![]() |
| সমকালীন ছোটগল্প |
কালান তার (পরিত্রাতা)
সাধ্বী রিপসিমা ও সেসংক্রান্ত শোকগাথা
Sacred to the memory of Aviet Ter Gregory Esqr.!
Who was born at Shiraz in Persia?
And departed this life on
the 9th May 1862 at Dacca,
Of which he was an old
resident at the advanced age of 108 years 4 months and 4 days.
: C.J.SANRIES, C.
Sacred to the memory of Khatch Khatun,
P.Elict of the Late David
Fridovitch Melickbaglar,
Died on June 1893.
‘Go home my child and cease
your tears,
I must be here till Christ
appears."
...আহা যতেক পক্ষীর বিষ্ঠা! কবর সকলের মর্মর বেদিতে মলিনতা। এই গোরস্থানে যারা এখন ঘুমিয়ে আছে, তাদের ভেতর পারস্য বা অদ্যকার ইরাণের জুলফা কি সিরাজে জন্ম নেওয়া আর্মেনীয়দের সংখ্যাই বেশি, এরেবুনি বা ইয়েরেভান নগরী হতে বহু দূরে।
তিনি
নিজে কখনো দ্যাখেননি ইয়েরেভান! শুধু মা-বাবার কাছ হতে গল্পে গল্পে আর ইংরেজি ও
আর্মানী উভয় ভাষার ধর্মগ্রন্থ পাঠ হতে যতটুকু জানা!
শঙ্কর!
শঙ্কর!
কালোপানা
শঙ্কর ত্রস্ত ভঙ্গিতে এসে দাঁড়ায়।
চা
হয়? আর এসকল কবর বহু নোংরা আছে!
একা
মানুষ সবদিক সামলানো কঠিন কত্তা!
শঙ্কর মিনাস মার্টিরোসেন সিরকো সাহেবের ঘরে ঢুকে পড়ে। ভেতরের দুটো ঘর পেরিয়ে তবে রান্নাঘর। বউ মরেছে বছর কুড়ি হয়ে গেল! ছেলে-মেয়ে চারটা সেই কানাডায়। বুড়ার তাই আব্দারের শেষ নাই। তাকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা বানিয়ে দাও। হুকুমের নানা খাবার বানিয়ে খাওয়াও! আবার, ম্যালা হাঁক-ডাক! শঙ্কর, কবরগুলোতে কাক পাখি ময়লা করেছে! ওরে সাদা চামড়া বুড়া আর্মানী, এই আর্মানীটোলায় তোদের গুষ্টির একজনও আর নাই! তুই বুড়া সেই সতেরোশ’ সালের গির্জা একখান আজো পাহারা দিয়ে আছিস! আমি শাঁখারির ঘরের পোলা - বউ-সংসার ফেলে এসে সারাদিন রাত তাকে দেখাশোনা করি। ক্যান, তোর জাতের খ্রিস্টান...আর্মানী না হোক, বাঙালি...ধরা যাক, আমার মতোই কালো পানা কোন খ্রিস্টান এসে তোকে দ্যাখে না ক্যান? করিস তো আমার সাথে কটর কটর। ক্ষমতা থাকে যা না এ পাড়ার গুন্ডা আবুল হিরণচি আর তার সাথের ছেলে-পিলেদের সাথে গিয়ে ক্ষমতা দ্যাখা! তা’ পারবি না! পারলে কি এই দুপুর বেলা গেটে তালা দিয়েও সারাক্ষণ কান উঁচিয়ে রাখতি কে আসে যায় কি কেউ কড়া নাড়ে কিনা? আর ছিল তোর এক পাগলা শিয়া মুসলমান দোস্ত টাঙ্গাঅলা...সে টাঙ্গাঅলার সাথে কি ফুসুর-ফাসুর বাপ রে বাপ! সে ব্যাটা আলী হাক্কানিও মরেছে আজ বহুকাল!
...অধিকাংশ
কবরের গায়েই ইংরেজি আর আর্মানী দু’টো ভাষাতেই লেখা। শঙ্কর চা দিতে বড় দেরি করে।
শঙ্কর,
চা দেরি হয়!’
হুম...
গোটা জীবন বাঙালিদের সাথে কাটিয়েও, বলে এই দেশে জন্মে-মরে-ভুত হয়েও সাহেবের বাংলার
কি ছিরি! এই যে বুড়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে লিখতে বসবে। লিখতে বসা মানে আগডুম বাগড়ম
নানা গল্প। একটু পর পর ডাক দিয়ে আবার শঙ্করকেই সে শোনাবে।
বুঝিলে
শঙ্কর, কালান তার শব্দের অর্থ কি হয় তুমি জানো?’
না
কত্তা!’
কালান
তার অর্থ পরিত্রাতা!’
আমি
সত্য-ক্রেতা-দ্বাপর যুগের গল্প জানি কত্তা! ত্রেতা যুগের অবতার ছিলেন রামচন্দ্র!’
‘ত্রেতা
নহে, শঙ্কর। ত্রাতা। কালান তার সকল সময়ে জন্মে না। কালান তারের অভাবেই আর্মানী
জাতির ইত্যকার কষ্ট। রাজা মহামতি দ্বিতীয় তিগ্রানেস ছিলেন আর্মানী জাতির কালান
তার। তুমি শঙ্কর ক্লাস এইট পড়ে! তবু তুমি কিছু জানে না!’
অবস্থা
দ্যাখো সাহেবের! ত্রেতা না ত্রাতার মতো কঠিন শব্দ কইতে পারে আবার
শঙ্কর কিনা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে এটাকে ঠিক ভাবে বলতে পারে না!
তারেক
জিয়া ছাড়া পাইছে কত্তা! আইজকার গরম খবর! এখনকার রাজা বাদশাদের কাÐ দেইখাই দিন পার
হইয়া যায়, তা ইতিহাসের রাজা-বাদশাদের খবর দিয়া আমি কি করব?
ইতিহাস
দিয়া কি করবে? তুমি জানো এখানে কত কত মিউটিনির সময়ে সিপাহির লাশ আছে শঙ্কর? আমার
গ্র্যান্ড মা'র মা...তার নাম রিপসিমা...আর্মানী মহিলা...শি ম্যারেড অ্যান আইরিশ
সোলজার অফ দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি? তারও কবর আছে এখানে! কি তোমার ইতিহাস ভালো
লাগে না? ইতিহাস না থাকলে কিছু থাকে না শঙ্কর!
জবাব
না করে ঘাড় গোঁজ করে মিনাস সিরকো সাহেবের চায়ের কাপে চামচ দিয়ে চিনি নাড়তে থাকে
শঙ্কর।
‘রিপসিমার
গল্প শোন শঙ্কর। রিপসিমা তো আমাদের জাতির এক বড় সতী হয়। তোমাদের যেমন ধরে সীতা বা
সাবিত্রী!
‘চুলায়
রান্না উঠাইছি। রান্না নামায় আসি কত্তা?’
মনে
মনে একটু মায়াও হয় শঙ্করের। আহা একা মানুষটা! কথা বলার লোক বলতে সে এই শঙ্কর নাগ।
রান্নাঘরে ঢুকে তড়িঘড়ি ‘বাংলা তোলমা’ নামিয়ে ফ্যালে শঙ্কর। শঙ্করের মা’কে এই
রান্না শিখিয়েছিলেন সিরকো সাহেবের মা স্বর্গীয়া এলেনা দেবী। ওদের নিজেদের দেশে
মুরগির কিমা আর ভাত আঙুরের পাতায় মুড়ে ভাপে সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। বাংলাদেশে আর আঙুর
পাতা পাওয়া যাবে কই? তাই লাউ পাতা, কুমড়া পাতা বা কলা পাতাই সই। মজা করে তোলমা-র
নাম ‘বাংলা তোলমা’ রাখা স্বর্গীয়া এলেনা দেবীরই কাজ। ‘বাংলা তোলমা’ কড়াই হতে
বাটিতে ঢেলে গামছায় হাত মুছে চায়ের কেটলি হতে অবশিষ্ট চাটুকু নিজের কাপে ঢেলে
তড়িঘড়ি সাহেবের সামনে এসে একটা মোড়ায় বসলো সে।
আজকাল
তুমি আমার কোন কথা শোনে না শঙ্কর! তোমার টাইম কম! সাহেব অভিমান করে।
না,
কন না কত্তা! কইছিলেন আপনাদের জাতের সীতা দেবীর কথা?
‘হাঁ,
ও যো আছিল...ওর নাম হইছিলো রিপসিমা! দ্যাখো, আমাদের দেশ যখন তোমার রোমের সৈন্যরা
দখল করিয়া নিলে, সে প্রায় তোমার হাজার বছর আগের কেস্সা... তখন রোমের সম্রাট ছিল
দায়োক্লেতিয়ান। বলো ত’ দেখি শঙ্কর?’
এত
কঠিন নাম কইতে পারুম না কত্তা! আপনি গল্পটা এ্যামনে কইয়া যান। যা বোঝার আমি বুইঝা
লমু!
সেইসময়
প্রভু যিশুর ধর্ম মানে খ্রিস্টান ধর্ম মাত্র তোমার প্রচার হইতেছিল। সারা পৃথিবীতে
একজন/দু’জন খ্রিস্টান! রোম দেশে রিপসিমা নামের এক পরমা সুন্দরী মেয়ে তো খ্রিস্টান
হইলো! এখন রোমের রাজা আসিয়া সারা দেশের সব সুন্দরী মেয়েদের জড়ো করিল যে কাহাকে সে
বিয়া করিবে। তার পছন্দ হইলো রিপসিমাকে। খোদ রোমেও তখন খ্রিস্টান ধর্ম নাই। তাহারাও
তখন তোমাদের হিন্দুদের ন্যায় নানা দেব-দেবীর পূজা করে।‘
‘তাই?’
‘এই
লক্ষ্মী-সরস্বতী-দুর্গা-কার্তিক-গণেশ?’
না!
ঠিক তাহা নহে। তাহাদের দেবতার নাম ছিল অন্যরূপ! যাহাই হউক... রিপসিমা যেহেতু
খ্রিস্টান, সে কহিলো যে সে পুতুল পূজারী...মনে কষ্ট লইয়ো না শঙ্কর...যে সে পুতুল
পূজারী রাজাকে বিয়া করিবে না! রিপসিমা পলাইয়া আসিলো আর্মেনিয়া!
তারপর?’
আর্মেনিয়া
আসিয়া রিপসিমা পড়িলো আর এক বিপদে। আর্মেনিয়ার রাজা তখন তৃতীয় ত্রিদাতেস। কও তো?
ওহ, তুমি ত’ আবার তাহা কইতে পারিবে না শঙ্কর! ত্রিদাতেসও দেব-দেবী পূজা করিতো! সেও
রিপসিমার প্রেমে পড়িলো!
দুই/দুইখান
রাজা এক মাইয়ার প্রেমে পড়লো কত্তা?’
‘হয়।
আর দ্যাখো তাহার কি তেজ...সে এই রাজাকেও কইয়া দিল যে সে বিবাহ করিবে না! ত্রিদাতেস
তখন রিপসিমা আর তার বান্ধবীদের পাথর ছুঁড়িয়া হত্যা করিতে আদেশ দিলো!
শঙ্কর
চা ঠান্ডা করে তখন হাঁ হয়ে গল্প শুনছে।
কি
তেজ গো মাইয়ার! দুই/দুইটা রাজারে ছ্যাঁকা দিয়া দিলো? তা সত্যি সত্যি মরলো নিকি?'
হাঁ,
মারা গেল! কিন্তু, হত্যা করিবার পরেই...ত্রিদাতেস পাগল হইয়া গেল! সে সত্যই প্রেমে
পড়িয়াছিল! তাই, ভালোবাসার মানুষকে হত্যা করিবার পরে ও পাগলের মতো করিতে লাগিল।
আমাদের ধর্মের এক বড় সন্ন্যাসী সেইন্ট গ্রেগরি ছিল তখন রাজার জেলে আটক। কিন্তু,
তিনি চিকিৎসা জানিতেন। রাজাকে চিকিৎসা করিতে তাহাকে ছাড়া হইলো। গ্রেগরি ওকে সুস্থ
করিলো তো ফের খ্রিস্টানও বানাইলো। রাজা সুস্থ হইয়া রিপসিমা যেখানে মরিয়াছে সেখানে
বানাইলেন শোকাগাৎ গির্জা। শোকাগাৎ অর্থ তোমার বাংলায় হইবে সূর্যরশ্মি। রাজা এরপর
বহু দেব-দেবীর মন্দির ভাঙ্গিয়া গির্জা বানাইলেন। যেমন তোমার এখমিয়াদজিন
গির্জা...আমাদের প্রধান গির্জার নিচে নাকি আছে পূজার বেদি...সেইখানে আগুন আর জলের
দেবতার পূজা হইত...বাপ-দাদার আচার মানিয়া তোমরা হিন্দুরা যেমন পাঠা বলি দাও...আমরা
খ্রিস্টান হইলেও ঐ আগের আচার...ধরো ভেড়া, মুরগি বা কবুতর বলি দিয়া থাকি গির্জার
অভ্যন্তরে! আর এক কাপ চা হইবে কি শঙ্কর?
গল্পের
নেশা ফেলে শঙ্কর চা আনতে উঠে পড়ে।
তা
কত্তা। আপনের গ্র্যান্ড মাদারের মা মানে কি ঠাকুরমা’র মা’র নাম?
‘না,
আমার ঠাকুরমা নয়...তোমরা যাকে বলো দিদিমা বা নানীর মা’র নাম রেখেছিল তার বাবা
রিপসিমা নামে। আমার গ্র্যান্ডমাদারের গ্র্যান্ডফাদার প্রথমে এসেছিলেন মোগল আমলের
শেষের দিকে। গোয়া হয়ে আগ্রা-দিল্লি-কলকাতা হয়ে ঢাকা আসেন। আমার গ্র্যান্ড মা’র মা
রিপসিমা বিয়ে করেন উইলিয়াম হার্নিকে। আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে তার বাসা। সিপাহি যুদ্ধের
বড় সোলজার ছিলেন। সেই মিউটিনির সময়...১৮৫৭ সালে তার বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর... ১৯০১
সালে মারা যান ছিল...আমার মা ও তার নাতনী শেনোবিয়া স্টিফেন ডাক নাম এলেনা তাহার
মাতামহের জন্য কবরের এপিটাফ খাড়া করেছে। পড়ো নাই কি?
In loving memory of William Harney (Mutiny Veteran),
Born
23 March 1830.
At
Belfast, Ireland.
Died
at Dacca on 16th July 1901- aged 71 years.
রিপসিমা অবশ্য মারা গেছিলেন স্বামীর তিনবছর আগে। ১৮৯৮ সালে!
আমার
ঠাকুর্দার কাছে মিউটিনির গল্প শুনছি কত্তা। লেংটাকালে বাহাদুর শাহ পার্কে গোরা
সৈন্যের হাতে হিন্দু-মুসলমান সিপাইদের ফাঁসি তিনি দেখছেন!’
তোমাদের
ফ্যামিলিকেও আমি তিন পুরুষ ধরে জানে শঙ্কর! তোমরা শাঁখারিরা ঢাকা এসেছে সেই যে কিং
বল্লাল সেনের পিরিয়ডে। তোমার ঠাকুর্দা, বাবা আর তুমি... তোমরা কেউ তো শাঁখ কাটার
কাজে গেলে না!Õ
কিন্তু,
আমার জ্যেঠা, কাকা, জ্যেঠতুতো কাকাতো ভাই-বোনরা করতাছে তো এই কাজ! নিজের ছেলে
দুইটা তো এখনো ছোট!
হাঁ,
দ্যাখো শঙ্কর- আমি তোমাদের শাঁখারিদের কথাও কিছু জানে! ব্রিটিশের আমলে ছয় হাজার
ডুবুরি মিলা সাগরের নিচ দিয়া তোমার শঙ্খ আনিতো! ইভেন ফ্রম দ্য বে অফ মানার অর দ্য
ইন্ডিয়ান ওশেন অন দ্য ব্যাঙ্কস অফ সিলন- মানার উপসাগর কি শ্রীলঙ্কার কুল হইতে এক
এক সীজনে পাঁচ লাখ শঙ্খ তুলিয়া ঢাকায় আনা হইতো। ধনী শাঁখারিরা এই সকল শঙ্খ পাইকারি
কিনিতো আর গরিব শাঁখারিরা কিনিতো খুচরা হিসাবে। আমি ডাউট করি কি তোমাদের ভেতর কিছু
বিদেশি রক্ত রহিয়াছে। তোমাদের কিছু কিছু ফ্যামিলিতে ফর্সা রং, লাল চুল আর নীল
চোখের ছেলে-মেয়ে আছে। তাহাদের আবার যে পরিবারে বিয়া হয়, সেই পরিবারের নতুন
শিশুদেরও ঐ রূপ চোখ মুখ হয়। শুধু আমরা আর্মানীরা খুব একটা মেলা-মেশা কাহারো সাথে
করি নাই! সে যাক, আমাকে আদালতের জন্য উঠিতে হইবে!’
‘ভাত
না খাইয়াই উঠবেন কত্তা? আইজ বাংলা তোলমা করছি! আসিয়া খাবো!’
কবিতার ফেরিওয়ালা
কে আমি?
আমি
এক নিঃস্ব কৃষিজীবী,
কখনো
বা পরাক্রান্ত প্রাচীন সম্রাট,
আমি
ধর্মান্ধ ও স্বধর্মত্যাগী-
আমি
সেই ইগ হায়েক,
সুফলা
জমি ছেড়ে যে আশ্রয় নিয়েছে গুহায়!
আমি
তিগ্রানেসের তীব্র তলোয়ার..
খ্রিস্টিয়
বাইজান্টিয়াম কি পৌত্তলিক পারস্য,
সন্ত
গ্রেগরির অলৌকিক ক্রুশ-
কিছুই
রক্ষা করতে পারেনি আমাকে,
যতদিন
না মেসরোপ মাশতোতস।
রক্তের
অক্ষরে লিখেছেন আমার বর্ণমালা-
আমি
তরুণ ইসাকিয়ান, কবিতার ফেরিওয়ালা!
আমি
ইনাম আর্মেনিয়া,
চিরন্তন
বাস্তুহীন যাযাবর!
মাইকেল সিরকোকে দেখেই ভাগ্নে স্টিফেন ম্যাকারটিক লজ্জায় খাতা লুকিয়ে ফেললো। স্টিফেন সম্ভবত কবি। গত দু’দিনে তার টেবিল হতে উদ্ভট সব কাগজ-পত্র উদ্ধার করেছেন সিরকো। ছোট বোনের স্বামী নয়া জুলফা হতে ঢাকা এসেছেন মাত্র ১৮৫০ সালে। মাইকেল সিরকো এসেছিলেন আরো আগে। স্টিফেন তখন আঠারো বছরের যুবক। ঢাকায় ব্যবসার সুবিধা হচ্ছিল না দেখে সিরকোর পরামর্শেই বোন ও বোনের স্বামী চলে গেলেন নারায়ণগঞ্জ। পাটের ব্যবসায় ভালোই করছে তারা। সমস্যা স্টিফেনকে নিয়েই। ছোটবেলা থেকেই সে প্রায়ই জ্বরে ভোগে। এই চব্বিশ বছরের ছেলেটি বলতে গেলে মেয়েদের মতো লাজুক ও চুপচাপ স্বভাবের। কিছুদিন হয় সে মানসিক অবসাদে ভুগছে। বোন জানিয়েছে ভাগ্নে নয়া জুলফা ছেড়ে আসার আগে একটি আর্মেনীয় পরিবারের মেয়ের সাথে প্রেম ছিল তার। তার প্রেমিকাকে পারস্য সম্রাটের সৈন্যরা বর্শার মুখে নিয়ে গেছে। ভাগ্নে বাবা-মার সাথে এই বাংলাদেশের ঢাকা অবধি চলে এলেও প্রেমিকাকে ভুলতে পারেনি। কিছুদিন হয় তার ছটফটানি বেড়েছে।
সে জুলফায় ফিরে যেতে চাচ্ছে। হায় জুলফা! একসময় আর্মেনিয়ার নিজস্ব শহর জুলফা ১৬০৫ সালে শাহ আব্বাসের অভিযানের পর থেকে ইরানের প্রদেশ ব্যতীত আজ আর কিছুই না। ইরানী সম্রাট শাহ আব্বাস প্রায় বারো হাজার আর্মেনীয়কে জুলফা হতে ইরাণের জিন্দারুদ নদীর তীরে ই¯পাহান নগরের পাশে ঘরবাড়ি করে দিলেন। আর্মানীরা জায়গাটার নাম দিল ‘নয়া জুলফা।‘ শাহ আব্বাস কিন্তু এই খ্রিস্টানদের ধর্ম বদলাতে কোন পেড়াপিড়ি করলেন না। আর্মানীরা তার কাছে বিনা সুদে টাকা ধার করতে পেরেছে কি বিনা বাধায় গির্জা স্থাপন করে ধর্মকর্ম করেছে। নিজ স¤প্রদায়ের নেতা বা কালান তারকে নির্বাচন করেছে। শাহ আব্বাস এমনকি আর্মানীদের শহরে কোন মুসলমানকে বাস করতে দেননি। কোন আর্মানীকে কোন ইরানী খুন করলে তাকে কঠোর শাস্তিও দিতেন শাহ আব্বাস।
শাহ আব্বাসের পর শাহ হোসেন বৈষম্য শুরু করলেন। নয়া জুলফায় ইরানীরা বসতি শুরু করলো। কোন ইরানী কোন আর্মেনীয়কে খুন করলে মাত্র এক বস্তা শস্যদানা দিলেই মাফ! এরপর এলো শাহ মাহমুদ আর আফগানদের হামলা। আর্মানীরাও তখন পাল্টা লড়াই করেছে বৈকি। ১৭৪২ সালে নাদির শাহ তছনছ করে দিল গোটা নয়া জুলফা। সিরকো নিজে জুলফা ছেড়ে হিন্দুস্থানে এসেছেন ১৮১৫ সালে। তখন তার বয়স সতেরো। ঢাকায় থাকছেন ১৮১৮ সাল থেকে। একা একা ঢাকায় আসা সেই বিশ বছরের সদ্য তরুণ নিজের শ্রমে আজ একান্ন বছরের অভিজ্ঞ ও সফল ব্যবসায়ী। তারও এক প্রেমিকা তিনি ফেলে এসেছিলেন নয়া জুলফায়। সে অবশ্য ছিল ইরাণী। ছিল শিয়া মুসলিম। শিরিন নাম। অসম্ভব সুন্দরী। তবে, সিরকো জানতেন শিরিনকে বিয়ে করতে হলে তাকে পরিবার ও ধর্ম ত্যাগ করতে হবে। তীব্র বিষাদ নিয়ে পনেরোর কিশোরী শিরিনকে...যার সাথে একই মহল্লায় শৈশবে খেলাধূলা করেছেন... তাকে দু’জনের মিলনের পথের প্রতিবন্ধকতা বুঝিয়ে ভাগ্যান্বেষণে চলে এসেছিলেন হিন্দুস্থান। এই একই যন্ত্রণায় ভুগে, প্রায় একই রকম বয়সের ভাগ্নে মুষড়ে পড়েছে। ছোট বোন তাই তার ছেলেকে ক’দিন হয় ঢাকায় ভাইয়ের বাড়ি পাঠিয়েছে বোন। যেন মামার বিপুল কর্মোদ্যোগ ও কর্মচাঞ্চল্য দেখে একটু সামাজিক, সক্রিয় ও কর্মী প্রকৃতির হয়ে ওঠে। তা’ কিসের কি? ছেলে বাড়ির কারো সাথে কথা বলে না! ঘাড় গুঁজে সারাদিন কি কি লেখে যেন! একে তিনি কি ব্যবসা-পত্র বোঝাবেন? ঢাকার বাঙালি-ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের জগতে সিরকোর বিপুল সুনাম আছে। শাঁখারি বাজারে ‘সিরকো এ্যান্ড সন্স’ তার বিশাল একটি দোকান। এখানে বিলেত, ফ্রান্স, জার্মানি কি বেলজিয়াম হতে আসা শৌখিন নানা ছবি, ঘড়ি, চা, বিলাস দ্রব্য, চীনা পোর্সিলিনের বাসন-কোসন, ইউরোপীয় নারী-পুরুষদের জামা-কাপড় নানা কিছু বিক্রি হয়।
তুমি কি কিছু লিখিতেছিলে স্টিফেন?Õ
স্টিফেন
লাজরাঙ্গা হয়।
‘দেখি?’
তিনি
ভাগ্নের হাত হতে কাগজ কেড়ে নেন, Õআর্মানী জাতি অতিশয় ভাগ্যাহত। আজ বহুকাল হয়
তাহাদের ভেতর সত্যিকারের কোন কালান তার জন্ম লয় নাই। সেই মহামতি রাজা দ্বিতীয়
তিগ্রানেসের মতো। আমার প্রেমিকা সোফিয়া আলেক্সান্দারের দূর্দশার কোন প্রতিকার আমি
করিতে পারি নাই। আমাকে জুলফা ফিরিতেই হইবে!’
তিনি
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ‘ধরো, তুমি জুলফা গেলে। সোফিয়াকে কি তুমি ফেরত পাইবে? এতদিনে হয়
সে কোন ইরানী সৈন্যের বউ...আরো খারাপ কিছু হইতে পারে...ধরো কোন সরাইখানার গণিকা
অথবা যদি তাহার কাছে সম্ভ্রম জীবনের চাইতে বেশি মূল্যবান হয়...তাহলে সে বাঁচিয়াই
নাই!’
ভাগ্নের
কাঁধে হাত রাখেন তিনি, Õশোক কাটাইতে কর্মের অপেক্ষা বড় ঔষধ নাই। কাজ সকল দুঃখ
ভুলায়। আমি ঢাকায় একটা নতুন ব্যবসা শুরু করিতে যাইতেছি। ঘোড়ার গাড়ি। এই
হিন্দুস্থান...এই বাঙালা মূল্লুকের...আরো ভালো করিয়া বলিলে এই পূর্ব বাঙালায় ইহাই
হইবে প্রথম ঘোড়ার গাড়ি...কলিকাতা শহরে অবশ্য ঘোড়ার গাড়ি আছে! থাকারই কথা। কলিকাতা সমগ্র
ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। কিন্তু, ঢাকায় ইহাই হইবে প্রথম ঘোড়ার গাড়ি! আমি আশা করিবো
যে তুমি আমার ব্যবসার এই দিকটির দায়িত্ব লও!’
আদালত থেকে ফিরে
ঢাকা জজকোর্ট থেকে আর্মানীটোলার চার্চ সংলগ্ন আবাসে ফিরতে ফিরতে মিনাস মার্টিরোসেন সিরকোর বেলা প্রায় চারটা গড়িয়ে গেল। চার্চের মুখোমুখি রাস্তার উল্টোদিকের চারতলা বাড়িটা বস্তুত মিনাসের পিতা জুলিয়ান মিনাস সিরকোর। গত ত্রিশ বছর হয় এখানকার ভাড়াটিয়ারা তাকে টাকা বাড়াতে দিচ্ছে না। ঠিক মতো ভাড়া তাকে দ্যায়ও না। এই নিয়েই মামলা। সকালে আজ ¯œান করতে পারেননি। এই অবেলায়ই, সত্তর বছরের হাড়ে, সেপ্টেম্বরের বিকেলের প্রাক-হিম ঠান্ডা জলেই ¯œান করলেন তিনি। শঙ্কর গরম জল করে দিতে চেয়েছিল। তিনিই না করলেন। ¯œান করে, শঙ্করের দুপুর বেলা রাঁধা ও বিকেলে গরম করে দেওয়া বাংলা তোলমা ও ভাত খেয়ে, চা খেয়ে ঘরের ভেতরের ইজিচেয়ারটায় শুলেন। সন্ধ্যার ছায়া গড়িয়ে নামছে চার্চের ভেতরের উদ্যান ও সমাধিক্ষেত্রে। দু/তিন শতাব্দী ধরে শ’ দেড়েক মানুষের কবর এই সমাধিক্ষেত্রে জমেছে। তাঁর স্ত্রী ক্যামেলিয়ার কবরও এখানে। মা, বাবার কবরও এখানে। হঠাৎই বিষণ্ণ লাগে তাঁর। যখন ছোট ছিলেন, বিশেষ করে লেন্ট পরবের চল্লিশ দিন ব্যপী টানা উপবাসের সময়টা এই আর্মানীটোলা কি সরগরমই না থাকতো! আর্মেনীয়, রুশ ও গ্রিকরা অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী। ইস্টারের আগে চল্লিশ দিন উপবাস থাকেন তারা। এর সাথে তুলনীয় আর মুসলিমদের রমজান মাস। রুশ লেখক তলস্তয়ের ‘রেজারেকশন’ উপন্যাসে এই টানা চল্লিশ দিন উপবাস আর ইস্টার উৎসব পালনের দীর্ঘ বর্ণনা আছে। রুশ ও আর্মেনীয় হরফে প্রচুর মিল। রুশ, আর্মেনীয়, ইংরেজি ও বাংলা মোট চারটা ভাষা পড়তে পারেন তিনি। কেন তিনি যক্ষের মতো...এদেশের হিন্দুরা যেমন বলে যক্ষের মতো...এই সমাধিক্ষেত্র গুলো পাহারা দিয়ে চলেছেন? এদেশে তাঁর নিজের স¤প্রদায়ের আর একজন মানুষও নেই। ভাই-বোনেরা ভারত, বার্মা, ব্রিটেন, কানাডায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ছেলেমেয়েগুলোও কানাডায় থিতু। আজ কেমন স্মৃতির প্রহার সব কিছু ভারি করে তুলেছে!
শঙ্কর!’
আজ্ঞে কত্তা!
শঙ্করের বাবা শম্ভু ছিল মিনাসের খেলার সাথী। বড় হয়ে
শম্ভু তাদের বাগানের পরিচর্যা করতো। শঙ্করের জন্ম ১৯৭১ সালে। শম্ভুর বউ রম্ভা আবার
মাঝে মাঝে বিকেলবেলা এসে ক্যামেলিয়ার হাতে মেহেদি, মুখে চন্দনের গুঁড়া মাখিয়ে,
চুল-টুল বেঁধে দিয়ে যেত। ২৫শে মার্চ যেদিন সারা শহরে পাকিস্তান বাহিনী আর্মি
নামালো, রম্ভা তখন চার মাসের গর্ভবতী। ২৫ শে মার্চ থেকে টানা দু’দিন ঘর হতে বের
হননি মিনাস ও ক্যামেলিয়া। ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় ভয়ার্ত, তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো রম্ভা
তাদের বাড়ির দরজায় ব্যগ্র, ব্যাকুল কড়া নেড়েছিল। দরজা খুলতেই আঁতকে উঠেছিলেন তারা।
বউদিদি গো!
ক্যামেলিয়ার পায়ে হুমড়ি খেয়ে কাটা জন্তুর মতো
গোঙাচ্ছিল রম্ভা, Õমানুষটা আর নাই কো! আমার দুইটা বাচ্চাও নাই! আমি কি নিয়া থাকবো
ঠাকুর?’
শম্ভু আর রম্ভার বড় দুই ছেলে-মেয়ে নীলাম্বর আর চ¤পাও
গুলি খেয়ে মারা গিয়েছিল। কি ফুটফুটে যে ছিল বাচ্চা দুটো! শঙ্করই বরং মা’র সুন্দর
চেহারা পায়নি। বাবার মতো কালো হয়েছে। তাদের লাশও আর ফিরে পাওয়া যায়নি। সবাই মিলে
সূত্রাপুর হতে কেরানীগঞ্জের দিকে নদী পার হতে যাবার সময়ই এই কান্ডটি ঘটে। কোন দৈবে
বা ঘোরে চারমাসের গর্ভবতী ও সুন্দরী এই নারী, শাঁখা-সিঁদুর তখনো খোলা হয়নি,
এয়োস্ত্রী সধবার সকল চিহ্ন নিয়ে ব্রাশফায়ার আর হত্যার শহরে উল্টো ফিরে আসে গর্ভের
সন্তান আর নিজেকেও অক্ষত রেখে... সেই এক রহস্য!
এখন মরলেও শান্তি! আপনাদের এইখানে... আপনারা সাহেব
মানুষ... খানেরা আসতে পারবে না!’ নিদারুণ
কান্না ও হেঁচকির ভেতর কোনমতে দম টেনে এই কথাটা বলেই স্বস্তি ও অস্বস্তির মুর্চ্ছা
গিয়েছিল রম্ভা। এভাবেই শঙ্কর আজন্ম পিতৃহীন। রম্ভা মরেছে আজ বছর চারেক। শঙ্করের
বিয়েও মিনাস মার্টিনাসই দিয়েছেন।
শঙ্কর!
তালা খোলে! ভিতরে ঢুকিব!’
শঙ্করের মন বলছিল যে কত্তা আজ চার্চের ভেতর ঢুকতে
চাইবেন। আর্মানীটোলার এই চার্চে আজকাল আর এমনকি রবিবার সন্ধ্যায়ও প্রার্থনা হয় না।
শঙ্কর চাবি এনে খুলে দিলো। সে অন্য ধর্মের মানুষ। কিন্তু, এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের
উপাসনা গৃহে কোন কোন সন্ধ্যায় দীপ জ্বালাতে হলে আজ শঙ্করই ভরসা। দীপদানগুলোতে একটা
একটা করে মোম জ্বালাতে থাকে সে। সে আলোতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ছবির যিশু।
ঐ যো পোগজ স্কুল ছিল না? তার হেড টিচার ছিলেন চার্লস
পোট। সে আঁকিয়াছে এই ছবি!’ মিনাস সাহেবের গোঁফের ভেতর হতে সরল হাসিতে দাঁতগুলো
উদ্ভাসিত হয়। তারপর হঠাৎই খুব শান্ত হয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ, নত মুখে বিড়বিড় করে
প্রার্থনা করেন।
‘দীপ নিভায়ে দাও...ন্ না থাকুক! মানুষ না থাকুক! আলো
জ্বলিতে দাও। লেট দেয়ার বি লাইট! কতই বা মোম পুড়িবে? কতটুকুই বা খরচ!’
আজ্ঞে!’
মিনাস সাহেব চার্চ হতে বের হয়ে সমাধিক্ষেত্রের ভিতর
নিঃশব্দ পায়ে ইতঃস্তত ঘোরাফেরা করেন।
এই গোরস্থানের...বুঝিলে শঙ্কর...অধিকাংশ মানুষই খুব
অল্প বয়সে মারা গিয়াছে! অকালমৃত্যু ছিল ঢাকার আর্মানীদের কপালের লিখন! কারণও ছিল।
বাইরের রক্ত ঠেকাইতে নিকট আত্মীয়দের ভেতর ঘন ঘন বিবাহ হইতো। মাসতুতো বা খালাতো
বোন, ফুপাতো বা পিসতুতো ভাই, মামাতো ভাই-বোন...এত বেশি নিকট রক্তে বিবাহ দেওয়া
হইয়াছে, যে শিশুদের আয়ু খাটো হইয়া আসে! তুমি বাড়ি ফিরিবে কি শঙ্কর? যাইতে পারো!
আমি আজ রাতে আর কিছু খাব না!’
আরো ঘণ্টাখানেক আছি!
‘হুম’
শঙ্কর জানে মিনাস সাহেব এখন ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে সেই
কাগজটা বের করবেন। ঢাকায় তারা কয় পুরুষ বাস করেছেন না করেছেন এইসব!
আপনাদের বংশের সবার বেত্তান্ত এই কাগজে!’
ইজি চেয়ারে বসে বংশ লতিকার লম্বা কাগজ ভাঁজ করতে করতে
হাসেন মিনাস, মূল কাগজখানা অতি লম্বা হয়! প্রতি পুরুষে কয় খানা ভাই-বোন, তাহাদের
কয় খানা করিয়া ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী, তাহাদের স্বামী-স্ত্রী বা
সন্তান-সন্ততি...আমি খুব জরুরি কয়েকটা নামই দেখিতেছি! নিজের মতো ছোট করিয়া
নিয়াছি!’
বিবাহ উৎসব
মাইকেল সিরকোর বাসায় আজ জমজমাট উৎসব। ভাগ্নে স্টিফেন ম্যাকারটিকের বিয়ে দিচ্ছেন তিনি এম, কাচাতুরের মেয়ে রোজ কাচাতুরের সাথে। খুব খুঁজে খুঁজে কাচাতুর পরিবারের সাথেই তিনি বিয়ে দিলেন। আর্মেনীয়রা রক্ষণশীল। এই দূর দেশে এসে কালো ভারতীয়দের সাথে বর্ণ মিশ্রণের চেয়ে সবাই নিকটাত্মীয়দের ভেতরই বিয়ে দিচ্ছে। এর বিষময় ফল ফলছে দু/তিন প্রজন্মেই। অধিকাংশ আর্মেনীয় পরিবারে শিশুমৃত্যুর হার চড়া। অথবা, দূরন্ত বসন্তের যে যৌবন, সে সময়েও মারা যাচ্ছে অনেক যুবক যুবতী। কাচাতুর পরিবারের সাথে সিরকো বা সিরকোর ভগ্নিপতির পরিবার ম্যাকারটিকদের সাথে দূর বা নিকট কোন রকমেরই কোন রক্ত স¤পর্ক নাই। ফলে, এই বিয়ে স্বাস্থ্যকর। এছাড়াও, কাচাতুর পরিবার সিরকো পরিবারের মতোই গত অর্ধ শতক সময়েই ঢাকার ইউরোপীয় স¤প্রদায়ের ভেতর একটি ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারের মর্যাদা লাভ করেছে। আজ সিরকো সাহেবের ভাগ্নের বিয়ে বলে কথা! তাও আবার কাচাতুর পরিবারের সাথে। আর্মানীটোলার গির্জা প্রাঙ্গণ একে একে ভরে উঠেছে ঢাকার নামী-দামি ও ধনাঢ্য আর্মেনীয় পরিবার প্রধানদের উপস্থিতিতে। পোগজ, আরাতুন, পানিয়াটি, কোজা মাইকেল, মানুক, হানি এবং সার্কিস পরিবারের কর্তা-গিন্নি-বাচ্চারা সহ সবাই প্রায় উপস্থিত। পানিয়াটি চট্টগ্রাম ও ভুলুয়াতে (নোয়াখালি) সমুদ্রের জল হতে লবণ চাষের ব্যবসায় এত লাভ করেছেন যে সেই টাকাতে জমিদারি কিনেছেন। কোজা মাইকেল দক্ষিণ শাহবাজপুরের (ভোলার) জমিদারি কিনেছেন। আরাতুনের জমিদারি আছে পরগণা হুসেন শাহীতে। আরাতুনের রূপলাল হাউস দেখতে মানুষ দূর দূরান্ত হতে আসে। লুকাস দৌলত খাঁর জমিদার। সি,জে, মানুক, জে,এ, মিনাস আর আনানিয়ার বড় বড় দোকান আছে পটুয়াটুলি, বাংলাবাজার ও দিগবাজারে। জে,জি,এন, পোগজ আবার ঢাকা ব্যাঙ্কের পরিচালক। কাচাতুর, আব্রাহাম পোগজ, মাইকেল সারকিস এবং পি.আরাতুন পাটের ব্যবসায় নাম করেছেন। এছাড়া ব্রিটিশ নীলকর জেমস ওয়াইজও এসেছেন। এরা সবাই আজকের বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথি। ভাগ্নের বিয়েতে এত খরচ করার একটা কারণও আছে বৈকি সিরকো সাহেবের। তার নিজের দুটো ছেলেমেয়ে এখনো ছোট ছোট। তাদের বিয়ে হতে দেরি আছে। ব্যবসায় ভাগ্য গড়তে গিয়ে তিনি নিজেই বিয়ে করেছেন যথেষ্ট দেরিতে। কাজেই, ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে পারেনি। ভাগ্নের বিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সমাজের সবার সামনে গত দশ বছরে নিজের অর্জিত বিত্ত-বৈভবের অনেকটা প্রদর্শন করা যাবে এমন একটা ভাবনাও তার মাথায় ছিল। কনে রোজের হাতে ভারতীয় কায়দায় মেহেদির লাল রঙে নানা নক্সা আঁকা হয়েছে। যাজক বর ও কনের দুটো আংটি দুটো মদের পেয়ালায় ভিজিয়ে দু’জনকে পরিয়ে দিল। এবার মদের পেয়ালা থেকে কনে রোজকে খেতে দেওয়া হলো। রোজ এক চুমুক খেয়ে স্টিফেনকে খেতে দিল। স্টিফেনের চোখ-মুখ ভয়ানক ক্লান্ত আর শুকনো দেখাচ্ছে। রোজ হাসি-খুশি আর উচ্ছল। অতিথিদের রঙিন কাগজ দিয়ে মোড়ানো মিষ্টি খেতে দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে গুলাব-নাবিত শরবত। এখন শুরু হবে নৈশভোজ। গির্জার পাশেই পায়ে হাঁটা দূরত্বে সিরকো সাহেবের বাসা। বাসার ভেতরের বাগানে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর্মেনীয়রা ব্রিটিশ কেতার খাবারের চাইতে মোঘল খাবারই পছন্দ করে। রুমালি রুটি, শাহি কোফতা, কাশ্মিরী পোলাও, ভেড়া ও মোরগের মাংস, বোরহানি, দই ও ক্ষীরের সন্দেশ পরিবেশন করা হচ্ছে। কোলকাতা হতে এক বাঈজি আর তার সাথের ওস্তাদ, কয়েকজন বাদ্যযন্ত্রী এসেছে। বাঈজি হিন্দুস্থানী সঙ্গীত পরিবেশন করল। বৃষ্টি ও কামনার নিদারুণ রাগ রাগিনী। একের পর এক খান সাতেক খেয়াল, ঠুমরি কি টপ্পা শেষ করার পর বাঈজি বিরতি নিলে নৈশভোজের শেষে সবাই নাচে অংশ নিল।
‘স্টিফেন ও রোজ, কামনা করি ঈশ্বরের আশীর্বাদে তোমরা সুখী হও!’ বাসর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সিরকো সাহেব প্রার্থনা করেন।
দিন-রাতের সামাজিকতা ও অনুষ্ঠান বাড়ির ক্লান্তি ভুলে
সিরকো গিন্নী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে শরীরের সব অলঙ্কার খুলছেন। গোলাপ জল আর
তুলা ঘষে পরিষ্কার করছেন ঠোঁট ও গন্ডদেশের যাবতীয় রঞ্জক।
‘স্টিফেনের বিবাহ হইলো। কিন্তু, সে সুখী হইবে কি?’
সুসান মাইকেল সিরকোর দিকে ফিরে তাকান।
মাইকেল একটু বিব্রত হন। সুসান সমাজের আর দশটা মেয়ের
মতো নয়। ভাগ্নের বিয়েতে এত খরচ বা ভাগ্নেকে ব্যবসার দায়িত্ব নিয়ে তার কোন মুখ কালো
করা নেই। আবার, বিয়ে বাড়ির এত আলোও স্টিফেনের অন্ধকার মুখকে লুকাতে পারেনি তার
সতর্ক দৃষ্টি হতে।
সুখী হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার...আমরা কহিবার কে? ব্যবসায়
দিলাম। তাহার মন নাই। বিবাহ দিলাম যদি তার মন ফেরে!’
‘সে অন্য প্রকৃতির ছেলে। কি জানি কি হয়!’
রোজ!
স্টিফেনের দিকে কোমল মুগ্ধতায় তাকায় রোজ।
তোমাকে একটি কথা বলা আবশ্যক!’
রোজ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।
‘তোমার জন্ম ঢাকাতেই?’
রোজ মাথা নাড়ে।
‘কিন্তু, আমার জন্ম ঢাকাতে নহে। আমি ইরানের জুলফার
ছেলে। মাত্র পাঁচবছর হয় আমরা এই ইন্ডিয়া বা বলা ভালো বাঙালাদেশে আসিয়াছি। তোমাকে
কি কহিব রোজ...জুলফায় আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসিতাম। তাহার নাম ছিল সোফিয়া
আলেক্সান্দার। সে আমার শৈশবের বাগদত্তা ছিল। সে ছিল পরমা সুন্দরী। অবশ্য তুমিও
খুবই সুন্দরী! কিন্তু, পারস্য দেশের সৈন্যরা পাঁচ বছর আগে যখন আমাদের আর্মানী
মহল্লায় হামলা চালায়, তাহাকে সৈন্যরা লুট করিয়া নিয়া যায়। হয়তো আজ সে কোনো পারস্য
সৈন্যের বধূ অথবা আরো মন্দ...পথের মেয়েমানুষ অথবা হয়তো বাঁচিয়াই নাই! আমি তাহার
হবু স্বামী... তাহাকে বাঁচাইতে পারি নাই...মামা আমাকে জোরপূর্বক বিবাহ দিলেন...এ
বিবাহে আমার মত ছিল না!’
রোজ কোনো উত্তর করে না। খুব আবেগহীন মুখে সে তাকিয়ে
আছে স্বামীর দিকে। বাসর উপলক্ষ্যে তাকে এদেশীয় মেয়েদের মতো রক্তবর্ণ বেনারসির
ঘাগরা পরানো হয়েছে। মাথাতেও বেনারসির ওড়না।
‘কি জানো, মনে হয় আমি খুব বেশিদিন বাঁচিবও না! মৃত্যুর
পূর্বে একবার জুলফা যাইতে চাহি। সে আমি সোফিয়াকে পাই বা না পাই! তোমাকে কষ্ট দিতে
বিবাহ করা আমার অনুচিত হইয়াছে। তুমি আমাকে ক্ষমা করিও। আমার মৃত্যুর পর অন্য
কাহাকেও বিবাহ করিও!’
নিচে বাগানে আলোর রোশনচৌকি ঘিরে কোলকাতা থেকে আসা
বাঈজি তখনো গাইছিল, না মানুঙ্গি না মানুঙ্গি না মানুঙ্গি/ ম্যায় তো উন হি কো
মানায়ে বিনা/ না যাউঙ্গি না যাউঙ্গি না যাউন্সি/ ম্যায় তো উন হি কো মানায়ে বিনা/
যাও জি যাও জি সখী/ দেখো। আপনা/ রস কি রসিয়া/ রস কি রসিয়া!
উষস আলোয়
গ্রিকরা যাকে বলতো উষস, ভারতীয়রা তাকেই বলে উষা। সূর্য ওঠার আগের সাদা আকাশ। মিনাস মার্টিরোসেন সিরকো কোলকাতা ও বোম্বেতে পড়াশুনা করেছেন। কোলকাতার এক হিন্দু বন্ধু তাকে একবার সকালের রক্তিমাভা সূর্যের উদয় বোঝাতে এক সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করে বাংলা তরজমা করে শুনিয়েছিলেন যে নববধূ যেমন স্বামীর নিকট রক্তাভ বক্ষদেশ উন্মোচন করেন, সূর্য তেমন উদিত হচ্ছেন। ভারত উপমহাদেশ বা আরো সোজা করে বললে বাংলায় আসা আর্মেনীয়রা বিয়ে, পানাহার, উৎসব-আয়োজনে অনেক এদেশীয় রীতি গ্রহণ করেছিলেন। তেমন রীতিতেই বিয়ের সময় চার্চে যদিবা কনের গায়ে থাকে সাদা পোশাক, বাসর ঘরে প্রবেশের আগে তাকে পরানো হয় রক্তবর্ণ বেনারসি। তার স্ত্রী ক্যামেলিয়াও তার রক্তাভ বুক প্রথম তার কাছেই উন্মোচন করেছিলেন। তেমন উদিত হচ্ছে সূর্য এই পরিত্যক্ত প্রায় আর্ম্মানীটোলার চার্চের উদ্যান ও সমাধিক্ষেত্রে। স্টিফেন ম্যাকারটিক...যে কিনা মিনাস মার্টিরোসেনের গ্র্যান্ডফাদারের কাজিন হয় স¤পর্কে...তেমন দূরের এক অপ্রত্যক্ষ পূর্বপুরুষকে নিয়েই বা কেন তিনি এত বেশি বিচলিত হন? পারিবারিক সিন্দুকে কাছে-দূরের কত আত্মীয়স্বজনেরই দিনপঞ্জি বা চিঠিপত্র থাকে? পেঁচানো ও ঘন বুনোটের হস্তাক্ষরে, আর্মেনীয় লিপিতে লেখা এই দিনপঞ্জিটি কেন তাকে এত উন্মনা করে? স্টিফেন অদ্ভুত যুবক ছিল নিশ্চিত। ফেলে আসা দূর স্বদেশে লুণ্ঠিতা ও হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার মর্মবেদনায় আপন স্ত্রীকে সে শরীরে গ্রহণ করেনি। স্টিফেন ম্যাকারটিকের মরক্কো চামড়ায় বাঁধাই এই দিনপঞ্জির পৃষ্ঠার ফাঁকে ফাঁকে স্ত্রী রোজ কাচাতুরের কিছু চিঠি সেই সাক্ষ্যই বহন করছে।
৭ই জুলাই ১৮৫৭
বাবুবাজার, ঢাকা
মাই ডিয়ার হাসব্যান্ড,
জানি না আপনাকে এই সম্বোধনের অধিকার আমার আছে কিনা। আপনার সাথে আমার স¤পর্ক আজো কাগজে-কলমেরই, রক্ত-মাংসের হইলো না। তবু বলিব, আপনাকে ঘৃণা করা উচিত কিন্তু করি না! আর কেহই না বুঝুক, আমি আপনার কষ্ট বুঝি। ইদানীং আমারো ভারি সোফিয়ার কথা মনে হয়। যদিও তাহাকে কখনো দেখি নাই।
আপনার উপর রাগ করিয়া আজি পিতৃগৃহে আসিয়াছি ছয় সপ্তাহ। আপনি একটি খোঁজ করেন নাই। ভালো, নাই হইলাম সোফিয়া... তাই বলিয়া কি একটি খোঁজ করিতে নাই? মাঝে মাঝে ভাবি, এ জীবন না রাখিলেই ভালো ছিল।
প্রিয় স্বামী, আপনি কি সত্যই জুলফা যাইতে চান? আপনার বাড়ি হইতে আসার দিন আপনি কহিয়াছিলেন যে সেইদিন রাত্রে আপনি স্বপ্নে দেখিয়াছেন যে জুলফায় আর্মানী জাতির নতুন কালান তার আসিয়াছে। তিনি রাজা মহামতি তিগ্রানিসের মতো ক্ষুরধার তরবারি স¤পন্ন। জুলফাকে তিনি মুক্ত করিয়াছেন। আর, সেই মুক্ত আর্মেনীয় নর-নারীর শোভাযাত্রায় আপনার সোফিয়াকেও আপনি দেখিয়াছেন। কিন্তু, না আপনার পিতা-মাতা না আপনার মামা-মামী আপনাকে জুলফা যাইতে একটি টাকাও দিতে ইচ্ছুক। আমি আমার সকল অলঙ্কার বিক্রয় করিলে কি আপনার জুলফা যাত্রার অর্থ যোগাঢ় হয় না? আপনি নিশ্চিত থাকুন যে জুলফা যাইবার অর্থ আপনার হইবে।
বিশেষ কি লিখিব? ইয়েরেভান নগরী কদাপি দেখি নাই। দেখি নাই বশরা, কার্মেন, ই¯পাহান, জুলফা, সিউন্না। জন্ম এই ঢাকাতেই। শুনিয়াছি ইয়েরেভান পাথরের শহর আর আর্মেনিয়া আয়াস্তান-কারাস্তান কি পাথরের দেশ। আপনি তেমন দেশের উপযুক্ত সন্তান।
আপনার সেবিকা,
রোজ।
...রোজ কাচাতুর সত্যিই অলঙ্কার বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু, স্টিফেন ম্যাকারটিকের জুলফা যাওয়া হয়নি। তার আগেই তাকে আক্রমণ করেছিল ক্ষয় রোগ। মৃত্যুর আগের দিন দিনপঞ্জিতে তার স্বীকারোক্তি:
৯ই নভেম্বর ১৮৫৭
আর্ম্মানীটোলা, ঢাকা
...আমার দিন ঘনাইয়া আসিছে। অদ্য সারারাত কাশিয়াছি। কাশির সাথে রক্ত। রোজ! সরলা হতভাগিনী! কেন বিবাহের মুহূর্ত হইতে গত এগারোটা মাস তাহাকে এত কষ্ট দিয়াছি? কোন্ নারী স্বামীর প্রেমিকা উদ্ধারের কাজে আপনার সব অলঙ্কার লুকাইয়া জলের দরে বিক্রয় করে? হায় দুর্ভাগ্য! তবু, আমার জুলফা যাওয়া হইলো না! কালব্যাধি নিমেষে সব হরণ করিলো। আহ্, বড় কষ্ট। ফাদারকে ডাকিতে হইবে। কনফেস করিতে হইবে যে রোজকে আমি গত এগারো মাসে ¯পর্শ করি নাই। সে বিবাহিতা তবে কুমারী। এখন আমার মৃত্যুর পর এই অপাপবিদ্ধাকে অন্য কোন ভদ্রসন্তান বিবাহ করুক। তাহার সংসার ধর্ম ও মাতৃত্ব লাভ হউক। কেন রোজকে এত কষ্ট দিলাম? না পারিলাম সোফিয়াকে রক্ষা করিতে, না রোজকে সুখী করিলাম। না হইলো জুলফায় যাওয়া। আমি না হইলাম বণিক, সন্ত, না কবিতার ফেরিওয়ালা কি তিগ্রানিসের ক্ষুরধার তরবারি স¤পন্ন কালান তার! আমরা আর্মানী সন্তানরা কি অভিশপ্ত য়িহুদি দিগের ন্যায় এক ভূমি হইতে আর এক ভূমিতে ক্রমাগত তাড়া খাইয়া ফিরিব? কোনদিন আমাদের নিজেদের স্বদেশ ভ‚মি ফিরিয়া পাইব না? আমাদের দয়িতাগণ নিত্যই লুণ্ঠিত হইবে? আমাদের দয়িতা সকল, আমাদের দ্রাক্ষা কুঞ্জ? কোথায় তুমি তিগ্রানিস হে মহান কালান তার? আমাকে ফেরত দাও আমার স্বদেশ ভ‚মি, আমার নীরোগ স্বাস্থ্য ও আমার হারানো প্রেমিকা! আমেন।
...স্টিফেন ম্যাকারটিকের মৃত্যুর পর তার কুমারী স্ত্রী
রোজ কাচাতুর দুই বছর শোক পালনের পর পুনর্বিবাহ করেছিলেন। স্টিফেন ম্যাকারটিকের ভাই
ভিভিয়ান ম্যাকারটিক ও তার স্ত্রী এ্যাঞ্জেলা পোগজ ম্যাকারটিকের সন্তান ম্যাক, এস, ম্যাকারটিকও
মারা গেছিল মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই। তাঁর প্রেমিকা ও ভাবী বধূ নিজের নাম প্রকাশ না
করেই সমাধি ফলকে খোদিত করেছিল এপিটাফ!
As
I loved him so I miss him,
In my memory he is near
Loved, remembered, longed
for always,
Bringing many a silent
tear!
Weep not for me my
sweetheart dear,
I am not dead but sleeping
here,
I was not yours,
But, Christ's alone,
He loved me most and took
me home.
ঢাকায়
সিরকো পরিবারের ঘনিষ্ঠতম পরিবার ম্যাকারটিক পরিবারে এভাবেই ঘনিয়ে এসেছিলো অকাল
মৃত্যু। সিরকো পরিবার অবশ্য আরো প্রায় তিন/চার পুরুষ টিকে গেছে। ...আজ এই উষস
সকালে...এই একদা আর্মেনীয় জনপদে...সবাই কই? ছোট ছোট শিশুরা ঘুমিয়ে আছে...ঘুমিয়ে
আছে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও টাটকা যুবক-যুবতীরা! একা তিনি মিনাস মার্টিরোসেন সিরকো যেন
অনাদি কালের যক্ষ!
‘ক্যামেলিয়া!
শম্ভু! তোমরা সব কোথায়?’
কত্তা!
কত্তা!’
শঙ্কর ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে বাইরের গেটের তালা খুলে উদ্যানসহ সমাধিক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে। কর্তার ঘরের দরজা খোলা। বারান্দায় ইজিচেয়ারে এই সাতসকালের হিমে...সর্বনাশ! সারা রাত্রি ঘুমায় নাই নাকি বুড়ো? একটু ইতস্তত করে বারান্দায় উঠে পড়ে শঙ্কর। নববধূর আরক্ত বুকের মতো সকালের রক্তিম আলোয় মার্টিন মিনাস সিরকো তখন কালান তারের স্বপ্নে বিভালে...

0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন