কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৬

অমিতাভ প্রামাণিক

চারানা আটানা






(৩৪) অনুবাদ কবিতা

আজকাল তো সবাই কবি। যারা এই সেদিন অবধি নিজেদের পাঠক/পাঠিকা বলতেও একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করত, এখন তারাও রীতিমত কবিতা লিখছে। শুধু তাই নয়, পুরনো কবিরা যেমন শুধু কবিতা লেখেন – কবিতাই লেখেন শুধু – নব্য কবিরা তাতেই আবদ্ধ না থেকে কবিতার সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মাঝে মুক্তগদ্য, অণুগল্প, পরমাণুপ্রবন্ধ, ফোটনুপন্যাস, ইলেকট্রনমহাকাব্যও লিখছেন। লিখছেন আর ফেসবুকে সাঁটছেন। উনুনে তরকারি পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু কবিতার স্বার্থে সেটা মেনে নিচ্ছেন। অফিসে ফাইল নড়ছে না, কিন্তু কোনটা নড়া বেশি জরুরি – মুক্তমনা কবিতা না দরকচা-মারা ফাইল? ফলে কবিতার জন্ম হচ্ছে পথে-ঘাটে, বালিশে-চাদরে, অফিসে-রান্নাঘরে। লিখেই চলে আসছে ফেসবুকের পাতায়। আসছে এই আশায় যে কয়েক হাজার লাইক পড়বে। না পড়লে রেগে যাচ্ছেন কবি। ক্রোধবহ্নি জ্বলে উঠছে, তার তেজে বাংলার আকাশ বাতাসের টেম্পারেচার বেড়ে যাচ্ছে কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্লোবাল ওয়ার্মিঙের, অন্তত বেঙ্গল ওয়ার্মিঙের – আই মিন বঙ্গ-উষ্ণায়ণের – এটাও একটা কারণ, সেটা লোকাল বা গ্লোবাল নির্বোধ বিজ্ঞানীদের কেউই বুঝতে পারছেন না।

আমিও যেমন সুযোগ পেলেই কবিতা লিখে ফেলছি। অন্তত ভাব করছি যেন কবিতা লিখছি। যারা আমার ঠাট্টা আর সিরিয়াস পোস্টের পার্থক্য বোঝেন এবং যারা বোঝেন না, তাদের কেউ কেউ যথাক্রমে বুঝে এবং না বুঝে লাইক মেরে দিচ্ছেন। আমি দিনের শেষে লাইক গুনছি আর ভাবছি, আহা, ‘আপনার আজকের দিনটি’ সংক্রান্ত বিষ্ণুশর্মা না কে যেন আনন্দবাজারে যে রাশিচক্রের বিধান দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে প্রায় পৌনে আঠাশ শতাংশ তো মিলে গেছে! প্রেমে বিরোধ, বিদেশযাত্রা বা স্বাস্থ্যের অবনতি তো আর ফেসবুকের কবিতায় লাইক থেকে সিদ্ধান্ত করা ঠিক হবে না


কথা হচ্ছে, একটু তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেই জানা যাবে, কবিতা লেখা খুব সহজ ব্যাপার। এর প্রযুক্তিগত কৌশল নিয়ে আমি একাধিক প্রবন্ধ রচনা করে পত্র পত্রিকায় ছাপিয়েছি। কোন পত্র পত্রিকায় জিজ্ঞাসা করে লজ্জিত হবেন না, বলছি যখন আপাতত বিশ্বাস করে নিন। সেই রীতি অনুসরণ করে বহু নব্য কবি কয়েকশো কবিতা লিখে পত্র পত্রিকায় ছাপিয়েছে। কোন পত্র পত্রিকায় জিজ্ঞাসা করে লজ্জা দেবেন না।

এই নিয়ে আবার কেঁচে গন্ডূষ করার দরকার নেই এখানে। গুগল সার্চ করুন, করলেই পেয়ে যাবেন। নিজে খুঁজে বের না করতে পারলে এই পত্রিকার সম্পাদক কাজলদাকে একটা চিঠি লিখে নিজের ঠিকানা-লেখা একটা পোস্টকার্ড-সহ পোস্ট করে দেবেন – ফেসবুকে না, ডাকবাক্সে উনি ভদ্রলোক, আপনার সে চিঠি পিয়ন ভাগাড়ে ফেলে না  দিয়ে উনার হাতে দিলে উনি নিশ্চয় উত্তর দেবেন।



তবে হ্যাঁ, সব কবিতা লেখাই একই রকম সহজ নয়। কবিতা লেখার ব্যাপারটা কঠিন হয়ে যায়, যখন কেউ কবিতা এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে যায়। কেননা, প্রথম কথা হচ্ছে যে ভাষা থেকে অনুবাদ করতে হবে এবং যে ভাষায় অনুবাদ করতে হবে, অনুবাদক কবির দুটো ভাষাই কাজ চালানো গোছের অন্তত জানা চাই। এমনিতে র‍্যাপিডেক্স ইংলিশ স্পিকিং কোর্স পড়ে কপিলদেব সহ অনেকে ইংরাজি শিখেছেন, ওয়ান-ডে ইন্টারন্যাশনালে হেরে যাওয়ার পর সাংবাদিক সম্মেলনে এই কোর্স-লব্ধ জ্ঞান দিয়ে ইন্টারভিউ বেশ ম্যানেজ করে নেওয়া যায়। কিন্তু ঐ কোর্সে কবিতা অনুবাদ করার ওপর অনুশীলন করানো হয় কিনা, সেটা আমার ঠিক জানা নেই, হয় না বোধহয়!

তাও ইংলিশ টু বেঙ্গলি আর বেঙ্গলি টু ইংলিশ মোটামুটি চালিয়ে দেওয়া যায়। কেতকী কুশারী ডাইসন যেমন রবীন্দ্রনাথের কবিতা রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পর বেশ অনেকগুলো নামিয়ে দিয়েছেন। সেগুলো তো বহু লোকে পড়ছে, পড়ে জানছে রবীন্দ্রনাথের মাহাত্ম্য। ফেসবুকেও এই নিয়ে হেব্বি পোস্ট পড়ে। অনুবাদ কবিতার সুবিধে হচ্ছে, এতে বিষয় নিয়ে কবিকে ভাবতে হয় না, শুধু শব্দগুলো নিয়ে ভাবলেই চলে। তারপর ট্রানস্লেশন না ট্রান্সলিটারেশন তা নিয়ে একটু ফেসবুকসুলভ প্রজ্ঞা ট্রান্সমিশন করে, ‘আমি প্রথমটায় বিশ্বাসী নই, কেবল দ্বিতীয়টায়’ ইত্যাদি বলে ফেসবুকে পোস্ট করে দিলেই হয়। কেউ কিছু কোশ্চেন জিজ্ঞেস করলে গড়ুরের মতো মুখ করে মিটিমিটি হাসি হাসা কর্তব্য। হুঁ হুঁ বাওয়া, কবিতার অনুবাদ, সোজা কতা!

তবে এগুলো আমার দ্বারা ভালো হয় না, কেননা আমি ইংলিশে যাচ্ছেতাই রকমের  কাঁচাআমি কিছু বছর আগে জন্মালে আমার ইংরাজি উচ্চারণ শুনেই ইংরেজরা ভারত ছেড়ে পালাত, কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট বা আলিপুর বোমার মামলা কিছুরই দরকার পড়ত না। টেন্স শুনলেই আমি টেন্স হয়ে পড়ি, কোনটা প্রেজেন্ট করব, তাই ভেবেই আমার ফিউচার মার্চ পাস্ট শুরু করে ইনডেফিনিটলি, কন্টিনিউয়াসলি, পারফেক্টলি।

কিন্তু সুযোগ পেলে এমনকি আমিও যে কবিতার অনুবাদের প্রচেষ্টায় দাঁত ফোটাই না, তা নয়। বাচ্চাদের দাঁত উঠলেই যেমন শুলায়, যেমন কামড়ে দিতে ইচ্ছে করে সেলফোনের কভার বা শারদীয় দেশ, তেমনি আমিও লড়ে যাই ইচ্ছেদানবের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে। নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে।



এই যেমন এবার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে একটা অনন্য সৃষ্টি বাজারে ছাড়লাম। সে আপনারা বললে বিশ্বাস করবেন না। রবি ঠাকুরের প্রিয় আফ্রিকার উপজাতি হিম্বা-র এক কবির কবিতা চেক রিপাব্লিকের একজন চেক ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, সেটা থেকে পরে রাশিয়ানে অনূদিত হয় সেটা। তার স্প্যানিশ অনুবাদ থেকে ইংরাজি ট্রানস্লেশন এক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে দেখে আমি সেটাকে বাংলায় অনুবাদ করার লোভ কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলাম নাএ রকম কবিতা পড়তে পাওয়াই ভাগ্যের কথা, এত ঘাটের জল খেতে খেতে এসেছে সেই সুদূর আফ্রিকা থেকে জন্ম নেওয়া কয়েকটা কাব্যময় অনির্বচনীয় পদ, ঘুরতে ঘুরতে আমার নয়নসমুখে এসে আমার অক্ষিযুগলকে ধন্য করেছে, আমার হৃদয়ে দিয়েছে দোলা, আমার মর্মে হেনেছে তীব্র কশাঘাত, এর অনুবাদের সুযোগ ক’জনের ভাগ্যে জোটে?

গুগল ট্রানস্লেট আর সংসদ ডিকশনারি ঘেঁটে আমি এর একটা যুৎসই অনুবাদ নামিয়ে দিলাম ও পরক্ষণেই ফেসবুকের পাতায় সেঁটে দিলাম। এই সেই অনুবাদ –

বিনুনির ভাঁজে চিঠির নাভিশ্বাস।
ভুট্টার মতো
দাঁতে দাঁত চেপে লড়ো।


মা ষষ্ঠীর অশেষ কৃপায় আমার ফেসবুক বন্ধুর সংখ্যা কম নয়। বঙ্গের বাইরেও অনেক বন্ধু আছে, যারা বঙ্গবন্ধু। আদ্দিস আবাবা ছাড়া প্রায় প্রত্যেক মহানগরী থেকে আমি নিয়মিত আমার পোস্টে লাইক পাই। কিন্তু এইবার জানতে পারলাম, এই অনুবাদ পড়ে আমার জাপানি বন্ধুদের একজন ভাবাবেগে অত্যন্ত আবিষ্ট হয়ে প্রায় হারাকিরি করতে গেছিল। সে ভেবেছিল, আফ্রিকার হিম্বারা বুঝি তাদের চেয়েও মিষ্টি হাইকু লিখছে আজকাল।


সে খবর উঠে এলো একটা পত্রিকার – না, নাম জানতে চাইবেন না, গুরুর নিষেধ আছে বলা – একেবারে হেডলাইনে। জাপানিদের নিয়ে এই একটা সমস্যা বটে, অন্যরা কেউ ওদের চেয়ে ভালো করছে, ওরা একেবারে সহ্য করতে পারে না, বিশেষ করে  মিনিয়েচারাইজেশনে। সেই ভয়েই রবীন্দ্রনাথ তানকা লেখেন নি।

যাইহোক, যথারীতি কবিতাটা নিয়ে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক শোরগোল শুরু হলো নিউ  ইয়র্কের টাইম স্কয়ারে আর লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে রীতিমতো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে  আমার এই অনুবাদ আবৃত্তি করলেন পৃথিবীর তাবড় বাচিক শিল্পীরা। আকাশবাণী থেকে ফোন এলো, আপনার এই আফ্রিকান কবিতা তো গুরুদেবের আফ্রিকা-র চেয়েও টি আর পি বাড়িয়ে ফেলছে, আমাদের একটা ইন্টারভিউ দিন। আমি হেঁ হেঁ করে ‘কী যে বলেন, আমি আবার একটা মানুষ’ গোছের একটা অভিব্যক্তি দিলাম। আফ্রিকান উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণীর পেলব খোঁপায় কী রহস্য লুকিয়ে ছিল, যার জন্য তাকে দাঁতে দাঁত চেপে সংগ্রাম করতে হচ্ছে, তা জানতে সব্বাই উদ্‌গ্রীব। দিকে দিকে এই বার্তা রটি গেল ক্রমে।

সি এন এন না রয়টার কারা যেন তাদের এক টিম পাঠালো আফ্রিকায় হিম্বাদের ডেরায়, এ নিয়ে অনুসন্ধান করতে, ভাবল এ থেকে যদি নৃতত্ত্বের কোনো অজানা সত্য উদ্ঘাটিত হয়! আফটার অল, মনুষ্য প্রজাতি তো আফ্রিকাতেই প্রথম জন্মেছে, তারপর  ছড়িয়ে পড়েছে কালিঘাট, ম্যাঞ্চেস্টার, ক্যালিফোর্নিয়ায়। সরেজমিনে তদন্তে গিয়ে সেই সাংবাদিকদের টিম জানতে পারল, এই কবিতার অরিজিন্যাল মালিক এক বুড়ো মাতাল হিম্বা। তার মাথার চুল এত ঘন যে জট পাকিয়ে অসহ্য অবস্থা তার। আর তার দাঁতগুলো নাকি ভুট্টার মতো, বিচি বিচি, হলুদ হলুদ, তাই তাকে কোনো যুবতী বিয়ে করতে চাইছিল নাচিঠি, নাভিশ্বাস, লড়ালড়ির ব্যাপার কিস্যু ছিল না তার লেখায়, ওসব এক ভাষা থেকে অন্যটায় ক্রমান্বয়ে ভুলভাল অনুবাদের ফল, যা সাধারণত প্রায় সমস্ত কবিতা-অনুবাদকই বেশ নিবিষ্ট চিত্তে করেন

তবে তার চেয়েও ইম্পর্ট্যান্ট হচ্ছে, ওই লেখাটা আদৌ কবিতা ছিল না। ওটা ছিল একটা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন। মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল হলে যা হয়, চুল আর দাঁতের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে সেই হিম্বা যে ডাক্তারের কাছে তার রোগের ব্যাপারে চিকিৎসার কারণে দেখাতে গিয়েছিল, তার ডায়াগনোসিস।


7 কমেন্টস্:

  1. Sir,আপনিই পারেন এমন লিখতে,আরও এমন লেখার অপেক্ষায় রইলাম

    উত্তরমুছুন
  2. Sir,আপনিই পারেন এমন লিখতে,আরও এমন লেখার অপেক্ষায় রইলাম

    উত্তরমুছুন
  3. স্যার সত্যি আপনার লেখার জুড়ি মেলা দুষ্কর। অসাধারণ সত্যি অসাধারণ

    উত্তরমুছুন
  4. স্যার সত্যি আপনার লেখার জুড়ি মেলা দুষ্কর। অসাধারণ সত্যি অসাধারণ

    উত্তরমুছুন
  5. sir, kobita lekhar projukti goto koushol ta kothay pabo doya kore bolbe?

    উত্তরমুছুন
  6. ইলেকট্রনমহাকাব্য। হা হা হা...

    আপনার লেখা পড়ে বারেবারে হাসি, বারেবারে মুগ্ধ হই।

    উত্তরমুছুন