কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

অভিজিৎ মিত্র

 

সত্যজিৎ, চোখ ও জীবন

 


আমি স্বপ্নে রোজ একজোড়া চোখ দেখি। সোজাসুজি। অনেক জিজ্ঞাসা। ভালবাসা, আদর। ভয়, আশঙ্কা, রাগ। হতাশা, স্বপ্নভাঙা, হাহুতাশ। কখনো খুনসুটি, শাসন, মমতা, গড়ে তোলার ইচ্ছে। সকালে, দুপুরে, সন্ধের টুইলাইটে, রাতের পেঁচায়। এপাশে, ওপাশে, সামনে, চার্পাশে, হাতে হাত, পিনড্রপ সাইলেন্স। কলকাতা বোলপুর দুর্গাপুর, যদি একটা ত্রিভুজ টানি। স্পর্শচোখ। গন্ধচোখ। হৃদয় অব্ধি নাদেখা ইথার কান্ট্রি রোডসে্‌র তার গেঁথে দেয়। ভাঙাচোরা চোখ, এক নতুন কনস্ট্রাকশন উঠে আসছে, যেন পিকাসো, কিউবিজম। যেন যামিনী রায়, চোখের ফোক কথকতা।

স্বপ্ন ভাঙে। দেখি সামনে ছ’ফুট চার ইঞ্চির সত্যজিৎ রায় পায়চারী করছেন আর তার কোন্‌ সিনেমায় কোন্‌ চরিত্রের চোখ দিয়ে কী দেখাবেন, সেটা নোটবুকে টুকে রাখছেন। আমি দেখতে থাকি, শিখতে থাকি, বুঝতে  পারি না জেগে আছি না অবচেতনে।

প্রথমে মাথার পাতায় কিছু সিনেমা উঠে আসে। সত্যজিতের মাইলস্টোন কিছু। পথের পাঁচালী (১৯৫৫), অপুর সংসার (১৯৫৯), দেবী (১৯৬০), তিনকন্যা (১৯৬১), অভিযান (১৯৬২), মহানগর (১৯৬৩), চারুলতা (১৯৬৪), নায়ক (১৯৬৬), অরন্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১), অশনি সঙ্কেত (১৯৭৩), ঘরে বাইরে (১৯৮৪), গণশত্রু (১৯৯০), শাখা প্রশাখা (১৯৯০), আগন্তুক (১৯৯১)। সিনেমা সম্বন্ধে সত্যজিতের কিছু কথা। সিনেমা সেলুলয়েডের পর্দায় জীবনের কিছু দিক ফুটিয়ে তোলে। ‘One quality which is sure to be found in a great work of cinema is the revelation of large truths in small details’। তাহলে? ধরা যাক, চোখের মধ্যে দিয়ে গোটা এক চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যাওয়া যায়। ভাবুন, এক ক্যানভাসে কালো রং চড়িয়ে তার মাঝে কিছু চোখ আপনার মানসজার্নিতে উঠে এল। ওপরের এইসব ছবির লিড রোল বা সাইড রোলে কিছু নারীর চোখ। রহস্য অথবা প্রাণখোলা।

একজন সমালোচক হিসেবে দেখতে পাই, সত্যজিতের এইসব ছবিতে কোন না কোন চোখ কোন এক স্পেসে কিছু না বলেও সিনেমার অনেক ডায়লগ বলে দিয়েছে। যেমন - সর্বজয়ার চোখ, দুর্গার চোখ, অপর্ণার চোখ, দয়াময়ীর চোখ, রতনের চোখ, মণিমালিকার চোখ, মৃন্ময়ীর চোখ, গুলাবি আর নিলির চোখ, আরতি আর চারুলতার চোখ, অদিতির চোখ, দুলির চোখ, তুতুলের চোখ, ছুটকির চোখ, বিমলার চোখ, ইন্দ্রাণী বা তাপ্তি বা অনিলার চোখ। কোন্‌ চোখ কোন্‌ সিনেমার, পাঠকেষু।

কাট্‌ কাট্‌। এবার একটু ডিটেলে যাব। পথের পাঁচালীর দুর্গার পাইপের মধ্যে দিয়ে জিজ্ঞাসু তাকানো বা দুর্গা  যখন অপুর চুল আঁচড়ে দিচ্ছে, তখন সর্বজয়ার অপত্য স্নেহে তাকানো, ভোলা যায়? দেবী ছবির দয়াময়ীর চোখ প্রতি ক্লোজ শটে আস্তে আস্তে জীবন্ত থেকে নিষ্প্রাণ হয়ে ওঠার সেলুলয়েড। অন্ধকারের লং শটে তিনকন্যার মণিমালিকার চোখে গয়নার প্রতি লোলুপতা, গায়ে কাঁটা দেয়নি? অথবা তিনকন্যার আরেক কন্যা মৃন্ময়ীর চোখেমুখে ছড়িয়ে থাকা গ্রাম্য সরলতা আর আকুতি। গুলাবির চোখে নরসিং-এর কাছে আত্মসমর্পণের আকুতি, ভালবাসার প্রতীক্ষা। আরেকটু এগোলে দেখা যাবে মহানগরের আরতি আর চারুলতা  কত ভিন্ন প্রকৃতির। একজন অফিসের কর্মী, একইসঙ্গে গৃহবধূ। আরেকজন শুধুই গৃহবধূ। কিন্তু তাদের চাহিদা যেন চোখের আয়নায় অহরহ, মনে পড়ে? পালামৌ-এর জঙ্গলে সাঁওতাল মেয়ে দুলির চোখে হাঁড়িয়ার জন্য আর্তি। আবার আগন্তুকের অনিলার চোখে সভ্যতার লজ্জা, যে লজ্জা তথাকথিত সভ্য কিন্তু নির্লজ্জ মানুষেরা দেখতে পায় না।

আমি এইসব চোখ দেখতে দেখতে ভুলে যাই যে দয়াময়ী বা অপর্ণা বা অদিতি বা তুতুলের চোখ আসলে শর্মিলা ঠাকুরের। মৃন্ময়ী মানে তো অপর্ণা সেন, গুলাবি আর কেউ নয় - স্বয়ং ওয়াহিদা রহমান, আরতি বা  চারুলতা মানে মাধবীর চোখ, দুলি হল সিমি গারেয়াল। ইন্দ্রাণী, তাপ্তি বা অনিলা আসলে মমতাশংকর।  ভাবুন তো, চারুলতায় মাধবী দোলনায় দুলে চলেছে, ক্যামেরা তার সঙ্গে সঙ্গে মুভ করছে যেন গোটা পৃথিবী দুলছে অথবা অরণ্যের দিনরাত্রি-তে শর্মিলা ঠাকুর হাতে বালি তুলে ঝুরো করে উড়িয়ে দিচ্ছে, চোখ একটু  নিচে। কি অদ্ভুত রোমান্টিক! আমি যেন এই সমস্ত শটে একজনকেই দেখতে পাই – ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটা। সত্যজিৎ রায়। যার জন্য এইসব চরিত্রগুলো সেলুলয়েড ছেড়ে রক্তমাংসে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে আমার আপনার পাশে হেঁটে এইমাত্র চলে গেল। এরা কেউ স্টার নয়, এরা শুধু বিভিন্ন সময়ে জীবনের একেক চাউনি, একেক পরিচয়।

সত্যজিৎ কিছু চোখ অমর করে গেলেন। আর আমি, পাগল ফকির। ভাবছি পথের পাঁচালীর কান্ট্রি রোড, নোটবুকে হিজিবিজি। নো লাইট, নো সাউন্ড, নো ক্যামেরা, নো অ্যাকশন – শুধু চোখ থেকে ধূপ ছড়িয়ে যাচ্ছে দেখছি, আমার জীবনে, এক সিলুয়েট। The sound of silence. আমি তো আজন্ম চাতক...।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন