![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
যে রিপু সারে না
বাঁ হাতের কালীমন্দির ছেড়ে স্যাট করে ডানদিকে ঘুরতেই মোড়ের মাথার দেখা মিলল। এবার চারপাশ ভাল করে দেখে নিয়ে পা বাড়াতে হবে। এসব রাস্তা সনাতনের হাতের তালুর মতো চেনা। বাঁদিক দিয়ে এগোলে সোজা দত্তদের আমবাগানে গিয়ে রাস্তা শেষ হয়। ডানদিক ধরলে বাজার পেরিয়ে হেলাবটতলা। তার পরেই বনবাদাড়ে ভরে থাকে জায়গাটা। বাজারের পর থেকেই জায়গাটা ছমছমে। দিনমানেও এসব রাস্তা নিঝুম থাকে। রোজের হালকা আলোয় চারদিকে দ্রুত চোখ বোলাল সনাতন। কেউ ঘাপটি মেরে নেই তো? সনাতন জানে আজ ওর টিকির হদিশ মেলাও খুব দুষ্কর, যেভাবে ছক সাজিয়েছে তাতে কাজ সেরে ফেলা যাবে রাতের মধ্যেই। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। তবু সাবধানের মার নেই। দূরে একটা সাইকেল দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুতভাবে ঝুঁকে পড়ে চালাচ্ছে কেউ। এভাবে চালানোটা কোথায় যেন দেখেছে? নামটা ঝিলিক দিয়ে উঠল মাথায়। শিবে। ছেলেটার ডান হাত বাঁ হাতের চেয়ে ছোট। নিজের হাতে করে চেলেটাকে গড়েপিটে নিয়েছিল সনাতন। বিশ্বস্ত ভাবত। ডান হাতটা ছোট হলে কী, ছেলেটার ওই হাতটাই চলত তরোয়ালের মতো। সেটা দেখে অনেক গোপন কৌশলও শিখিয়ে দিয়েছিল ওকে। ভেবেছিল, সনাতন বড় দাঁও মারতে এদিক-ওদিক গেলে এদিকের ডেরার কাজ। ছেলেটাই সামলে নিতে পারবে। তবে সব কাজ আর ভাবনা তো একলাইনে খাটে না। শিবের বেলাতেও খাটেনি। সদ্য টাকার লোভে নাকি ও দল পাল্টেছে বলে খবর আছে সনাতনের কাছে। শিবের ঘটনার পর আর কেউ দল ছাড়লে আফসোস হত না সনাতনের। এখনকার ছেলেদের বেশি মালের লোভ থাকবেই। আর এই লাইনেও যা কম্পিটিশন। ও যখন এলাকায় ছিল তখন এসব দল ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারত না। ওই উঠতি দলটা আজও ওর জন্য কুকুরের মতো ওত পেতে আছে। একদিন ওদের হাতের গ্রাস কেড়ে নিয়েছিল সনাতন। পুলিশ ছাড়লেও ওরা ছাড়বে না।
সাইকেলটা স্যাঁত করে বেরিয়ে গেল
সনাতনের সামনে দিয়ে। একবার এদিক পানেই দেখল না? এত রাতে কেন যায় ও? গায়ের চাদরটা
গুটিসুটি মেরে আরও গুটিয়ে নিল সনাতন। মাথা মুড়িয়ে নাক অবধি ঢাকা। দেখা যাচ্ছে শুধু
চোখ দুটো। ইচ্ছে করেই জুতো পরেনি আজ। সে। এমনিতে খালি পায়ে হাঁটাচলার অভ্যেস ওর আছে।
মানুষের পা-কে বিড়ালের পায়ে পরিণত করা ওকে অনেক কসরত করে শিখতে হয়েছে। কীভাবে দৌঁড়লে
আওয়াজ হয় না, তা-ও জানতে হয়েছে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। সে বিদ্যে মাঝেমধ্যেই কাজে
লাগে। তবে এসব প্র্যাকটিস একবার কমে গেলে আয়ত্তে আসতে চায় না সহজে। তাই চার বছর পর
আজ ওকে বেশি সজাগ থাকতে হচ্ছে। একবার চোখ তুলল সনাতন। মাথার উপর একটা অশ্বত্থ গাছ।
ঝুরিটুরি নামিয়ে দেওয়াল হয়ে আছে। এখান থেকে মোড়ের মাথাটা দেখা যায়। এর পিছনে দাঁড়িয়ে
থাকাই নিরাপদ। সহজে চোখে পড়বে না। রাত ক’টা হবে এখন? ঘড়ি ছাড়াও সময় মাপতে জানে
সনাতন। তবে কিছুই এমনি এমনি একদিনে শেখা যায় না। এসবও অনেক সময় নিয়ে হাতে ধরে শিখিয়েছিল
এর শুরু। সনাতনও ছিল চোস্ত ছাত্র। এসব কৌশল শিখে নিতে ওরও বেশি সময় লাগেনি। আর যত
দ্রুত পেরেছে সেসব অ্যাপ্লাই করেছে কেরিয়ারে। এই যেমন পায়ের হিসেবে যেমন দূরত্ব মাপা
যায়, তেমন সেই উপায়েই কী করে সময় মাপতে হয় সে বিষয়ে সনাতন বিশেষ দড়। মনে মনে
হিসেব কষে দেখল, রওনা দেওয়ার সময় থেকে যত পা হেঁটেছে, যত পা দৌড়েছে, তা নিয়ে হিসেবটিসের
কবলে ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গিয়েছে। তার মানে এখন আড়াইটে প্রায়। বিলুর আসার সময় হয়ে
এল। নীপার খবরটা ওকে বিলুই দিয়েছে। সরাসরি পায়ে হেঁটে নয়, খুব কাঠ খড় পুড়িয়ে
খবরটা সনাতনের কাছে এসেছে। আজকাল ভিতরে থাকলে খবরটার পাওয়াও খুব একটা সহজ হয় না।
আগেকার চেয়ে ব্যবস্থা কড়া হয়েছে। তবু সনাতন গুস্তাদের কাছে সব ব্যবস্থাই মামুলি।
আলোর চেয়েও ওর মাথা জোরে চলে। অসুবিধেকে কী করে সুবিধে করে নিতে হয় সেসব সনাতনের
বাঁয় হাতের খেল।
কথাটা ভেবেই ফিক করে হেসে ফেলল
সনাতন। এর গুরু বলত, ওর যা গুণ, আরও বড় লাইনে যাওয়া উচিত ছিল। উচ্চাশা যে সনাতনেরও
ছিল না তা নয়। দু’-একবার অন্যরকম বড় দাও এসেও ছিল। সেসব ঠিকঠাক সালটেও নিয়েছিল সনাতন।
তবে ওই যে নীপা। ও খুব একটা চাইত না সনাতনের এদিক-ওদিক যাওয়া। অশান্তি করত হেব্বি।
বরং চাইত, এখানে থেকেই বড় আরও দাঁও ঝাড়ুক সনাতন। কিন্তু সেসব তো মেয়েপাচার, নইলে
হেরোইনের চক্কর। ধ্যার। এতে কাঁচা টাকা বেশি ঠিকই, কিন্তু ওসব সনাতনের পোষায় না। এমনিতে
সনাতনদের লাইনটাই কাঠখোট্টার। খুব বেশি দয়া-মায়ার চাল এখানে নেই। তবে সনাতন লক্ষ
করে দেখেছে, সকলের সঙ্গে একরকম হলেও নীপার সঙ্গে ও কিছুতেই কড়া হতে পারে না। মেয়েটার
মধ্যে কেমন একটা রমকছমক আছে। সনাতনের প্রেমিকাকে
এসবই মানায়। আজকাল মাঝে মাঝেই মেয়েটার মুখটা ঝাপট মারে সনাতনের মনে। অন্য অনেক অসুবিধার
মধ্যে এটাও একটা। কতদিন মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়নি! একটু পরেই দেখা হবে ভেবেই এত টেনশনের
মধ্যেও কোথাও একটা হাওয়া খেলল যেন।
বিলুর মাধ্যমে সেদিন খবরটা শুনেই ভেবলে গিয়েছিল সনাতন। এসব খবর শুনে চুপ করে থাকা যায় না, নিজের হলে যাও বা নীপার হলে কখনওই নয়। এদিকে হাত একদম ফাঁকা। বাইরে থাকলে যাও বা এটা-সেটা আনশান করে দু’পাত্তি কামানো যেত, এখন সেসব পথও বন্ধ। হাতে খুব বেশি সময়ও নেই বুঝে তখনই ছক কষে ফেলেছিল সনাতন। দিন কয়েকের মধ্যেই ছেলে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল বিলুকে। বুঝিয়ে দিয়েছিল কী করতে হবে। সেও খুব সাবধানে, অনেক খেটেখুটে। আজ একটু টেনশন হচ্ছে বইকি। এই প্রথম কোনও কাজে ও বিলুর সঙ্গে নেই। ওর ছক মেনে কাজটা ঠিকঠাক করতে পারবে তো বিলু? দূরে একটা ছায়ামানুষ দেখা দিতেই উশখুশ করে উঠল সনাতন। বিলুর হাইট, হাঁটার ধরন, হাঁটতে হাঁটতে হাত দোলানোর কায়দা — সব সনাতনের মুখস্থ।
তাই ছায়ামানুষটা দেখেই নিশ্চিন্ত
হয়েছে মনে মনে। মোড়ের মাথায় হালকা আলোয় ছায়াটা এসে দাঁড়ালে সনাতন হালকা আওয়াজ
দিল, ‘এদিকে, অশথের পিছনে আয়।’ কাছাকাছি পৌঁছতে সনাতন দেখল বিলুর মুখে দিন তিনেকের
না কাটা দাড়ি বাদ দিলে চেহারাটা এই ক’বছরে খুব একটা বদলায়নি।
কত কথা মনে পড়ছে সনাতনের। শুরুর
দিনগুলো। শিবুর অনেক আগেই বিলু ওর সঙ্গে ভিড়েছিল। গায়ে গতরে শিবুর মতো এক্সপার্ট
না হলেও ছেলেটার মাথা ঠান্ডা। দায়িত্ব দিলে কাজটা ফতে করে আনতে পারে। যেটুকু যা আটকায়
সেটা এই দৌড়ঝাপের কাজে। তাই দলে বিশেষ কিছু দায়িত্ব পেত বিলু। মাথাটা খোলতাই হওয়ায়
খবরটর আনা-নেওয়ায় ও ছিল সনাতনের ডান হাত। কত বেইমানি দেখেছে এ লাইনে সনাতন, তবু বিলু
ওকে ছেড়ে যায়নি কখনও। সনাতন না থাকায় এখন দলটাই ম্যাদামারা হয়ে গিয়েছে। বিলুরও
অবস্থা পড়ে গিয়েছে। এলাকা ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে এটা-সেটা করে কাজ চালাচ্ছে বলে শেষ
খবর পেয়েছিল সনাতন। নতুন দলটা নাকি ওকেও ভাঙিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ও যায়নি। ফেঁসে
যেতে পারে জেনেও বেঁকে বসেছিল। এমনিতেইও দলটার প্রতি ওর হেবি খার আছে। বিলুর জন্য তাই
গব্ব হয় সনাতনের। ছোটবেলায় ওর এক অঙ্কের মাস্টার ছিল। যদিও লেখাপড়ায় খুব একটা মতি
কোনওকালেই ছিল না সনাতনের। তবু মা চেষ্টাচরিত্তির করে একজন মাস্টার দিয়েছিল সনাতনকে।
এইটের পর মা মরে যেতে সেসব পাট চুকেবুকে গেছে। সেই মাস্টার ওকে মাঝে মাঝেই বলত, ‘বুঝলি
সনাতন, বেইমান ভাল ছাত্রের চেয়েও অশিক্ষিত বিশ্বাসী ছাত্র মাস্টারদের জীবনে খুব দরকার
রে ব্যাটা। শিক্ষা দেওয়ার আনন্দের চেয়েও মানুষ করার আনন্দ অনেক বেশি।’ মাস্টারের
সব কথা ওর ঘিলুতে কোনও কালেই খুব একটা ঢুকত না, সে তো কত কিছুই ঢোকে না, তাতে কী? শুনতে
বেশ লাগত। এই যে এখন রোজ সকালে ওদের কাগজ পড়তে দেওয়া হয়, তাতে কত কিসিমের কত কথা
লেখা থাকে, কত দেশ-বিদেশের নেতাদের নাম — সব কি সনাতন বোঝে? বেশি শক্ত। বানান দেখলে
পড়েও না। তবু নাড়াচাড়া করতে ভাল লাগে সকালের কাগজটা, তাই ওল্টায়। মাস্টারের কোনও
কথা না বুঝলেও এই কথাটা এখন হাড়ে হাড়ে বোঝে সনাতন। হাজার হলেও সেও তো এখন মাস্টার।
‘গুরু, কাজ হাসিল। এই নাও।’ ভাঙা
ভাঙা গলায় ফিসফিসিয়ে বলল বিলু। ।
কাজটা তাহলে শেষ অবধি করে ফেলেছে
বিলু, আর করেছে সনাতনের সঙ্গ ছাড়াই। যাক, ছেলেটাকে তবে এ ক’দিন ঠিকঠাক লাইনে আনতে
পেরেছে সনাতন। অনেক দিন পর বিলুর মুখে ‘গুরু’ ডাকটা শুনে একটু থমকাল সনাতন। গলার কাছে
কী যেন দলা পাকিয়ে আসছে ওর গুরুসত্তাই ফাল দিয়ে উঠল যেন। ফাঁকা রাস্তায় বিলুকে হঠাৎ
জড়িয়ে ধরে বুঝল, চোখটা চিকচিক করছে।
‘গলা ভাঙলি কী করে বে, ঠান্ডা লাগিয়েছিস?’
নরম গলায় বিলুকে জিজ্ঞেস করল সনাতন।
‘আমাদের আবার ঠান্ডা-গরম! আজ একটা
বিলা হতে যাচ্ছিল। পরে বলব তোমায়।’
বিলার কথায় নিমেষে শক্ত সনাতন।
শিবে হারামজাদাটাকে দেখলাম। এই রাস্তা ধরেই সাইকেলে গেল। দেখতে পায়নি, কিন্তু আর একটু
হলেই...।
শিবের সঙ্গে ওর দেখা হওয়াটাও মুখ
ফসকে বলেও ফেলতে যাচ্ছিল সনাতন। কোঁত করে গিলে ফেলল। থাক, ছেলেটা এসব শুনে সঙ্গে জুটে
যেতে চাইলে আরও বিপদ। আজ বেশি ঝামেলা চায় না সনাতন। এমনিতেই আজকের বেরনোটা খুব ঝুঁকির,
তায় আবার খালি হাতে বেরতে হয়েছে। আজ বেশি লোকফোকে কাজ নেই। ঠান্ডা মাথায় কাজ সেরে
পিঠটান দিতে হবে।
‘কাজ সেরে কোথায় যাবে?’ শব্দ আর
ইশারা মাখিয়ে কথাটা বলল বিলু।
‘দেখি।’
‘দেখো ওস্তাদ, বেশি রিস্ক না হয়ে
যায়। সেদিন বারবার খবর পাঠালাম, বললাম, আমাকে সঙ্গে নাও। শুনলে না। এমনিতেই ধরা পড়লে
কিন্তু হেব্বি কিচাইন হবে।’
বিলু ওকে ভালবাসে তা জানে সনাতন।
ওর কাঁধে হাতটা রেখে একটু হাসল শুধু। তবে বিলুর চিন্তাটা দেখে হাসি পেয়েছে সনাতনের।
ওদের জীবনটাই এমন। বাড়ির লোকজন চিন্তা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ভাবা বন্ধ করে
দেয়। টুকটাক যত্নআত্তি, ভাবনা-চিন্তা যেটুকু তা দলের ছেলেরাই করে। চার বছর আগে কালীপুজোর
রাতটা চোখের সামনে ভেসে উঠল ওর। রতনের দলের হাত থেকে বিলুর বোনকে বাঁচাতে গিয়েই নিজের
বিপদটা ডেকে এনেছিল সনাতন। দলের ছেলের বিপদে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। এমনিতেই ফিসফিসে
আওয়াজ রাতদুপুরেও ভাল নয়। হাওয়ারা সব ফিসফিসানি অন্ধকারে টেনে নিয়ে যায় অনেক দুর।
সেদিনের ফিসফিসে ক’টা কথার জন্যই তো আজ সনাতনের এই হাল। নইলে শালা পুলিশের বাপের ক্ষমতা
ছিল ও কোথায় তা জেনে ফেলা!
নিজের চটক নিজেই কাটাল সনাতন। এখানে
বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। বিলুকে ইশারায় চলে যেতে বলে টাকা ক’টা কোঁচরে গুঁজল।
এবার সটান নীপার বাড়ি। এখান থেকে একটু জোরে হাঁটলে মিনিট পনেরো। কিন্তু না, জোরে হাঁটা
যাবে না। লুকিয়ে চুরিয়ে হাঁটতে গেলে তিরিশ মিনিট কাবার হয়ে যাবে। মানে সাড়ে তিনটের
কাছাকাছি। আবার হিসেব কষে নিল সনাতন। নীপার সমস্যাটা শুনেছিল, তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে
পারেনি সনাতন। রীতিমতো লাইফ রিস্কের এই মোক্ষম চালটা বাছতেই হয়েছিল ওকে। প্ল্যানটা
জেনে আঁতকে উঠেছিল বিলু। কায়দা করে যোগাযোগ করে ভয়টা জানিয়েওছিল। একটা মেয়ের জন্য
গুরু এত বড় ঝুঁকি নেবে এটায় রাজি ছিল না বিলু। শেষে গুরুর আশ্বাস আর কাজ সালটানোর
কায়দায় ভরসা আছে বলে আর কথা বাড়ায়নি।
সনাতন নীপাকে শেষ দেখেছে আজ থেকে
চার বছর আগে। নীপা টেন পাশ । মায়, কপালে একখানা পাশ আছে। সিক্স ফেল সনাতনের সঙ্গে
আলাপ হওয়ার কথাই নয়। কিন্তু ওই যে ভবিতব্য! কখন কাকে কার সঙ্গে জোড়ে ভগাও জানে না।
ও আর নীপাও সেভাবেই জুড়ে গিয়েছিল এক সময়। এসব লাইনের রিস্ক নীপা জানে। বরং অনেক
কাজ সারতে যাওয়ার আগে এর সঙ্গে পরামর্শ করে দেখেছে মেয়েটার মাথাটা বরফের মতো ঠাণ্ডা।
সনাতন মনে মনে ভরসা পেত, যাক, শালা আমি মরলেও দলটা উঠে যাবে না। আজ যখন নীপার সঙ্গে
দেখা হবে, প্রথম কী বলবে নীপা। চোখে জল আসছে সনাতনের।
খুট করে দরজাটা খুলে গেল। সনাতনের
কথা মতো বিলু কালকেই খবর দিয়ে রেখেছে। দরজা ঠেলে ঢুকেই দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করল
সনাতন। ঘরের হালকা আলোয় ডুরে শাড়ির নীপা যেন আরও মায়াবী। চার বছরে আরও ঢলঢলে। ঘরে
ঢুকেই আগের মতো গন্ধটা পেল সনাতন। নীপার গায়ের গন্ধ। এখনও একই আছে। সব ভুলে দীপার
কোমর জড়িয়ে বুকে মুখ গুজল সনাতন। ঘড়িতে টিক টিক ছাড়া সব নিস্তব্ধ। সময় কমে আসছে।
যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। আবেগ সরিয়ে কাজে মন দিতে হবে এবার। নীপার হাতে টাকা ক’টা
গুঁজে দিয়ে বলল, “একটায় টেস্টকেস্ট ওষুধষুধ সব হয়ে যাবে। আপাতত চালাও। ভয় পেও না,
বাবা ভাল হয়ে যাবে। আমি তো আছি।”
কেমন একটা অবিশ্বাসের চোখ নিয়ে
যেন তাকিয়ে আছে নীপা। কিছুতেই আসতে পারবে না ভেবেছিল নাকি। নাকি টাকা কোত্থেকে পেল
ভাবছে! হাহ্। প্রেমিকার বিপদ শুনেও কোনও উপায় বের করতে পারবে না — সে বান্দা সনাতন
মিত্তির নয়। আরও একবার নীপার হাতটা ভুল সনাতন।
“আমি পারি না এমন কিছু নেই নীপা।
টাকা ক’টা বিলুকে দিয়েই....। ক টা দিন যাক, তোমাকে খবর দেব ঠিক সময় এবার নীপাও হাসল
পালটা হাত রাখল হাতে।
সেটা দেখেই বুকটা ছমছম করে উঠল সনাতনের। এবার জায়গাটা ছেড়ে যেতে হবে। আলো ফোটার আগে এখান থেকে কাটতে না পারলে বিপদ আছে। নীপার কপাল থেকে চুলের গোছা সরিয়ে বলল, "তদ্দিন সাবধানে থেকো। যাই।”
অন্ধকার গলি পেরিয়ে বড় রাস্তা
দিয়ে খানিক এগোতেই গতিক সুবিধের ঠেকল না সনাতনের। নীপার বাড়িটা গলির শেষপ্রান্তে,
সেখান থেকে বড় রাস্তা খুব ভাল দেখা যায় না। কিন্তু আসার সময় তো এতটা অস্বস্তি হয়নি।
নাকি এখনকার মতোই সব ছিল, মাথার মধ্যে নীপানাম ঘুরছিল বলে টের পায়নি সনাতন। ভর অভিজ্ঞ
মাথা বলছে, চারপাশে কেউ আছে। কিন্তু সংখ্যাটা এক না একাধিক। মানুষের শ্বাসের ওঠাপড়াও
সনাতন বুঝতে পারত আগে। চার বছরে অনেক বিদ্যেই অভ্যাসের অভাবে কানা হয়েছে টের পায়
আজকাল। তবু আরেকটু কান খাড়া করল সনাতন। চকিতে ভেবে ফেলল প্ল্যান-বি। ও জানে, এসব কেসে
যত বেশি রিস্ক তত বেশি প্ল্যান হাতে রাখতে হয়।
বড় রাস্তার পাশের ঝোপটা দেখেই
পছন্দ হয়ে গিয়েছিল সনাতনের। কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকার জন্য আদর্শ জায়গা। ধীরে-সুস্থে
আঁচ বুঝে ভোরের আলো ফোটার আগে কেটে পড়তে পারলেই হবে। সকাল হলেই খোঁজ খোঁজ শুরু হয়ে
যাবে সনাতন জানে। ওর মনটা এখন অনেক ফুরফুরে। যে কাজটায় বেরিয়েছিল, সেটা ফতে করা গিয়েছে।
আহা রে! টাকা ক’টা হাতে না পেলে নীপার খুব বিপদ হয়ে যেতে পারত। থাক, এবার অন্তত বাবার
ওষুধষুধগুলো কিনতে পারবে। মা মরা মেয়েটার বাপ ছাড়া তো কেউ নেই। কবে যে মেয়েটাকে
নিজের কাছে এনে রাখতে পারবে সনাতন। এসব ভাবলেই বুকটা টনটন করে ওঠে।
ঝোপের আড়ালে কতক্ষণ কেটেছে কে
জানে। অস্বস্তিটাও কাটছে আস্তে আস্তে। হয়তো কেউ ছিলই না। অনেকদিন পর অপারেশনে বেরিয়েছে
বলে মনটা একটু বেশিই কু ডেকেছে হয়তো। আলো ফোটার অপেক্ষায় আকাশটা কেমন কালচে লাল মেরে
আছে। ঝোপটা ছেড়ে চুপচাপ বেরিয়ে এল সনাতন। এসব রাস্তায় পুলিশি টহল থাকে না। তবু পা
চালাতে হবে যতটা পারা যায়।
তেরচাভাবে রাস্তাটা পেরোতে যেতেই
নিমেষে অনেকগুলো টর্চ লাইটের আলোয় ঝনঝন করে উঠল চোখ। প্রতিবর্তর অঙ্কে উলটো মুখে দৌড়
শুরু করতেই সনাতন টের পেল সেখানেও আলো। ডান-বাঁ সব দিকে। ছায়া ছায়া মানুষগুলোর হাতে
নানচাকু আর হকিস্টিক। অন্ধকারটাও অনেক আগেই চোখ সয়ে এসেছিল, মুখগুলো অবছা দেখা যাচ্ছে।
ভিড়ের মধ্যে দু’চারটে মুখ চিনতে পেরেই সনাতন বুঝল, হারামিগুলোর হাতে ধরা পড়ে গিয়েছে।
আর কোনও উপায় নেই। তবু বুদ্ধি ফসকালে চলবে না। এভাবে ধরা পড়ার কোনও মানেই হয় না।
ভড়কি দিয়ে একটু একটু করে এগোতে এগোতে হাতের প্যাঁচে ঝটিতি সামনের কয়েকজনকে শুইয়ে
দিল ও। ধস্তাধস্তিতে ওর নাগালেও একটা হকিস্টিক এসে গিয়েছে এখন। একেবারে নিরস্ত্র থাকার
চেয়ে লড়াইটা একটু সোজা এবার। ওরা যে বাধা দেয়নি তা নয়, কিন্তু সমর ওস্তাদের চেলা
ও। প্যাঁচে ওর সঙ্গে এঁটে ওঠা অত্ত সস্তা নয়। নানচাকুর ঘায়ে বাঁ দিকের গালটা কেটেছে
মনে হচ্ছে, জায়গাটায় ঘাম লেগে জ্বালা করছে। কিন্তু ওসবে মন দেওয়ার সময় নেই এখন।
সামনের আরেকজনকে উল্টে দিয়েই সোজা হয়ে দাঁড়াল। লাইনে আসা ইস্তক শেখা শরীরের সব প্যাঁচকে
একজায়গায় করে সদ্য জেলভাঙা আসামি সনাতন মারল আচমকা একখানা মারণঝাঁপ। এই কাটার জন্য
বোধহয় ছেলেগুলোও রেডি ছিল না। চোঙা প্যান্টের ছেলেগুলোর হাত থেকে ও এখন বেশ দূরে।
ওরা হল্লা করতে করতে ছুটে আসছে। কয়েক পা ছুটে না এলে ওকে ধরা এখন অসম্ভব। ওহ্! বিপদটা
পেড়েই এনেছে প্রায়। মানুষের পা-কে নিমেষে চিতার পায়ে নিয়ে গেল সনাতন। তীরবেগে দৌড়তে
পারলে আজকের রাতটা নিরাপদ। পায়ের পেশি টান করে দৌড় শুরু করতে না করতেই হোঁচট।
কে ও!
চোখা কায়দায় সটান ওর দিকে বন্দুক
তাক করে আছে শিবে! সঙ্গে আরও তিনজন। সনাতনের সব পালানোর পথ বন্ধ। চোস্ত হাতে ট্রিগারে
চাপ দিচ্ছে ছেলেটা, ঠিক যেভাবে সনাতন ওকে শিখিয়েছিল। ভোর ফুটছে। নীপার ঘামে ভেজা মুখটা
শেষবারের জন্য মনে পড়ল সনাতনের। মেয়েটাকে কে দেখবে এবার! গুলিটা সনাতনের মাথা তাক
করে ছুটে আসছে দ্রুত।
ঠিক ততটাই দ্রুত, যতটা দ্রুত নীপার
ঘরে এখুনি পৌঁছে গিয়েছে শিবে। হাতে একটা প্যাকেট। এমন আনন্দের দিনে নীপা আজ খাওয়াতে
চেয়েছে। ভালোয় ভালোয় কাজ মেটাতে পারলেই যেন শিবে ওর কাছে চলে আসে, এমনটাই কথা হয়েছিল।
সনাতন জেলে যাওয়ার পর থেকেই নীপার সঙ্গে ওর আশনাই শুরু। পছন্দ আগে থেকেই ছিল, শুধু
দলের লিডারের হকের জিনিস নিজের করে নেওয়ার একটু অসুবিধা ছিল। সনাতনকে জেলে ভরার একটা
মওকা খুঁজছিল আগে থেকেই। আর আজকের পর থেকে আর কোনও বাধা রইল না। আজ নীপার জন্যই দলে
ওর প্রোমোশন বাঁধা। লিডার নিজে আজ অপারেশনের ছক সাজিয়েছে। সনাতনের সব তেল নিংড়ে নিয়েছে
ও। নাহ্ মেয়েটার এলেম আছে। যেমন বিছানায়, তেমন বুদ্ধিতে। খাটে বসেই চকচকে চোখে ছোট-বড়
দু’টো হাত দিয়ে নীপাকে আঁকড়ে ধরল শিবে।
‘ভাগ্যিস! তুমি বিলু হারামিটাকে
নাটক করে কাত করে দিয়েছিলে নীপা। ওহ্, কী একটা প্ল্যানই না বানালে মাইরি! পুরো মাখন!’
শিবের হাতের বেড় ছাড়িয়ে মুখ
টিপে হেসে রান্নাঘরে উঠে গেল নীপা। শিবে এখন দু’-তিন পাত্তর বাংলা খাবে। নীপাকেই বানিয়ে
দিতে হবে তা। এই দলটার লিডার হারার দেওয়া চিঠিটা পরশু রাতেই হাতে এসেছে নীপার। পড়েছে
ও। লোকটার এখন যেমন তাখত, তেমন পয়সা। ওরও যে নীপার প্রতি নজর আছে, তা তো জানত না!
জেনেছে পরশু রাতে। এ সুযোগ বয়ে যেতে দেওয়া যায় না। সনাতন চলে যাওয়ার পর এতদিন বড্ড
কাঁচা পলকা ডালে ঘুরতে হচ্ছিল ওকে।
শিবের প্রিয় লালচে তরলের গ্লাসে
সেঁকো বিষের শিশিটা উপুড় করছে নীপা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন