দোদুল দোলে ঝুলনা...
ঘটিহাতা ফ্রক জীবনের খাঁজে খাঁজে শুধু সোনালী রঙের বালি। নাড়াচাড়া করলে উড়ে উড়ে সোনালী রোদ হয়ে চিকচিক আর চিকচিক। চোখে ঢুকে কিচকিচ, তারপর খানিক জল টেনে বের করে আনে।
আমাদের আশেপাশের চার পাঁচটা বাড়ি আর তার চৌখুপ্পি ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা সবাই সকাল সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে সাত, এই একঘন্টা দত্ত বাড়ির হরিসংকীর্তনে নিজেদের কানকে অভ্যস্ত করেছি বাধ্য হয়েই। আজ বেলা ন’টা গড়িয়েও তার বিরাম নেই দেখে বিরক্ত হলাম। কিছু বলার আগেই মা বললেন, আজ ঝুলন।
আজ ঝুলন! নিজের অজান্তেই বাক্সবন্দী ফ্রক থেকে একমুঠো সোনালী বালি ছড়িয়ে গেল। কণায় কণায় লেগে আছে এক বারান্দা ভর্তি খেলনা শহর। সেই শহরে পাহাড়, নদী, রাস্তা, খেলার মাঠ, ধানক্ষেত, যুদ্ধক্ষেত্র মিলেমিশে একাকার। মেয়েকে সেই শহর গড়ার গল্প বলতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। ওকে বোঝাতেই পারছি না! আজকাল তো সব আন্তর্জাল আর ভিস্যুয়াল। আমাদের প্রাগৈতিহাসিক ঝুলনশহর ওর মনে কোনো দাগই কাটল না। সোনার গুঁড়ো মেখে আমি একাই ফিরে গেলাম।
দু’ একটা বাড়ি ছাড়া পাড়ার বেশিরভাগ বাড়িতেই ঝুলন পূর্ণিমায় বসে যেত খেলনাশহর। বিশেষ করে যে সব বাড়িতে কচিকাঁচাদের ভিড় ছিল। কাজেই উত্তেজনা ছিল চরম, প্রতিযোগিতা আরও বেশি। সাজানো শহর নষ্ট করে দেওয়া বা পুতুলচুরি, এসবও চলত। কাজেই সবাইকে সজাগ থাকতে হতো। পাড়ায় গলিতে ঢোকার মুখের বাড়িটা জয়দাদাদের, উল্টোদিকে খাল। প্রতি বছর নতুন ভাবনা নতুন পুতুল নিয়ে ওর ঝুলনশহর সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। একবার ওর সাজানো শহর থেকে পাহাড়টাই উড়ে গেল। জয়দাদা পাড়াময় দাপিয়ে বেড়ালো, কিন্তু চোর পাওয়া গেল না। চোরকে নাক ফাটিয়ে দেবার হুমকি দিয়ে, কেঁদে-কেটে ক্লান্ত উপোসী জয়দাদা শেষ দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ল। বিকেলে খালের নোংরা জলে তার পাহাড়ের অংশবিশেষ পাওয়া গেল। শোকে দুঃখে রাস্তার ওপর গড়াগড়ি দিতে দিতে হাত-পা ছুঁড়ে তার কী কান্না! এর বেশ কিছু বছর পরে এই ঝুলনের জন্য শ্যাওলা জোগাড় করতে গিয়েই পা ভেঙেছিল জয়দাদার। পাঁচিল দেওয়াল গাছের গুঁড়ির গায়ে জমে থাকা শ্যাওলা ছিল শহর বানানোর দামী উপকরণ। ভারত সেবাশ্রমের আটফুট পাঁচিল বেয়ে সেই শ্যাওলা নিয়ে নামার সময় পা হড়কে নিচে ভাঙা ইঁটের গাদায়। কিন্তু পা ভেঙে যাওয়ার জন্য যত না কেঁদেছিল, শ্যাওলা নষ্ট হবার দুঃখে কেঁদেছিল ঢের বেশি। সে বছর ভাঙা পা নিয়ে ঝুলন পাহারা দিতে বারান্দাতেই কাটিয়েছিল জয়দাদা।
সে এক মজার শহর তৈরি হতো। বাড়ি কম সবুজ বেশি, রাস্তা ছোট গাড়ি বড়। পুরনো চাদরে কাদা মাখিয়ে বাঁশের কঞ্চি ইঁট দিয়ে তৈরি হতো পাহাড়। শ্যাওলা লাগিয়ে সবুজ পাহাড় আর তুলো লাগিয়ে বরফ। ভাঙা কাচের টুকরোর চারপাশে মাটির বেড় দিয়ে হতো নদী, পুকুর। গড়িয়া মোড়ের ‘ভারত স মিল’ থেকে আনা কাঠের গুঁড়োর সঙ্গে রঙ মিশিয়ে বানানো হতো সবুজ মাঠ, কালো পিচরাস্তা, লাল মেঠো পথ, ধূসর যুদ্ধক্ষেত্র। ঝুলনের জন্য হাল্কা চ্যাপটা একরকমের প্লাস্টিকের পুতুল পাওয়া যেত রথের মেলায়। চাষি, সৈনিক, বাস, গোরুর গাড়ি, নৌকো, গাছ, কুঁড়েঘর, দালান আরো কত কত রকমের! যার যত খেলনা, তার শহর তত বড়। তখন কলকাতা সবেমাত্র হাত পা ছড়াতে শুরু করেছে।
মাঝে মাঝেই আশেপাশের ফাঁকা জমিতে বালির পাহাড় গজাতো। সেই রকম বালির পাহাড় থেকে বালি চুরি করে বানানো হতো মরুভূমি। মনে আছে, জয়দাদা একবার সোনার কেল্লা বানিয়েছিল। সে বছর ওর ঝুলন দেখার জন্য কী ভিড়, কী ভিড়! ছোট বড় যেমনই হোক না কেন, সব ঝুলনে রাধাকৃষ্ণের দোলনা অবশ্যই থাকত। সামনে একটা প্রণামীর থালা। তাতে কত প্রণামী এলো, রোজ গোনা হতো। পাড়ার বড়রা একদিন দেখতে বেরোতেন। তাঁরাই বিচারক। শ্রেষ্ঠ ঝুলন নির্মাতা পেতো জিলিপি-বোঁদে সহযোগে ১০ টাকা পুরস্কার। পূর্ণিমার সন্ধ্যায় আমাদের ছোট পাড়ার ততোধিক ছোট মাঠের পাশের আম গাছে দোলনা টাঙিয়ে জীবন্ত রাধা-কৃষ্ণর ঝুলন হতো। মধুদা আর মিঠুদি সাজত রাধা আর কৃষ্ণ। অত সুন্দরী রাধা আজ অব্দি আমার নজরে আর এলো না! সঙ্গে গান আর খাওয়া। ব্যানার্জি জেঠিমা বানাতেন মালপোয়া, আর গাঙ্গুলি জেঠিমা সুজি-লুচি। চাঁদা তুলে আসতো পান্তুয়া আর রসমালাই।
মাঝে মাঝেই আশেপাশের ফাঁকা জমিতে বালির পাহাড় গজাতো। সেই রকম বালির পাহাড় থেকে বালি চুরি করে বানানো হতো মরুভূমি। মনে আছে, জয়দাদা একবার সোনার কেল্লা বানিয়েছিল। সে বছর ওর ঝুলন দেখার জন্য কী ভিড়, কী ভিড়! ছোট বড় যেমনই হোক না কেন, সব ঝুলনে রাধাকৃষ্ণের দোলনা অবশ্যই থাকত। সামনে একটা প্রণামীর থালা। তাতে কত প্রণামী এলো, রোজ গোনা হতো। পাড়ার বড়রা একদিন দেখতে বেরোতেন। তাঁরাই বিচারক। শ্রেষ্ঠ ঝুলন নির্মাতা পেতো জিলিপি-বোঁদে সহযোগে ১০ টাকা পুরস্কার। পূর্ণিমার সন্ধ্যায় আমাদের ছোট পাড়ার ততোধিক ছোট মাঠের পাশের আম গাছে দোলনা টাঙিয়ে জীবন্ত রাধা-কৃষ্ণর ঝুলন হতো। মধুদা আর মিঠুদি সাজত রাধা আর কৃষ্ণ। অত সুন্দরী রাধা আজ অব্দি আমার নজরে আর এলো না! সঙ্গে গান আর খাওয়া। ব্যানার্জি জেঠিমা বানাতেন মালপোয়া, আর গাঙ্গুলি জেঠিমা সুজি-লুচি। চাঁদা তুলে আসতো পান্তুয়া আর রসমালাই।
উফ্! কী দিন ছিল সব! মুঠো ভর্তি ছিল আনন্দের রঙ। আজ না ফেরা অনেক কিছুর মতোই হারিয়ে ফেলেছি সেই শহর, উত্তেজনা, রাধা-কৃষ্ণের দোল খাওয়া, প্রণামীর টাকায় একসঙ্গে ফিস্টি করা। মধুদা আর মিঠুদি রাধা-কৃষ্ণর বদলে রুক্মিণী- কৃষ্ণ হয়ে দিব্যি জীবন কাটিয়ে চলেছে। জয়দাদাদের বাড়ি দোতলা হয়েছে। কিন্তু দোতলার বারান্দায় বসার অধিকার নেই তার। ওটা তার দাদার। বেকার জয়দাদা ছাত্র ঠ্যাঙায় আর ফাঁকা সময়ে সেই বারান্দায় খালের দিকে মুখ করে একটা বেতের চেয়ারে বসে থাকে। পাশে তার ক্রাচ।
বেশ ভালো একটি লেখা
উত্তরমুছুন