কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

পি. শাশ্বতী

 

রাসযাত্রার তাত্ত্বিক ও লোকায়ত বৃত্তান্ত

 


বারোমাসের তের পার্বণের দেশে রাসযাত্রা একটি অন্যতম জনপ্রিয় পার্বণ। যা শ্রীকৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু কৃষ্ণলীলার এই রাসযাত্রাটি আসলে কীসের দ্যোতক, এই তত্ত্বকথাটি আমরা সাধারণ মানুষ সত্যি সত্যিই কতটা গভীরভাবে জানি? বেশিরভাগই জানি না। ব্যাখ্যা অনুযায়ী রাস কথটির উৎপত্তি ‘রস’ থেকে। এই রস শুধুই আনন্দরস। তত্ত্বগতভাবে এই রাস উৎসব একটি জটিল তত্ত্বের মায়াজালে ঘেরা। যার গভীরতা জ্ঞানের অনেক অতলে তলিয়ে আছে। সেই আধ্যাত্মিক মায়াজালের খোঁজ পাওয়া আমাদের মতো সংসারী মনুষ্যকুলের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন ও জটিল। আমরা বাস্তব জীবনে রাসলীলা বা রাস উৎসবকে মধুরভাবেই পালন করে থাকি। এই উৎসব ভগবানের সঙ্গে ভক্তের মিলিত হওয়ার যাত্রাপথ রচনা করে দেয়। 

সাধারণ কথায়  বৈষ্ণবভাবজাত উৎসবগুলি এইভাবে চিহ্নিত হয় — দোলযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, রাসযাত্রা ইত্যাদি। এরমধ্যে কার্তিকী পূর্ণিমার রাত্রে যে উৎসবটির শুরু সেটিকেই আমরা রাসযাত্রা বা রাস উৎসব বলে মহাসমারোহে পালন করে থাকি। শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণ জীবনের নানা লীলাকাহিনি বর্ণিত হয়েছে, এই মহাপুরাণেই বিধৃত আছে রাস উৎসব আর তার উৎসকথা। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে বাস করছেন। বৃন্দাবনের গোপীগণ তাঁর অনুরাগী। কেলিকদম্বমূলে বসে তিনি যেই বাঁশিতে ফুৎকার দেন অমনি সেই বংশীধ্বনিতে গোপীদের প্রাণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাঁরা আর ঘরে থাকতে পারেন না। সকলেই যন্ত্রচালিতের মতো উপস্থিত হন সেই কদম্বমূলে। সেখানেই তাঁরা তাঁদের প্রিয় কৃষ্ণবরণ কালার সঙ্গে মিলিত হয়ে আলাপ করেন, আনন্দ করেন, মধুর রসে অবগাহন করেন; তাঁর সান্নিধ্যে স্নিগ্ধ হয়ে আবার নিজের নিজের ঘরে ফিরে যান। এই গোপীদের মধ্যে প্রধানা হলেন আয়ান ঘোষের স্ত্রী শ্রীরাধিকা। যদিও ভাগবতে কোথাও শ্রীরাধার নাম উল্লেখ করা হয়নি। এই নাম আমরা পরবর্তীকালে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মধ্যে বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হতে দেখি। রাস উৎসবের মূল নিহিত আছে কৃষ্ণ ও গোপীদের সম্পর্কের মধ্যে। এখানে কৃষ্ণ ও গোপীগণকে ভগবান ও ভক্তের প্রতীক বলে মনে করে এই উৎসবের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে। কৃষ্ণকে ভালোবাসেন গোপরমণীরা। তাঁরা শাস্ত্রজ্ঞ বা পণ্ডিত নন, কেবল ভালোবাসা দিয়েই তাঁরা কৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভ করছেন। শাস্ত্র সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বলা হয়, ‘এতে চাংশ কলা পুংশ কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং’। অর্থাৎ সকলে ঈশ্বরের অংশ বা কলা হলেও শ্রীকৃষ্ণ হলেন স্বয়ং ভগবান। কেন একথা বলা হল? কারণ সমাজে যখন নারী আর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ধর্ম সরে গিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের অধীন হয়ে যায়, যখন ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা বলেন — তুমি আমার কাছে এসো, আমি তোমাকে মুক্তি দেবো। তখন সেই ধর্ম সীমায়িত হয়ে পড়ে, পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।  ধর্মকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সঠিকভাবে  ছড়িয়ে দিতে অবতারের আবির্ভাব হয়। এ হল সনাতন ধর্মের বিশ্বাস। কৃষ্ণের জীবনেও আমরা তাই-ই দেখি। তিনি খুব সাধারণ মানুষের রূপ ধরে  সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মের দুরূহ তত্ত্বের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। রাস উৎসবের মর্মকথাও এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বুঝতে হবে। গোপরমণীদের সঙ্গে তিনি লীলার মাধ্যমে তাঁদের ধর্মের সজ্জায় সজ্জিত করে তোলেন। অধ্যাত্মের প্রেমরসে সিক্ত করে তোলেন তাঁদের মনপ্রাণ। যাতে তাঁরা সেই রস সঞ্চারিত করতে পারেন অন্য সাধারণ রমণীদের মধ্যে।

ভাগবতেই পাওয়া যায় শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অনুরাগী গোপরমণীদের বস্ত্র হরণ করেছিলেন। বিবস্ত্র রমণীগণ তাঁরই কাছে বস্ত্রকামনা করেছেন। কিন্তু কৃষ্ণের লীলার এমন রূপ কেন? ভগবান ভক্তের সমস্ত পাপ, লজ্জা, ঘৃণা, ভয়কে আকর্ষণ করে নেন নিজের মধ্যে। ভক্তের হৃদয়ে সেই শূন্যতার মধ্যে তিনি নিজে ভক্তহৃদয়ে বিরাজিত হন। এই বস্ত্রহরণের দিন কৃষ্ণ গোপীদের কাছে অঙ্গীকার করেন, পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি বৃন্দাবনে রাসলীলা করবেন।

‘যখন করেন হরি বস্ত্রহরণ

গোপীদের কাছে তিনি করিলেন পণ।।

আগামী পূর্ণিমাকালে তাঁহাদের সনে।

করবেন রাসলীলা পুণ্য বৃন্দাবনে।।’

শ্রীধরস্বামী বলছেন, ‘রাসো নাম বহু নর্ত্তকীযুক্তে নৃত্যবিশেষঃ।’ বহু নর্তকী-যুক্ত নৃত্যবিশেষের নাম রাসনৃত্য। হরিবংশ ও ভাসের বালচরিতে উল্লেখ আছে, শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে হল্লিশ বা হল্লিবক নৃত্য করেছিলেন। এই হল্লিশনৃত্য যদি তালযুক্ত ও বিবিধ গতিভেদে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় তবে তাকে রাস নামে অভিহিত করা হয়। তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘রসো বৈ সঃ’ অর্থাৎ ব্রহ্ম ‘রস’ ব্যতীত আর কিছুই নন। বৈষ্ণবদর্শনে এই রসকে মধুর রস বলেই চিহ্নিত করা হয়েছে।

রাসের যে কাহিনি আমরা ভাগবতে পাই তা খুবই বিচিত্র। ভাগবতে শ্রীশুকদেব রাজা পরীক্ষিৎকে বলছেন, 

‘ভগবানপি তা রাত্রীঃ শারদোৎফুল্লমল্লিকাঃ।

বীক্ষ্য রন্তুং মনশ্চক্রে যোগমায়ামুপাশ্রিতঃ।।’

পূর্বনির্দিষ্ট সেই শরৎকালীন মল্লিকা সুশোভিত শারদপূর্ণিমা রাত্রি। সেই রাত্রির শোভা দেখে ভগবান যোগমায়ার সাহায্যে গোপীদের সঙ্গে ক্রীড়া করতে ইচ্ছুক হলেন। তাই শারদ পূর্ণিমার তিথিতে কৃষ্ণ ধীরে ধীরে বাঁশিতে সুর তুললেন। আবার কারও মতে তিনি কামবীজ ‘ক্লীং’ বাজিয়ে সমস্ত অনুরক্তা গোপীদের আহ্বান করেন। এই সুর অনঙ্গবর্ধক সুর। যমুনার তীরে যে স্থানে তিনি বসে গোপীদের আকর্ষণ করেছিলেন সেই স্থানটি ‘রাসোওলি’ নামে খ্যাত। কৃষ্ণের বাঁশি শুনে গোপীগণ চঞ্চল হয়ে যমুনা তটে অপেক্ষারত কৃষ্ণের দিকে ধাবিত হলেন। তখন কোনো গোপী গরু দোহন করছিলেন, তিনি কালবিলম্ব না করে সেই অবস্থায় চলতে লাগলেন। কেউ দুধ জ্বাল দিচ্ছিলেন, তিনি চুল্লির উপর দুধের পাত্র রেখেই রওনা দিলেন। কেউ যব বা গমের রুটি তৈরি করছিলেন, সেই অর্ধ-সেঁকা রুটি রেখে কালবিলম্ব না করে ধাবিত হলেন। কোনো কোনো গোপী গৃহে অন্নাদি পরিবেশন করছিলেন কিংবা স্বামীসেবা করছিলেন, কেউ-বা অন্নগ্রহণ করছিলেন। সকলেই তাঁদের কাজগুলি অসমাপ্ত রেখে উঠে দাঁড়ালেন। এত দ্রুত তাঁরা যমুনাতটে উপস্থিত হলেন যে শরীরের ঊর্ধ্বভাগের বসন নিম্নভাগে বা নিম্নভাগের বসন ঊর্ধ্বাঙ্গে ধারণ করেই চলে এলেন। বসনবৈষম্য তাঁদের মনে কোনো বিকার সৃষ্টি করল না। যাঁরা গৃহে স্বামী বা পিতার নিষেধে অবরুদ্ধ হয়ে রইলেন তাঁরা অশ্রুপূর্ণ চোখে শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। এর ফলে তাঁরা সূক্ষ্ম শরীরে উপস্থিত হলেন কৃষ্ণের কাছে। ঈশ্বর লাভের প্রতি ভক্তের তীব্র ব্যাকুলতার যে চিত্র ভাগবতে তুলে ধরা হয়েছে তা একেবারে অসামান্য।

গোপীরা উপস্থিত হওয়ামাত্র কৃষ্ণ তাঁদের সঙ্গে নৃত্য করতে থাকলেন — এমনটি কিন্তু নয়। প্রথমে কৃষ্ণ এই ব্যাকুল গোপীদের পরীক্ষা করার জন্য বাক্যজাল বিস্তার করে বললেন, ‘‘এত রাত্রে তোমরা গৃহের কার্য অসম্পূর্ণ রেখে, কর্তব্যগুলি সমাপ্ত না করেই চলে এলে? গৃহের কর্তব্য করা প্রতিটি নারীর ধর্ম, আর এই বনের মধ্য দিয়ে আসতে ভয় করল না তোমাদের? যে-কোনা মুহূর্তে যে-কোনো বিপদ আসতে পারত। তা গোপীগণ, তোমাদের পিতা-মাতা, অভিভাবকগণ তোমাদের খোঁজ করবেন না? খোঁজ করাটাই স্বাভাবিক। তোমাদের তাই বলি, এখনই গৃহে ফিরে যাও!’’ গোপীগণ এ-কথা শুনে অবাক! এত রাতে নিজেই বাঁশিতে ডেকে এনেছেন, কিন্তু এখন আবার উল্টো কথা বলছেন!

কৃষ্ণের কথা শুনে গোপীদের মুখ মলিন হল, অভিমান হল, তাঁদের কেউ কেউ মুখ নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগলেন। কেউ-বা নাকের পাটা ফুলিয়ে কালাকে রাগ দেখাতে লাগলেন। কেউ মুখ ফিরিয়ে রইলেন। আবার কেউ বলে উঠলেন, ‘‘আমরা লজ্জা, ভয়, কর্ম ত্যাগ করে এসেছি ঠিকই, এতে হয়তো ধর্মচ্যুত হব, কিন্তু আমরা তোমার আশ্রিত, তুমি যদি আমাদের ত্যাগ কর তবে তুমি নিশ্চিত আরও বেশি পাপের ভাগী হবে। শরণাগতকে রক্ষা করা তোমার কর্তব্য।’’

কৃষ্ণ যখন গোপীদের পরীক্ষা করছিলেন তখন গোপীগণ কৃষ্ণের চারদিকে চারটি দলে বিভক্ত হয়ে ক্রমাগত বলে চলেছিলেন, ‘‘পতি পরিত্যাগ আমাদের ধর্ম কী অধর্ম তা পরে দেখা যাবে, কিন্তু আমাদের পরিত্যাগে তোমারই ধর্মদোষ বর্তাবে তা অপরিহার্য।’’

গোপীদের এই কথা শুনে কৃষ্ণ সহাস্যে যূথপতির মতো সেই যমুনা তটে বৈজয়ন্তীমালা ধারণ করলেন এবং গোপীদের সঙ্গে ক্রীড়া করতে লাগলেন।

বেশ কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর হঠাৎ সব গোপরমণীই মনে করলেন কৃষ্ণ তাঁরই সঙ্গে নৃত্য করছেন। কৃষ্ণ তাঁরই। মণ্ডলাকারে এই নৃত্য যখন খুব তন্ময়তা সৃষ্টি করেছে তখন প্রত্যেক গোপী কৃষ্ণকে একান্ত নিজের মনে করলেন এবং নিজেকে রমণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা বলে অনুভব করলেন। এই ভাবনা তাঁদের গর্বিত করল। গর্ব থেকে তৈরি হল অহংকার। সেই অহংকার তাঁদের ও কৃষ্ণের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করল। যেই এই ব্যবধান রচিত হল অমনি নৃত্যরতা গোপীদের ছেড়ে কেবল একজনকে নিয়ে কৃষ্ণ বনের গভীরে প্রবেশ করেন। এইখানে কেবল ভাগবতে রাধার উল্লেখ প্রচ্ছন্নভাবে পাওয়া যায়। যে গোপী অহংকারে স্ফীত হননি, যিনি গভীরভাবে কেবল কৃষ্ণসঙ্গেই তৃপ্ত ছিলেন, তাঁকে নিয়েই কৃষ্ণ রাসমণ্ডল থেকে সরে যান। এখানে উল্লিখিত একটি শ্লোক—

‘অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান হরিরীশ্বরঃ।

যন্নো বিহায় গোবিন্দঃ প্রীতো যামনয়দ্রহঃ।।’

গোপীগণ ভাবলেন, ‘‘এই রমণী নিশ্চয় ভগবান হরির আরাধনা করেছিলেন, তা না হলে কি গোবিন্দ আমাদের পরিত্যাগ করে প্রীতি সহকারে তাঁকে এই নির্জনস্থানে নিয়ে এসেছেন।’’ ‘অনয়ারাধিতো নূনং’ কথাটির মধ্যে থেকে রাধা শব্দটি বৈষ্ণব ভাবুকগণ তুলে নিয়েছেন। অর্থাৎ যে গোপরমণীকে নিয়ে কৃষ্ণ সকলের থেকে পৃথক হয়ে যান তিনি রাধা। কৃষ্ণ রাসমণ্ডল থেকে অন্তর্হিত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে গোপীদের চমক ভাঙে। তাঁরা কৃষ্ণ-অন্বেষণে ব্যাকুল হন এবং কৃষ্ণের পদচিহ্ন অনুসরণ করে চলতে থাকেন, এই সময় তাঁরা কৃষ্ণের লীলা স্মরণ করে নিজেরা তাঁর পূতনাবধ, গোবর্ধন ধারণ, কালীয় দমন ইত্যাদি ঘটনা অভিনয় করে দেখাতে লাগলেন।

এদিকে কৃষ্ণ যে গোপীকে একান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনিও নিজেকে একসময় শ্রেষ্ঠা ভাবতে শুরু করলেন। অবশেষে তিনি বসে পড়ে বলেন, ‘‘হে কৃষ্ণ, আমি আর বনভ্রমণ করতে পারছি না, তোমার যেখানে ইচ্ছা হয় সেখানে আমাকে নিয়ে চলো।’’ কৃষ্ণ একথা শুনে বললেন, ‘‘বেশ, তবে আমার কাঁধে ওঠো।’’ গোপী যেই কৃষ্ণের স্কন্ধে আরোহণ করতে গেলেন অমনি কৃষ্ণ অন্তর্হিত হলেন। একান্ত বিলাসিনী গোপী তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে, ‘হা কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ’ শব্দে কাঁদতে  লাগলেন। গোপীগণ সেই কান্নার শব্দে নিভৃতস্থানটি খুঁজে পেলেন, কিন্তু তাঁরা কৃষ্ণকে খুঁজে পেলেন না। এরপর তাঁরা অনেক আকুতি ও শরণাগতি নিয়ে কৃষ্ণের স্তব করলে কৃষ্ণ আবার সেই স্থানে ফিরে এলেন। তাঁরা সকলে ফিরে এলেন যমুনার তটে। আকাশে তখন পূর্ণচন্দ্র, বালুতটের স্নিগ্ধ বালু। এই লীলা দর্শন করার জন্য আকাশের চাঁদ তার গতি স্তব্ধ করেছে, গ্রহগণ একস্থানে স্থির হয়ে রয়েছে। তাই রাত্রি তার পরিক্রমা শেষ না করে অতি দীর্ঘ হয়ে উঠল। রাসলীলাকে যেন সে নিজ অঙ্গে জড়িয়ে রাখল। কৃষ্ণ এই সময় তাঁর গোপীদের নিয়ে বনক্রীড়া, জলক্রীড়া করতে লাগলেন। গোপীদের মুখ ভালোবাসায় জ্বলজ্বল করে উঠল, তাতে জ্যোৎস্নার আলো পড়ে এত শোভা ধারণ করল যা দেখে ভ্রমর পুষ্পস্তবক ভেবে রাতেই গুনগুন করতে লাগল। বিমানচারিণী দেবীরাও গোপীদের সুখতৃপ্ত-মুখ মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন। দেবতারাও উঁকি দিলেন। দেবর্ষি নারদ তখন দেখলেন, ষোড়শ সহস্র গোপীর সঙ্গে ষোড়শ সহস্র কৃষ্ণ নৃত্য করছেন। ধীরে ধীরে ঊষা উপস্থিত হল। ব্রাহ্মমুহূর্তে গোপীগণ যে যার ঘরে ফিরে গেলেন। সমস্ত রাত যে আন্দোলন হল সেটাই ভাগবতবর্ণিত রাস বা রাসযাত্রা।

এই কাহিনির মধ্যে সব থেকে আশ্চর্যজনক ক্ষেত্রটি হল কৃষ্ণ কি করে একই সঙ্গে সকলকে পৃথকভাবে সঙ্গদান করলেন। বলা হয়, এক্ষেত্রে কৃষ্ণ যোগমায়ার সাহায্য নিয়েছিলেন। যে মায়ার আবেশে গোপীগণের মনে হয়েছিল কৃষ্ণ তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই পৃথকভাবে বিরাজ করছেন। দ্বিতীয়ত, গোপীগণ অত্যন্ত দীনভাবের অনুসারী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অহংকার সৃষ্টিও একটি বিরল ঘটনা। ভক্ত ও ভগবানের মিলনের পথে যে ক-টি বাধার বিষয় আমরা দেখি, সেই অন্তরায়গুলি যেন একে একে উপস্থিত হয়েছে কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলার মধ্যে। অন্তরায়গুলি অপসারণের পথও কৃষ্ণলীলায় পরিস্ফূট হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগতের অন্যতম টীকাকার তাই বলেছেন, ‘নৃত্যগীতচুম্বনালিঙ্গনদীনাং রসানাং সমূহো রাসস্তময়ী যা ক্রীড়া’ বা রাসক্রীড়া রূপে চিহ্নিত।

যদি আমরা আরও গভীরে গিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করি, তাহলে দেখা যাবে রাস হল জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের সুখানুভূতির সার্থক লোকায়ত বর্ণনা। যে বর্ণনার মধ্য দিয়ে মানুষ খুব সহজে ক্ষুদ্র আমির সঙ্গে বৃহৎ আমির মিলনের ক্ষণটি বুঝতে সক্ষম হবে। বৈষ্ণবভাব মূলত দ্বৈতভাব। ভগবান প্রভু ও আমি ভক্ত, তাঁর দাস। কিন্তু রাস উৎসবের মধ্য দিয়ে ভক্ত ও ভগবানে অদ্বৈত, এক হয়ে যাওয়ার অনুভূতিকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘রসো বৈ সঃ’ অর্থাৎ ব্রহ্ম রস ব্যতীত আর কিছুই নন।  বৈষ্ণবদর্শনে এই রসকে মধুর রস বলেই চিহ্নিত করা হয়েছে।

আগেই বর্ণিত, তত্ত্বগতভাবে রাস উৎসব যতই গভীর হোক না কেন, বাস্তবে এই উৎসবটি কিন্তু মধুরভাবে লোকায়ত প্রেক্ষিতে পালিত হয়। ভগিনী নিবেদিতা এই উৎসবটির বর্ণনাকালে বলেছেন, ‘‘কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিটিতে কেউ চাঁদকে কি দেখেছেন। আমাদের উৎসবগুলি চাঁদের গতিবিধির উপর যেন বেঁধে দেওয়া এক কাব্য। প্রতিটি পূর্ণিমা, প্রতিটি অমাবস্যায় কিছু না কিছু উৎসবের সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতিটি পূর্ণিমাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণের সুযোগ যার হয়েছে সে অনায়াসে বুঝবে কার্তিকী পূর্ণিমায় চাঁদের বাহার অন্য পূর্ণিমার থেকে অনেক বেশি।’’

বর্ষার ঘনঘটা নেই, শীতের কুয়াশায় চারদিক আচ্ছাদিত। এই সময় মিঠে আলো দেওয়া চাঁদ ভারি মনোহর। রাত যত গভীর হয় ততই স্তব্ধতা বৃদ্ধি পায়। সেই চাঁদের আলোয় ঘরে ঘরে, মন্দিরে মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহকে  নিয়ে আসা হয় আগে থেকে তৈরি করে রাখা  রাসমঞ্চে। কোনো কোনো মন্দিরে পৃথক রাসমঞ্চ তৈরি করা থাকে। সেই রাসমঞ্চ ফুল-পাতা ও আলো দিয়ে সাজানো হয়। রাধা-কৃষ্ণের মনোহর মূর্তির পাশে থাকেন শ্রীরাধিকার অষ্টসখী আর একটি তুলসী মঞ্জরী। সেই মঞ্চের চারপাশে গোপী ও কৃষ্ণের নৃত্যরত মূর্তি সাজানো থাকে। সমস্ত জায়গায় কৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা-কাহিনিকে মূর্তি দিয়ে সাজানো হয়। যেমন পূতনা বধ, ননীচুরি, গোবর্ধন ধারণ ইত্যাদি। রাস উপলক্ষ্যে বহু মন্দিরপ্রাঙ্গণে মেলা বসে। আর বৈষ্ণব আখড়াগুলিতে বেজে ওঠে বাঁশি। তার সঙ্গে মৃদঙ্গ আর খঞ্জনির সঙ্গতে পরিবেশ রসমণ্ডিত হয়ে ওঠে। বৈষ্ণবীর কণ্ঠে বাজে কৃষ্ণলীলার মাধুরী মেশানো গীতধারা — সব নিয়ে একটি মধুর উৎসব রাস। এই রাসনৃত্যর পাঁচটি ভাগ আছে — মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, দিব্যরাস ও নিত্যরাস।

সমগ্র ভারতের মধ্যে মণিপুর অঞ্চলে রাস একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র এই রাস উৎসবের প্রচলন করেন। কথিত আছে, তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই উৎসবের সূচনা করেন। নিজের কন্যাকে রাধা ও মন্দিরের কৃষ্ণকে নিয়ে রাসনৃত্য সৃষ্টি করেন। তিনি নিজে ছিলেন মৃদঙ্গবাদক। শোনা যায় ওই তালবাদ্য তিনি স্বপ্নেই পেয়েছিলেন।

বাংলায় মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থান নবদ্বীপ ও শান্তিপুরে রাস উৎসব অত্যন্ত জমকালোভাবে পালিত হয়। তবে ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলায় যে নবজাগরণ হয়, তার অনিবার্য হোতা যেমন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, ঠিক তেমনই সমসাময়িক সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তান্ত্রিক সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তাঁর মাধ্যমেই নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র (১৭২৮-’৮২) এই নবদ্বীপে শাক্তরাসের আয়োজন করেন। রাসের সময় এখানে বড় বড় শক্তিমূর্তি প্রস্তুত করে সেগুলি নিয়ে নগর পরিক্রমা করা হতো। তাই 'বৈষ্ণবরাস'-এর সঙ্গে ‘শাক্তরাস’ও বাংলার একটি উৎসব।

শান্তিপুরে বৈষ্ণব রাসকেই দীর্ঘ করা হয়েছে। ওখানে রাস চারদিনের উৎসব। তৃতীয় দিনে সজ্জিত রাসলীলার মূর্তিগুলিকে নিয়ে নগর প্রদক্ষিণ হয়। এই উৎসবকে ‘ভাঙা রাস’ বলা হয়। চতুর্থ দিন হয় ‘ফুলদোল’। ফুলের সাজে দেবতারা সুসজ্জিত হন। উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে বিখ্যাত মদনমোহন মন্দির। তার পাশেই সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির। ফুলদোলে কিন্তু দুই মন্দিরই সজ্জিত হয় ফুলের বেশে।

সেই কবে, কোন যুগে কৃষ্ণ অনঙ্গ আহ্বানে বংশীধ্বনিতে বৃন্দাবন মুখরিত করেছিলেন, আজও সেই বাঁশি বেজে চলেছে। ভক্তহৃদয়কে আপ্লুত করে আকর্ষণ করে সৃষ্টি করছে নিত্যনতুন ভক্ত-ভগবানের লীলাখেলা। এ রাসনৃত্য, ভক্তের ভগবানে মিলিত হওয়ার যাত্রা। তাই একে আখ্যায়িত করা হয় রাসযাত্রা।।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন