বাচ্চাটা
সিঁড়িটা বাইতে যতটা কষ্ট
হবে ভেবেছিলাম, ততটা হয়নি। ধাপগুলো অবশ্য ছোটই, তাও এই প্রথম আমি অনায়াসে
সিঁড়ি ভাঙলাম। কলিং বেলটা টেপার আগে ভীষণ নার্ভাস লাগছিল আমার। কী বলব? কাল রাতভর
মনে মনে কত কী আওড়েছি, সব গুলিয়ে গেছে। বাচ্চাটার জন্যে একটা ক্যাডবেরি বারের
প্যাকেট এনেছি। যাকগে যা হবার হবে! আমার ঘড়িতে এখন আটটা বেজে দশ। কলিং বেলে চাপ দিই আলতো করে।
আজ প্রায় বারো তেরোদিন হচ্ছে বাচ্চাটাকে দেখছি
না। ব্যালকনিতে কাউকে দেখাও যায় না। কোনো কাপড়চোপড়ও ঝোলে না। শুরুতে
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও পরে কেবলই মনে হতো, এই বুঝি ও সেই গায়ে জ্বালা
ধরানো ছড়াটা কাটতে শুরু করল! কত বয়েস হবে ওর? চার বছর? পাঁচ? এর বেশি হলে মায়ের হাত ধরে ঠিক
স্কুলে ছুটতো। ওর মা নিশ্চয়ই কাজে যায়, নইলে এত্তটুকুন বাচ্চাকে
একা কেউ ব্যালকনিতে ছাড়ে!
সেইদিন রিকশা থেকে নামার
মিনিট খানেকের মধ্যে আমার নজরে পড়ে ও। উল্টো দিকের বিল্ডিঙের দোতলার রেলিঙ ঝুকেঁ নিচে কিছু দেখছিল। ঐটুকুন
বাচ্চা উল্টে পড়ে যায় যদি! বুকটা ধ্বক করে উঠেছিল। আটটা বাজে নি তখনও, কিন্তু রাস্তা জেগে গেছে
পুরোপুরি। এই রাস্তাটা বেশ শোরগোলের। ফুটপাতের দু’ধারেই সার সার বাড়ি আর তার সাথে জোর পাল্লা
দিয়ে দোকান। এখানে ওখানে নোংরা জমে আছে। মায়েরা স্কুলের বাচ্চাদের হাত ধরে নাকে আঁচল চেপে
দ্রুত পেরুচ্ছে। আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না ঠিকঠাক। আমার বাঁ পা জন্ম থেকেই খাটো আর সরু। সেদিন একটু আগেই চলে এসেছিলাম। চাকরির প্রথম দিনে সময় হাতে নিয়ে
বেরুনো ভালো।
আগে একটা প্রাইভেট কলেজে
পড়াতাম। বেতন অনিয়মিত হলেও আমার চলে যেত। কিন্তু বছর দেড়েক আগে প্রিন্সিপাল
পাল্টালো। রাজনৈতিক নিয়োগ। ক’দিন যেতেই সময়ে অসময়ে ডেকে পাঠাতেন রুমে। কথা বলার সময় চোখ জোড়া আমার শরীরের গলি ঘুপচি দৌড়াতো। অন্য
চাকরির খোঁজ করছিলাম।
হঠাৎ নিগার ম্যাডামের
সাথে দেখা। নিউমার্কেটে। ম্যাডাম কলেজে আমাদের জুওলজি পড়াতেন। রিটায়ার্মেন্টের পরে স্কুল দিয়েছেন একটা। ম্যাডাম চিনতে পেরেছিলেন। কথায় কথায় চাকরির কথা উঠে এলো। ব্যস ওখানেই পাকা। বেতন ভালো। শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের জন্যে নিজস্ব পরিবহন। একটাই
অসুবিধা, আমার রুটে এখনো বাস যাচ্ছে না। তবে কাছাকাছি দশ মিনিটের রিক্সার দূরত্বে এই জায়গাটা থেকে আমাকে তুলে নিতে অসুবিধে হবে না। আমি এক কথায়
রাজী।
চাকরির প্রথম দিন। রাস্তা ফাঁকা, তাই পৌঁছে গেলাম আগেভাগেই। বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। এতটা সময় দাঁড়ানো আমার জন্যে কষ্টকর। পা কাঁপছিল। দূর্বল পা’টা চাপ নিতে পারছিল
না। শরীরের ভারকেন্দ্র ঠিক রাখতে হেলান দেওয়া জরুরি। আড়চোখে দেখি বাচ্চাটা তখনও দেখছে আমায়। কোমরের কাছটায় টনটন করছিল, অগত্যা পেছনের বিল্ডিঙের
কেন্টিলিভারের নিচে পিলার ঘেঁষে দাঁড়ালাম। আমার
হাঁটার রকম দেখে অনেকে আলগোছে ঘুরে তাকাচ্ছিল। ছেলেবেলা থেকেই আমি এতে অভ্যস্ত।
কিন্তু পেছনে কচি একজোড়া চোখ দেখছে আমায় এই ভাবনাটাই অস্বস্তিতে ফেলছিল। হেলান দিতে না দিতেই ‘আন্টি আন্টি’ ডাক। ওমা! বাচ্চাটা
আমাকেই হাত নাড়ছে। আমি কী করব ভেবে পাই না। অতঃপর হাত নাড়ি আমিও আর তখনই সেই হুল
ফোটানো ছড়া,
‘আন্টি আন্টি
ল্যাংড়া ল্যাংড়া’
আমি হতভম্ব। বাচ্চাটা অদ্ভুত ভঙ্গী করে এ মাথা ওমাথা করছে আর রেলিঙে
ঝুঁকে আমার দিকে তাকিয়ে ছড়া কাটছে। কী লজ্জা!
সেদিন সারাটা সময় কানের
ভেতর বাজছিল ওর সুর কেটে ডাক। নতুন কাজের জায়গায় মন বসেনি একটুও। দুপুরে বাস থেকে নামার সময় চোখ চলে গেল ব্যালকনিতে। নাহ্ কেউ দাঁড়িয়ে নেই। পরের দিন আবার সকালে রিক্সা থেকে নেমে যেই দাঁড়ালাম, হাওয়া ফুঁড়ে বেরোলো যেন, আর একটু পরেই ঠিক একইভাবে ছড়াটা কাটতে লাগল। এরপরে সকালে বাসের জন্যে দাঁড়ানোটাই
বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল।
দু’মাসের বেশি সময় প্রতি সকালে শনি থেকে বৃহস্পতি ও
আমাকে দেখে একইভাবে ছড়া কেটেছে। আমি প্রাণপণ চাইতাম সিধে হয়ে হাঁটতে। কিছুই হতো না। তারপরেই দুম করে সব সুনসান। প্রায়
দু’ সপ্তাহ ধরে ওকে আর দেখিনি।
গত পরশু কন্ডাক্টরের
সাহায্য ছাড়াই হাতল ধরে বাসে উঠলাম। খুশি সামলাতে পারছিলাম না। ক-তদিন চেষ্টা করেছি! ঠিক সেই সময় গহীনে কেউ আওয়াজ দিল,
‘আন্টি আন্টি
ল্যাংড়া ল্যাংড়া’
মনে হলো ধন্যবাদটা স্বশরীরে দেওয়া উচিত।
আমার ঘড়িতে এখন ন’টা। কলিং বেলটা বেজেই চলেছে। আশ্চর্য, কেউ দরজা খুলছে না!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন