কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

শৌভিক দে

 

সমকালীন ছোটগল্প


দগ্ধ গাছের ছায়া

দুবার বেজে বেজে মোবাইলটা থেমে গেছে। দুবারই প্রিয়তোষ উঁকি দিয়ে দেখেছে কিন্তু তোলেনি। তৃতীয়বার আবার রিং হতে ওর বন্ধু কাম পার্টনার করঞ্জাক্ষকে মোবাইলটা দেখিয়ে বলল -

- 'দেখ সকাল থেকে পাঁচবার হল। কি করি বলত'?

করঞ্জাক্ষ ঘাড় উঁচিয়ে একবার নামটা দেখল। তারপর হাত উল্টে কাঁধ ঝাঁকাল। কিছু বলল না। প্রিয়তোষ বিড়বিড় করতে করতে কল নিল। আর সঙ্গে সঙ্গে পালটে নিল তার আসল মেজাজ। নকল আবেগ আর  ডগমগ উচ্ছ্বাসে বলল -

-'আরে কাকু কি সৌভাগ্য সকাল সকাল আপনার ফোন। কেমন আছেন। আগেও করেছেন? আচ্ছা! চারবার?  সরি কাকু। মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে ছিল। জানেন তো এত আজে বাজে ফোন আসে আজকাল। না না আপনাকে বলছি না। আপনাকে সে কথা বলতে পারি আমি? বাবার সঙ্গে কত দিনের হৃদ্যতা আপনার। সেই ছোট্টবেলা থেকে আপনার গান শুনে বড় হলাম। যাক গে কি খবর বলুন। নতুন কোন এ্যালবাম বেরোচ্ছে না কি? বেরোলে অবশ্যই বলবেন। সব প্রোমোর দায়িত্ব আমাদের। কি বলছেন ... বেরচ্ছে না? কি যে বলেন আপনার গানের প্রযোজক পাচ্ছেন না। আপনার সেই সব গান ... হ্যাঁ... ডানা মেলো গাঙচিল ... তারপর ধরুন - সাইরেন বেজে যায়... কত বলব। বাবা বলতেন আপনার দেখা পাওয়াই ছিল ভাগ্যের। হ্যাঁ বলুন... কি ... মঞ্চানুষ্ঠান...  মানে মাচা ... আরে সেই তো দুখ: কাকু। বাবার ব্যবসা ছাড়তেও পারি না। ঘরের থেকে জোগান দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছি। কত দিন পারবো কে জানে। কোভিডের পর সেই যে সব এলো মেলো হয়ে গেছে এখনো বাজার শুধরোল না। আপনাকে তো যে সে স্টেজ দেওয়া যায় না। আচ্ছা দেখছি কাকু। কাউকে যদি পাই। আর সব ... শরীর ঠিক আছে তো? গলা? এই শীত পড়ো পড়ো হলেই সবার আগে গলার বারোটা বাজে। সাবধানে থাকবেন কাকু। কিছু খবর থাকলেই ফোন করব। এখন রাখি? ভালো থাকবেন'।

ফোনটা কেটে 'ওওওওওফ' বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল প্রিয়তোষ। এতক্ষণ এই একতরফা আলাপ শুনে মিটিমিটি হাসছিল করঞ্জাক্ষ, এবার হাসিতে ফেটে পড়ল। যোগ দিল প্রিয়তোষ। তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাঝারি অফিস ঘরের দেওয়ালে ঝুলানো সাম্প্রতিক নামী শিল্পীদের ছবিগুলোও হাসল বোধহয়। তাদের উল্টো দিকে সোফায় ডুবে বসে একজন খবরকাগজ পড়ছিল। সে কিন্তু হাসল না। কাগজটা মুড়ে জিজ্ঞেস করল -

- 'ফোনটা কি রণজয় -'।

- 'বর্মণ। ঠিক ধরেছিস। আরে পাগল করে দিল। বাবার বন্ধু তাঁর উপর অতীতের স্টার। কড়া কথা বলতে পারি না। তোরা - মানে শিল্পীরা ভাবিস একটা অনুষ্ঠানের বন্দোবস্ত করা কোন ব্যাপারই নয়। গেলি -  গান গাইলি - কি বাজালি - পেমেন্ট নিলি - ব্যাস। আমাদের মত যদি সমস্ত ঝামেলা মাথায় নিতে হত বুঝতিস তা হলে। একটু নাম হল কি তোদের গুমোর দেখে কে। গান তো গান দু একটা সিরিয়ালে যারা মুখ দেখিয়ে দিয়েছে - তাদের তো চাহিদার অন্ত নেই। একবার দাঁত ক্যালাবে স্টেজে - তো - তার হ্যানা চাই ত্যানা চাই।  দেখ না কোভিডের পর যে কি করে চালিয়েছি। কোন মাচা হয় না, নায়েক ফোন ধরে না। যারা প্রতি বছর এসে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতো স্রেফ ফোন কাটতে লাগল। দু তিন বছর ঘরের টাকা ভেঙ্গে চালিয়েছি। এখন আবার ভগবানের ইচ্ছেয় বাজার একটু গরম হয়েছে। কিন্তু পাবলিকের মুড বোঝা দুষ্কর। এখন আর পুরনো গান শুনবেন না তেনারা। কণ্ঠীদের দিন শেষ। টপ ব্যান্ডগুলো ছাড়া বাকিরা বসে যাচ্ছে। রবীন্দ্র নজরুল কিছুটা খাচ্ছে এখনও। তবে কে জানে কদিন। এখন শুধু সিনেমার গান - হিন্দি বেশী - বাংলা কম। তাই সই। নেহাত বাবার ব্যবসা আর... সত্যি বলতে ... আমরা অন্য কিছু তেমন জানিও না... তাই চালিয়ে যাচ্ছি। ইম্প্রেসারিও হওয়াটা পাপ বিশেষ।

- 'রণজয় বাবুর - রণ অন দ্য রক - বলে যে ব্যান্ডটা ছিল সেটা...'।

- 'রক বটম হয়ে শিঙে ফুঁকেছে। দেখ এই ভদ্রলোক প্রবীণ শিল্পী। খারাপ কথা বলা উচিত নয়। কিন্তু নিজের টপ ফর্মে সবাইকে চটিয়ে রেখেছিল। যাকে যা খুশি বলত। মাচা থেকে দর্শককেও ছাড়ত না। ঘ্যাম আকাশ ছোঁয়া। পারিশ্রমিক আলাদা আর ঢুকুঢুকু আলাদা। তাও আবার সেরা ব্র্যান্ড। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে মঞ্চেই টল টলায়মান। গোসাবায় মার খেতে খেতে বেঁচে গেছল। তারপর থেকেই আর আমরা সাহস করতাম না। তাছাড়া গলাও গেছে। এত অত্যাচার শরীরে সয়। এখন দেখ অনুষ্ঠান ভিক্ষে চাইছে প্রায়'।

- 'গলফ গ্রিনের ফ্লাটেই আছে তো এখনো'?

- 'দূর। বেচে খেয়েছে। এখন এন্টালির দিকে এক কামরার ভাড়া বাড়িতে থাকে। খারাপ লাগে বুঝলি। কিন্তু ভাই জনগণ খুব নির্মম, কাজেই আমরাও...। যাকগে। তুই  তো প্রথম দিকে তবলা বাজাতি ওর সঙ্গে'?

- 'বাজাতাম না। একবার বাজিয়েছিলাম'।

- 'বটে? তারপর'?

- 'যেতে দে। আজ উঠি'।

- ' ঠিক আছে আয়। এক মিনিট - আদিত্য পরশু রবীন্দ্র সদনে কিন্তু ধারালো সাড়ে ছটা... বুঝলি না ...হে হে ... মানে সার্প সিক্স থার্টি। ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবি কিন্তু ভাই। সুরশ্রী ম্যাডাম আবার তবলার ব্যাপারে খুব  খুঁতখুঁতে। তাল টালের গোলমাল হলে ...'।

- 'আমার তাল ভুল হয় না। চলি। পরশু দেখা হবে'।

রাস্তায় নেমে তক্ষুনি বাইকে বসল না আদিত্য। বসল বাঁদিকের বাঁধানো গাছের তলায়। তারপর দুপুরের রোদ শুষে নিল স্মৃতির কুয়াশা। হুহু করে ছুটে গেল সময়ের গাড়ি। পিছিয়ে দাঁড়াল পঁচিশ তিরিশ বছর আগেকার একটি আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে।

বাংলা গানে আশির দশকের শেষ দিকে  একটু ভাঁটার টান এসেছিল। শ্রোতারা কিছুটা দিশা হারা। আধুনিক বা সনাতনী চলছে ঠিকই কিন্তু যেন  শান্ত নদীটির মত। প্লাবন নেই। সেই সময়  'মুখ্য জীবন' বলে একটি বাংলা গানের  সোচ্চার ধারা নিয়ে এলেন কয়েকজন। প্রার্থিত জন জোয়ার ফিরে এলো অনুষ্ঠানে। ক্যাসেট কোম্পানির মুখে হাসি ফুটল আবার। যারা গান বুঝলেই তানপুরা বুঝতেন তারা এবার গিটার ঘাড়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন জলে। বেনো জল মিশল প্রচুর। প্রায় এক যুগ বা তাঁর কিছু বেশী দিন তাতার বাহিনীর মত বাংলা সঙ্গীত সাম্রাজ্য শাসন করলেন তাঁরা। তারপর পিছলাতে পিছলাতে  জন গণেশের মাথা , ঘাড় , কোল, বুক খালি করে নদীর চরে নেমে দাঁড়ালেন। দু এক জন মহীরুহ, দু একটি এরন্ড গাছ,  রয়ে গেলেন ঠিকই কিন্তু বাকিদের মাটি , রং , ভেসে গেল জলে। পড়ে রইল কাঠামো টুকু।  নুনের পুতুলরা মিশে গেল সাগরে।  রণজয় তেমনি একজন - বালুচরে দাঁড়ান - একাকী -  নিষঙ্গ শামুকের ফোঁপরা খোল।

যে সময়ের মঞ্চে এখন মনে মনে দাঁড়িয়ে আদিত্য - রণজয় তখন তার খ্যাতির তুঙ্গ বিন্দু থেকে হাত নাড়ছে উত্তাল শ্রোতা, দর্শকদের। তীব্র ঘূর্ণায়মান আলোর বৃত্তে তার ব্যান্ড 'রণ অন দ্য রক' ক্যাম্প ফায়ারের  শিখার মত স্ফুলিঙ্গ ছিটিয়ে দুলছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত মঞ্চ থেকেই তাদের নিয়মিত গর্জন শোনা যায়। রণজয়ের ইউনিক সেলিং পয়েন্ট ছিল - সময় বুঝে - একটু প্রতিবাদী মোড়ক চাপিয়ে যাকে তাকে অপমান করা। সে সংগঠক, সহশিল্পী, কিশোর কিম্বা প্রবীণ শ্রোতা, যেই হোক না কেন। তার এই ক্যাপসুলে ঢাকা তিক্ত বিনোদন এক শ্রেণীর জনতার খুব পছন্দ ছিল। বাকিরা চুপ করে থাকত। কথায় কথা বাড়ে। ধীরে ধীরে অতীতের দিকপাল সুরকার, শিল্পীরাও রণজয়ের চাঁদমারির বৃত্তে আসতে লাগলেন। এ সবের আক্ষরিক প্রতিবাদ হত ঠিকই। কাগজে কাগজে 'পাঠকের মতামত বিভাগে' শোরগোল পড়ে যেত। তাতে রণজয়ের বিজ্ঞাপন বাড়ত বই কমত না। ঋণাত্মক প্রচারের ঘি আরো সুস্বাদু। তবে তার ঋণ থেকে যায়। ইতিহাস - কালের নিয়মে ফিরিয়ে দেয় সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা বাসিফুল, পচা নারকেল।

এই ধরনের অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি কোন একটি বহুশ্রুত প্রবাদপ্রতিম গান গাইত রণজয়। সুর তাল নিয়ে ছিনি মিনি খেলত। তারপর ঘাড় বাঁকিয়ে শ্রোতাদের জানাত -

- 'মনে করবেন না এ সব আমি গাইতে পারি না। কিন্তু কি হবে আবর্জনা আঁচড়িয়ে। নতুনকে এগোতে হলে পথের জঞ্জাল সরিয়ে - পুড়িয়েই এগোতে হয়। কি ভাই সব... ঠিক বলছি কি না'?

মাইক বন্দুকের ভঙ্গিতে এগিয়ে দিত দর্শকদের দিকে। সেই অপরিসীম ঔদ্ধত্যকেই সংস্কৃতির সাক্ষর মনে করে 'গুরু গুরু' কলরবে গর্জে উঠত জনতা।

তখন নব্য যুবক আদিত্য। তবলিয়া হিসেবে ধীরে ধীরে জমছে বাজারে। টুকটাক বাজাচ্ছে এদিক ওদিক, অল্প নামও হচ্ছে। একদিন রণজয়ের এক অনুষ্ঠানে ডাক পেয়ে হাজির তবলা নিয়ে। বলতে গেলে একটা গানেই বাজাবে। একটি বহু নন্দিত আবহমান গান 'পরদেশী মেঘ, যাওরে ফিরে'। প্রথম দিকের উন্মাদনা শান্ত হলে তার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে সেই গান শুরু করল রণজয়। প্রথম লাইন প্রচলিত সুরে গেয়ে শুরু হল তার নটরাজ নৃত্য। আদিত্য প্রাণপণে ধরে রেখেছে তাল, লয়। সমের মুখে রণজয় ভুল করল ঠিক। তাল কাটল। রাগে আপেল হয়ে গান থামাল রণজয়। যাচ্ছেতাই বকল আদিত্যকে। এরকম তালিমহীন ছেলে কে বা কেন তার সঙ্গে বসান হয়েছে তাই নিয়ে উদ্যোক্তাদের তুলোধোনা করে দিল মাইকের সামনেই। আদিত্যর ভুল ছিল না। কিন্তু খ্যাতির চূড়ায় বসা রণজিৎ কে বলবে সে কথা? সংগঠকদের একজন দৌড়ে এসে তাকে স্টেজে থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে চোরের মত বাড়ি ঢুকল সে।

অবশ্য তার যে খুব ক্ষতি হল এ কথা বলা যাবে না। উল্টে সহানুভূতির খানিকটা জোয়ার পাওয়া গেল। যারা সে সময় রণজিতের অপছন্দের তালিকায় ছিল তারা হল আদিত্যর জোগানদার। বহু চন্দ্র-ভুক অমাবস্যা পেরিয়ে এখন তার নিয়মিত ছাত্র আছে অন্তত গোটা পঞ্চাশ। বিদেশ গেছে। নিজের ফ্ল্যাট। স্ত্রী ও এক সন্তানের খেল ঘর। প্রথম সারির না হলেও মধ্যম মানের বাজিয়ে হিসেবে তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত বলা যায়। আজ জানল রণজয়েরই প্রায় প্রতিমা বিসর্জন হয়ে গেছে বাংলা গানের চালচিত্র থেকে।

আপন মনে একটু হাসল আদিত্য। এবার উঠতে হবে। তাদের পাড়ায় জগ-ধাত্রী পুজোয় তার কিছু দায়ভার থাকে। বিশেষত পুজোর পরে একদিনের বিচিত্রানুষ্ঠানে প্রায় পুরোটাই তার দায়িত্ব। খুব বেশী বাজেটের হয় না। তবু এখনকার রণজয়কে বোধহয় হজম করা যাবে। 'মরা হাতি লাখ টাকা' ধরনের কিছু পেশাদারী মিথ্যাচার করতে হবে। তা হোক। বলতে গেলে তার অপমানেই আদিত্যর ভাগ্যের চাকা ঘুরেছিল। এখন কিছুটা গুরু দক্ষিণা দেওয়া যেতেই পারে। করঞ্জাক্ষর থেকে পরশু রণজিতের ঠিকানাটা জেনে নিতে হবে।

বিচিত্রানুষ্ঠানের শেষ শিল্পী হিসেবে রণজয়ের নাম বেশ কায়দা করে ঘোষণা করেছিল তাদের পাড়ার ঘোষক। এটা রণজয়ের অহংকে একটু সুড়সুড়ি দেবার জন্যে। তবে আসল কারণ - যদি ভালো না লাগে তবে দর্শক যেন বাড়ি চলে যেতে পারে। হই হল্লার গল্প নেই। ব্যান্ড ভেঙ্গে গেছে। নিয়মিত সহশিল্পী ও কেউ নেই। সবই আদিত্য জোগাড় করে দিয়েছে। এমন কি ছোট একটা পাইন্ট ও। তবলা অবশ্য ও নিজেই বাজাবে, নিখরচায়।

সেদিন বহু খুঁজে রণজয়ের এন্টালি এক কামরার ফ্লাটে গিয়েছিল। ছেঁড়া পাঞ্জাবীতে অপ্রস্তুত রণজয় তাকে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে দিয়েছিল বসার জন্যে। আদিত্যকে সে চিনতে পারেনি। চেনার কথাও নয়।  চারিদিকে তাকিয়ে বেশি ক্ষণ বসার ইচ্ছে হয়নি। তাই তাড়াতাড়ি কাজের কথা আর পারিশ্রমিক ফয়সালা করে উঠে এসেছিল আদিত্য। আসার আগে মনে করিয়ে দিতে ভোলেনি তার প্রিয় 'পরদেশী মেঘ' গানটি যেন অবশ্যই থাকে উপস্থাপনায়।

আদিত্য বুঝতেই পারেনি তিরিশ বছর আগেকার অপমান এখনো ধিকি ধিকি ছিল বুকের ভিতরে। এত দিনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে আবার। কাজী সাহেবের 'পরদেশী মেঘ' - 'আদ্ধা' তালে গাইবার কথা। মনে হয় যেন তিন তাল। দুজনেই ষোল মাত্রার। কিন্তু আদ্ধার ক্ষেত্রে সূক্ষ তফাৎ হল প্রতিটি বিভাগের তৃতীয় মাত্রায় কিছু নেই, সামান্য শূন্যস্থান। প্রথাগত শিল্পীরা ত্রিতালকে মান্য করে আদ্ধাতেও ফাঁকটি মিলিয়ে নিতে পারেন।  কিন্তু আদিত্য নিশ্চিত জানে সেটা সনাতন সঙ্গীতের তীব্র বিরোধী - রণজয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তার তাল সেদিনও কেটেছিল, এবারেও কাটবে। কিন্তু এবারে - আদিত্য আর ভুল করবে না। পরিষ্কার মাইকে জানিয়ে দেবে ভুলটা রণজয়ের আর সে 'আদ্ধা'  ব্যাপারটাই হয়ত জানে না। কি রকম মুখটা হবে তখন 'রণ অন দ্য রক' এর। অনেকগুলো রাতে ঘুমোবার আগে কল্পনা করেছে আদিত্য। ঘুম - একাত্তরে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর মানেক শ'র মত প্রশান্ত হয়েছে।

দুএকটি পুরনো গান শোনাবার পর ধীরে ধীরে দর্শক উঠতে শুরু করল। আদিত্য একদৃষ্টে তাকিয়েছিল রণজয়ের দিকে। লাল জামা পরা রণজয় যেন অতীতের ছাই। বেহিসাবি মদ্যপানে তার হাত কাঁপে সব সময়। মাইক ঠিক জায়গায় ধরতেই পারছে না। দমের সমস্যা। সেই ক্ষুরধার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, ঘাড় ঘুরিয়ে দর্শকদের দিকে মাইক বাড়িয়ে দেওয়া, গাইতে গাইতে সিগারেট ধরিয়ে নেওয়ার ঔদ্ধত্য - এসব কি এই লোকটিই করত? রণজয় তার দিকে তাকিয়ে ধরল 'পরদেশী মেঘ, যাও রে ফিরে'। জড়তা কাটিয়ে তবলায় ঘা দিল আদিত্য 'ধা ধিন (-) ধা ধা (-) ধিন (-) ধা ধা  তিন (-) তা তা ধিন (-) ধা ধা'। সেই মহেন্দ্রক্ষণ সমাগত। ধীরে ধীরে আদিত্যর পাতা ফাঁদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রণজয়। কিন্তু ঠিক পড়ার আগেই ছোট্ট একটা তেহাই দিয়ে সামলে নিল আদিত্য। কৃতজ্ঞ চোখ আদিত্যর সঙ্গে মিলিয়েই নামিয়ে নিল রণজয়। সে রাতে বাড়ি ফেরার ট্যাক্সিতে বসার আগে একবার আদিত্যর হাত চেপে ধরল এক পরাজিত সম্রাট। প্রত্যুত্তরে আদিত্যও আরেকটা হাত রাখল সেই শিরাওঠা হাতে।

অনেকে প্রাচীন ধ্বংস স্তপে নাম লিখে আসে। সে নাম কিছু অশোভন প্রচার পায় হয়ত, কিন্তু পাথরটি কিম্বা সংবেদনশীল দর্শক সেই নির্মমতায় নিশ্চিত কষ্ট পায়। তেমন নিষ্ঠুরতা বদলে জয় - না - আদিত্য চাইতে পারে না।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন