কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় হিন্দী ছবি - পর্ব ১১ – ২০১৭ থেকে ‘থ্রিলার’

 


২০১৭ সালের ইত্তেফাক ছবির কাহিনী অভিনবত্বের দাবী রাখে। সাধারণ অপরাধমূলক কাহিনী যেভাবে শেষ হয় তার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে এই ছবির অপরাধী দু-দুটি হত্যা করেও অনুসন্ধানকারী পুলিশ অফিসারকে বোকা বানিয়ে, নিজের অপরাধের সবচেয়ে অপরিহার্য প্রমাণ – দুটি মৃতদেহের প্রথমটি – লোপাট করে অবলীলাক্রমে দেশ ছেড়ে চলে যায়। প্রথম হত্যার কারণও ছিল অপরাধীর আরেক গর্হিত কর্ম – পুরোপুরি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এক গণধর্ষিতা মহিলার পরিচয় সর্বসমক্ষে রাষ্ট্র করে দেওয়া, এবং এই কাজের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়াতে সচেষ্ট থাকা। অপরাধী যে শুধু নিজে পালিয়ে যায় তা নয়, তার আগে সে মিথ্যা প্রমাণ সাজিয়ে তার দ্বিতীয় শিকারের স্বৈরিণী স্ত্রী এবং তার প্রেমিককে সেই দ্বিতীয় শিকারের হত্যাকারী সাব্যস্ত করে পুলিশের হাতে বন্দী করায়!

মূল চরিত্রগুলির রূপায়ণে আছেন সিদ্ধার্থ মালহোত্রা, অক্ষয় খান্না, সোনাক্ষী সিনহা এবং মন্দিরা বেদী।

প্রসঙ্গত, অভয় চোপড়া পরিচালিত ইত্তেফাক-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল বি আর চোপড়া সংস্থা, যারা ১৯৬৯ সালে একই নাম দিয়ে রাজেশ খান্না ও নন্দা অভিনীত এক অপরাধ কাহিনী চিত্রায়িত করেছিল!

দুটি ছবিরই উৎস ১৯৬৫ সালের হলিউডি ছবি Signpost to Murder, যার পেছনে আছে ১৯৬২ সালে ব্রিটিশ নাট্যকার মন্টে ডয়েল রচিত ঐ নামেরই এক নাটক।



২০১৮-য় মুক্তিপ্রাপ্ত শ্রীরাম রাঘবন পরিচালিত আন্ধাধুন (অর্থ ‘অন্ধ’, ‘বাছবিচারহীন’ এবং ‘বেপরোয়া’)  অপরাধ কাহিনী হবার সঙ্গে-সঙ্গে এক অতি-উপভোগ্য, এবং নির্মম, ‘ব্ল্যাক কমেডি’। পরিচালক ২০১০ সালে নির্মিত স্বল্প দৈর্ঘের ফরাসী ছবি L’accordeur (The Piano Tuner) থেকে দৃষ্টিহীন পিয়ানো-বাদকের চরিত্রটি নেন। পুণে শহরে আকাশ সরাফ (আয়ুষ্মান খুরানা) নিজের পিয়ানো-বাজানোতে উৎকর্ষ আনতে অস্বচ্ছ ‘কন্ট্যাক্ট লেন্স’ পরে অন্ধের জীবন যাপন করে। সোফি নামের একটি মেয়ে (রাধিকা আপ্তে) তার দু-চাকার যান দিয়ে আপাত-অন্ধ আকাশকে ধাক্কা দিয়ে ফেলার ফলে আকাশ অনুতপ্ত সোফির বাবা ফ্র্যাঙ্কোর রেস্তোরাঁয় পিয়ানো বাজাবার বরাত পায় এবং সোফির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। রেস্তোরাঁয় হিন্দী ছবির প্রাক্তন নায়ক-অভিনেতা প্রমোদ সিনহা (অনিল ধাওয়ান) আকাশের বাজনা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে বলেন নিজের বিবাহ-বার্ষিকীতে আকাশ যেন তাঁর ফ্ল্যাটে গিয়ে তাঁর স্ত্রী সিমিকে (টাবু) পিয়ানো বাজিয়ে শোনায়।

নির্দিষ্ট দিনে আকাশ প্রমোদের ফ্ল্যাটে পৌঁছলে সিমি তাকে প্রথমে ঢুকতে দিতে চায় না। যখন আকাশ সিমিকে  বোঝায় যে সে অন্ধ তখন উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের  প্রতিবেশিনী মিসেস ডি’সার কৌতূহল এড়াতে সিমি আকাশকে  ঢুকতে দেয়। পিয়ানো বাজাতে-বাজাতে আকাশ ফ্ল্যাটে এক মৃতদেহ (প্রমোদের) দেখে। বাথরুম যাবার অছিলায় সে বাথরুমে এক পিস্তলধারী পুরুষকেও লুকিয়ে থাকতে দেখে। এই ব্যক্তি হলো মনোহর (মানব ভিজ), সিমির প্রেমিক। প্রমোদ দুজনকে হাতেনাতে ধরে ফেলায় তারা প্রমোদকে হত্যা করেছিল।

ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পুলিশে খুনের অভিযোগ জানাতে গিয়ে ‘অন্ধ’ আকাশ দেখে যে থানার ইন্সপেক্টার সেই মনোহর! আকাশ তখন অন্ধত্বের ভান করে নিজের বেড়াল খুন হবার গল্প ফাঁদে। প্রমোদের দেহ নদীতে পাওয়া যাবার পর (মনোহরই সেটি সুটকেসে ভরে নিয়ে গিয়ে সেখানে ফেলে দিয়েছিল) আকাশ প্রমোদের মেয়েকে পিয়ানো শেখাবার দায়িত্ব পায়। আবার প্রমোদ-সিমির ফ্ল্যাটে গিয়ে সে দেখে যে সিমি মিসেস ডি’সাকে বহুতলের বারান্দা থেকে নীচে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে, কারণ তিনি পুলিশকে প্রমোদের মৃত্যুর দিন ফ্ল্যাটে এক অজানা ব্যক্তির (মনোহর) ঢোকার কথা বলে দিয়েছিলেন।

এবার সিমি আকাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে কৌশলে জেনে ফেলে যে আকাশ দৃষ্টিহীন নয়, এবং মন্দিরের প্যাঁড়ার সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে আকাশকে সত্যিই অন্ধ করে দেয়। ইতিমধ্যে সোফি সেখানে উপস্থিত হলে সিমি ভান করে যে সে আকাশের শয্যাসঙ্গিনী। ক্ষুব্ধ সোফি আকাশের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করে এবং রেস্তোরাঁতে তার পিয়ানো বাজাতে আসাও বন্ধ করে।

এবার সিমি মনোহরকে আকাশের ফ্ল্যাটে পাঠায় আকাশকে খুন করতে। আকাশ দৃষ্টিহীন অবস্থাতেও কোনরকমে পালিয়ে রাস্তায় টেলিফোন পোলে ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরলে সে দেখে সে ডাঃ কৃষ্ণ স্বামীর (জাকির হুসেন)  ক্লিনিকে শয্যাশায়ী যেখানে ডাক্তার দুই সহচর মুরলী আর সখুকে নিয়ে দেহাংশ পাচারের বেআইনি ব্যবসা চালান। নিজের দুই মূত্রাশয় রক্ষা করতে আকাশ তাদের বুদ্ধি দেয় সিমিকে অপহরণ করে মনোহরকে এক কোটি টাকার ‘ব্ল্যাকমেল’ করতে। মনোহর টাকা দিতে আসার ভান করে মুরলীকে গুলি করে, সখু বহুতলের লিফটের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে লিফটের মধ্যে মনোহরকে আটকে দেয়। ক্ষিপ্ত মনোহর অন্ধকার লিফটের বন্ধ দরজায় গুলি করলে, সেই গুলি ফেরত ছিটকে এসে মনোহরকেই শেষ করে! মুরলীর প্রেমে পাগল সখু মনোহরের দ্বারা গুলিবিদ্ধ মুরলীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে দেখা যায় যে মনোহর ব্যাগে ভরে বেশীর ভাগ জাল টাকা এনেছিল!

ডাঃ স্বামী এবার অপহৃতা, তাঁর ভাষায় ‘লেডি ম্যাকবেথ’ সিমিকে, গাড়ির বুটে পুরে আকাশকে নিয়ে বিমানবন্দরের দিকে রওনা দেন। সিমির যকৃত তিনি বিক্রী করবেন মধ্যপ্রাচ্যের এক কন্যার কোটিপতি পিতাকে, চোখের তারাদুটি পাবে আকাশ আর মূত্রাশয় দুটি ডাক্তার ছেড়ে দেবেন খোলা বাজারে সর্বোচ্চ দরদাতার উদ্দ্যেশে! মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে সিমিকে ঘুমের ইনজেকশন দেবার জন্য বুট খুলতেই সিমি ডাক্তারকে পরাভূত করে গাড়ির চালকের আসনে এসে আকাশকে নেমে যেতে বাধ্য করে। এবার সে গাড়ি দিয়ে আকাশকে পিষে দেবার উপক্রম করে।

দু’বছর পর পূর্ব ইউরোপের কোন এক শহরে সোফি দেখে আকাশ পুরো বাদকের দল নিয়ে পিয়ানো বাজাচ্ছে আর শ্রোতাদের বাহাদুরি কুড়াচ্ছে। আকাশের কাছে সোফি সমস্ত ঘটনা শোনে।

ছবির শুরুতে আমরা দেখেছি একটা খরগোশ বাঁধাকপির খেতে ফসল নষ্ট করছে আর বন্দুকধারী এক পাহারাদার তাকে গুলি মারবার চেষ্টা করছে।

যখন সিমি আকাশকে চাপা দেবার উপক্রম করছিল, আকাশ সোফিকে বলে যে বন্দুকের গুলি ছোটে আর সেই লম্ফমান শশক গুলিবিদ্ধ হয়ে ছিটকে এসে সিমির চালানো গাড়ির কাঁচের পর্দায় ধাক্কা মারে, গাড়ি উল্টে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটে সিমির!

যাবার আগে সোফি বলে যে আকাশের ডাঃ স্বামীর কথা শুনে এই নরঘাতিনী সিমির দেহাংশ নিজের কাজে লাগানোই সমুচিত হতো।

এবার আকাশ তার অন্ধের ছড়ি নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ছড়ির এক বাড়ি মেরে রাস্তায় পড়ে থাকা একটা টিনের ক্যান সরিয়ে দেয়। সে কি আগের মতো অন্ধত্বের ভান করছে? অর্থাৎ সে কি সিমির চোখের তারা ব্যবহার করে দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে?

ছবির নামকরণ একেবারে যথার্থ। দু’রকম অন্ধত্ব – আসল ও নকল – আছে; সিমি-মনোহরের আচরণ আক্ষরিক অর্থে বেপরোয়া, কিন্তু তাদের ক্রিয়াকর্মের পরিণাম তাদের হিসেবের সঙ্গে মেলে না, ভাগ্যও আক্ষরিক অর্থে বাছবিচারহীন, যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, আমার কাছে, বিদ্যুৎহীন বন্ধ লিফটে ক্ষেপে গিয়ে মনোহরের গুলি ছোঁড়া আর  সেই গুলিই ছিটকে এসে মনোহরের পটল তোলা। আরও আছেঃ রাস্তায় পোলে ধাক্কা খেয়ে সংজ্ঞাহীন আকাশের দেহাংশব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়া, আবার সিমির দেহাংশের কল্যাণে আকাশের দৃষ্টি ফিরে পাওয়া, ইত্যাদি।

আন্ধাধুন ২০১৮-র তৃতীয় সফলতম ছবি।



২০১৩ সালের মালয়ালম ছবি দৃশ্যম ২০১৫-তে হিন্দীতে নিশিকান্ত কামাতের পরিচালনায় পুনর্নির্মিত হয়।(দাবি করা হয় যে ছবির কাহিনি ২০০৫ সালের জাপানী উপন্যাস The Devotion of Suspect X অনুপ্রাণিত, যদিও মালয়ালী পরিচালক জীতু জোসেফ একথা অস্বীকার করেছেন।) ২০২১ সালে এই অসাধারণ ও রূদ্ধশ্বাস থ্রিলারের দ্বিতীয় অংশ মালয়ালমে আসে এবং ২০২২-এ তা বলিউড পুনর্নির্মাণ করে। আমার বক্তব্য অভিষেক পাঠক পরিচালিত হিন্দী দৃশ্যম ২ নিয়ে, কারণ ২০২২-এর এই দ্বিতীয় সফলতম ছবিটিই আমি বড় পর্দায় দেখেছি। রহস্যের ঘোরপ্যাঁচ যাঁরা ছবিদুটি দেখেননি, তাঁদের জন্য ফাঁস করব না। বরং কেন এই ছবিদুটি আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, তাই নিয়ে বক্তব্য রাখব।

"কুপুত্র যদি বা হয় কুমাতা কখনো নয়" – একটি সর্বৈব মিথ্যা প্রবচন, যার অসারতা খবরের কাগজের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দেওয়া, মধ্যের পাতার দিকে নজর রাখলে বারবার প্রকট হবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভুবনের মাসীর কথা বলেই ক্ষান্ত দিয়েছেন, কিন্তু বাস্তব জীবনে ভুবনদের কুকীর্তি এবং তার থেকে তাদের প্রাপ্য শাস্তি থেকে তাদের রক্ষা করতে তাদের মায়েরা অনেক বেশী দৃশ্যমান। ২০১৭ সালে – যে বছরে মালয়ালী দৃশ্যম ২ আত্মপ্রকাশ করে – নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন রাখে যে একজন নয়, একদল মহিলা ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের গুণধর পুত্রদের সমর্থনে বাজার গরম করেন। এই ছেলেগুলি বিভিন্ন কলেজে মেয়েদের ওপর যৌন আক্রমণ চালিয়েছিল। প্রতিবেদনে এক ‘নারীবাদী’ বলে পরিচয় দেওয়া মা এও বলেন, “সত্যিই আমাদের ছেলেদের ধর্ষণ না করার শিক্ষা দেবার প্রয়োজন নেই!” "We don't really need to teach our sons not to rape.”

আমাদের দেশে বিহারের প্রাক্তন সংসদ হেমলতা যাদব তার পুত্র মৃত্যুঞ্জয় ওরফে বাবলুকে প্রতিবেশিনী চম্পা বিশ্বাসকে ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭-এর মধ্যে একাধিকবার ধর্ষণ করতে সাহায্য করে। মাতা-পুত্রদ্বয় তিন বছরের ওপর জেলের ঘানি টেনেছে।

অষ্টম পর্বে ২০১৬-র কাপুর এ্যান্ড সনস ছবিতে এক কুমাতার কথা বলেছি।

দৃশ্যম­-এ আমরা কী দেখি? ‘ফোর্থ গ্রেড ফেল’ বিজয় সালগাওঁকার (অজয় দেবগণ) গোয়ার পোন্ডালেমে কেবল টিভির ব্যবসা করে সংসার চালায়। বাড়িতে আছে তার স্ত্রী নন্দিনী (শ্রীয়া সরন), পালিতা কন্যা অঞ্জু (ঈশিতা দত্ত) আর ছোট মেয়ে অনু (মৃণাল যাদব)। ইস্কুল থেকে অন্যান্য ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ক্যাম্পে থাকাকালীন গোয়ার ইন্সপেক্টার-জেনারেল মীরা দেশমুখের (টাবু) কুপুত্র স্যাম/সমীর (ঋষভ চাড্ডা) অঞ্জুর নগ্ন অবস্থায় স্নানরত ভিডিও তোলে। অঞ্জু বাড়ি ফেরার পর স্যাম তাকে নিজের ফোনে সেই ভিডিও দেখায়। ২রা অক্টোবর রাতে সে বিজয়ের বাড়িতে বিজয়ের অনুপস্থিতিতে এসে অঞ্জু এবং নন্দিনীকে ভিডিওটি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার শাসানি দিয়ে যৌন ব্ল্যাকমেল করে। স্যাম এবার তার মাকেও তার কু-উদ্দেশ্যের লক্ষ্য করেছে দেখে দিশেহারা অঞ্জু স্যামের ফোন কেড়ে নেবার চেষ্টায় তাকে এক লোহার রড দিয়ে আঘাত করতে যায় আর দৈবদুর্বিপাকে সে রড স্যামের মাথায় লেগে স্যামের মৃত্যু ঘটায়।

বাকী ছবি জুড়ে আছে বিজয় কিভাবে তার পরিবারের সকলের ঢাল হয়ে দাঁড়ায় তার চমকপ্রদ এবং রূদ্ধশ্বাস চিত্রণ।

এখানেই আসরে অবতীর্ণ হয় হিংস্র প্রকৃতির ‘ক্ষমতায়িতা’ নারী মীরা। আপাত-নিরুদ্দেশ ছেলের ব্যাপারে যেহেতু বিজয় এবং তার পরিবারই সন্দেহের তালিকায়, মীরা দাঁড়িয়ে থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত সাব-ইন্সপেক্টার গাইতোন্ডেকে দিয়ে – যে নানা কারণে বিজয়ের প্রতি চরমভাবে বিরূপ – বিজয়, নন্দিনী, অঞ্জু, এমনকি শিশু অনুর ওপরেও বীভৎস শারীরিক নিপীড়ন চালায়, যা চরমে ওঠে যখন মীরা স্যামের সহপাঠীর কাছ থেকে নিজের ছেলের করা ভিডিওটি দেখে। এবার তো মীরা নিশ্চিত যে স্যামকে হত্যা করেছে এই পরিবারই, তা সে ছেলে অঞ্জুর নগ্নাবস্থার চলমান ছবি তুলেছিল তো কী!

দৃশ্যম-এর শেষে ‘ফোর্থ গ্রেড ফেল’ বিজয়ের বুদ্ধিমত্তার কাছে হার মানতে বাধ্য হয় মীরা, তার স্বামী মহেশ (রজত কাপুর), গাইতোন্ডে, সকলে।

দৃশ্যম ২-এর কাহিনি শুরু হচ্ছে আট বছর পর। সমাজে বিজয় এবং তার পরিবার কিন্তু নিন্দিত। অঞ্জুর বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে যাচ্ছে কারণ জনশ্রুতি বলে স্যাম ছিল ‘ভালো ছেলে’ অঞ্জুই তাকে প্রলুব্ধ করে বাড়িতে নিয়ে আসে, তারপর বিজয় বেগতিক দেখে স্যামকে খুন করে! বিজয় এরপর বুদ্ধি খাটিয়ে পুলিশকে ব্যর্থ করে, যার মূলে ছিল স্যামের দেহ লোপাট করা। এবার সেই দেহ পুনরাবিষ্ক্রিত হওয়ার উপক্রম। কোথায় বিজয় স্যামের দেহ পুঁতে রেখেছিল এবং প্রতিহিংসাকামিনী মীরা আর সাত বছর সাসপেন্ড থাকা গাইতোন্ডের হাত থেকে সে নিজেকে আর পরিবারকে কীভাবে রক্ষা করে তা জানতে হলে ছবিটি দেখুন। এবারেও আবার গাইতোন্ডেকে দিয়ে নন্দিনী, মৃগীরোগাক্রান্ত অঞ্জু (কারণ আগের ‘ট্রোমাটিক’ অভিজ্ঞতা) এবং অনুকে নির্মমভাবে প্রহার করাবে কুমাতা মীরা! মীরার বিশেষ লক্ষ্য এবার অঞ্জু কারণ সে আন্দাজ করে ফেলেছে যে স্যামের কীর্তির ফলে অঞ্জুর হাতেই ছেলের মৃত্যু ঘটেছিল। গাইতোন্ডের প্রহারের ফলে অঞ্জু পুলিশ স্টেশনেই মৃগী-আক্রান্ত হয়ে পড়ে, যা তার পক্ষে মারাত্মক হতে পারে বলে এর আগে ডাক্তার বিজয় আর নন্দিনীকে সাবধান করেছিলেন।

এক পিতা স্ত্রী এবং কন্যাদ্বয়কে রক্ষা করার কাজে নিজের বুদ্ধিমত্তা উৎসর্গ করেছে; আর নিজের নীচ স্বভাবের পুত্রের কুকীর্তি জেনেও তার মা’র একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেই পিতার এবং তার পরিবারের সর্বনাশ করা।

প্রবচনটি এবার সংশোধন করে বলতে হবে, ‘কুপুত্র যেমন হয়, কুমাতাও কম নয়!’



২০২৪-এ মুক্তিপ্রাপ্ত, শ্রীরাম রাঘবন পরিচালিত এবং ফ্রেদেরিক দার রচিত ফরাসী উপন্যাস Le Monte-charge (The Bird Cage) আধারিত মেরি ক্রিসমাস আপাত দৃষ্টিতে দৃশ্যম আর দৃশ্যম ২ থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম এক রহস্য কাহিনি। কিন্তু, মন দিয়ে দেখলে তিনটি ছবির গল্পে একাধিক সমান্তরলতা প্রকট হয়। দৃশ্যম ছবিদুটিতে এক কুমাতার দাপট দেখেছি, যার বিরুদ্ধে আছে (অনিচ্ছাকৃত) অপরাধে জড়িয়ে পড়া এক পরিবারের চার সদস্য যাদের প্রতি দর্শক সহানুভূতিশীল। মেরি ক্রিসমাস-এ এক কু-পিতা আছে, এবং তার বিপরীতে আছে তার স্ত্রী, কন্যা, এবং স্ত্রীর দ্বারা ঘটনাচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া এক ব্যক্তি। দর্শক কিছুক্ষণের মধ্যেই স্ত্রী মারিয়ার (ক্যাট্রিনা কাইফ) মুখ থেকে সেই ব্যক্তি, অ্যালবার্টের (বিজয় সেতুপতি) সঙ্গে জানতে পারবে যে মারিয়ার স্বামী জেরোম (লিউক কেনি) তাদের শিশুকন্যা অ্যানির (পরি মহেশ্বরী) ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছিল, যার ফলে অ্যানি হয়ে গেছে মূক! জেরোমকে আমরা প্রথম দেখি তার আর মারিয়ার ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায়, এবং তখন মনে হয় যে সে আত্মহত্যা করেছে। অ্যালবার্ট সেখানে উপস্থিত থাকা সত্বেও পুলিশ ডাকতে অস্বীকার করে। সে মারিয়াকে জানায় যে সে নিজের বান্ধবী রোজিকে (রাধিকা আপ্তে) হত্যার অপরাধে সাত বছর জেল খেটে সেই দিনই (দিনটি বড়দিনের আগের দিন) ছাড়া পেয়েছে। অতএব পুলিশ এলে জেরোমের মৃত্যুকে আত্মহত্যা নয়, তার আর মারিয়ার মিলে করা হত্যাকাণ্ড মনে করবে।

এরপর মারিয়া অ্যালবার্টকে ফ্ল্যাট থেকে বার করে দেয়। কিছুক্ষণ পর, রাস্তায় কফি খেতে খেতে অ্যালবার্ট অবাক হয়ে দেখে যে মারিয়া অ্যানিকে নিয়ে আবার বেরিয়েছে (এর কিছু আগে অ্যালবার্টের সঙ্গে মারিয়া আর অ্যানির দেখা হয়েছিল প্রথমে এক রেস্তোরাঁয় এবং তার পরে এক সিনেমা হলে।) এবার চার্চে গিয়ে অসুস্থ হবার ভান করে মারিয়া আরেকজন পুরুষকে ফাঁদে ফেলে, তার নাম রনি (সঞ্জয় কাপুর)। ঠিক অ্যালবার্টের মতো রনিকে মারিয়া নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায় এবং জেরোমের মৃতদেহের সামনে ফেলে। রনি পুলিশ ডাকে। পুলিশ ইন্সপেক্টার পরেশ কামদার (বিনয় পাঠক) এবং মহিলা কনস্টেবল লক্ষ্মী (প্রতিমা কাজমী) দুজনেই সন্দেহ করে যে রনি আর মারিয়া মিলে পরকীয়াসুখের জন্য জেরোমকে খুন করেছে। থানায় রনি অ্যালবার্টের কথা বলতে (অ্যালবার্ট রনি আর মারিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয়বার ফ্ল্যাটে গিয়েছিল, যে কথা প্রথমে পুলিশকে জানানো হয়নি) সেও জেল-ফেরত খুনের আসামী হিসেবে সন্দেহের তালিকায় চলে আসে।

অবশেষে একের পর এক চমক দিয়ে প্রায় তিন মিনিটের সংলাপহীন, শুধু আবহসঙ্গীত সম্বলিত এক দৃশ্যে কীভাবে ছবি শেষ হয় নিজেরাই দেখুন। দৃশ্যম-এর মতো দর্শক সহানুভূতি কিন্তু আপাত-অপরাধীর দিকেই।

চারটি রহস্য-চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করলাম। এর মধ্যে একটিতে অপরাধী দুটি খুন করে পুলিশকে প্রথমে বোকা বানিয়ে ও পরে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। আরেকটিতে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটাবার ফলে এক পরিবার বিপদে পড়ে, আর আমরা মনেপ্রাণে চাই যে উক্ত পরিবার হিংস্র এবং দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশের হাত থেকে মুক্তি পায় – এবং তাইই ঘটে। শেষ ছবিতেও আমাদের সহানুভূতি আপাত-অপরাধীদের দিকেই; যাদের মৃত্যু তারা ঘটিয়েছে, তাদের একজন এক পশ্বাধম পিতা (জেরোম) আর অপরজন এক পরকীয়ায় লিপ্ত পরস্ত্রী (রোজি) যে তার স্বামী এবং তার প্রেমিককে (অ্যালবার্ট) সমানভাবে শোষণ করেছে। একমাত্র আন্ধাধুন-এ আমরা অপরাধীর বিরুদ্ধে এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রের পক্ষে, এবং অপরাধীরা দুজনেই অপঘাতে মারা যাচ্ছে।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন