![]() |
| সমকালীন ছোটগল্প |
আস্তাবল ও বাদশা কথন
বিষয়টা অমিমাংসিতই ছিলো যেভাবে যৌবন উদ্গমের দিনগুলোতে রাস্তার শ্রীরাধাকে পটিয়ে ফেলতে আপ্রাণ গান মুখস্থ করতাম 'অনেক কথার মরণ হলে হৃদয় কথা বলে' ইত্যাদি, রাধা তো পটলো কিন্তু স্বল্পকালীন ফুরুৎ ফুরুৎ পর্ব কাটতে না-কাটতেই বিচ্ছেদ পর্বে এসে স্ক্রীপ্ট লটকে যায়। বস্তুত এই 'অনেক কথা' কত কথায় হয় যেহেতু গীতিকার আমাদের জানায়নি, বিষয় কিছু কিছু তাই অমিমাংসিতই থেকে যায়। অমিমাংসিত। মিমাংসা। কত রাত জানলার পাশে খোলা রাস্তার আলো যেটুকু কিছুতেই ছেড়ে যায় না, হামলে ঢোকে ঘরে, তাকে সাক্ষি রেখেই গভীর মিমাংসা ভেবেছি বা ভাবতে চেয়েছি। এবং ভাবতে ভাবতে যখন বুঝেছি সব ঢপ, একেবারে ঢপের কেত্তন, জন্মরস ছিটকে ফেলে বিছানায় চিত্তির হয়েছি। কিসের মিমাংসা, কেন মিমাংসা, মিমাংসা বস্তুত এক আপোষ। আপোষের গভীরে এক পোষ মানানোর পূর্বাভাষ। যেদিন দিব্যজ্ঞান হলো মধ্যরাতে দরজা খুলে শহরের রাস্তায় হেঁটেছি উদ্দাম গোড়ালি দাবড়িয়ে। পথকুকুরদের মহামিছিল ছাড়া আর কেউ বিঘ্ন ঘটায়নি সেই পদচারণার। পয়সা না দিলে মানে রোজগার না থাকলে সে করতে দেবে না, আগে পয়সা জোটাও অতঃপর হ্যাঁচ্চো। পুরো বোকাচোদা বানানোর ফর্মুলা। মধ্যবিত্ত জীবন বোধ। মা মাসি বাপ কাকা সবাই তাই করে, তুমি কোন লাটের বাঁট এর বাইরে যাবে! সাপোর্ট দিলো বার্নার্ড শ'-- Marriage is nothing but legal prostitution. লে ধামাকা। পয়সা দিয়ে যদি করতে হয়, স্ট্রেট ড্রাইভ টু বেশ্যা পাড়া। হরেক মাল বাজিয়ে খাও। সুতরাং মিমাংসার ত্যানা জ্বেলে লাল আলো জ্বালিয়ে রাখলাম গাড়ির সিগন্যালে। চল নিশুতি কদম্ব বনে যাই, বনকুল চুরি করে খাবো না-হয় সাপের কামড়ে ইত্যাদি। দর্শনটা এটাই। তাই অমিমাংসিত এক মহাকাল একালের বালকদের ফাজলামোর নেশায় পড়ে বিগড়ে গিয়েছে। গাঁজা টেনে নিরন্তর চোখ উল্টিয়ে ভেবেই চলেছে, মালগুলোতো এখনও একটা ডাইস মানে মানুষের ডাইস থেকেই ল্যাণ্ড করে তবু এত বেপরোয়া কিভাবে হয়! সে তো আর জানে না, হাবিজাবি দিয়ে বেঁধে রাখা এ সব সমাজশেকল দুদিন পর পঞ্চবটি ডালে লটকে এরা বানিয়ে তুলবে বোতাম সংসার। যাকগে, অমিমাংসা-মিমাংসার প্রসঙ্গ তুলে এসব বোতাম, মহাকাল ইত্যাদি বড় বড় বিষয়ে এখন হ্যাজাতে যাবো না।
কাকুরাম ঝিলঝিলি কাল এসে হঠাৎ বলে কি, তোমাকে ছাড়া থাকতে
পারছি না। কেন? রাত্রে শুলেই নাকি বিছানা জ্বলতে থাকে তুখোর নেশায়। আমার নেশায়। লাইনে
পেয়ে সরাসরি বললাম--
-- জল দিয়ে
বিছানা নেভাতে খরচ আছে। দিতে পারবি?
-- কত নেবে,
বলো?
-- দশ হাজার,
একবার নেভাতে।
-- মাত্র!
আমি পঁচিশ দেবো।
-- (চোখ গোলগোল
করে তোতলাতে থাকলাম) পঁ--চি--শ!
-- চাইলে আরও
দোবো।
-- আরও!
-- হ্যাঁ।
কাকুরাম ঝিলঝিলিকে পশ্চাদে লাথিটা না মেরে বললাম, সাড়ে
দশটায় তোর ঠিকানায় ফায়ার-ফাইটার পৌঁছে যাবে। ভালো মেশিন, সময় একটু বেশী নিয়ে আগুন নিভিয়েই
ফিরবে। টাকাটা রেডি রাখিস। কাকুরাম চোখ ঝরাতে পারে ধরে নিয়েই দরোজাটা পার করিয়ে বন্ধ
করলাম ফ্ল্যাটের দরোজা। দু-চারবার এক্সট্রা নক শুনবই না ঠিক করে নিয়ে মিমাংসা বানিয়ে
নিয়েছি। কিন্তু সব খাপে খলবলি সহসা মেটে না।
১১ বছর সাতমাস। মাঝে মধ্যেই ডুকরে ওঠে সঞ্চারির স্তণের ময়ুর। বিরুদ্ধ বেগবান হাওয়ায় কেমন অগোছালো হয়ে যায় কব্জীর নিষিদ্ধ ফ্যাসিবাদ। যাঃ শ্লা, ফেঁসে গেলাম হাভাতে হল্লায়। একেবারে অরিজিনে ফিরে এসেছি। হ্যাঁ, শুরুটা এপথেই। লড়াইয়ের পথে। শোষক শোষিত। শোষিত সংগঠিত হবে এবং ক্যালাবে। কিভাবে ক্যালাবে, সেটা নিয়েই ক্যাচাল। খুপড়িতে বুলেট ঠুসে দেবে, নাকি ভোট কাগজে ছাপ্পা খ্যাচাবে। সঞ্চারি এসব দিনে প্রায় সব খুলে ফেলে চিলেকোঠা উবুড় করছে। বেশি ঝামেলায় থাকে না সে, কেবল মিটিং, মিছিলে ডানা তুলে ছুঁয়ে আছে বন্ধুর নিখাদ নক্সা। সবাই জানতো সবকিছু। কেউ তাই ঘাটাতো না এই জুটিটাকে। কিন্তু বাদশা একাই কত কত দিন মাংস থেকে খুলে নিয়ে মাংসের অবাধ্য স্বদেশ, জন্তুজন্ম এঁকে দিত উদলা কোরে ফ্যাসিবাদী চূড়ান্ত আক্রোশে। পসেশন। পসেসিভ। বিপরীত লিঙ্গের দুই মানুষ-মানুষীর সম্পর্কের মধ্যে আঠা টাইট রাখার মহামন্ত্র। শরীরের ওপর দখল কায়েম। সুতরাং পারিবারিক ছোট ছোট ইউনিটে যতদিন এই পারিবারিক ফ্যাসিবাদ বজায় থাকবে, পরিবার থাকবে অটুট। এই আঠায় যদি বিপ্লব খোঁচাতে যাও পরিবার গোল্লা। এসব মহা মহা জ্ঞানবাজী করবার জন্যে তো বোতামে আঙুলচাঁটাতে বসিনি, লিখব সেইসব দিনের কথা যখন উড়ছি উড়ছি আর হাওয়ায় খুলে খুলে ছড়িয়ে যাচ্ছে একেকটি পালক। বয়সের পালক, ক্যারিয়ারের পালক, ন্যূনতম চাহিদা মেটাবার মত পয়সা রোজগারের জন্য সময় দেবার বদলে সবকিছুকে নস্ম্যাৎ করবার তুমুল স্পর্ধা। ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ দূর হটো, বুর্জোয়া গণতন্ত্র নিপাত যাক, প্রোলেতারিয়েতের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নতুন নতুন স্বপ্নের নীল নক্সায় মহাযুদ্ধের আয়োজন। রাষ্ট্র নিপাত যাক, শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই। সঞ্চারী উড়ছে, উড়তে উড়তে পড়ছে, পড়েও আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে, শরীর ছড়িয়ে দিচ্ছে রাজপথের মতো, বাদশার বন্য ঘোড়া যখন তখন ফাটিয়ে চলেছে সেই পথের পাথর কাদা উন্মুক্ত প্রসারণ। মোলায়েম গীতিকবিতার পংক্তি এসব ক্ষেত্রে অসহায় ভাবে উপেক্ষিত-- এমন দিনে তারে বলা যায়, ইত্যাদি। কেবলু যেন ঘরের কোণে ছাদ চাপা পড়ার আগে বসে কান্নাকাটি করছে। এভাবেই হাসি মস্করায় উপহাসে লটকে থাকতো 'এমন দিনে তারে ... যায়' ইত্যাদি। হায়! দলা পাকিয়ে ওঠা পারিবারিক, সামাজিক যুদ্ধক্ষেত্র তবু ছোট ছোট বৃত্তেই লাট খায়-- যখন বোঝা গেলো তখন দেরি হয়ে গেছে খুব। চাহিদা ও যোগানের হিস্টোরিকাল, ডায়ালেক্টিকাল যাবতীয় মেটেরিয়ালিজম হামলে পড়ে ঘেঁটে দেয় প্রোলেতারিয়েতের ক্ষমতায়নের জন্য মহাযুদ্ধের স্বপ্নপ্রস্তুতির ঘোরে বুঁদ থাকা সময় বিনিয়োগ। জীবিকা চাই এবং স্থায়ী জীবিকা, নইলে সঞ্চারী ফানুস হয়ে উড়ে যাবে অন্য কোন হরির গোয়ালে। অভিভাবকেরা চেতে উঠে তীব্র বিদ্রোহ করে। বাদশা কেলসে যায় ঝড়ের দাপটে। সঞ্চারী তড়িঘড়ি জীবিকার খোঁজে নিজেও সক্রিয় হয় কিন্তু সময় সীমিত। একের পর এক অসফল চেষ্টায় বিধ্বস্ত পরিবারের সিদ্ধান্তে সমর্পণ করে দেয় নিজেকে। বিষয় বাধ্যতই অমিমাংসিত থেকে যায়। সময়ও ডুকরে ওঠে ব্যালট পেপারে। আলকাতরা মাখা দেয়াল ঠিকরে থাকে শুধু সেইসব গুপ্তকথার সাক্ষি হয়ে 'বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস' কিম্বা 'পৃথিবীতে এমন দিন আসবে যেদিন বড়লোকের পিঠের চামড়ায় গরিবেরা জুতো বানাবে'। বিষয় অমিমাংসিত। মিমাংসা মানে আপোষ, আপোষের গভীরে জট পাকাতে থাকে পোষ মানানোর এলিট জ্যামিতি। বরং সঞ্চারী মাদুরাই থেকে মাদ্রিদ হয়ে ডালাস। বিছানার তলায় রাখা অব্যবহৃত কয়েকটি কন্ডোম চোখে পড়লেই বাদশা আজও নিখাদ উদাস হয়ে অমিমাংসিত বিষয়ের কেন্দ্রে বারকয় সঞ্চারী সঞ্চারী করে গোপনে কঁকিয়ে ওঠে কখনও কখনও। আজ গীতিকবিতার লিরিক তাকে সঙ্গ দিয়ে যায় কোনো ঘোর নিশীথ বা চন্দ্রালোকিত আবছায়ায়-- এমন মেঘস্বরে / বাদল ঝরঝরে / তপনহীন ঘন তমসায়...

0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন