কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

০১ আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

কবির জাতীয়তা আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

লিখি কবিতা। প্রশ্ন জাগে, তাহলে আমার জাত কী? জাতীয়তাই বা কী? কবি-জাত আমি কবিতা-জাতীয়তা আমার? উত্তরে যদি হ্যাঁ করি তাহলে একটি জটিলতা আসে। কারণ মানুষের নানা রকমের পরিচয়-চিহ্নের মতো কবিও একটি পরিচয় আর কবিতা একটি শিল্প-শাখার নাম। কবি বলতে এখানে ঠিক মানুষ হিসাবে তার জাত বা জাতীয়তা আসে না। কিন্তু যে মনে প্রাণে এই শাখটিকে জাগিয়ে রাখে, একে নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যম হিসাবে বেছে নেয়, তাহলে হ্যাঁ করাকে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। আমার জাতীয়তা যদি কবিতা হয় তাহলে আমি কোনো ইস্যুকে হাইলাইট করে আমার জাত ও জাতীয়তা প্রকাশ করি। ভাব আর স্বপ্নধ্বনি -- এমন থোকা থোকা আত্মমগ্নতার এক একটা ছবি, রঙ রেখার বীজ তার মাথায় শেকড় গাড়ে বলে কবির কোনো দেশ থাকে না। পুরো পৃথিবী পুরো ইউনিভার্সই, সমস্ত সীমানা সমস্ত দেওয়াল একাকার করে তার চিন্তা আর ধ্যানে একটি চলন্ত মুভি-বাক্স হয়ে আছে। এসব থেকে কবি নিজেকে কীভাবে ছাড়িয়ে আনবে? তার ভাষাবোধ তার আত্মপরিক্রমণের আর এক ট্রান্সপারেন্ট জলপিঠ যেন। যেখানে নুড়ি পাথরের মতো ভেসে বেড়ায় তার অভিনিবেশ, তার ধ্যান। দেশ একটা থাকলেও জন্ম গ্রহণের কারণে সেটি একটা আলাদা জন্মস্থান, ভূখণ্ড মাত্র। এটিও আবার তার স্ব-নির্বাচনের আওতায় থাকে না। এটি তার নিয়ন্ত্রণহীন, অন্যের স্বেচ্ছাচারী প্রয়োজনে গড়া। মানে তার এই জাত বা জাতীয়তার পরিচয় অনেকটা নিয়তি তাড়িত। কিন্ত যে জিনিসটা নিয়তি তাড়িত নয়, সেটি হলো তার কবি হওয়া। যেটি তার স্বাভাবিক হওয়ার মধ্যে আছে, যেটি তার ‘বিঙ’, সেটি তার কবিজীবন। এই জীবন যেখানেই থাকুক না কেন, তার ভাষা, তার প্রতি মুহূর্তে হয়ে ওঠার ভাষা, কোনো রকমের সামাজিক ভাষার কর্তৃত্ব ছাড়াই এটি নিজেকে জানান দেয়।

কবির যাত্রা তার জন্ম-ভূখণ্ড থেকে নিজের ভেতরের নিজস্ব হওয়ার দেশে। সেখানেই সে রচনা করে প্রকৃত তাকে। তার চারদিকের বস্তুরাশি তাকে যে প্রণোদনা দেয়, তার থেকে সে তার কাব্যভাষার দরকারি মাল মসলা তুলে নেয় শুধু। কবির ঠিকানা কবির শারীরিক অবস্থানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা, তার মন আর মননের আয়নাভূমি। সেখানে কবি তার আপন চেহারা প্রতিষ্ঠিত করে। তাই যে কোনো ভাষায় লেখা হোক না কেন, কবিতার একটি নিজস্ব মুখ থাকে। সত্যিকারের কবির কোনো নির্দিষ্ট ভাষা নেই, দেশ নেই, জাতির পিতাও নেই। তার চিন্তাস্ফূরণ, তার ভাববিন্যাস অনেকটা বস্তু বা অবস্তু হয়ে, ভাব ভাবনার মূর্ত প্রকাশ থেকে ক্রমশ একটা না-হওয়া, না-ফোটা দেশের দিকে ধাবিত। সেখানে যারা থাকে সেটি এক একটা মানুষের কণ্ঠ, মানুষের চেহারা, এক সাথে পৃথিবীর মানুষের বিবিধ মানসিক আর সামাজিক কারেক্টার-ট্র্যাণ্ড। তাই তার ভাষা বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ বা আরবি যাই হোক, এইগুলি তাকে শেষ পর্যন্ত একটি বিশেষ ভূখণ্ড বা দেশের কোনো কনক্রিট ভাষাবোধে জারিত করে না। লিখছি কবিতা, এমন কিছু অনুভব জ্ঞানকে নিয়ে যে, এগুলির কোনো জাত নেই, জাতীয়তা নেই। নারীর সৌন্দর্য, শীতের বিচবালি, উড়ন্ত এই পাখির ওপেরা, ঘুমিয়ে থাকা কচ্ছপের শান্তি, এমন কি এই যে সত্য-মিথ্যা, ভালোবাসা বা এই রাত্রি তাড়িত যৌনতার মাতৃভাষা কী? এইগুলো কি বাংলা? ইংরেজি, ফরাসি, আরবি? এইগুলি কোনো জাতির একক ভাষাবোধ নয়, এগুলি কবির কবিতাবোধ, অন্ধকারে, ঘুম জাগরণ, স্বপ্নের চোরাগলিতে কবির জন্য ইশারা নিয়ে বেড়ায়। এইগুলি আমি লিখি আমার ব্রেইনে প্রোথিত, আমাকে দেওয়া আমার স্ব-ভাষায়। আমি লিখি স্বপ্ন-কবিতা। স্বপ্নের ভাষা কী? এর জাতীয়তা কী? পৃথিবীতে সব স্বপ্ন এক রকমই। তাদের ভাষাবোধও এক। শুধু প্রকাশ ভিন্ন চিহ্ন রেখায় ব্রেইনে প্রোথিত, চাপিয়ে দেওয়া স্ব-ভাষায়। 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন