তেইশে শ্রাবণ
সিঙ্গাড়ার মাঝামাঝি ভাঙতেই সূক্ষ্ম ধোঁয়ার ফিতে চশমার সিলিন্ড্রিক্যাল কাচ ছুঁয়ে মিলিয়ে গেল শূন্যে। সামনে মেলে ধরা খাতাপত্র থেকে চোখ তুলেছিল অয়ন। কিছু লিখছিল। জানালা দিয়ে দেখল চায়ের লিকারের মতো ক্রমশ গাঢ় আকাশ আর নিজেকে পেল চায়ের টঙ দোকানে। তুলকালাম বৃষ্টি গত ক’দিন। আজ কিছু বৃষ্টি আবার রোদেলা। টঙের পাশে আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে সে। সিঙ্গাড়ার ঠোঙ্গা ফেলে চায়ে চুমুক দিল। আজ তেইশে শ্রাবণ। গতকাল যেহেতু বাইশে শ্রাবণ উদযাপিত
হয়েছে, আজ তেইশেই হবে। এছাড়া বাংলা দিন তারিখে তার কোনো গরজ নেই।
আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজের সামনে বিড়ি ফুঁকছে নুলো ভিখিরি। দুটো ছেলে সহ উদাস বসে ভিখিরি মা। ড্রাইভারের সাথে হেসে কী যেন বলে। সিকিউরিটি গার্ড আজ আর তাড়িয়ে দেয় না। এমনকি যুতসই সুযোগ বুঝে
গাড়ির পেছনের দু’ চাকার নিচে কানখাড়া করে বসে থাকা বাদামী সারমেয় পর্যন্ত উঠে এলো। এখন গুটিসুটি একটু দূরে বিল্ডিং-এর পোর্চের নিচে অলস
শুয়ে। চমৎকার সহাবস্থান।
সিঙ্গাড়াভাজা ছেলেটা স্টোভের আগুন বাড়ায়। ব্যস্ত মেইন রোডের পাশে ফুটপাথ ঘেঁষে হঠাৎ আমগাছ বড়
বেমানান। কোনো ঋতুতেই আমগাছটি ভেঙে পড়ে না, পল্লবিত কিংবা মুকুলিত হয় না। অয়নের
মতোই একঘেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বছরভর।
দুপুর জুড়ে
শ্রাবণী রোদ্দুর। তেজরহিত। আমপাতা চুঁইয়ে নরম কমলাভ আলো নামল। টুপ। মনে মনে অয়ন বলেছিল, তৃষা একটু পেছন ফিরে
তাকাও, প্লিজ! আশ্চর্য ৯০ ডিগ্রী ঘুরে
তাকিয়েছিল তৃষা। সে চাহনী অজস্র আদরে চোখের কোণে জমিয়ে রেখেছে কেউ। তৃষার জানার
কথা নয়। এমন রঙেই আঁকতে হয় তাকে। ভারমিলিয়ন রেড আর প্রুশিয়ান ব্লু কন্ট্রাস্ট।
নইলে হয়ে ওঠে না। ঝুম বৃষ্টিতে চা খেতে চেয়েছিল তৃষা আর নিজের একটি নৌকো। গাঢ় নীল রঙের, কালোর কাছাকাছি। নীল আভা বেরুবে শুধু।
- দাম কত হবে? কোথায়
পাওয়া যায়? বলতে পারেন?
- রাখবে কোথায়,
তোমাদের গ্যারেজে?
- আপনার বাড়িতে
থাকবে। ঘোর বর্ষায় আমি আর আপনি নৌকোয়। গোলাপি শালুক ঠেলে এগোব।
সময় এলাকা আর
রাস্তার ডিভাইডারের ওপর কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো বদলে গেল চোখের সামনে। বদলে গেছে অয়নও। আর্লি স্পন্ডোলাইটিস। নেকব্লক হয় প্রায়ই। কলেজ শিক্ষকের
পড়া আর পড়ানো নিয়েই কাজ কারবার। বছরের পর বছর ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ে অমন বিদঘুটে রোগ
বাধিয়েছে। চিরসঙ্গী হয়ে আছে মাইগ্রেন। হাওয়ার ঝাপটে ভেজা চকচকে পীচে পাপড়ি ঝরছে।
কালোর ওপর এমনি লাল হলুদ বুটির জামদানী পরেছিল তৃষ্ণা। বৃষ্টি বৃষ্টি। অমন সি থ্রু
শাড়ি। রাগ লাগছিল ভীষণ অয়নের। পাশ দিয়ে যাবার সময় সবাই কেমন দেখছে। প্রায় দৌড়ে এসে
দাঁড়িয়েছিল ওরা কৃষ্ণচূড়ার নিচে। আর বাতাসে ভাসছিল বৃষ্টিকণা। তৃষ্ণা বলেছিল, দেখুন, ড্যান্সিং রেইন! অয়ন দেখেছিল। তৃষার ফর্সা পেটের গহীন গভীরে লেপ্টে
আছে কৃষ্ণচূড়ার একটি ভেজা সবুজ পাতা। উফফ! কী মারাত্মক বৃষ্টি অরণ্য এনেছিল সেদিন!
অথচ অরণ্য চিনে
নেয়নি তার গাছগুলো। তাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য কয়লা-বিদ্যুৎ তৈরি করে। শিশুরা ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠে। শশশশ…! বর্গী এলো দেশে। হাতে ধারালো চাপাতি, গ্রেনেড আর
কালাশনিকভ ৪৭। এদেশে আজীবন বুলবুলিতে ধান খেয়ে যায়। বিশ বছর আগেকার মতো চিলেকোঠা থেকে অয়ন
নেমে যায় ওসমানের সাথে। দীর্ঘ মিছিলে কে নেই! ওই তো বাহে মুলুকের নুরুলদিন। বাহাদুর শাহ্ পার্কের ফাঁসির দড়ি খুলে নেমে
এসেছে ঝুলন্ত সেপাইরা। হাড্ডিসার মসলীন তাঁতি আর সারা গায়ে চাবুকের দাগ নিয়ে নীলচাষীরা
এগিয়ে যায়। শত শত বছর আগেকার মানুষ পাহাড়ী ঢলের মতো নেমে আসে, সময়ের হাঁ করা মুখ
গহ্বর থেকে। রফিক-বরকত, রুমি-আজাদের পাশে কে? তৃষা! মধুর ক্যান্টিন থেকে বেরিয়েছে বান্ধবীদের সাথে। সেকেন্ড
ব্র্যাকেটের মতো গোলাপি ঠোঁটের ওপর বলপেনের দাগ। রাত জেগে পড়ার ক্লান্তি চেহারায়। অথচ চোখ দুটোয় কী দীপ্তি! অয়নের হাত মুঠিবদ্ধ,
পূর্ব পুরুষের সাথে তার শ্লোগান মিশে যায়, গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক!
পিজা হাটের হোম
ডেলিভারী বাইক চলে গেল পাশ দিয়ে। চায়ের কাপ আর চামচে জলতরঙ্গের অসাধারণ মৃদু সুরধ্বনি
তুলছে চা-ওয়ালা। তরুণদের টি-শার্টে লেখা ‘এ্যডাপ্ট
অর পেরিশ - দ্যাট’স ইভোলিউশান’! কখনও বুকে রোম্যান্টিক বিপ্লবী চে। অয়নের পাশে
দাঁড়িয়ে ওরা চায়ে চুমুক দেয়, ঝালমুড়ি-চানাচুর খায়। দ্বিতীয় বার চায়ের সাথে সিগারেট
ধরায় মধ্যবয়সী অয়ন। বাতাসের বিপরীতে। আশ্রয় খুঁজে বেড়ায় সে আজও। ভেতর থেকে ভেতরে জায়গা বদল করে যেখানেই ঠাঁই
নিয়েছে, বৃষ্টি শেষে গাছের পাতা বাড়তি জলটুকু ঢেলে কাঁপন বাড়িয়েছে শুধু। চারিদিকে
ছায়াদের ভিড়। ঘোলাটে চোখে আর মানুষ দেখতে পায় না অয়ন।
তেইশে শ্রাবণ। আরেকবার অপ্রেম থেকে জেগে অয়ন বলবে কি, ‘শুভ জন্মদিন, ঝুমপাতা’? শীতে কেঁপে ওঠা হৃৎপিণ্ডে সে কাঠ-কয়লার
একটি টুকরো গুঁজে রাখে। ফুঁ দিলেই আগুনের স্ফুলিঙ্গ।
ভাল লাগল।
উত্তরমুছুন