কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

১১ অর্ক চট্টোপাধ্যায়

প্ল্যানচেট
অর্ক চট্টোপাধ্যায়


বিরাট রাস্তার পাশে ছোট্ট ডানদিক : এক ফালি সরু গলি। দু’পাশে বিরাট বিরাট বাড়ি। কোনোরকমে শ্বাস নেওয়া পুরনো একটা গলি। বড় জোর চলে যাবার জায়গা, দাঁড়ানোর জায়গা নয়। গলিটায় ঢুকে নাক বরাবর ওপর দিকে তাকালে চোখে পড়ে পর পর অনেকগুলো খাঁচা। মাকড়সার জালের মতো সারি সারি তার থেকে ঝুলে রয়েছে। পথচারী দ্রুত শব্দে হেঁটে যায় এপাশ ওপাশ। সিডনি শহরের ব্যস্ততম এবং বিখ্যাততম এলাকা এটা। চতুর্দিকে বাজার। পথচারী ক্লান্ত হলে চোখে পড়ত বা কানে পড়ত বললে ঠিক বলা হবে যে, গলিটায় ঢুকে এক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়ালে ক্ষীণ কয়েকটা শব্দ শোনা যায়, কিচিরমিচির শব্দ! হয়তো কখনো কেউ কেউ শুনেওছে সেই কিচিরমিচির, কিন্তু বিশেষ পাত্তা দেয়নি তেমন। খানিক জিরিয়ে নিয়ে শহরের অভ্যাসমূলক কাজে ছেড়ে গেছে গলিটাকে। ভুলে গেছে পাখির আলতো মোলায়েম কিন্তু বিষণ্ন ডাক! 

জুতোগুলো পাথরে বাঁধানো রাস্তার ওপর দিয়ে যেখানে গটগট করে হেঁটে চলে যায়, সেখানে ধুলোয় মলিন একটা ফলকের মতো রয়েছে। পাথরের ওপর কী যেন লেখা রয়েছে! এমন নয় সেগুলো কেউ পড়ে, কেউ দ্যাখে! তাই তো গল্প দেখছে, পড়তে চাইছে। পড়েও ফেলছে, লেখা আছে : "Forgotten Songs"। আশেপাশে নজর করলে দেখা যাবে, এদিক ওদিক পাথরের ওপরে একেকটা নাম লেখা আছে; কবরখানার মতো! কাছে গিয়ে গল্পের মতো পড়তে জানলে পড়া যেত একেকটা পাখির নাম: "Fan-tailed Cuckoo", "Scarlet Robin" ইত্যাদি। তারপর "Forgotten Songs" লেখাটার নিচের দিকে আরেকটা আবছা ফলক, সেখানে যা লেখা আছে, সেটা বাংলায় অনুবাদ করে নিলে এরকম দাঁড়ায় : এই খাঁচাগুলোর ভেতর রেকর্ড করা রয়েছে ৫০টি অবলুপ্ত এবং লুপ্তপ্রায় পাখির ডাক; একসময়ে সিডনির আশেপাশে এদের সত্যি সত্যিই শোনা যেত, কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে আর এদেশে ইউরোপের উপনিবেশ গড়ার পরে ক্রমশই এই সব পাখিরা সীমানার দিকে সরতে সরতে এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! তাদের নামেই এই "Forgotten Songs", এই হারানো সুরের সাউন্ড ইনস্টলেশন হয়েছে বছর তিনেক আগে।

গল্প দেখছে আর পড়ছে নানান পাখির নাম। তারপর কান পাতছে গলির ভেতর আর শুনে নিচ্ছে সুরের কবরখানায় সেই সব হারানো সঙ্গীত। ঠিক এমন সময় গল্পের হাওয়ায় ভর করে একটা পাখি উড়ে এলো এক ফালি সরু গলিটাতে। উড়ে এসে একটা খাঁচার ওপর বসলো; তারপর একটু উড়ে পরের খাঁচাটার ওপর গিয়ে বসলো। এইভাবে সারা সন্ধ্যা জুড়ে সে এক খাঁচা থেকে অন্য খাঁচায় উড়ে উড়ে বসে বসে খেলাধুলো করতে লাগলো। এক পাখি গিয়ে আরেক পাখিকে বললো, সে গিয়ে আরেক পাখিকে আর ক্রমশ গলির ঐ খালি খাঁচাগুলো পাখিদের আনাগোনায় ভরে যেতে লাগলো। লাইভ কিচিরমিচিরে ঢাকা পড়ে যেতে লাগলো রেকর্ডিং! প্রতিটা খাঁচার ভেতরে যেখানে একেকটা কালো বাক্স বসানো ছিলো, যার ভেতর থেকে রেকর্ডেড শব্দগুলো বেরিয়ে আসতো, সেখানে কান পেতে অন্য সময় থেকে ভেসে আসা সেই সব শব্দ শুনতে লাগলো পাখিরা। আস্তে আস্তে অতীতের এই সঙ্গীত তাদের এতই মুগ্ধ করে তুললো যে তারা খাঁচার চতুর্দিকে গোল হয়ে বসে বসে সেই হারানো সুর শুনতো আর তারপর তাদের মতো নিজেরাও গাইবার চেষ্টা করে যেত। ক্রমশ রেকর্ডের ডাক আর লাইভ ডাকের মধ্যে ফারাক বোঝা দায় হয়ে উঠলো; আর খবরের কাগজ, ওয়েবসাইট, ব্লগ মিলিয়ে জায়গাটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেলো। রাস্তার ওপর এই তালে খানদুয়েক দোকান-কাম-কাফেও জাঁকিয়ে বসলো। চেয়ার টেবিলে কফি নিয়ে বসে লোকজন অতীত ও বর্তমানের সেই সম্মিলিত সঙ্গীত শুনতে লাগলো। কালো বাক্সের ভেতর থেকে রেকর্ডেড ডাক বেরিয়ে আসতো আর তারপরে বাক্সের গায়ে কান পাতা গল্প-হাওয়ার পাখি সেই সুরে গলা মেলাতো। সময়ের জোড় খোলা মৌনমুখর এই গলিতে নতুন এক বসত গড়ে উঠলো এভাবে। গল্প দেখলো, অন্য একটা সময় আর উচ্ছেদহীন সেই উল্লম্ব সময়ের প্রেত প্রবেশ করলো কফি কাপের মধ্য দিয়ে তার শরীরে!  

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন