ইটাভাট্টার একদিন প্রতিদিন
"মা তাহাদের খাল পুকুরে শামুক কুড়ায় মাছদুপুরে
ছেলেমেয়ের
ভাগ্যে তার শামুক ঝোল আর ভাতের মাড়"
সৃজন সরকারের এই কবিতা সত্তরের দশকে 'অনুষ্টুপ' পত্রিকায় কবে পড়েছিলাম! কবি বা পত্রিকার নাম দুটোই হয়তো ভুল বলছি। তখন বয়স ছিল ১৪ কী ১৫। আজ আমিও তো ৭০ ছাড়িয়ে গেলাম! ২০১০ সালে যেদিন এই ছবিগুলো ক্যামেরাবন্দী করেছিলাম তখন এই কবিতাটাই মনে পড়ছিল।
এদিকের প্রান্তিক মানুষজন তখন হিন্দিও বুঝত না ভালো করে। উমাশঙ্কর মাঠে
ধানকাটা একজনাকে দেখে তার কাছে উবু হয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিল,
- ইধার অ্যাইসা কই গাঁও হে যাঁহা ল্যান্ড কন্ট্রাডিকশন বহুৎ
শার্প হ্যায়?
উমাশঙ্করের দিকে ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষণ
চেয়ে থেকে মানুষটা বলেছিল,
- হামরা ত দিনে কাইজ করি রাইতে ঘুমাই। হামরা কি অতো জাইনেছি!
৯০এর দশক থেকে শীতকালে মাঝে মাঝেই রবিবারে আমরা ছয়-সাত জন অ্যামেচার ফটোগ্রাফার দুপেয় বাহন নিয়ে কাকভোরে বেরিয়ে পড়তাম জামশেদপুরের গাঘেঁষা কোনো গ্রামে। এরকম শীতকালীন ফটো অভিযানকে ৱ্যাম্বলিং বলা হতো। ভূদেবদা এরকমই একটা
রামলিঙে, একদিন আফসোস করে বলেছিলেন,
- হায়, সেই দিনগুলো গেছে যখন এরা ব্লাউজও পরত না। শান্তিদারা আদুর
গায়ের বউগুলোর কত ছবি তুলেছে। এখন এরা যা সব ব্রা পরে, আমার বউও সেগুলো দেখেনি।
এই পর্বের ছবিগুলি ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে
তোলা। জামশেদপুরের কাছেই
পতোমডা ছাড়িয়ে চার-পাঁচ কিলোমিটার এগোলে এই ইটাভাটা দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু কর্মরত মানুষগুলোর
আশেপাশে কোন ওভারশিয়ারকে দেখতে পাওয়া যাবে না, কারণ এখানে কাজ করানোর নিয়মটা
এরকম - পুরুষেরা দিনমজুর তাই ডেলি রেট আর মহিলারা
ক’ট্রিপ ইট মাথায় করে ভাটার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, তার হিসেবে রাখা হয় প্লাষ্টিকের
টোকেন গুনে। এক চক্কর মাথার ইটের ডালা নিয়ে পুরো করতে পারলেই একটা
রঙিন প্লাস্টিকের টোকেন পাবে টুলে বসে থাকা টাকমাথা লোকটার কাছে। সারাদিনে কতগুলো
টোকেন পেলে সেটা গুনে মহিলাদের পয়সা। তখন বোধহয় একট্রিপ পুরো করলে ২৫ বা ৫০ বা ৭৫ পয়সা দেওয়া
হতো।
প্লাস্টিকের চাকতির রঙের ফারাক ছিল - লাল, সবুজ আর হলুদ। মাথায় ছটা ইট বইলে হলুদ, আটটা হলে লাল, আর বারোটা আনতে পারলে হরি ঝান্ডি। সংখ্যার এই রকমফের
শিশু শ্রমিকদের সুযোগ করে দেয়া সুকুমার রায়ের
খুড়োর কলের মত কিছু পয়সার রঙ্গিন টোকেন কামিনদের সামনে ঝুলছে আর ওরা ক্ষিপ্রগতিতে ছুটছে। এত অমানুষিক শারীরিক
পরিশ্রম এই অঞ্চলের আদিবাসী মহিলারাই পারে। চারিদিকে ইট আর মাটির ধুলোয় মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে ধুলোর
কুয়াশায়।
কাজের পরিবেশ এমনই, অন্য কেউ ওখানে পাঁচমিনিট দাঁড়ালেই ধরাশায়ী হবে। বাড়ি ফিরে শাপান্ত করবে-'ওখানে কেউ যায়! যত সব পাগলের দল!'
ডিজিটাল ক্যামেরা আসার আগে শৌখিন ফটোগ্রাফি এক ধরনের পাগলামি ছিল। একটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ফিল্ম-এর দাম পঞ্চাশ থেকে একশো টাকা। একটাক্রোম স্লাইড ফিল্ম দুশোর কিছু উপরে। বাড়িতে ডার্করুমে প্রিন্ট করতে কিনতে হতো প্রিন্ট পেপার, ৮ বাই ১০ ইঞ্চির ১০টা পেপার প্যাকেট ৪৫০ টাকা। মাস শেষে আমার নশো টাকার মাইনের চাকরি। প্রথম ক্যামেরা কণিকা রেঞ্জ ফাইন্ডার সেকেন্ডহ্যান্ডে ১৫০০ টাকায় কিনতে সহকর্মীর থেকে ধার নিতে হয়েছিল। সমস্যা আরো ছিলো। ত্রুটিপূর্ণ মিটার রিডিং-এ কী ছবি হলো, ফিল্মটা ডেভেলপ করার পরে জানতে পারা যেত। ফটোগ্রাফি সে সময় আর্থিক দিক থেকে চরম অস্বাস্থ্যকর ছিল। তবে আজ ইঁটভাটায় ফটো তোলা একেবারে পুরোটাই অস্বাস্থ্যকর।
ছুটছে মেয়ে-মহিলা-শিশু শরীরের পেশী শক্ত করে ধুলোর ঝড়ে। আর সারা শরীরে লালধুলো মাখা লালফ্রকে ওই মেয়েটিকে দেখে মনে হবে - 'লাল ছড়ি ময়দান খড়ি / ক্যায়া খুব লড়ী ক্যায়া খুব লড়ী'! তবে তা হিন্দি চলচিত্রের লোরেলাপ্পা গান নয়, বরং জীবন সংগ্রামের দামামা।
পুরুষেরা যেখানে ধুলোর ঝড় তুলছে সেখানে ছবি তুলতে নরক ধুলোর ঝড়ে হাতের ক্যামেরা বিকল হয়ে যায়। তবে সেই মুহূর্তে মানুষের এই করুণ অবস্থা মাথায় আসে না, তখন তো ছবির জন্য ছুটছি আর ভাবছি এই ছবিটা দারুন হবে! আসলে তখন কারুর পৌষমাস। অন্যদিকে কোদাল হাতে ধুলোমাখা মানুষ নিজের মতো করে হয়তো ভাবছে – 'অমর কাব্য লিখিও তোমরা যাহারা আছো সুখে'।




0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন