কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

রাশিদা সুলতানা

 

সমকালীন ছোটগল্প


অ্যাসিড

 

(১)

কেউ অ্যাসিড ছুঁইড়া মারলে তো তোমার মুখে, গলায়, ঘাড়ে কোথাও ছিটাটিটা লাগত! কিন্তু কোথাও ছিটাফোটার চিহ্ন নাই। শুধু বামহাতে। দেখলে মনে হয় কেউ যেন যত্ন কইরা ঢালছ!”

রাহেলা বেগম কিছু বলার আগেই বড়ভাবি বলেন, “অরা বোতল খুইলা কিছু ছুঁইড়া মারতাছে হ্যায় এইটা দেখনের লগে লগে পাশ ফিরা গ্যাছে। আর অরা অত কাছ থিকা মারে নাই তো! একটু দূরে থিকা মারছে বইলা এত ছড়াইতে পারে নাই।”

রাহেলা বেগম নিশ্চুপ। কিন্তু দারোগাকে দেখে মনে হয় ভাবির কথায় যেন সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।

দূরের থিকা ছুঁইড়া মারলেও, আশেপাশে অন্ততঃ দাগটাগ তো থাকত! তাছাড়া এজাহারে রাহেলা বেগমের ভাই মোটামুটি চৌদ্দগুষ্টিরে আসামি করছেন। অপরাধ করলে ঐ পোলা করতে পারে, কিন্তু, হের বাপও আসছিল ঐ পোলার লগে আপনার মাইয়ারে অ্যাসিড মারতে? এইডা বিশ্বাস করনের কথা?”

রাহেলা বেগমের পিতা উত্তেজিত।

ঐ পোলা আমার মাইয়ারে বিয়া করার লাইগা বহুদিন পিছে ঘুরছে। অর বাপমায়েরে দিয়া আমাগোর বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাইছে। আমরা কেউ রাজি হই নাই। আর এই কারণেই অরা খেপছে। আমার এত বড় সর্বনাশটা হেরা করছে, আর আপনে এইসব উল্টাসিধা প্যাঁচাইতাছেন? মেডিকেল রিপোর্টে কী আছে, আপনে মেডিকেল রিপোর্ট দ্যাখেন।”

কিন্তু আপনের মাইয়ার চেহারা, শরীর স্বাস্থ্য, কোনোটাই তো এমন কোনো সুবিধার না যে কেউ তারে বিয়া করার লাইগা পাগল হইয়া যাইব। এই মাইয়া, তুমি নিজের মুখে বল কী হইছে। আপনেরা কেউ কথা বলবেন না।”

রাহেলা বেগম বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে। মুখটা বড় বেশি অসহায় লাগছে যেন। তিনি কি ঘামছেন? কাঁপছেন কি? কাঁপুনি কমানোর জন্যই যেন রাহেলা বেগমকে আরও জোর দিয়ে বলছেন, “বল্ মা, যা হইছে খুইলা বল্।”

রাহেলা বেগম বিবৃত করেন, “হেইদিন মাঝরাইতের দিকে আমার পেসাব চাপলে আমি ঘুম থিকা উঠি। ঘর থিকা বারঅইয়া যখন উঠানে নামছি, দেখি চাইরপাঁচজন মানুষ আমার দিকে আইতাছে। বেশিরভাগই মুখ বান্দা, তার মইধ্যে আমি কমরুদ্দির পোলা সাঈদরে চিন্যা ফালাইছি। আমি উল্টা দিকে দৌড় দিমু, আমার দিকে হেরা কী জানি ছুঁইড়া মারল, আর আমার বাম হাতটায় মনে হইল কেউ আগুন ধরাইয়া দিছে।”

(২)

দ্যাখ রাহেলা, কমরুদ্দি আমগোরে সবদিক থিকা শেষ কইরা দিছে। মনিররে দুই বছর ভুয়া ডাকাতির মামলায় ফেরার বানাইছে। কত জায়গায় টাকা পয়সা ঢাইলা যে আমি উদ্ধার পাইছি তা খালি আমি জানি আর আল্লাতালা জানে। নান্দলালেরা ইন্ডিয়া যাওনের পর অগোর জমিগুলান আমি ভাগ কইরা লইছি। এই কমরুদ্দি শুয়ারের বাচ্চা ডিসি আপিসে দৌড়াদৌড়ি কইরা এইডাত প্যাঁচ লাগাইছে। মনিররে আসামি কইরা আমারে যেই ধাক্কাটা মারছে আমি আর সোজা হইতে পারি নাই। মেম্বার ইলেকশনেও আমি হারছি। আমারে শেষ কইরা ফালাইছে শুয়ারের বাচ্চারা। তর উকিলগো লগে আলাপসালাপে আমি যা বুঝছি হেইডা হইল, একমাত্র নারী নির্যাতন মামলায় অগোরে ফাঁসান যায়। কারণ, দারোগারা নারী নির্যাতনে চার্জশিট না দিলে পেপার পত্রিকা সব ছাঁইকা ধরে, কয়, ঘুষ খায়া আসামী বাঁচায়া দিছে। দ্যাখ্, তুই একটু কষ্ট সইয্য করলেই আমাগোরে উদ্ধার করতে পারস। কমরুদ্দির গুষ্টিরে আমরা জন্মের শিক্ষা দিয়া দিতে পারি। জীবনে আর কোমর সোজা কইরা অরা দাঁড়াইতে পারব না। আম্মা, একটু কষ্ট সইয্য করলে আমরা অগোরে চৌদ্দঘাটের পানি খাওয়াইতে পারি। এই জাতেরে শোয়াইয়া না দিতে পারলে অরা আমাগোরে শেষ কইরা ফালাইব।”

রাহেলা বেগমের পিতার দুই চোখ জিঘাংসায় জ্বলজ্বল করে। পিতা বলে যান, বড়ভাই, ভাবি সামনে বসে নীরব সমর্থন জানায়। তবে পরিবারের কারোরই পিতার সঙ্গে অমত করার দুঃসাহস নাই। এই অভ্যস্ততার বাইরে যাবার সৎসাহস কারো মধ্যে তৈরি হবার সুযোগই ঘটে নাই এই পরিবারে। তবে, মা কান্নাকাটি করবেন বলে তাকে নানির বাড়ি পাঠিয়ে দে’য়া হয়েছে পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক। মেজোছেলে মনির হোসেন বিগত দুই বৎসর ডাকাতি মামলার ফেরারি আসামি। পুলিস বহুদিন বাড়িতে হানা দিয়েছে মনির হোসেনকে খুঁজতে। উত্তরপাড়ার কমরুদ্দির বাড়িতেই ডাকাতি মামলার আসামি করা হয়েছে তাকে। যদিও রাহেলা বেগমদের পরিবারের সকলেই সাক্ষ্য দিয়েছিল যে বেঘোর জ্বরে কাতর মনির হোসেন ডাকাতির ঐ মুহূর্তে ঘুমাচ্ছিল বাড়িতেই। কিন্তু কমরুদ্দির স্ত্রী পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন যে দু’একজন ডাকাতকে তিনি চিনতে পেরেছিলেন, তার একজন মনির হোসেন।

রাহেলা বেগম কিছুসময় বোধবুদ্ধিহীন, নিষ্কম্প হয়ে বাবার মুখের পানে তাকিয়ে বসে থাকে। তারপর হুহু কেঁদে ভেঙে পড়ে।

তর সামান্য কষ্ট হইব, আমরা বহুত টাকাপয়সা খরচ কইরা তরে বিয়া দিমু।”

কোনো বরাভয়ই রাহেলা বেগমকে আশ্বস্ত করতে পারে না। সন্ধ্যারাতের প্রস্তাব মধ্যরাতের খানিক পূর্বেই কার্যকর হয়। পুকুরের দক্ষিণ দিকের কবরস্তান থেকে কতকগুলো শিয়াল চিৎকার করে ওঠে নিকষ অন্ধকারে। তখনই, রাহেলা বেগমের চিৎকারও শিয়ালের চিৎকারের সঙ্গে মিশে গিয়ে আকাশটাকে ফালি ফালি চিরে ফ্যালে। আর সেখান থেকে আগুনের ফুলকি ঝরতে থাকে পৃথিবীর উপর, আর মাঠ, ঘাট, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, পাঠশালা, গাছপালা, রাহেলা বেগমের পিতা, ভাই ভাবি, মা, কমরুদ্দি, তৎপুত্র, সকলেই দাউ দাউ পুড়ে যায়।

(৩)

রাহেলা বেগম আব্বাকে আশৈশব যমের মতো ডরায়। বাড়ির সকলেই। আব্বার সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলবে, এটা ভাবলেই তার বুকে দুরুদুরু শুরু হয়। আজীবন আব্বাকে দেখে এসেছে, বাইরে থেকে বাড়ি ফিরেই, হাতের কাছে প্রয়োজনীয় কোনো কিছু না পেলে, বা পেতে সামান্য দেরি হলে, বাড়ির সকল “লাটসাহেবের বেটিদের” চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে। এযাত্রায়ও তাই নীরব কান্না ছাড়া তার কিছুই করার থাকে না। তাছাড়া, বাড়িতে অপাঙ্ক্তেয়তম তার কথা শোনারই বা আছে কে?

সমবয়সী মেয়েদের তুলনায় সে খানিক বেঁটে হওয়ায় তাকে নানা বাজে মন্তব্য শুনে শুনে বড় হতে হয়েছে। বাড়িতে ভাইবোনেরা ডাকত “বাডুনি” এবং স্কুলে সবাই “দেড় ব্যাটারি”। তার বড়বোনের বিয়ের আগে পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে এলে ভাবি, ভাইয়েরা সবাই বলত, “খবরদার, তুই পাকঘর থিকা বাইরইস না। তরে দেখলে বিয়া ভাইঙ্গা যাইব। পোলার আত্মীয়স্বজন কইব মাইয়ার বইন খাটা। এই বিয়া অইলে বাচ্চাকাচ্চাও খাটা হইব।” রাহেলা বেগমও রান্নাঘরে ঢুকে থাকত সাড়াশব্দহীন। বড়বোনের বিয়ের পর তার নিজের জন্যও কিছু প্রস্তাব এসেছিল কিছুদিন। কিন্তু পাত্রী দেখার পর কথাবার্ত্তা আর এগোয়নি।

(৪)

হাসপাতালে রাহেলা বেগমের জ্ঞান ফিরলে সে দ্যাখে শিয়রেই পিতা দণ্ডায়মান। তাকে চোখ মেলতে দেখেই, তার মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে তিনি হাউমাউ কাঁদেন। বিলাপ করেন, “আম্মা, তুমি মাফ কইরা দেও। আমায় তুমি মাফ কইরা দেও। আমার মতো খারাপ বাপ দুইন্যাতে হয় না। আমি তরে যেই কষ্ট দিছি কোনো বাপ তার সন্তানরে তা দেয় না।”

রাহেলা বেগম গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করে দুঃসহ যন্ত্রণায়, কোনো কথাই তার কানে ঢোকে না। রাহেলা বেগমের পিতার অনুতপ্ত চেহারায় একটু পরেই ফুটে ওঠে ভীতি ও অসহায়ত্ব।

যন্ত্রণার ছটফটানি একটু কমে এলে পিতা কানের কাছে ফিসফিস করে, “তুমি যদি ঠিকমতো সাক্ষি না দেও, আমাগো চৌদ্দগুষ্টির জেলের ভাত খাওন লাগব। আম্মা, তোমার হাতে এখন সবকিছু। তুমি বাঁচাইলে আমরা বাচমু, মারলে মরমু।”

রাহেলার পিতার আর্তি করুণতর হতে থাকে, এবং তারপর তিনি ডুকরে কাঁদতে লাগেন পুনরায়। ডাক্তার নার্সদের জিজ্ঞাসার জবাবে রাহেলা বেগমের নিজের কিছুই বলার দরকার হয় না। পিতাই মন্ত্র আওড়ানোর মতো বর্ণনা করে যান। আম্মা ফুঁপিয়ে উঠেন খানিক পর পর। পিতা এবং ভাইয়েরা ধমক দিয়ে কিছুসময় পর পর তাঁকে ধাতস্থ করেন।

 (৫) 

ক“সার, আমার বিয়ার যুগ্যি মাইয়াডারে শ্যাষ কইরা দিছে, সার দ্যাখেন।”

হাতকাটা কামিজের উপর থেকে ওড়নাটা সরালে মানচিত্রের মতো, ফাটা, ফোলা, কালো, বীভৎস পোড়া হাতটা দৃশ্যমান হয়। পুলিস সুপার ভ্রূ কোঁচকান, “আহাহা, এমন সর্বনাশ করেছে!” বিবরণ জানতে চান। পিতা বিড়বিড় বলে চলেন, কোনখানে কতটুকু জোর, কীরকম সুর প্রয়োগ করা সমীচীন, এইসকল বিবেচনা করে করে। এমনকি ব্যাকরণসম্মতভাবে চোখের পানিও ফ্যালেন সম মাফিক। বড় ভাবিরও চেহারায় প্রাণান্তকর অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস।

পুলিশ সুপার আশ্বস্ত করেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তিনি নেবেন। রাহেলা বেগমের মুখ নিচু, নিশ্চুপ। সাঈদের কথা মনে পড়ে। স্কুলে আর সকলের সঙ্গে সেও তাকে দেড় ব্যাটারি ডাকত। একদিন নীলা আপাদের গাছ থেকে আম চুরি করে দেয়াল থেকে রাস্তায় লাফ দিয়েই রাহেলা বেগমকে সামনে দ্যাখে সে। তার হাতে দু’টো আম দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন