| কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৪১ |
কুরু-পাণ্ডব আর দুপুরের খাবার
জায়গাটা অনেক দূর। প্রথমে ট্রেন তারপর বাস তারপর অটো না থাকলে টানা দু-মাইল হাঁটা। সুরেশের করার কিছু ছিল না, কাছেপিঠে কোনোরকম কোনো কাজ না পাওয়াতে এখানে গ্রামের ইস্কুলের মাস্টার হতে হয়েছে।
গ্রামের ইস্কুল যেমন হয় তেমনি। সরকারি টাকায় চলে। সরকার থেকে মিড-ডে মিল মানে দুপুরের টিফিন আসতো, কিন্তু মাঝে সে নিয়ে একটা ঘোটালা হয়ে যাওয়াতে খাবার আসা বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পড়ুয়াদের আসাও। এসব দিকে এররকমই হয়। তা দেখে এখানকার এক বড় ব্যবসায়ী সদয় হয়েছেন। এই মাইল দশেক দূরে একটা কারখানা, গোটা কয়েক ময়দা আর চালকলের মালিক তিনি। প্রত্যেক দিন একটা ছোট ডালা লাগানো টেম্পোতে খাবার আসে। খিচুড়ি, একটা তরকারী আর কোনো কোনো দিন ডিমসেদ্ধ। চাটনিও আসে মাঝেসাঝে। গোটা ষাটেক ছেলেমেয়ের নাম আছে খাতায়, মোটামুটি সকলেই আসছে এখন। সেদিন দুপুরের দিকে খাবার বিরতির আগের ক্লাসটা নিচ্ছিল সুরেশ।
সুরেশ আগে জানত না যে সে মোটামুটি ভালোই পড়াতে পারে। কদিনের চেষ্টায় সে খানিকটা শিখিয়েছে বাচ্চাগুলোকে। যোগ-বিয়োগ, অ-আ, এবিসিডি। আজ সুরেশ ভাবল এসবের সঙ্গে এদের এক-আধটু নীতিশিক্ষাও তো দেওয়া দরকার। সে আজ ক্লাসে মহাভারতের গল্প ফেঁদে বসেছে। একদিকে একশভাই নিয়ে কৌরব যারা বিশেষ সুবিধের লোক ছিল না আর অন্যদিকে পাঁচভাই পাণ্ডব। পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণ ভগবান আছেন কারণ পাণ্ডবরা সত্যি কথা বলে, কারোর ক্ষতি করে না। কুরু-পাণ্ডবদের মধ্যে লেগে গেল এক ভীষণ যুদ্ধ। কৌরবরা অন্যায় করত বলে তাদের দিকের বীর যোদ্ধারা মারা পড়তে লাগলো …
এদিকে সুরেশের মনে ভাবনা হচ্ছে, দুপুরের খাবার আসতে এত দেরী হচ্ছে কেন রে বাবা! বড়লোকের খেয়াল নয় তো! সমাজসেবার ঝোঁক চেপেছিল কদিনের জন্য, এখন নেমে গেছে! এখন হয়তো শোনা যাবে – ব্যবসার অবস্থা ভালো নয় তাই আজ থেকে খাবার পাঠানো বন্ধ!
ইস্কুলে খেতে পাবে বলে বাচ্চাগুলো বাড়িতে খাবার পায় না। ওদের আর তর সইছে না। কী করে এদের ধরে রাখবে ক্লাসে? মহাভারতের যুদ্ধও তো শেষ হতে চলল! সুরেশ ভাবল কথা বলিয়ে বলিয়ে যদি এদের মন টেনে রাখা যায়! সুরেশ জিগেস করল – “তোমরা এবার বল তো কারা ভালো ছিল – কৌরব না পাণ্ডব?”
সবাই চুপ। কারো কোনো আগ্রহ নেই। সুরেশ একটা ছেলের পিঠে হাত রেখে বলল, “বল বল, তোমার কী মনে হয়? কুরু-পাণ্ডবের ভেতর কারা ভালো?”
দায়সারা ভাবে ছেলেটি বলল, “জানি না”।
এবার একটি মেয়েকে জিগেস করতে সে নিষ্পৃহ ভাবে
বলল, “আমি এদের কাউকে চিনি না।”
বোঝো ঠ্যালা! বাচ্চাগুলো শুনলো তো এতক্ষণ, কিন্তু একটুও কি বোঝেনি
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন