্যুর অভিশাপ দিলো। এইভাবে সৃষ্টি থেকে মানবজাতি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
এই মিথ গল্পটি এটাই বোঝায় মৃত্যু মানুষের চেতনাতে আসলো এবং তার মানেই সে অমরত্ব হারালো। মৃত্যু কী যে উপলব্ধি করেনি তার আবার মরণ কি? যতক্ষণ না তার অহং মৃত্যুকে আলাদা করে চিহ্নিত করছে মৃত্যু তার কাছে কোনো সমস্যাই নয়। সে অনন্তের পথে এক পা রেখেই এই পৃথিবীতে আসছে। আবার নিয়ম মাফিক চলে যাচ্ছে। মৃত্যু এখানে কেবল পরিস্থিতির একটি ক্ষুদ্র পরিবর্তন মাত্র। এটা প্রাগৈতিহাসিক মানুষ অতি সহজে মেনে নিয়েছিল বলে আমাদের মতো এত হৈ চৈ করেনি । শান্ত ভাবে মর্যাদার সঙ্গে তারা মৃত্যুকে বরণ করেছে। তাদের এত সহজে মরার প্রবণতা রয়েছে যে একটি দুটি উদাহরণ দেওয়া যথেষ্ট হবে। একজন বুশম্যানকে যদি একদিনের বেশি বন্দী করে রাখা হয় উৎসাহ হারিয়ে সে মৃত্যু বরণ করে কারণ জীবনকে তার আর জীবন বলে মনে হয় না। একবার এক খবরে পড়েছিলাম এক ব্যক্তি জনৈক নিগ্রো মানুষের অনুভূতিকে আঘাত করায় সে রেগে গিয়ে বলে “তুমি একটু অপেক্ষা করো”। পরদিন সকালে ওই ব্যক্তি দেখে যে তার দরজায় নিগ্ৰো মানুষটির ঝুলন্ত মৃতদেহ। ওই ক্ষুব্ধ নিগ্রোটি পাল্টা আঘাত হানতে আত্মহত্যা করে বসেছে। যেন লোকটি জীবিত হিসেবে প্রতিপক্ষকে যতটা শাস্তি দিতে পারত প্রেত রূপে তাকে আরো বেশি শাস্তি দিতে পারবে ওই প্রতিশোধ স্পৃহায় আত্মহত্যা করেছে। ওই অঞ্চলে যে এরকম বিশ্বাস প্রচলিত তা আর বিশদে বলার অপেক্ষা রাখে না।
মৃত্যু আর অহং যেন বিজড়িত, অহং এর পতন যেন মৃত্যুরই সামিল। প্রবৃত্তিগুলো যেন ব্যক্তিকে এই ভাবেই গড়ে তুলেছে।
মুমূর্ষু মানুষের স্বপ্ন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তারা প্রবৃত্তিগুলির উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। জীবনের শুরুতেই এইসব প্রবৃত্তিগুলোর উপর ভর করে যাত্রা শুরু হয়েছিল। যাত্রা শেষের সময়েও মানুষ এইসব প্রবৃত্তিগুলিকে বেশি ভরসা করেন। এই প্রবৃত্তিগুলি যত সহজে জীবনে প্রবেশ করতে সাহায্য করে, ঠিক তত সহজেই জীবন থেকে বেরিয়ে যেতে সহায়তা করে। এই প্রবৃত্তিগুলিকে পশু প্রবৃত্তি বললেও ভুল কিছু বলা হবে না। এই প্রবৃত্তিগুলি শেখায় কত সহজে মৃত্যুবরণ করা যায়। যদি কেউ এই পশু প্রবৃত্তিকে বিশ্বাস করে, দেহগত প্রবৃত্তিকে বিশ্বাস করে তবে সুসংযতভাবে শরীর ত্যাগ করতে পারে ঠিক যেভাবে একদিন সে এই দেহতে প্রবেশ করেছিল।
অনেকে মিথ বিশ্লেষণ বলে যে আগুন চুরি আসলে মানব মনের চেতনার জন্মের প্রতীক। এই চেতনার পথ বেয়েই মৃত্যুচেতনা। আফ্রিকানদের প্রমিথিউস মিথ বলে, এই চেতনার জন্মের প্রাক মুহূর্ত পর্যন্ত স্বর্গ মর্ত যেন একাকার হয়ে থাকে, যেন হাত দিয়েই স্বর্গ ছোঁয়া যায়। কিন্তু আগুন চুরি চেতনার জন্ম যা মানব সভ্যতার বিকাশ বা মানব সভ্যতায় পদার্পণের মুহূর্তেই স্বর্গ যেন দূরে চলে যায়। শৈশবের চেতনা অবচেতনার মিলিত স্বর্গ অহং শূন্যতার স্বর্গ বড় হবার সাথে সাথে বড় দূরে চলে যায়। অবচেতনার জগতের সুরটি যেন কেটে যায়, মানুষের বেঁচে থাকার ট্রাজেডি শুরু হয় চেতনার আবির্ভাবের সাথে সাথে।
কিন্তু ম্রিলের গল্পে ঠিক এর বিপরীত ক্রিয়া ঘটে। সে আগুন চুরি করে না, উল্টে সে আগুনের ব্যবহার শেখায় কোনও স্বর্গীয় রাজ্যের দেবগণকে। মানব চেতনার আনয়ন করে সে সেই দেবগণ ভূতগণের স্বর্গীয় রাজত্বে। এ যেন অচেতনার গভীরে চেতনার আলো ফেলার মত। ম্রিলে আলোকবর্তিকাধারী অচেতন জগতের জন্য। তাই সে কোনো কালচারাল হিরো বা খলনায়ক নয়। সে বৈদ্যবিদ বা ওঝা। এই ওঝারা অবচেতনকে আলোকিত করে শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো গোষ্ঠীর জন্য। এখানেই এক্সিমো প্রভৃতি উপজাতীয়দের সঙ্গে এদের পার্থক্য হয়ে যায়। কারণ ওরা ঝাড়ফুক ছাড়া বিশেষ কিছু করে উঠতে পারে না। আমাদের আলোচ্য কাহিনীতে অচেতন যেন বোধগম্য হতে চাইছে, অন্ধকার যেন আলোর স্পর্শ পেতে চাইছে।
মিরচা এলিয়াড (Mircea Eliade) তার স্যামনিজম গ্রন্থে স্যামন বা ওঝাদের পুরোহিতদের থেকে পৃথক করেছেন। পুরোহিতরা আচার-আচরণ রক্ষা করে আর ওঝারা মৃতের আত্মাকে শান্তি লাভ করতে সাহায্য করে। আফ্রিকান অস্ট্রেলিয়ান প্রভৃতি উপজাতিগুলিতে ওরা মনোচিকিৎসকের ভূমিকা নেয় প্রায়শই। এমনকি এক্সিমোদের মধ্যেও পুরোহিত ও ওঝার পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আফ্রিকানদের মধ্যে দেখা যায় তিনটি দল— আচার রক্ষক পুরোহিত, জাদুকর যারা ফুস মন্তর ইত্যাদির সাহায্যে চোর ধরা প্রভৃতি কাজ করে। আর জ্ঞানী ব্যক্তিগণ যারা বুঝতে পারেন ঈশ্বরের ইচ্ছা ও সেই মতো গোষ্ঠীকে নির্দেশ দেন। গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ বক্তা হয়ে ওঠেন। এমনকি যুদ্ধ বাঁধলে পূর্বপুরুষগণের নির্দেশ গ্রহণ করতে পারেন ও গোষ্ঠীকে সেই মতো পরিচালিত করেন।
নঞর্থক (ক্ষতিকারক অর্থে) মাতৃ গূঢ়ৈষা পুত্রের সক্রিয়তার বা সক্রিয়তার উপর ধ্বন্যাত্মক প্রভাব ফেলে। ম্রিলের বীজশাবককে তার মা হত্যা করে। আসলে তার সৃজনশীলতাকে হত্যা করা হয়। তার শৈশবের কল্পনাশক্তি এইভাবে ব্যাহত হওয়াতে সে ক্রমশ তার অচেতনার গভীরের দিকে ভেসে যেতে থাকে। যা তার নিউরোসিস বা মনো স্নায়বিক রোগের কারণ হয়ে ওঠে।
সৃজনশীল প্রবৃত্তি শিশুদের মধ্যে শুধু অন্তর্মুখহীনতায় লিপ্ত থাকে না। তা বাইরে বেরিয়ে আসে যখন সে অন্য শিশুদের সাথে খেলা করে। কিন্তু যদি না এই সৃজনশীল প্রবৃত্তি প্রকাশিত হতে পারে বাচ্চাটি তা লুকিয়ে রাখতে রাখতে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে চুপচাপ, গম্ভীর। দিনের বেলায় তার মন একঘেয়ে বিরক্তিতে ভরে থাকে। রাতে স্বপ্ন কল্পনায় তার সেই সৃজনশীলতা মাথা চারা দিয়ে ওঠে তার স্বপ্নরাজ্যের মধ্যে। সে গড়ে তোলে তার এই কল্পনার মাধ্যমে একটি দ্বিতীয় জগৎ। যেহেতু তার কল্পনা সকল বাস্তবে প্রকাশ্যে সে ফুটিয়ে তুলতে পারে না; এমনকি অতি আপন মাতা পিতার থেকেও সে তা প্রাণপণে লুকিয়ে রাখে; তা তাকে ক্রমাগত মনোস্নায়বিক রোগী, ক্রমশ পাগলাটে করে তোলে। তার এই সকল কল্পনার কোনো সংশোধন হয় না, সে হয়ে ওঠে মর্মব্যথী। কিন্তু এই কল্পনাই প্রকাশ্যে এলে হয়তো তার খেলার সাথীরা বা পিতা-মাতা তা সংশোধন করে দিতেন-নির্দেশ করতেন কোনটা করা ঠিক বা কোনটা ঠিক নয়। কিন্তু কল্পনা প্রবৃত্তিকে লুকিয়ে রাখা শিশু ক্রমশ মনোযোগ হারিয়ে ফেলতে পারে। বিদ্যালয় থেকে এ বিষয়ে অভিযোগ আসতে থাকে। বাচ্চাটি ক্রমশ তার সহপাঠীদের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে শুরু করে। সে বাস করতে আরম্ভ করে নিজস্ব মনোস্নায়বিক কল্পনার জগতে। তবে সব সময় যে এই ধরনের শিশু মন ও স্নায়বিক রোগগ্রস্ত হবে তাও নয়। অনেক দৈব প্রতিভাসম্পন্ন শিশু তার কল্পনা শক্তি লুকিয়ে রাখলেও মনোরোগী হয় না যদি পরবর্তী জীবনে তার কল্পনাশক্তি আবার জেগে ওঠে। সে হয়তো বাস্তবতা থেকে কিঞ্চিৎ সরে যেতে পারে কিন্তু কখনই মনোরোগী হয়ে ওঠে না।
ফ্রানৎস লিখিত “Aeternus”—A psychological study of adult struggle with the paradise of childhood বইতে এই সকল অভিজ্ঞতার কথাই বর্ণিত হয়েছে যার ভিতর দিয়ে বহু তরুণকে অল্প বয়সে অভিযানে বেরোতে হয়। উক্ত পুস্তক দেখাচ্ছে শুধুমাত্র অস্তর্থ্যক মাতৃ গূঢ়ৈষার (মায়ের প্রতি অতিমাত্রায় টান বা আকর্ষণ যা পুত্রকে আত্ম অবলম্বনে বাঁধা দেয়) কারণে এসব হয় না। নঞর্থক মাতৃ গূঢ়ৈষা (পুত্রের সৃজনশীল প্রবৃত্তি ধ্বংসকারী) তরুণকে বাস্তব থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় সে হয়তো নিউরোসিস এর রোগী হয়ে যায় না কিন্তু তার মূলগত সত্ত্বা ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় তার মায়ের দ্বারা। হতেই পারে ভবিষ্যৎ জীবনে উচ্চ মানের বুদ্ধিজীবী ভালো মেধাবী ছাত্র হয়তো অল্প বয়সেই দর্শন শাস্ত্রের মত বিষয় সে রপ্ত করে ফেলে। কিন্তু অপর দিয়ে শারীরবৃত্তিয়ভাবে সে দুর্বল হয়ে ওঠে খেলাধূলায় হয় অনাগ্রহী। কোনো সামাজিক বন্ধন এমনকি সহপাঠীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় অক্ষম।
এই যে বাস্তব জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আসা তাকে সব সময় খারাপ ভাবার কোনো কারণ নেই। এটা মায়ের নঞর্থক নিয়ন্ত্রণ থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এ যেন নিজের জন্য একটি পুরুষালী জগত তৈরি করা যেখানে মা এর প্রবেশ করা অসম্ভব যদি না তার বুদ্ধিমত্তা উচ্চ পর্যায়ের হয়ে থাকে। স্বনির্মিত এই কল্পনা সাম্রাজ্যের রাজা ওই তরুণ যেখানে সে তার মায়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত স্বাধীন।
কিন্তু পরবর্তী জীবনে যখন সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় তখন সে টের পায় ঘরে ফিরবার ইচ্ছা তার মধ্যে প্রগাঢ় হচ্ছে। নঞর্থক মাতৃ গূঢ়ৈষা তার মধ্যে কামনা বাসনার বিস্ফোরণ ঘটায়। দৈনন্দিন বাস্তবে সে তার প্রবৃত্তিগুলির বশবর্তী হয়। সে স্ত্রী সঙ্গ পেতে চায়। পরিণতিতে তার মধ্যে শূন্যতা বোধই বাসা বাঁধতে থাকে।
ঐসব তরুণরা ব্যক্তিগত জগতে দারুণ জীবন উদযাপন করে কিন্তু বাস্তবে ফিরতে গেলে নঞর্থক মার্তৃ গূঢ়ৈষা-র ড্রাগন তাকে চেপে ধরে। পরবর্তী জীবনে বিশেষ করে 30 বছর বয়সে পর তাকে তার মনোপরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতেই হয় বাস্তবে মাটিতে পা রাখার জন্য কারণ পলায়নের পথ আর নেই।
এসব ক্ষেত্রে আমি বিমানের বা বায়ুযানের রূপক ব্যবহার করি। কারণ অসংখ্য স্বপ্নের আমি এটা পেয়েছি আমার মনে পড়েছে এক তরুণের স্বপ্নের কথা যে সব সময় স্বপ্নে দেখত যে সে একটি ছোট বিমান চালাচ্ছে। যেখানে মাত্র দুটি আসন আর তার আসনের পাশে দ্বিতীয় আসনে রয়েছে একটি ঝমঝম শব্দ করা অস্থি পূর্ণ কফিন। এটি আসলে তার ব্যক্তিত্বের অর্ধেক অংশ যা তার মা হত্যা করেছে। বিমানটিকে মাটিতে নামাতে পারছে না যতক্ষণ না তার ব্যক্তিত্বের অর্ধেক সত্ত্বা ওই কফিনের মধ্যে পুনর্জীবিত হচ্ছে। পুরো অভিজ্ঞতাটাই ভীষণ দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক।
মা তার সন্তানের সৃজনশীল কল্পনাসমূহকে হত্যা করে হয় কিছু না বুঝে উঠতে পেরে নয় জাদু মন্ত্র ইত্যাদির প্রতি ভয় কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুত্রের সৃজনী সত্ত্বা এবং পৌরুষের প্রতি ঘৃণার জন্যে।
একবার ভাড়া বাড়িতে বাস করাকালীন আমি তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিবারকে প্রতিবেশী হিসেবে পাই। মা মহিলাটি ছিলেন অশ্লীল স্থূলকায়া যিনি একটু বেশি বয়সে বিবাহ করেন ও ৩৮ বছর বয়স পেরিয়ে একটি পুত্রের জন্ম দেয় যে কেউ দেখলে বুঝতে পারত যে মা ওই অসহায় জীবটিকে রোজ খেয়ে ফেলছে। কিন্তু এসব ব্যাপারে নাক গলানো উচিত নয় ভেবে ওই বাড়িতে কি চলছে তা আমি দেখেও না দেখার ভান করতাম। একদিন শুনতে পেলাম মা ছেলেটিকে পিটাচ্ছেন আর ছেলেটি চিল চিৎকার করে কাছে। আমি আর স্থির থাকতে না পেরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ছেলেকে তিনি কেন মারছেন? মা ক্রুদ্ধ স্বরে বলল যে, ছেলেটি একটি জল ছিটানোর পিচকারী চেয়েছিল ক্রিসমাসের সময়ে। তিনি তা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন “কেবলমাত্র বসন্ত কালে বাগানে এটি ব্যবহার করবে অন্য কোন সময় বা বাড়ির ভিতর অন্য কোথাও না”। “কিন্তু ভাবতে পারেন যেই আমি আজ একটু বাড়ি থেকে বেরিয়েছি ওই পিচকারী নিয়ে জল ভরে কার্পেটের ফুল গুলোতে জল ছিটিয়ে ভিজিয়েছে”। এবার আমি মহিলাকে বললাম “দেখুন এইসব জল ছিটানোর বুদ্ধি আপনি ওর মাথায় প্রথমে ঢুকিয়েছেন। এছাড়াও বাচ্চারা এরকমটা করবে এটাই স্বাভাবিক এর জন্য আপনি ওকে ধমকাতে পারেন না”। মহিলা এবার বলে উঠলেন “এটা যদি স্বাভাবিক হয় তাহলে তো ১৬ বছর বয়সেই ও মেয়েদের চুমু খাবে”।“পাঠক ভাবুন একবার ওই মহিলার আজব চিন্তাভাবনা পিচকারী থেকে কোথায় গিয়ে পৌঁছালো”! “এই পিচকারী শিশুটির প্রথম জীবনের পৌরুষ ও তৎসংক্রান্ত সৃজনশীল কল্পনা শক্তির প্রতীক। মহিলা এটিকে ঘৃণা করেন। এটাকে গোড়াতেই ধ্বংস করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন কারণ তিনি মনে করেন এটাই একদিন তাঁর পুত্রকে তাঁর থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবে। ৩-৪ বছর বয়সেই এটাকে শেষ করে দিতে পারলে ১৬ বছর বয়সে এই শক্তির আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ছেলেটির যখন ৩২ বছর বয়স তখনও সে অতিবাহিত। বিবর্ণ তার মুখমণ্ডল। একটি ব্যাংকে সে কাজ করে, কাজের শেষে বাড়িতে সে মায়ের কাছে বসে থাকে। রাস্তায় তাকে দেখতে পেলেই আমি ভাবি “হে ভগবান! আমি জানি এমন ওর হল কীভাবে”।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন