কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

ইন্দ্রপুরী রহস্য

 


(২)

অপ্সঃ

কাণ্ব ঋষি গায়ত্রী ছন্দে 'অপ্সঃ'র উল্লেখ করেছেন। এই শব্দর অর্থ এক দর্শনীয় গজ। যে যাত্রীকে দিকনির্দেশ করে। আমরা পিজি হাসপাতালের ময়নাতদন্ত বিভাগে সেই অপ্সঃর নির্দেশেই যেন ছুটে গেলাম। সম্বরণদাই ছিল ডিউটিতে। শুভায়ু দের বডি ওখানে পৌছেচে জানার পর মিডিয়ামহল উপছে পড়েছে চারপাশে। সামাল দিতে পুলিশ মোতায়েন হয়েছে। আশুদা যেতে যেতে বলল,"কতো মানুষের মৃত্যুরহস্যর কিনারা হল না আজও।তারা হারিয়ে গেল আমাদের অজান্তেই। অথচ দেখ, একজন সেলিব্রিটির ক্ষেত্রে বিপরীত নিয়ম।" বিখ্যাত মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে তার ময়নাতদন্তর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আমার আছে। একবার এক রাজনৈতিক নেতার পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটেছিল। দুর্ভাগ্যবশত সেই দেহটির ব্যবচ্ছেদ আমাকেই করতে হয়েছিল। সেদিন মনে আছে, মিডিয়া আর দলের লোকেদের ভয়ে ডিপার্টমেন্টেই রাত কাটিয়েছিলাম। সম্বরণদাকে দেখেই বুঝলাম চাপে আছে। তবে আমাদের দেখে সেই মানসিক চাপ খানিকটা শিথিল হল বুঝতে পারলাম। আশুদার সঙ্গে পরিচয় করাতে সম্বরণদা বলল, "আপনার কথা আমি শুনেছি অর্কর মুখে, লোকের মুখেও। আজ দেখা করে বেশ রোমাঞ্চিত হচ্ছি।"প্রাথমিক কথোপকথনের পর সম্বরণদা আমাদের ভিতরের হিমঘরে নিয়ে গেল।কড়া নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় সেখানেই শুভায়ুর দেহটা শায়িত ছিল। মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী কারণ মাথায় মর্মান্তিক চোট যার ফলে তার মাথার কিছুটা অংশ থেঁতলে ঘিলু বেরিয়ে গেছে। শরীরের বাকি অংশে তেমধ কোনও চোট নেই। ভিসেরা রিপোর্ট তখনও আসেনি। প্রাথমিকভাবে তেমন কোনও সন্দেহপ্রবণ কোনও সংকেত মেলেনি। আশুদা দেহটা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। দেখলাম আশুদা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুভায়ুর ডান হাতটি দেখছে। শুভায়ুর ডান হাতে দুটি বড় বড় উল্কি আঁকা। উল্কির চারপাশ বেশ রক্তাভ থাকায় অনুমান করা যায়, উল্কি দুটি খুব পুরনো নয়। প্রথম উল্কিটি একটা শিখার মতো। এই চিহ্নটা অনেক জায়গায় দেখেছি বটে, কিন্তু এটার অর্থ আমার কাছে অজানা। একটি কুণ্ডলী পাকানো কালো রেখা ক্রমশ উর্ধ্বগামী হয়ে একবার ডান দিক, একবার বামদিকে প্যাঁচ খেয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। তিন বার এভাবেই এঁকেবেঁকে চলবার পর রেখাটি এবার স্থির উলম্ব হয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে। তারপর সামান্য উঠে মিলিয়ে গেছে। তার ঠিক উপরে সরল রেখায় তিনটি কালো বিন্দু। পুরো উল্কিটিই কালো কালিতে করা। তার নীচে নীল রঙের একটি বাজপাখির মুখ। দুটি ছবির চারদিকেই চামড়াটা বেশ ফোলা।

-এটা তো পোস্টমর্টেম লিভিডিটি মনে হচ্ছে না...

আশুদা আপনমনেই বলে। সম্বরণদা সম্মতি জানিয়ে বলে, "না। কখনোই না।"

-এগুলোর বয়স এক সপ্তাহের বেশি হবে না। কী বলো?

সম্বরণদা মাথা নেড়ে বলে,"সেরকমই তো মনে হচ্ছে।"

-তোমাদের টক্সিকোলজির স্যাম্পেল পাঠানো হয়েছে?

-হ্যাঁ। কাল বা পড়শু রিপোর্ট আসবে।

-এই ট্যাটুগুলোর নীচের টিশ্যুগুলো একটু টক্সিকোলজি অ্যানালিসিসে পাঠানো যাবে? আমার মনে হয়, এখনও খুব দেরি হয়ে যায়নি!

সম্বরণদা কৌতূহলী হয়ে বলল,"সেটা সম্ভব। কিন্তু আপনি কি কিছু সন্দেহ করছেন আশুদা?"

আশুদা গভীর মনোযোগ দিয়ে উল্কিটি দেখতে দেখতেই বলল,"এই ট্যাটুতে ব্যবহৃত রঙের ভিতর অতিরিক্ত পারদ থাকতে পারে। আমার মন বলছে, এই চামড়ার রঙের ধরণ ওই পারদের বিষক্রিয়ার ফলাফল। যদিও প্রমাণিত না হলে এই অনুমান ভিত্তিহীন। কী বলিস অর্ক?

আমরা হিমঘর থেকে বেরিয়ে এসে খানিক চা খেতে খেতে কথাবার্তা বললাম। সম্বরণদা বলল, ময়নাতদন্তর রিপোর্টটা তৈরি হলে সে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। আমরা অগত্যা ফিরে এলাম আমাদের বাড়ি। আমার মনে সঞ্চরমান প্রশ্নগুলির উত্তর কখন পাব, সেই অপেক্ষাকে দীর্ঘায়িত করেই অলোকেশ ফোন করল আমাকে। তার পুলিশি জেরা হয়ে গেছে। যতোটা ভয়ানক পরিণতি হবে, বলে অনুমান করছিল সে, তার কিছুই ঘটেনি, সেটা জানাতেই সে ফোন করেছিল। গলা শুনে বুঝলাম, সে এখন সামলে নিয়েছে অনেকটাই।

ঘরে ফিরেই আশুদা গা এলিয়ে দিল সোফার ওপর।তারপর সিলিংএর দিকে তাকিয়ে কী ভাবতে লাগল।আমি আর আগ্রহ লুকিয়ে রাখতে না পেরেই বললাম।

-তোমার কি এই ইন্দ্রপুরী রেসিভেন্সির ঘটনাটা নিছক আত্মহত্যা মনে হচ্ছে না?

আশুদা চিন্তিতভাবেই বলল,"নিশ্চিতভাবে কোনও কিছু বলবার সময় এখনও আসেনি।তবে ঘটনায় কয়েকটা সূত্র আমাকে ভাবাচ্ছে।

-কীরকম?

আশুদা এবার সরাসরি উঠে বসে বলল,"একটা কথা বল তো, এই যে তুই ঘরের ভিতর আছিস, তুই কি জুতো মোজা পরে আছিস? অথচ তথাগত আমাকে ক্রাইমস্পটে যে তোলা ছবিগুলো দেখালো, সেখানে স্পষ্ট দেখা যায় শুভায়ু দে পরিপাটি জুতোমোজা পরা শ্যুটেট বুটেড। অবশ্য এই রূপোলিপর্দার লোকেদের ভিতর ভিতর একটা হিস্ট্রায়নিক ব্যাপার থাকে অনেক সময়। খানিকটা আত্মসচেতন ভাব।মৃত্যুর পরও তাকে যেন নায়কোচিত দেখতে লাগে তার প্রস্তুতি হয়তো নিয়েছিল শুভায়ু। তবু অলোকেশের বয়ানে শুভায়ু ছিল ঘরের পোশাকে। আর আধঘন্টার ভিতর সে এতো সাজগোজ করে তারপর আত্মহত্যা করে ফেলল, এমন মানসিক স্থিরতা শুভায়ু পেল কোথা থেকে?

-কিন্তু শুধু বেশভূষার ভিত্তিতে কি এতোবড় সিদ্ধান্তে আসাটা ঠিক হবে?

-ঠিকই বলেছিস। সেক্ষেত্রে অন্যান্য সূত্রগুলোও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যেমন জানালা থেকে মাটির যেখানে দেহটা পড়েছিল, সেই দূরত্ব আত্মহত্যার ক্ষেত্রে উলম্ব হওয়াটাই উচিত ছিল। কিন্তু আমি পরিমাপ করে দেখলাম, সেই দূরত্ব তো নয়ই, বরং অনেকটাই অতিভূজের মতো।

-এর মানে?

-এর অর্থ, উদ্দিষ্ট ভিক্টিমকে কেউ পিছন থেকে ঠেলে দিয়েছিল!

আমি চমকে উঠলাম। শুভায়ু দের ঘটনাটার পিছনে হত্যার পরিকল্পনা থাকতে পারে ভাবিইনি। কিন্তু আশুদা যেন মৃতদেহের মাংসের একটা স্তর থেকে আরেকটা স্তরে পৌছোবার ব্যবচ্ছেদের মতোই সব কিছু যুক্তির স্ক্যালপেল দিয়ে স্পষ্ট করে দিচ্ছে।

-আরো সূত্র আছে অর্ক। শুভায়ুর ঘরে যে জানালা দিয়ে ও ঝাঁপ দিয়েছে, তার কাঠামোটা কাঠের। আমি মন দিয়ে দেখলাম। সেখানে জুতোর ঘষটানির দাগ স্পষ্ট, যদিও সেটা খানিকটা মোছার চেষ্টা হয়েছে বলেও আমার মনে হল। তবু...

-তার মানে একটা ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়েছিল।

-ব্রিলিয়ান্ট অর্ক।

-কে তবে ধাক্কা দিল শুভায়ুকে? ঘরে যারা ছিল? ঘরে তো দুই জন। শুভায়ুর স্ত্রী নবনীতা আর সুনন্দ। একজনের পক্ষে তো শুভায়ুকে ধাক্কা দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কি দুজনে মিলেই...

-আর অলোকেশ।

-তুমি কি অলোকেশকেও সন্দেহ করছ?

-ব্যবচ্ছেদের সময় কোনও সম্ভাবনাকেই তো উড়িয়ে দেওয়া যাবে না অর্ক!

-কিন্তু সেই তো সাতসকালে এসে শুভায়ুর খবরটা দিল। এমনকি তুমিও তো এই তদন্তে জরিয়ে পড়লে ওর জন্যই।

-নিজেকে নিরাপদ করে ফেলার এর থেকে ভালো উপায় কি আর আছে অর্ক? এটা একটা সম্ভাবনা। তোকে মাথায় রাখতে হবে। তবে, নিছক এটুকুই আমাকে ভাবাচ্ছে না। পিজিতে শুভায়ুর দেহটা দেখবার পর থেকে একটা অন্য চিন্তাও আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

-ওই উল্কিটা?

-ঠিক তাই। ওই চিহ্নটা আমি এর আগে কারো হাতে দেখেছি। অবশ্য ওই চিহ্নটা ট্যাটু আর্টিস্টদের খুব পছন্দের। তাই নেহাত কাকতালীয়ও হতে পারে। তবু...

-ওটা তো একটা উনালোম?

আশুদার চোখ উৎসাহে জোনাকির মতো জ্বলে ওঠে।

-সাবাশ অর্ক। বলতেই হবে এই তদন্ত আর এআই তোকে ক্ষুরধার করে তুলছে দিনদিন।

আমি মাথা চুলকে বলি,"গুগলে দেখলাম আশুদা। প্রাচীন বৌদ্ধ চিহ্ন। কেউ কেউ বলেন, এর উৎস প্রাচীন হিন্দুধর্মে। শিবের ত্রিনয়ন এই চিহ্নর উৎস।"

আশুদা উৎসাহ পেয়ে এবার একটা সাদা কাগজ টেবিলে পেতে শুভায়ুর দেহে আঁকা সেই 'উনালোম' এঁকে ফেলল। প্রথমে একটা কুলকুণ্ডলিনী। সে হল জন্ম ও জ্ঞানত হবার পর্যায়। তারপর রেখাটা প্যাঁচ খেয়ে বামদিক ডানদিক হয়ে উপরে উঠে গেছে। এই জটিল এপাশওপাশ হল জীবনের উত্থানপতন, টানাপোড়েনের ইঙ্গিত।এরপর সেই রেখা সরলরেখা হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে।এই সরলরেখা জাতকের পরিণত জীবনের প্রতীক। আমি বিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আশুদা, তুমি সম্বরণদাকে এই উল্কির স্যাম্পেল পরীক্ষায় পাঠাতে বললে কেন?"

আশুদা হেসে বলল,"শুভায়ুর ট্যাটুটার চারপাশের রক্তাভ আভা দেখে বোঝা যায় এটি সম্প্রতি করা। কিন্তু আরো মনোযোগ দিয়ে দেখলে বুঝতি, এই উল্কির উপরের তিনটি বিন্দুর ওপর এই আভা অসম্ভব বেশি। এর অর্থ?"

-চিহ্নর শেষ তিনটি বিন্দু পরে ট্যাটু করা হয়েছে।

-দুর্দান্ত অর্ক। আর সেই তিনটি বিন্দুর ভিতর বিষ থাকতে পারে। বিশেষত পারদ। পারদ অতিরিক্ত মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে তা নানান মানসিক বিকৃতি ঘটাতেই পারে। শুভায়ুর যে মানসিক অস্থিরতার কথা অলোকেশ আমাদের বলছিল, তার এই আকস্মিক মাত্রাতিরিক্ত হবার একটা কারণ এই বিষ হতেই পারে।

আমি ভাবছিলাম। আশুদার অনুমান সত্যি হলে এই রহস্যমৃত্যুর কারণ হিসেবে অনেকগুলো সম্ভাবনার পথ খুলে যাবে। তবে একটা কথা আমার মাথার ভিতরেও ঘুরপাক খাচ্ছিল। এই 'উনালোম' আমিও যেন কোথায় দেখেছি! খুব চেনাচেনা যেন।

-ওই শেষ তিনটি বিন্দুর অর্থ কী জানিস?

আমি চেয়ে থাকি। এতোটা খেয়াল করিনি আমি।আশুদা বলে চলে।

-উনালোমের উপর তিনটি বিন্দু থাকার অর্থ নির্বাণপ্রাপ্তি। নির্বাণ অর্থাৎ মোক্ষ। আর মোক্ষপ্রাপ্তির একটা পথ হল মৃত্যু!

তবে কি শুভায়ুর এই মৃত্যু পূর্বপরিকল্পিত! কী সাঙ্ঘাতিক। তবে আপাতত আশুদা রণে ভঙ্গ দিয়ে আবার ঋকবেদ খুলে বসল।"প্রতি ত্বা শবসী বদদ্ গিরাবপ্সো ন যোধিষৎ। যন্তে শত্রুত্বমাচকে।" ইন্দ্রদেবের মা অদিতি বলছেন ইন্দ্রকে, যে তার শত্রুতা কামনা করবে, তার সঙ্গে যুদ্ধ হবে পর্বতস্থিত অপ্সঃর মতো। এই 'অপ্সঃ' আমাদের আপাতত কোন দিকে চালিত করে, সেটুকুই দেখার। তবে আশুদার নিদান। কাল তথাগতর সঙ্গে কথা বলে আশুদা ঠিক করে রেখেছে। শুভায়ুর মৃত্যুমুহূর্তে ঘরে উপস্থিত আর শুভায়ুর সঙ্গে পরিচিত এমন কিছু লোকের ইন্টারভিউ নেবে আশুদা। যথারীতি আমাকেও সেখানে থাকতেই হবে। অর্থাৎ আবার একটা টগবগে ক্রাইম ডিসেকশন!

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন