বিশ্বাসবাবু
বিশ্বাসকে আমি দুটো সমান্তরাল লাইনের মতো দেখি। বিশ্বাসের দুটো হাত কেউ কাউকে না
ছুঁয়ে একে অপরের থেকে সমান দূরত্বে থেকে যায়। কোন্ হাত বেশি শক্ত বোঝার
উপায় থাকে না সব সময়ে। একেক সময়ে মনে হয় ডানহাত বুঝি বেশি মজবুত, আবার কখনও বাঁ
হাতকে দৃঢ় মনে হয়। সে যাইহোক, এই যে কম-বেশির ভাবনা – এর মধ্যেই দোলাচলে থেকে যায় বিশ্বাস। যখন ট্রেন আসার
সময় হয়, লাইন দুটো সঙ্কেত পেয়ে কেমন শক্ত হয়ে ওঠে! আমি দেখতে পাই ওদের চোয়াল কেমন আঁট
হয়ে আছে। অপেক্ষায়। ঝমঝম করে বিশ্বাসের দুই হাতের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে গেলে, ওরা
আবার এলিয়ে পড়ে। যেন খুব ক্লান্ত, ঘুম পেয়েছে ওদের। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার
ওরা সজাগ হয়ে উঠবে।
কখনও আমার বিশ্বাসকে ঠিকঠাক নুন-মিষ্টি-ঝাল দেওয়া
সুস্বাদু তরকারির মতো লাগে। যে
হাত এই নুন, মিষ্টি, ঝাল, মশলা দেয়, তারই ওপর বিশ্বাসের দায় থেকে যায়। এই হাতকে
আমি নিজের মতো করে পেতে চাই অনেক
সময়ে। সব সময়ে নয় অবশ্য! কারণ মনে হয়, সব সময়ে
ঠিকমতো মাপের নুন-মিষ্টির
তরকারি খেলেও ‘বোর’ হয়ে যেতে পারি। একটু কম-বেশিও তো স্বাদের
বৈচিত্রের জন্য দরকারি! ধরুন এই যে বর্ষার মরশুম, খুব ঝাল দেওয়া কিছু
মশলাদার আইটেম খেতে ইচ্ছে হলে, ঝাল মশলা তেল সবই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দিতে হবে।
বিশ্বাসকেও তেমনই সময় বুঝে বেশি বেশি ঝাল দেওয়া তরকারি খেতে হয়। আবার বীভৎস গরমে
হালকা খাবার খেতে দিই ওকে। বিশ্বাসকে যেমন খাওয়াই, আমিও তেমনি বিশ্বাসকে খাই। কখনও
বেশি, কখনও কম। না খেলে বাঁচব কেমন করে! আমি আর বিশ্বাস দুজনেই ভোজনরসিক
কিনা!
খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রচুর আলাপ
আলোচনাও চলে। বিষয়ের কোনো ঠিক থাকে
না অবশ্য। সে ‘ওয়েদার ফোরকাস্ট’-এর অসফলতা নিয়ে ঠাট্টা তামাশা থেকে
বারাক ওবামার বেড়াল কুকুর পর্যন্ত। সেদিন যেমন কথা হচ্ছিল সংসার নিয়ে। অথচ দেখুন
বিশ্বাস চিরকালের বাউন্ডুলে। সংসার নিয়ে ওর আগ্রহ থাকারই কথা না। আর আমিও সংসার
নিয়ে ব্যস্ত, আমারও আগ্রহ কমে যাওয়ার কথা। তবু চলল কথা। আবার একদিন কথা হলো শান্তি নিয়ে। কীভাবে শান্তি পাওয়া যায় বা যেতে পারে, এই
সব। এই নিয়ে সেদিন এমন তর্ক বেঁধেছিল যে হাতাহাতি লেগে যাওয়ার উপক্রম। ওর বক্তব্য
ছিল, চুপচাপ সব মেনে
নিলেই শান্তি আসে। যেখানে ঝামেলা অশান্তির মূল, সেখান থেকে দূরে থাকলেই সব শান্তি।
আমি বলেছিলাম, তার মানে তুমি হলে গিয়ে পলায়নবাদী। ব্যাস্, আর যায় কোথায়! রেগে টং
একেবারে। তো মারামারি লাগল না আমারই জন্য। আমি গিলে নিলাম বিষয়টা। অবশ্য এই গিলে
নেওয়ার আগে অনেক রাগ হজম করতে হয়েছে। সে যাইহোক, আমাদের এমন ধারাই চলছে।
বিশ্বাসকে আমার কখনও ছবির মতো লাগে। সেদিন যেমন দেখলাম, ছাতা হারানো বিশ্বাসবাবু
একা একা রাস্তা দিয়ে কাক ভেজা হয়ে চলেছেন। এই যে দেখলাম, একটা সিলুয়েটের
মতো আমার চোখে দৃশ্যটা
স্থির হয়ে আটকে রইল। হয়তো উনি ছাতা হারান নি আদৌ, হয়্তো ইচ্ছে করেই ভিজছেন; এসব আমার জানার কথাও না, ইচ্ছেও
নেই। শুধু ওই দৃশ্যটা আমার চোখে স্থির এক ছবির মতো লেগে রইল। ছবি আর
বিশ্বাস বলতেই যেমন সেই জাঁদরেল ছবি বিশ্বাসের মুখ মনে পড়ে, ‘জলসাঘরে’র ঝাড়বাতিটা দোলার দৃশ্য মনে পড়ে, আমার বিশ্বাস
বলতে কিন্তু ওই ভিজে হেঁটে যাওয়া মানুষটির কথাই মনে পড়ে। এই মনে হওয়া বা মনে থেকে
যাওয়া অবান্তর যত কিছু, এসবই তো নিজস্ব বিশ্বাসের ফসল। আমাদের নিজেদের মনে এমন কত
যে চাষবাস হয়, আর এমন কত যে ফসল আমরা ঘরে তুলি, তার ইয়ত্তা নেই। তবু কেন
জানি, ওই ক্ষয়ে যাওয়া, দুবলা-পাতলা
বিশ্বাসবাবুকে দু’ হাত
আকাশের মতো প্রসারিত করে মায়ায় জড়াতে ইচ্ছে হয়।
তবে সত্যি বলতে কি, বিশ্বাস নিয়ে এমন আজব কল্পনায়
আমি একটুও বিশ্বাসী নই। বিশ্বাস আমার কাছে কঠিন পাথরের মতো ঠাঁই। যাকে নড়ানো যায় না এক আঙুল দিয়ে।
তবে ধ্বস নামলে হুড়মুড় করে গড়িয়ে পড়ে আর তখন সেই পাথরের তলায় নিজের পিষে যাওয়া
দেহটা আবিষ্কার করতে হয়। এই আবিষ্কারের কৃতিত্বও তখন নিজের থাকে না। একটা
থ্যাঁতলানো দেহকে আর কী ক্রেডিট দেবে কেউ! ফলে বিশ্বাসের সদগতি করে ফেলতে হয় চটপট।
বেশিক্ষণ ফেলে রাখলে দুর্গন্ধ ছড়ানোর ভয়, ইনফেকশন ছড়ানোর ভয় থাকে। এখানে আবেগ
দেখাতে গেলেই তুমি আবার মরবে। যে গেছে, তাকে তৎক্ষণাৎ বিদেয় করে এসে গঙ্গায় স্নান
করে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। তারপর অবশ্য অশৌচের সময় তুমি কান্নার সময় পাবে। ওই
কান্নায় তোমার বিশ্বাস হারানো বেদনা যত না থাকবে, তার থেকেও বেশি থাকবে তোমার হেরে
যাওয়ার ক্ষোভ। হার ছাড়া একে আর কী বলি বল? তুমি তো নিজেই চিনতে পার নি, তাই
বিশ্বাস করেছ। এখন ঠকে গেলে দোষটা তোমারই। এ পৃথিবীতে হেরে যাওয়া মানুষদের জন্য
আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। হেরে যেতেই পারে যে কেউ। তবে তার জন্য সারাজীবন
হাহুতাশ করায় আমার সমর্থন নেই। জীবনের বেশিরভাগটাই তো হেরে যাওয়ার কাহিনী! কত কাঁদবে শুনি তার জন্য! এক হারের পর পরের
লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।
তো এই যে আমি বিশ্বাসকে ছেড়ে অন্য ট্র্যাকে চলে
যাচ্ছি, বিশ্বাস এটা মেনে নেবে? তার সব সময়ে মনোযোগ চাই। ওর দিক থেকে মন সরালেই ও
বেঁকে বসবে। পালাই পালাই করবে। বিশ্বাস আসলে বড় কাছাকাছি থাকতে চায়। দূরত্বে ওর
ভয়। হারাবার ভয়। আর এটা অনেকে বোঝে না বলে, বিশ্বাস হারিয়ে গেলে ওকেই দোষী করা হয়।
ও যে কেন চলে গেল, সেটা তো আগে বুঝতে হবে! তবে একেবারে বিনা কারণেও মাঝেমাঝে
বিশ্বাস চলে যায়। কিছুটা খামখেয়ালে, কিছুটা না বুঝে, কিছুটা বা অন্যকে ভুল বুঝেও
চলে যায়। আর ঠিক এই সময়টায় আমার বিশ্বাসবাবুর ওপর থেকে সব মায়া চলে যায়। মনে হয়,
যে গেছে যাক্! আর তাকে ফিরতে হবে
না। আর ফেরার সুযোগও যেন না থাকে ওর। কিন্তু সময় যেমন সব
ভুলিয়ে দেয়, সব ক্ষত সারিয়ে দেয়, তেমন ভাবেই বিশ্বাসও আবার আমাকে সব ভুলিয়ে ফিরে
আসে। আবার মায়ায় জড়ায়, আবার ডেকে নেয় কাছে।
আমার সঙ্গে বিশ্বাসের মাঝেমাঝে লুকোচুরি খেলা হয়।
একবার আমি চোর, তো একবার ও। আর প্রত্যেক বারেই দুজনেই ধরা পড়ি। ফলে চোর হওয়ার পালা
দুজনেরই সমান সমান। আজকাল আমাদের তাই কোনো রাগ নেই। অভিমান নেই। ঝগড়া নেই। আমরা আছি পাশাপাশি। কেউ কাউকে না ছুঁয়ে,
না কথা বলে, না ডেকে। আমাদের দিব্যি চলে যাচ্ছে এভাবে। কখনও কখনও অবশ্য আমিই গায়ে
পড়ে দু’ একটা কথা বলি। জবাব
পাব না জেনেও বলি। এই বলাটুকু না বললেও হতো আমি জানি। কারণ না বললেও ও কী করে যেন সব বুঝে
নেয়, শুনে নেয়! অথচ এক সময়ে ভাবতাম ও আজন্ম হাবাকালা, জন্মান্ধও বটে।
ভুল ভেঙে তো যায়ই, তাই না?
দারুণ লেখা।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুন