বর্ণমালার সাতকাহন
(পর্ব
৩০)
ছেলেবেলায়
খুব। খুবই এক ছোটবেলা। দেখতাম বাড়িতে খালি কাঁসি হাতে ভিখারী। "একমুঠো ভাত দেবে গো”! পথে ঘাটে স্টেশনে খুব ভিখারী বাচ্চা থেকে বুড়ো। এখন তাদের দেখি না আর। এখন সরকারের পাঁচটাকার ডিম্ভাত ডাল। সেও ভালো। এই পাঁচটাকার লাইনে বড় বাড়ির অবহেলিত বৃদ্ধাও। বাড়ির সামনে দিয়ে যেত বিশাল বড় ঝুড়ি করে ঘুঁটে নিয়ে হাতে সবুজ লাল কাঁচের চুড়ি পরে হিন্দুস্থানী মহিলা। বাঁকে করে ঊড়ে ভারি জল দিয়ে যেত শহরে পাড়ায়। দুদিকে ঝকঝকে দুটি বালতি ভর্তি জল ব্যালান্স করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসত আমার ভবিষ্যতের শ্বশুরবাড়িতে, দিদিমার মাসী মামাদের বাড়িতে। একই বালিগঞ্জ পাড়ায়। খুব আবছা একটা স্মৃতি বিজন সেতু নির্মাণের পূর্বের বালিগঞ্জ স্টেশনের লেভেল ক্রসিং। আনন্দ পালিত রোডের টানা ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে মহরমের মিছিল। শহর থেকে গ্রাম ট্রেনে। মাঝে বিশাল প্রান্তর আর জলাশয় বাঘাযতীন পেরোলেই বিরাট জলাশয়গুলো আয়না আকাশের। পালপাল গরু আসত এখানে ঘাস খেতে। আমরা ইস্কুল থেকে পিঠে ব্যাগ নিয়ে ফিরতাম তাদের সঙ্গে, রাখালদের সঙ্গে। আমাদের সেই গ্রাম আজ স্মৃতির মতো।
বাড়ির সামনে দিয়ে সরু রাস্তাটা
বাঁশবনের সামনে দিয়ে চলে গেছে বেঁকে আরো ভেতরে অনেক দূর। বাড়ি থেকে ওই বাঁকটা অবধি
দেখা যেত যেখানে মোষপুকুর। মাঝে মাঝে সে রাস্তা ধরে চলে যেতাম অনেক দূর। হয়ত তেমন কিছু
নয় কিন্তু আমার কাছে সেই ছিল দেশ আবিষ্কার। দুপাশে মাঝে মধ্যেই পুকুর। সারি সারি মাটির
বাড়ি টালির বাড়ি, বনবিবির মন্দির, ভাঙা দোল মন্দির, গাজীবাবার থান যেখানে পীর সাহেবের
মেলা হয় এখনো ফাগুনমাসে আর তারপর বিরাট বড় মাঠ, একপাশে শীতলা মন্দির। এই মাঠ এক বিরাট
আকর্ষণ ছিল।
এখানে চৈত্র সংক্রান্তিতে হতো গাজনের
মেলা ,চরকের ঝাঁপ আমি পাড়ার কোনো মাসির সঙ্গে পৌঁছে যেতাম। ঝাঁপের আগে যারা সন্ন্যাস
রাখত ও যিনি আসল ব্যক্তি শিব সাজতেন তিনি একগাদা
তাড়ি খেয়ে দুলে দুলে পুরোনো বটগাছটা প্রদক্ষিণ করতেন পেছনে পুরো দলটা আর সব শেষে কুচো
কাঁচারা হৈ হৈ করত। শিবের নামেই কোনো গান এখন আর মনে পড়ে না। শুধু দৃশ্যগুলো গেঁথে
আছে মনে। বাঁশ দিয়ে লম্বা মতো একটা টাওয়ার তৈরি হতো মাঠের মাঝখানে। লোকে লোকারণ্য।
আমাদের গ্রামের সরস্বতী মাসি বলত লোকে লোকাণ্ড।
মাঝ বরাবর পেরেকের বস্তা। যারা
মানত রাখত ওই টাওয়ারের ওপর থেকে ঝাঁপ দিত পেরেকের বিছানায়। অনেক লোক মিলে লুফে নিত
ওই কাঁটা সাপের পর। কিন্তু কারোরই কিচ্ছু হতো না। দারুন আশ্চর্য হয়ে যেতাম। এরকম আরো
দু এক রকমের ঝাঁপ ছিল, যেমন আগুনের ওপর, অনেকে গরম লোহার শিক গিঁথে। বীভৎস রস রবীন্দ্রনাথ
বোধহয় একেই বলেছেন। এই শিবের উৎসব অতি প্রাচীন সংস্কৃতি আমাদের লৌকিক যাপনের ইতিহাসে।
গাজনের মেলায় সং যারা সাজতেন পরে আবার বাড়ি ঘুরে ঘুরে টাকা তুলতেন। চরকের মেলা সবচেয়ে
অভিনব হতো। এছাড়া ফাল্গুন চৈত্র মাসে আরো কিছু মেলা হতো গ্রামে। বনবিবি মেলা হতো। দক্ষিণ
চব্বিশ পরগনা মূলত অনেকটা অংশই সুন্দর বনের অন্তর্গত ছিল। আদিগঙ্গা বয়ে যেত গ্রামের
পাশ দিয়ে। বাঘ ও সাপ এই দুই মুখ্য প্রাণীর থেকে নিরাপদ থাকার জন্য বনবিবির পুজো। বনবিবির
থানে অনেকেই মানত করতেন হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে। বনবিবির মেলায় যেতাম। এই মেলাতে
পীরবাবার মেলার মতো অত ভিড় হতো না কারণ সময়
সীমিত থাকত।
তারপরেই হতো পীরের মেলা গাজিবাবার
থানে। ওখানে ছোটো মসজিদ ছিলো। গ্রামের হিঁন্দু বউরাও যেত গাজিবাবার থানে মাদুলি আনতে,
জলপড়া দিতে। সন্তানাদি না হলে,কারো স্বামী
বা সন্তানের অসুখে। একটু একটু বড় হচ্ছি তখন ভাই খুবই ছোটো আর পরেও সে কখনো যেতো না।
আমি একটু গেছো ধরনের ছিলাম তাই হয়ত এসব মেলা খুব টানত। গাজিবাবার মেলাতে নানারকম পসারি
আসত। সাপখেলা হতো। সব শেষে ওই গাজনের মাঠেই শীতলা মেলা হত। নাগরদোলা, ঘুরন্ত সিটে বসা,
একটা ছোট্ট জায়গা ঘিরে পর্দা ফেলা থাকত। সামনে সাদা কালো কঙ্কালের ছবি। আমাকে কেউ ভেতরে
নিয়ে যায়নি। মা নাকি নিষেধ করেছেন। বাইরে থেকে প্রতিবার নানারকম রহস্যময় আওয়াজ আসত।
কী যে হতো এখনো জানি না। বাইরে গরম জিলিপি,
নিমকি, কাচের চুরি নানা রকম খেলনা বিক্রি হতো। সারা গ্রাম সেজে গুজে দল বেঁধে আসতো
গাজিবাবার মেলায় আর শীতলা মেলায়।
মনে আছে বাড়িতে মুস্কিল আসান আসতেন।
রঙবেরঙের লম্বা জোব্বা, লম্বা ঝোলা আর বিরাট দাড়ি গোঁফ। একটা চামর জাতীয় জিনিস মাথায়
বুলিয়ে দিতেন। আমাদের আশীর্বাদ করে যেতেন। মা অনেককিছুই দিতেন। এখন আর মুস্কিল আসান
দেখি না। তাই মুস্কিলের পাহাড় বাড়ে কেবল। আসান
করার কেউ নেই।
স্কুল থেকে ফিরে এমন কোনো কোনো
বিকেলে বায়োস্কোপওলা আসত। একটু বড় হবার পর আর দেখিনি।
টিফিন বাক্সর ঢাকার মতো দুদিকে
আটকানো একটা বড় টিনের বাক্সে একটা তিনঠেঙে স্ট্যাণ্ডএর ওপর থাকত। টাকা দিতেন মা তখন
ঢাকা খুলত। চোখ লাগিয়ে দেখতে হতো। গান বাজত আর ভেতরে বিভিন্ন নর নারীর ছবি নানা পোজে। আমাদের কেন জানি না হিন্দি
সিনেমা দেখা বারণ ছিল তাই একমাত্র অমিতাভ বচ্চন ছাড়া বাকিদের চিনতাম না। ছয় সাত বছরের
পরে আর কখনো বায়োস্কোপওলা দেখিনি। তাঁরা কোথায় হারিয়ে গেলেন জানি না। যেমন মুস্কিল
আসানরাও ধীরে ধীরে আসতেন না আর।
এভাবেই অনেক কিছু হারিয়ে গেল। ইন্দ্রনীলকে
তখনো মনে পড়ত। তারপর এলো বই। আর দেখা হলো প্রথম প্রেমিক ইন্দ্রনাথের সঙ্গে। ন'বছর বয়স।
বইয়ের পাতা থেকে একেবারে হৃদয়ে।
(ক্রমশ)

0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন