![]() |
| সমকালীন ছোটগল্প |
সাঁকো
প্রায় দেড়দিন
হতে চলল পেটে একটা দানাও পড়েনি। জলও বিস্বাদ লাগছে। গা ঘুলিয়ে উঠছে। বটতলায় ওই সিঁদুরমাখা
পাথরটার সামনে গ্রামের মেয়ে বউরা চাল, কলাটলা দিয়ে যায় প্রায়ই। ওগুলো এতদিন ওরই মালিকানা
ছিল। কিন্তু কিছুদিন হল কোত্থেকে একটা সজারু এসে জুটেছে। হারামিটা একটুও সময় নষ্ট করে
না। ওৎ পেতে থাকে। দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব খেয়ে পালিয়ে যায়। খিদের সময় কিছু না পেলে
মাথা গরম হয়ে যায় ওর। যারা দিয়ে যায়, তাদের মনে স্থির বিশ্বাস জন্মেছে, দেবতাই নাকি
সজারুর রূপ ধরে এসে খেয়ে যায় খাবারগুলো! ছড়িয়েছেও কথাটা। মাঝখান থেকে ওর কপালে আর কিছু
জুটছে না।
ও চুপ করে বসেছিল ইটভাটার পাশেই নদীর ধারে। আচমকা ওর কানে ভেসে এল একটা উল্লাসধ্বনি। তাকিয়ে দেখল ইটভাটার কজন মজুর মিলে একটা বড়সড় সজারু মেরে নিয়ে আসছে। আগুনে ঝলসে নিয়ে হাড়িয়া দিয়ে খাওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে ও উঠে পড়ল। একছুটে বটতলায় এল। চুপিচুপি আড়াল থেকে দেখল দেবতাকে সদ্য দিয়ে যাওয়া ভেট সজারুটা দ্রুত সাবাড় করে ফেলছে। ও আর দেরী করল না। হাতের কাছে একটা পাথর পেয়ে ছুঁড়ে মারল সজারুটার মাথা লক্ষ্য করে। নিঁখুত টিপ। সজারুটা থেতলে যাওয়া মাথা নিয়ে পড়ে রইল। তখনো মুখের চারপাশে কয়েকটা চালের দানা লেগে রয়েছে। শাল্লা!
সেদিন রাতে যখন সজারুর ঝলসানো মাংস খাচ্ছে চুরি করে আনা হাড়িয়ায় চুমুক দিতে দিতে, আঃ কী স্বাদ! নেশায় চুর হয়ে, ভরা পেটে ও শুয়ে পড়ল, আর কখন যে গভীর ঘুমে ডুবে গেল, খেয়াল নেই। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল সাঙ্ঘাতিক পেটব্যথায়। কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। এ কি হল! কেন খেতে গেলাম সজারুটাকে! তাহলে সত্যিই কি দেবতা সজারুটার মুখ দিয়ে খেত! হে ঠাকুর, পাপ করে ফেলেছি। এবারের মত মাফ করে দাও। কিন্তু ঠাকুর ছাড়ল না। ভয়ঙ্কর পেটের ব্যথার চোটে আছাড় খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে নদীতে পড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওর মনে হচ্ছিল, ও মরে যাচ্ছে… এভাবেই কি মরে যায় সবাই!
আনোয়ার রাতভর নদীতে ভেসে ভেসে মাছ ধরে। বড় জালের আশপাশ দিয়ে ছিটকে আসা ছোটখাটো যা পায়, নেহাত মন্দ নয়। পরদিন সকালে গঞ্জের হাটে সেসব বেচে হাট থেকেই জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসে। রান্না বসে তারপর। একবার একটা ছোট্ট কচ্ছপ উঠেছিল জালে। কিন্তু সঙ্গে থাকা মোস্তাফা ছোঁড়াটা ভয় দেখিয়েছিল, “এটা ছেড়ে দাও চাচা। এ বেচতে দেখলে তোমাকে পুলিশ ধরতে পারে”। আনোয়ার মোস্তাফার কথা শোনে। শুনেওছিল।
ঝপাস করে ওখানটায় কিসের একটা আওয়াজ হল না! আজ আবার মোস্তাফাটাও আসেনি। কিন্তু কৌতুহল যেমন টেনে নিয়ে যায় অজানার উদ্দেশ্যে, আনোয়ারও রেহাই পেল না এর থেকে। ওকে মাছ ধরা আপাতত বন্ধ রেখে যেতেই হল ওইদিকে। হায় আল্লা, এ যে আস্ত একটা মানুষ! এক্ষুণি না তুললে ডুবে যেতে পারে! অতবড় শরীরটাকে একা কি আর ডিঙিতে তোলা যায়! অনেক কসরত করে শেষ পর্যন্ত আনোয়ার পেরে উঠল। অজ্ঞান হয়ে আছে, যদিও বুকে কান পেতে শোনা গেল ধুকপুক করছে তখনও। আনোয়ার মাছ ধরা মুলতুবি রেখে ওকে নিয়ে ফিরে চলল। রাতের অন্ধকার সবে ফিকে হতে শুরু করেছে।
এ কে গো চাচা?
চিনি না।
কোত্থেকে জোটালে?
নদী থেকে।
ব্যাস, কাল আমি যাইনি, অমনি তুমি
একটা কান্ড ঘটিয়ে ছাড়লে!
মেলা বকিস না, মোস্তাফা। মানুষটা
নদীতে ডুবে মরে যেত, বাঁচাবো না?
মোস্তাফা চুপ করে গেল বটে। কিন্তু
ওর মনে একটা জিজ্ঞাসা ঘুরপাক খেতে লাগল, একে কেউ কি অজ্ঞান করে জলে ফেলে দিয়েছিল? মারতে
চেয়েছিল লোকটাকে? ও দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে। আনোয়ার ওকে থামিয়ে বলল, “এখনই পাঁচকান
করিস না। সুস্থ করে তুলে চলে যেতে বলবখ'ন।” মোস্তাফা চেয়ে রইল আনোয়ারের দিকে। তারপর
কিছুই না বলে বেরিয়ে গেল। আনোয়ার সরষের তেল আছে কিনা দেখতে গেল। তেল গরম করে পায়ের
তলায় ডললে জ্ঞান ফিরতে পারে। বহু প্রাচীন এ টোটকা।
“তোর মতলবখানা কি বলতো?” মোস্তাফা সরসরি জিজ্ঞেস করল ওকে। ও কথা বলতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে শুধু চেয়ে থাকে। চেয়ে থাকাটায় কি যেন একটা আছে। বেশ কিছুদিন পর আনোয়ার ও মোস্তাফা সেদিন রাতে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় ওকে পইপই করে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, রাতের বেলা কোন কারণেই যেন দরজার খিল খুলে বাইরে না বেরোয়। মোস্তাফা অতিরিক্ত বোঝাতে গিয়ে ইশারায় বলেছিল - এমনকি পায়খানা পেচ্ছাপ পেলেও না।
আনোয়ার ও মোস্তাফার এই পরিবারে
আর কেউ নেই। ওরা বাপ ব্যাটা নয়। কোন কালে আনোয়ার ভোরবেলা ফেরার সময় কুড়িয়ে পেয়েছিল
একটি শিশুকে। ফজরের নামাজের আগে এ যেন আল্লাহরই দান মেনে নিয়ে আনোয়ার নিজের কাছেই রেখে
দিয়েছিল শিশুটিকে। ছুন্নত করিয়ে নিয়েছিল। নাম দিয়েছিল মোস্তাফা। কিন্তু কেন যে ওকে
আব্বা ডাকতে শেখায়নি! একা আনোয়ারের ওপর মোস্তাফার ভালোবাসার অধিকারবোধ সন্তানের চেয়ে কোন অংশে কম তো নয়ই বরং এতটাই তীব্র
যে এখানে ও কোন শরিক চায় না। অতএব এই নতুন মানুষটা যে আস্ত একটা সমস্যা ছাড়া কিছুই
না, এ তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তার ওপর কথা বলতে না পারায় ওকে বুঝতেও পারা যায় না
সবসময়। সংসারের কাজকর্ম কিছুই করতে জানে না সেভাবে। প্রথমদিন থেকেই মোস্তাফার ওকে মনে
ধরেনি।
আনোয়ারও বুঝতে পারে না নিজের মনের ভেতর কি চলছে, কোন হদিশ পায় না। তবু এ পরিবারের একজন হয়েই ও রয়ে গেল আজ কতদিন হল।
এখন ভোরবেলা ওরা ফিরে এলে ও ওদের
হাত পা ধোওয়ার জল, গামছা, নিমদাঁতন এগিয়ে দিতে শিখেছে, নামাজের পর মুড়ির বাটিও ধরে
সামনে। একদিন ও মোতার সময় মোস্তাফা দেখে ফেলেছিল যে ও মোছলমান না। ও আনোয়ারকে সরাসরি
বলেছিল কথাটা। কিন্তু আনোয়ার কোন আমলই দেয়নি। মোস্তাফা অবাক হয়েছিল। চাচাকে কি তুক
করল!
“একে রেখে দিয়ে, কি করবে চাচা?“
মোস্তাফার কথার বিষে আনোয়ারের ভ্রূদুটো কুঁচকে গিয়েও আবার আগের মত নিরীহ হয়ে গিয়েছিল,
মুখে কোন কথা ফোটেনি। চিবুকের সাদা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে আনোয়ার উন্মন হয়ে বিড়ি
টানছিল। বিড়ির ধোঁয়া উড়ে যেতে যেতে আনোয়ারের মনে ছেড়ে যাচ্ছিল মোস্তাফার কথার প্রতি
একপ্রকার সমর্থনই - সত্যিই তো, এবার তো ওকে চলে যেতে বলা উচিত। কিন্তু ওর ভাবগতিক দেখে
মনে হয় ওরও যেন চলে যাওয়ার কোন তাড়া নেই, ইচ্ছেও কি নেই! ওর কি আত্মীয়স্বজন কেউ নেই।
হে আল্লা, এ কোন পরীক্ষা নিচ্ছ তুমি?
আগে খাওয়া দাওয়ার কোন ঠিকঠিকানা থাকত না। খাবার যোগাড় করতে করতেই সারাদিন কেটে যেত। কখনো কিছু জুটত, কখনো কিছুই না। এখন ওসবের কোন অভাব নেই। আব্বাও খুব ভালোবাসে, যদিও মোস্তাফা কোন এক অজ্ঞাত কারণে ওকে ঠিক পছন্দ করে না। ওরও এ সুখের জীবন যেন আর সইছে না। এতদিন হয়ে গেল এ পরিবারকে নিজের বলে ভেবে উঠতে পারল কি আদৌ। আগে যেখানে থাকত, সেই জায়গাটার কথা খুব মনে পড়ে ওর। ঠাকুরের প্রসাদ খেয়েই চলে যাচ্ছিল। এখন এই মোল্লা পরিবারে খাবার জুটছে বটে। খিদেয় কোন ধর্মের রং হয়না। পেটের জালাটায় কিছু একটা ভরে দিতে পারলেই হল। আব্বা ওর নাম দিয়েছে হামিদ। যদিও আব্বা কখনো ওকে নামাজে যেতে বলেনা।
মোস্তাফা কদিন হল কোথায় যেন গেছে। হামিদ এখন আব্বার সঙ্গে রাত্রে বেরোচ্ছে। মাছ ধরায় ও ক্রমশঃ পারদর্শী হয়ে উঠছে। সকালে ফেরার সময় হাট থেকে মাছ বিক্রি করে আসতে আব্বা বেশ সময় নেয়, ও ততক্ষণে বাড়ি এসে কাজকর্মে হাত লাগায়। শিখেও নিয়েছে অনেককিছু। শুধু রান্নাটা এখনও সেভাবে শিখে উঠতে পারেনি। ভাত ফোটাতে পারে। সেদিন ওর ভাত ফোটানো হয়ে গেছে অনেকক্ষণ হল। আব্বা ফিরলে রান্না চাপবে। এমনসময় দেখে অনেকে মিলে আব্বাকে একটা খাটিয়ায় শুইয়ে নিয়ে এল। ওরা বলছিল, হাটে মাছ বিক্রি করতে করতেই আব্বা হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেছিল। আর ওঠেনি। নগেন ডাক্তার আসতে আসতেই সব শেষ। ডাক্তার বলেছিল – এ জীবন থেকে মুক্তি পেল আনোয়ার। হাটের সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছিল সেদিন। অজাতশত্রু মানুষটার শেষসঙ্গী হতে চেয়েছিল হিন্দু মুসলমান সবাই।
মাটিও হয়ে গেল সময়মত। আশ্চর্য! ওর চোখ দিয়ে একটুও জল গড়ায়নি! ওর শুধু মনে হচ্ছিল, আর হামিদ ডাকার কেউ রইল না… কী করবে এখন ও! সেদিন ও সারারাত ঘুমোতে পারেনি। মাঝরাতে ঘরের বাইরে এসে ডিঙিটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে মনে মনে বলেছিল, “ভালো থাকিস”।“
মোস্তাফা ফিরল পরদিন সকালে। সবকিছু শুনেও কিছুই বলল না। উঠোনের যেখানটায় মাটি দেওয়া হয়েছে, সেখানটায় গিয়ে চুপ করে বসে রইল অনেকক্ষণ। ফিরে এসেও কোন কথা বলছিল না। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “তুই কি চলে যাবি?”
হামিদ এ কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো
না।
মোস্তাফা আবার বলল, “যাস না”।
আব্বা ওকে প্রাণে বাঁচিয়েছিল। কোন
সম্পর্ক ছাড়াই ওকে সম্পর্কের চৌহদ্দিতে এনে রেখেছিল। ও কে, ওর ধর্ম কী, এসব কিছুই জানতে
চায়নি কোনদিন। মোস্তাফা না চাইলেও জোর করেই গুঁজে রেখেছিল কাছটাতে। ওর মনে হত এ বড় দামী এক ঘেরাটোপ। আজ আব্বা না থাকায়
কষ্টের মত ভারী একটা দলা এসে আটকে রয়েছে ভেতরে কোথাও।
ও অবাক হয়ে গেল যে মোস্তাফা ওকে কোনওদিন একটুও পছন্দ করেনি, চায়নি ও এখানে থাকুক, সেই কিনা আজ চলে যেতে বারণ করছে। কিন্তু কেন! সম্পর্কের আঠায় ও এখন আটকে থাকতে শিখে গেছে। আব্বার চলে যাওয়া থেকে যে কান্নাটা ওর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেনি, এখন আর তাকে আটকে রাখা যাচ্ছে না।
মোস্তাফা বিড়বিড় করছিল, “আমারে
নিজের ভাবতে পারলে কই! ছাওয়াল তো আর না। নাহলে আমি নেই, তখনই চলে যেতে হল তোমাকে”।
ও গিয়ে মোস্তাফার কাঁধে হাত রাখল। মোস্তাফা উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে। এক প্রবল কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল ছেলেটা। টুপিটা কখন যে খুলে গেল মাথা থেকে। এই ছেলেটাকে ও চেনে না। চেনা অচেনার সংজ্ঞা কখন যে বদলে যায়, সত্যি আমাদের জানার পরিধির চেয়েও অনেক দূরে!
মোস্তাফার কান্নার রেশ তখনও রয়ে গেছে। কিছুটা সামলে নিয়ে ও বলল, “যা রোজগার হবে দুজনে মিলে চালিয়ে নেব কোনরকমে। কি রে, পারবি না?”
হামিদ আর পারল না... ভেঙে পড়ল এবার।
মোস্তাফার উপলব্ধি করতে একটুও অসুবিধা হল না, এই কান্নার মধ্যে বাঙময় হয়ে উঠতে চাইছে কত আবেগ, অভিমান, নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার ব্যথা। ও হামিদের পিঠে হাত রাখল।
একজন আরেকজনের ক্ষতে বুলিয়ে দিচ্ছে
আরোগ্যের আঙুল।

0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন