কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

শ্রেষ্ঠা সিনহা

 

‘জাহানারা-জাহানারা’; একই মুদ্রার দুই ভিন্নরূপের প্রতিস্বর



 

"পরেন বটে জুতো মোজা, চলেন বটে সোজা সোজা,

বলেন বটে কথাবার্তা অন্য দেশী চালে,

তবু দেখ সেই কটাক্ষ, আঁখির কোণে দিচ্ছে সাক্ষ্য

যেমনটি ঠিক দেখা যেত কালিদাসের কালে।

'কাল' চিরপ্রবাহমান, এবং মুহূর্তে মুহূর্তে তার নতুন ঢেউ। আর যুগের পরিবর্তন ঘটেছে সিঁড়ি ভাঙা নিয়মে...। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে উন্নত হয়েছে মানুষের জীবনশৈলী, আমূল বদল ঘটেছে তার আচার-আচরণের, কিন্তু নারী জাতির প্রতি বদলায়নি সমাজের সেই ভ্রূ-কুঞ্চন। সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে নিপীড়িত, শোষিত কেবলমাত্র নারীই। উনিশ শতকে নবজাগরিত সমাজে জন ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন সহ গৌরীশঙ্কর, পণ্ডিত মদনমোহন, নীলকমল বন্দোপাধ্যায়প্রমুখের উদ্যোগে নারীশিক্ষার প্রচলন হলেও বিষয়টিকে কেন্দ্র করে রক্ষণশীল সমাজের বিরূপ মনোভাবের পরিচয় মেলে। সাহিত্যে নারী বীরভজ্ঞা রূপে অঙ্কিত হলেও বাস্তবে সে চার দেওয়ালের বন্ধনে আবদ্ধ প্রাণীমাত্র। রবি ঠাকুরের 'সাধারণ মেয়ে' যতই 'সবলা' হয়ে উঠুক, সমাজের পরীক্ষায় সে বরাবরই অকৃতকার্য হয়েছে।

বাংলা নাট্য-সাহিত্যের ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায়, নাটক মঞ্চায়নের পর্ব থেকেই নারীদের নামভূমিকায় পুরুষরাই মূলত অভিনয় করত। ১মে, ১৭৮৯ সালে মিসেস ব্রিস্টোর প্রাইভেট থিয়েটারেই প্রথম অভিনেত্রী গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী সময় প্রতিষ্ঠিত থিয়েটারগুলিতে মেয়েরা অংশগ্রহণ করলেও সেখানকার সিংহভাগ অভিনেত্রীই ছিলেন পতিতা অর্থাৎ তথাকথিত সমাজ-বর্হিভূতা। সমাজপতিদের রক্তচক্ষু কখনোই যেকোনো ক্ষেত্রে সর্বস্তরের নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে মেনে নিতে পারেননি। তাই উচ্চস্তরীয় সমাজের মহিলারা বাংলা রঙ্গমঞ্চের বৃত্ত থেকে ব্রাত্য ছিলেন। পাশ্চাত্যে শেক্সপিয়ারের নাটকে দেখা যায় সেখানকার সব নারীচরিত্র একরকমের নয়। "নায়িকাদের মধ্যে যেমন রয়েছে ওফেলিয়ার মত দুর্বল মানুষ, তেমনি আবার আছে ডেসডিমোনার মত পিতৃআজ্ঞা অবজ্ঞাকারী কন্যা। কেউ জুলিয়েটের মত ঐকান্তিক, কেউ ক্রেসিডার মত পক্ষপরিবর্তনকারী। রজালিন্ড বিদগ্ধ, ক্যাথেরিনা ঝগড়াটে। লেডি ম্যাকবেথ বুদ্ধিমতী, গাট্রুডের মত সরল নয়, মিরন্ডা প্রায় কিছুই জানে না, বিয়েত্রিচ অনেক কিছুই জানে।” বৈচিত্র্যতাস্বরূপ শেক্সপিয়রের নাটকে নারী-পুরুষ সমানাধিকারের তত্ত্বটি প্রতিভাত হলেও তাঁর নায়িকাদের মধ্যে ঐক্যও লক্ষণীয়। "তাঁর নায়িকারা পুরুষের প্রাধান্য মেনে নেয়, মেনে নিয়ে বিয়ে করে কিংবা করতে চায়, আর বিবাহিত নারীরা স্বামীর অনুগামী হয়ে চরিতার্থতা খোঁজে।... তাদের চলাফেরা অনেক সীমিত। তাঁদেরকে কেউ দেখে কাম্যবস্তু হিসাবে। কেউ বা রাখতে চায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে। লোভাতুর পুরুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য নারীদের ছদ্মবেশ নিতে হয়।"

ইতিহাসে নারী এবং প্রতীক বা চিহ্ন হিসাবে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে ঔপন্যাসিক ভার্জিনিয়া উল্ফের মন্তব্যটি এপ্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য: "Imaginatively she is of the highest importance. কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নারী সম্পূর্ণ তুচ্ছ, নগণ্য। কবিতার বইয়ের মলাট থেকে সে জুড়ে থাকে; অথচ ইতিহাসে সে অনুপস্থিত। সে রাজা ও যুদ্ধজয়ী বীরদের জীবন নিয়ন্ত্রিত করে উপন্যাসে ও গল্পে। বাস্তবিক পক্ষে যে কোনো বালকের পিতামাতা যদি জোর করে তার আঙুলে আংটি পরিয়ে দেয়, সে হয়ে দাঁড়ায় তার ক্রীতদাস। সাহিত্যে কিছু কিছু অনুপ্রাণিত শব্দ, কোনো কোনো গভীর চিন্তা তার ঠোঁট থেকে ঝরে পড়তে পারে, কিন্তু বাস্তব জীবনে সে কোনো কথা উচ্চারণ করতে পারে না কারণ সে তার স্বামীরসম্পত্তি বিশেষ।"

কালপ্রবাহে মানুষের মননের পরিবর্তন ঘটলেও তার ভাবনার পরিসরের প্রসারণ ঘটেনি। যে কারণে একবিংশ শতাব্দীতেও একজন নারী তার জৈবিক অধিকার স্বরূপ নয়, ধর্ম এবং পেশার ভিত্তিতেই স্বীকৃতি পান।সমানাধিকার তত্ত্ব এক্ষেত্রে মরীচিকা স্বরূপ প্রতিভাত। যার প্রক্ষিপ্ত প্রতিফলন চন্দন সেন প্রণীত 'পছন্দের ৬ নাটক' গ্রন্থভুক্ত 'জাহানারা-জাহানারা নাটকে' দেখা যায়। নাটকটিতে নাট্যকার একাধারে যেমন একবিংশ শতাব্দীতে সমাজে জায়মান পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন, ঠিক তেমনভাবেই স্রোতের বিপরীতে হেঁটে চলা জাহানারাদের প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদকেও সুস্পষ্ট রূপদান করেছেন।

বাংলা থিয়েটারের অন্যতম জনপ্রিয় নাট্যকার চন্দন সেনের জন্ম ১৯৪৪ সালে। বাবার চাকরির সুবাদে গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে অতিবাহিত হয় তাঁর ছেলেবেলা। ছেলেবেলা থেকেই পিতার নাট্যপ্রীতি তাঁকে থিয়েটারের প্রতি আকর্ষিত করে তোলে। পরবর্তীকালে অহীন্দ্র চৌধুরির 'সাজাহান' নাটক কিংবা উৎপল দত্তের 'সেতু', 'ক্ষুধা' প্রভৃতি নাটক তাঁর নাট্যচেতনাকে উদীপ্ত করে তোলে। নদীয়ার প্রতিভাবান নাট্য-নির্দেশক প্রয়াত অমল বিশ্বাসের সূত্রেই সত্তরের দশকে নাট্যকার হিসেবে চন্দন সেনের প্রথম পদার্পন। 'নিহত সংলাপ', 'ঝড়ের খেয়া', 'অরাজনৈতিক' দিয়ে তাঁর নাট্যজীবনের সূত্রপাত। আশির দশকের সূচনা থেকে 'দুই হুজরের গপ্পো', 'দায়বদ্ধ', 'কর্ণাবতী', 'অনিকেত সন্ধ্যা', 'স্পর্ধাবর্ণ' ইত্যাদি নাটকের মাধ্যমে চন্দন সেন এবং তাঁর লেখনী চার দশক ধরে বাঙালির নাট্য-অঙ্গনে বহুল আলোচিত ও সমাদৃত। নাটক রচনার পাশাপাশি ইংরেজি সাহিত্যে শিক্ষকতার সূত্রে শ্রী সেনের ভাবনায় ইউজিন, ব্রেখট, গলসওয়ার্দি প্রমুখের সৃজন তাঁর রচনায় বারবার ফিরে এসেছে। এছাড়া গেস্ট-লেকচারার হিসেবে অধ্যাপনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজনৈতিক বোধ আর সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহ এবং সরকারের সংকীর্ণতা গুঁড়িয়ে দেবার স্পর্ধা বহুবর্ণী লেখার উৎস। 'শ্রুতি নাটক সমগ্র', 'কর্ণাবতী ও অন্ধগলি' এবং 'আমাদের থিয়েটার' চন্দন সেনের জনপ্রিয় শ্রুতি নাটক। হিন্দি, অসমিয়া, ওড়িয়া, তেলেগু প্রায় সব ভাষাতেই চন্দন সেনের নাটকগুলি ভাষান্তরিত হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাটক হল 'দুই হুজুরের গপ্পো', 'জ্ঞানবৃক্ষের ফল', 'ব্রেখটের পাঁচটি ছোট নাটক', 'সাধুসঙ্গ', 'দায়বদ্ধ', 'হিসেবের কড়ি', পঞ্চরঙ্গ', 'দেওয়াল লিখন', 'ফিরে এসো প্রেম' প্রভৃতি। নাট্যজগতে অসামান্য কৃতিত্বস্বরূপ সম্মানিত হয়েছেন দীনবন্ধু পুরস্কার, নাট্য আকাদেমি পুরস্কার, নাট্য-সঙ্গীত-নৃত্য-দৃশ্য-কলা আকাদেমি পুরস্কার, সত্যেন মিত্র পুরস্কার এবং পার্থপ্রতীম চৌধুরী পুরস্কারে।

উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা অনুসৃত যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার প্রতিফলন ধরা পড়েছিল সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক নানা ধারার কর্মকান্ডের মধ্যে। পূর্ববর্তী যাবতীয় সাহিত্যকলা পদ্য মাধ্যমে রচিত হলেও; এই শতাব্দীর সূচনা পর্ব থেকে বাংলা গদ্যের বা নাটকের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। পাশ্চাত্য সাহিত্য সংরূপের অনুসরণে বাংলাসাহিত্যে ধীরে ধীরে জন্মলাভ করে বিভিন্ন প্রকার সাহিত্য সংরূপ; নাট্যসাহিত্যের ধারা তার মধ্যে অন্যতম। ফলে উনিশ শতকে রচিত বাংলাসাহিত্যের সকল সংরূপে অভিনবত্ব ও বৈচিত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়। সময়ের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যসাহিত্যের ড্রামার প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে নাটকের সূচনা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য পর্বে, তারাচরণ শিকদারের কলমে (ভদ্রার্জুন, ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে)। ওই বছরই প্রথম বাংলা ট্রাজেডি নাটক 'কীর্তিবিলাস' রচনা করেন যোগেন্দ্রচন্দ্র গুপ্ত। এরপর হরচন্দ্র ঘোষের 'ভানুমতিচিত্তবিলাস', 'চারুমুখ চিত্তহরা' ও উমেশচন্দ্র মিত্রের 'বিধবা বিবাহ' রচিত হয়। পরবর্তীকালে কালীপ্রসন্ন সিংহ, রামনারায়ণ তর্করত্ন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, মনমোহন বসু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের কলমে পরিপুষ্টতা লাভ করে বাংলা সাহিত্যের এই সংরূপটি।

রেঁনেশাপুষ্ট সময় থেকে পরবর্তী শতাব্দীতে ক্রমউত্তরণের ক্ষেত্রে যুগগত পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষের জীবনশৈলী এবং আর্থ-সামাজিক পটভূমিরও বিবর্তন সাধিত হয়েছে। স্বভাবতই নাট্যসাহিত্যের দর্পনেও প্রতিফলিত হয়েছে এই ক্রমবিবর্তনের রেখাচিত্র। সমকালীন সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে নাট্যকারের কলমে স্থান পেয়েছে মানুষের মনের গহনকোণে থাকা সুপ্ত বাসনাসহ তার মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কাহিনি। 'জাহানারা-জাহানার' নাটকটি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য। এই নাটকের মূল কেন্দ্রে আছে ক্যানিং থেকে নাম বদলে কলকাতার 'ধর্মপ্রাণ' অভিজাত বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতে আসা জাহানারা তথা তার মত নারীদের জীবন-কথা। সঙ্গে ইচ্ছেমৃত্যু বা মার্সিকিলিং-এর পরোক্ষে পাশে দাঁড়ানো এক যন্ত্রণা-দগ্ধ জীবনকথা। এছাড়া ‘শ্যামা’, ‘নীপা’, ‘রাজারাম’ কিংবা ‘প্রফেসর অমর্ত্য সান্যাল’ এবং ‘বিনীতার’ জীবনকথাও পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। নাটকের প্রতিটি চরিত্রই সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি স্বরূপ চিত্রিত। রেঁনেশাবিধৃত বাঙালি সমাজ নবজাগরিত হলেও তার মননে সেই সনাতনী ধর্মজ্ঞান বিরাজমান। যে কারণে জঠর-জ্বালা নিবারণের জন্য যে কারণে প্রতি মুহুর্তে ‘জাহানারা’ কিংবা ‘শামিমা’দের সত্ত্বাবদলের পথ অবলম্বন করতে হয়। ধর্মান্ধ সমাজপতিদের চোখে তাদের পরিচয় বিধর্মী, তাই স্রোতের অনুকূল প্রবাহে গা ভাসিয়ে জাহানারা কিংবা শামিমা সমধর্মী রঙিন মোড়কে আবৃত করে সমগ্র দুনিয়ার কাছে 'জুলি' কিংবা 'শ্যামা' হিসাবে পরিচিত হয়। দক্ষতা, যোগ্যতা কিংবা মনুষ্যত্ব নয়, সঙ্কীর্ণ ধর্মবোধই হয়ে ওঠে একজন মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা নিবারণের অপরিহার্য শর্ত। অথচ এই বিধর্মী নারীদের ভোগের বস্তু হিসাবে গ্রহণ করতে নারীপিপাসু সমাজের বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ হয় না। কিন্তু শুধুমাত্র কি বিজাতীয় ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ! জ্ঞানের ধ্বজাধারী শিক্ষিত সমাজ কী নিজেদেরকে সম্পূর্ণ শিক্ষিত করতে পেরেছে? পাঠক কে এ প্রশ্নে আর একবার ভাবিত করে প্রফেসর অমর্ত্য সেন ও তার পারবারিক পরিমণ্ডলের অধিবাসীরিরা। কালের প্রবাহমানতায় সময়ের পরিবর্তন হলেও পরিবর্তিত হয়নি মানুষের সংস্কারী রীতি-রেওয়াজ তথা মানসিকতার। বদল ঘটেনি রক্ষণশীলসমাজের বর্ণভেদ প্রথার। বিদ্যাসাগর সহ অন্যান্য সমাজসংস্কারকরা নারীপ্রগতিকে প্রাধান্য দিলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারী বলতে কেবল 'নিত্যসুখ প্রদায়িনী' অন্তঃপুরিকাদের নির্দেশ করে। একজন অন্তঃপুরিকাও যে নিজগুণে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে দুনিয়া এ মতে বিশ্বাসী নয়।

যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ অধ্যাপক সেনের স্ত্রী নীপার প্রতি প্রভাতরঞ্জন সান্যালের অবহেলিত আচরণ, "সান্যাল বাড়ির বউরা টাকার জন্য কখনো বাইরের কারোর কাছে আবেদন করে না।" প্রভাতবাবুর মতে তার পুত্র নাপিত বংশীয় সহপাঠিনীর সঙ্গে প্রণয়ালাপ করলেও অমর্ত্যবাবুর স্ত্রী রূপে একজন কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যাই বাঞ্ছনীয়। ঘটনাক্রমে নীপা দেবী 'নাপিত বংশীয়' হওয়ায় শাস্ত্র মতে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে সান্যাল পরিবার। কিন্তু এখানেই থেমে থাকে না সান্যাল পরিবারের সনাতনী জ্ঞান; পারিবারিক যে কোনো অনুষ্ঠানে নীপা সান্যালের অংশগ্রহণ তাদের ভ্রু-কুঞ্চন বৃদ্ধি করে। যার দরুণ প্রফেসর সেনকে তার বাবার রক্ষণাবেক্ষণের কাজে 'একজন খাঁটি ব্রাহ্মণ ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাপয়েন্ট' করতে হয়। বিধর্মী সমাজের প্রতি বিদ্বেষ তো জগতের অন্যতম জায়মান সত্য। কিন্তু বিধর্মী নারীকে ভোগ করা কোনো ধারার অপরাধ নয়। অথচ একজন বারগণিকা মা-এর সন্তানকে মর্যাদা দিতে সেই পৃথিবীই লজ্জাকাতর হয়ে পড়ে। যার অন্যতম কারণ নবজাতকের পিতৃপরিচয় হীনতা। মাতৃগর্ভে একজন সন্তান দশমাস দশদিন ধরে লালিত হওয়ার পর পৃথিবীর আলো দেখলেও, সন্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে আজ একবিংশ শতাব্দীতেও পিতৃপরিচয় অদ্বিতীয় শর্ত। তাই বারগণিকা ‘জুলি’ ওরফে জাহানারা খাতুনের সন্তান বিনীতাকে সম্পূর্ণ পরিচয়হীনভাবেই অরফ্যানেজহোমে কাটাতে হয় জীবনের ১২টা বছর।

স্রোতের বিপরীতে হেঁটে আত্মজার পরিচয় গঠনে ধনুকভাঙা লড়াই শুরু করে জাহানারা খাতুন। যে লড়াইয়ে নিজেকে বাজি রাখতেও পিছপা হয়না তার মাতৃসত্তা। সমাজ তাকে যৌনকর্মী ‘জুলি’ হিসাবে স্বীকৃতি দিলেও বস্তির কুঁড়েঘরে বসে জাহানারা বিনীতার আকাশছোঁয়া মুহুর্তের রেখাচিত্র অঙ্কন করে। এখানেই শেষ হয় না তার সংগ্রাম; নারীলোলুপ পিশাচদের দাঁত, নখ, শিকার থেকে বিনীতাকে রক্ষা করার জন্য সংহারিণী রূপধারী জাহানারার উক্তি সমগ্র মানবসমাজ কে আরও একবার প্রশ্নের সম্মুখীন করে, " আপনারা আমার মতো পাপী নষ্ট মেয়ের জন্য কোনো দোয়া মাঙবেন না, কিন্তু ওই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখবেন... দেখবেন তো?...”

"ফুল ছুঁয়ে যায় চোখের পাতায়, জল ছুঁয়ে যায় ঠোঁটে

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি রাত থাকতে ওঠে

শুকতারাটি ছাদের ধারে, চাঁদ থামে তালগাছে

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি ছাড়া কাপড় কাচে

দু-এক ফোঁটা শিশির তাকায় ঘাসের থেকে ঘাসে

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি ট্রেন ধরতে আসে

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির মস্ত পরিবার

অনেকগুলো পেট বাড়িতে, একমুঠো রোজগার

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির পোঁটলা পুঁটলি কোথায়?

রেল বাজারের হোমগার্ডরা সাত ঝামেলা জোটায়

সাল মাহিনার হিসেব তো নেই, জষ্টি কি বৈশাখ

মাসিপিসির কোলে-কাঁখে চালের বস্তা থাক

শতবর্ষ এগিয়ে আসে শতবর্ষ যায়

চাল তোলো গো মাসিপিসি লালগোলা বনগাঁয়"

'জাহানারা-জাহানারা' নাটকটির মূল কেন্দ্রে রয়েছে ক্যানিং থেকে নাম বদলে কলকাতার 'ধর্মপ্রাণ' অভিজাত বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতে আসা এই রকমই 'মাসিপিসি' অর্থাৎ একশ্রেণির অসংগঠিত শ্রমিকদের জীবনপঞ্জি। নাটকটিতে জাহানারা চরিত্রটিকে বহুমুখীচরিত্র হিসেবে অঙ্কন করেছেন নাট্যকার চন্দন সেন। কোথাও সে এই সমাজের 'ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি' বা পরিচারিকাদের প্রতিনিধিত্ব করেছে। কোথাও বা বারগণিকাদের প্রতিনিধি আবার কোথাও স্বপ্নপ্রত্যয়ী মাতৃসত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে জাহানারা খাতুন চরিত্রের মধ্য দিয়ে।

আলোচ্য ক্ষেত্রে 'ওয়ার্ক অ্যাসিসটেন্ট' রূপে চিত্রিত জাহানারাদের পেশার দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, তাদের নির্দিষ্ট কোনো সংগঠন নেই, নেই কোনো কাজের নিশ্চয়তা। কেবলমাত্র কায়িক পরিশ্রমই তাদের উপার্জনের এক এবং অদ্বিতীয় পথ। স্রোতে শ্যাওলার মত ভেসে চলাই তাদের দিনলিপি; "রবীন্দ্রনাথ যাদের সভ্যতার পিলসুজ বলেছিলেন, তারা দেশের শ্রমজীবি, ভূমিজীবি মানুষ। কিন্তু প্রাত্যহিক সংসারের কাজের মাসি, ঝি-চাকর-ঠাকুর যারা, তাদের কথা তেমন বলেননি।” যুগ বদলেছে, পরিবর্তিত হয়েছে সমাজপ্রক্ষিতও। ঝি-এর আধুনিক নাম হয়েছে কাজের মাসি ওরফে পরিচারিকা। ফলে তাদের পরিধিরও কিছুটা প্রসারিত হয়েছে। তারা একাধারে ঠাকুর এবং ঘরকন্নার কাজ করে। সময়ের গতিতে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে এই অসংগঠিত শ্রমিকদের অবস্থানেও পরিবর্তন ঘটেছে। স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বাদ স্পর্শ করেছে তাদের মরুপ্রান্তর। কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ তাদের সাময়িক স্বস্তির মত, পরিচারিকাদের অন্ধকারের কালো আকাশে সেই স্বস্তি যেন একফালি চাঁদের মত উঁকি মারে। যা তাদের পরিবারে নিয়ে আসে আশা-প্রত্যাশা তথা স্বপ্নপূরণের হাতছানি। কিন্তু আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগেও কোনো মানুষের পেশাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে তার 'ধর্ম' অর্থাৎ তার ধর্মীয় পরিচয়ই প্রতিকূলতার সৃষ্টি করে।

উচ্চবর্গীয়দের মধ্যে এই অবস্থার অত্যাধিক প্রভাব দেখা না গেলেও; প্রান্তিক সমাজের মধ্যে এর গুরুতর প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রসঙ্গক্রমে এই অবস্থারই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন নাটককার। জাহানারা থেকে কখনো 'জুলি' কখনোবা 'জুঁই ব্যানার্জী' প্রয়োজন মাফিক তার এই পরিচয়বদলের ঘটনাই এই ঘটনার স্বপক্ষে যুক্তি দেয়। কিন্তু আর পাঁচটা মায়ের মতন করে নয়, অগোচরে থেকেই জাহানারা প্রত্যাশিত ভোরের স্বপ্ন দেখে। একদিকে 'কর্ণে'র মতো বেড়ে চলে 'বিনীতা' ধীরে ধীরে পরিচিত হতে শুরু করে নিজ পরিচয়ে; অন্যদিকে 'কুন্তী'র মত দূর থেকে সন্তানের অজ্ঞাতবাসে বসে স্বপ্ন দেখে, "একটা নতুন ফ্ল্যাট কিনব দাদা...তার জন্য টাকা জমাচ্ছি... একটু বড় হলে ও নিজের ফ্ল্যাট থেকে কলেজ যাবে... চাকরি করবে...এই নরকের ঠিকানা তো সে কোনোদিন জানবে না... জানাবোই না।" তাই পরি বিনীতার স্বপ্ন-প্রত্যয়ী আশা-আকাঙ্খা পরিপূর্ণের জন্যে যে-কোনো মূল্যে অর্থ উপার্জনই জাহানারার একমাত্র লক্ষ্য, কারণ তার-

"মাথার উপরে কোনো সূর্য নেই, চন্দ্র নেই

ভূমি তলে কোনো বৃক্ষ নেই…’’

মহাকবি কালিদাস লিখেছিলেন--'অর্থো হি কন্যা পরকীয়া এব'; অর্থাৎ কন্যা মানে পরের সম্পদ। এই মনোভাব থেকেই কন্যা সন্তানকে অপরের সম্প্রদান করে ক্ষান্ত হন পিতামাতারা। যার ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক অগ্রগতি আজও চোরাবালি আচ্ছন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম 'নারী' কবিতায় বলেছেন, "বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর'। অথচ মেয়েদের সার্বিক উন্নয়নে সমন্বিত না করে তাদের অসূর্যস্পশ্যা রূপে রেখে তাদের অন্তর্নিহিত শক্তির অপচয় সাধন করা হয়। সে যতই দেশ-কাল-সময়ের বিবর্তন ঘটুক না কেন নারী যে কেবলমাত্র ভোগ্যবস্তু হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

"লিঙ্গ রাজনীতির চেনা ছকে সচেতনভাবে নারীত্বের যে অবয়ব গড়ে ওঠে সেখানে সে নিতান্তই 'মেয়েছেলে'। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় নির্মিত 'নারী' এবং তার বিভিন্ন প্রতিশব্দের বুৎপত্তিতে রয়েছে তার 'পরনির্ভরতা' তার লতার মত বেষ্টনশীলতা তার সেবাপরায়ণতা-এককথায় তার অসম্পূর্ণতা। শাস্ত্রীয় অবরোধ ও সামাজিকীরণের সিলমোহর সহযোগে ভারতীয় প্রেক্ষিতে পুরুষতন্ত্র আবহমানকাল থেকেই নারীর 'ভুবন' নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রসঙ্গত, সিমোন দ্য বোভেয়ারের বিখ্যাত মন্তব্য স্মরণযোগ্য-'কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, সমাজই তাকে নারী করে তোলে।' তাইতো সতীত্বের গৌরবে গরবিনী চিরকালীন নারীর 'আর্কেটাইপ' সীতার নিজের কোনো ঘর হয় না। মেয়েমাত্রই যেন চির উদ্বাস্তু, চির নির্বাসিত।”

পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চোখে "নারীই সব। নারীর মধ্যেই থাকে আদিম landscape। এবার নগ্ন-নারীর মধ্যেই থাকে আদিম বন্যতা। নগ্নতা একটা আর্ট। মনের গহন থেকে উঠে আসা অনেকগুলো চেতনার, অনেকগুলো জমে থাকা গ্লানির যোগফল হল নগ্নতা।  ‘পছন্দের ৬ নাটক’-এ এই চিন্তাধারাই প্রতিফলন দেখা যায় 'জাহানারা-জাহানারা' নাটকের জাহানারা এবং শামিমা চরিত্রের মধ্যে। "সোনারপুর স্টেশনের আগে রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা বহুদিনের বস্তির মধ্যে হাল আমলে তৈরি টালি দেওয়া সিমেন্টের ঘরে থাকা জাহানারা বা শ্যামারা অস্তমিত সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে জঠর পূর্তির সহ দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের দায়ে বেশ কিছু পারভার্ট মানুষের কামনার শিকার হয়। যার একমাত্র উপহার অসম্মান, চক্ষুলজ্জা। অথচ ওইসব নারীপিপাসুরাই সমাজের বুকে তাদের ধর্মবোধের জ্ঞানাস্ফালন করতে পিছপা হন না। কারণ সমাজে তারা উচ্চস্তরে আসীন এবং একটি নির্দিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণিভুক্ত। তাই তাদের আছে আত্মসমপর্ণের মাধ্যমে প্রাত্যহিক চাহিদা পূরণের জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয় জাহানারা র মতন মেয়েদের; হয়ে উঠতে হয় জুলি কিংবা শ্যামা। শামিমাকে তাই সিঁথিতে লম্বা করে আর কপালে গোল করে সিঁদুর পরে আইন মতে, শাস্ত্র মতে 'শ্যামায়' রূপান্তরিত হতে হয়। তার জবানীতে ব্যক্ত হয় সে ঘটনারই প্রতিধব্বনি, "কত বিদ্বান বুড়ো ধাম্মিক বামনঠাকুর আমায় ইয়ে সিনেমায় ঢোকে...হলে লাইট নিভলে প্রথমেই নাম শুধোয়... শামিমা বললে ওদের হাত, ওদের পৈতে বাঁধা বডি বাওয়ালি করতে" পারবে না, বরফ হয়ে পড়বে। নারীলোলুপ সমাজের প্রতি ব্যঙ্গ করে বলে সে বলে, "ঠাকুরের জাততো...হোলডে কত্ত দেবতাকে পুজো চড়িয়ে ওঁরা সিনেমায় আসেন...ওদের হাত হায়ে লাগলেই মনে হয় গায়ে পুণ্যি লাগছে।... পদ্দার সামনে আমার গায়ে ঠাকুরের পুন্যি ধূপ, চন্দন-বেলপাতার গন্ধ মাখা হাত দিয়ে গঙ্গাজলের মতন আমায় ধুয়ে দিচ্ছে।”

একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের উত্তাল অগ্রগতি ঘটলেও অপসৃত হয়নি গোত্রবাদ বা বর্ণমহিমা। "মুসলমানের খোদা তো নিরাকার, বিমূর্ত, শোনা যায় হিন্দুরও চূড়ান্ত ঈশ্বর নিরাকার; নিরাকার-নিরঞ্জন” আকাশলীনা সারা বিশ্ব এই সম্পর্কে অবগত হলেও তাদের সেই জ্ঞান পুথিগত বিদ্যার স্তূপে আবৃত। অধ্যাপক অমর্ত্য স্যানাল তার বাড়ির ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে একজন 'খাঁটি ব্রাহ্মণ'কে নিযুক্ত করার বিষয়টিকে আলাদা করে দেখতে নারাজ। বর্হিবিশ্বের কাছে 'সাম্প্রদায়িকতা আর কুসংস্কার' সম্বন্ধে তিনি বাংলার সেরা বাগ্মী, তার পরিবার অশিক্ষিত না হলেও ভীষণ প্রাচীনপন্থী। অতএব পরিবারের এহেন মতাদর্শ তার কাছে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অধ্যাপক স্যানালের তথা ধর্মান্ধ মানুষের নজর এড়িয়ে, "ক্যানিং-এর জাহানারা খাতুন...সারারাত্রি ধরে মাংস খুবলাতে দেওয়া শরীরটাকে এই সালোয়ার, এই কামিজ, এই মাঞ্জামারা পোশাক, এই চাম্পু চশমায় সাজিয়ে বালিগঞ্জ স্টেশনের লেডিজ টয়লেটে ঢুকবে। শাড়ি পরবে, শাঁখা-সিঁদুর পরবে...সারাদিনের মতো জাহানারা হাত, পা, বডি, মাথা বন্ধক দিয়ে জুঁই ব্যানার্জী হয়ে বালিগঞ্জের সান্যাল বাড়িতে ল্যান্ড করবে। ৭৫ বছরের ধম্ম খুঁতখুঁতানি এক গস্তানিরের খিদমত খাটবে... ঠাকুরের ঘরের পুজোর বাসন মাজবে... শাঁখ বাজাবে, উলু দেবে... তারপর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরবে জাহানারা আবার জুলি...।"

“যত্র নাৰ্য্য–পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবত : বা ‘নারী তু নারায়ণী’ শাস্ত্রে এমনতর আমাদের দেশে সে যুগেও ছিল--- এ সময়েও দুর্লভ নয়। কিন্তু প্রকৃত সত্যটা কি তা আমরা সকলেই জানি। অনিবার্যভাবে বিবাহ নামক সামাজিক ব্যবস্থাপনায় কথা আসে। বিবাহের সবকটি মন্ত্রেই উচ্চারণ করে বলা হয় স্ত্রী যেন চিন্তায় ও কাজে স্বামীর অনুবর্তিনী হয়, স্বামীর চিত্তের অনুগামিনী হয়। কোথাও বলা নেই, স্ত্রীরও চিত্ত বলে একটা কিছু আছে এবং স্বামীকে তার প্রতি অনুকূল হতে হবে। মধ্যে মধ্যে শোনা যায়,সুন্দরী বধূ স্বামীর প্রেম লাভ করে—(শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩/১/৯৬)। এতে বধূকে দেহমাত্র সার করে দেখা হয় এবং তার যে অন্য কোনো আকর্ষণ থাকতে পারে সেকথা শাস্ত্রে কোথাও স্বীকৃতি পায়নি।”

সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বসবাসকারী আপডেটেড আধুনিক সমাজ অসমধর্ম তো বটেই সমধর্মের মধ্যেও আতসকাচ নিয়ে বর্ণভেদ অন্বেষণে অগ্রণী। লালন ফকির যতই বলুন না কেন নারীর মধ্যেই রয়েছে মানুষের সম্পূর্ণতা, নারীর কোনো জাত নেই। কিন্তু "বেদ ও ধর্মাচারে শূদ্র ও নারীর অধিকার নেই। বিয়ে হলে নারীর গোত্র ও ধর্মবদল হয়। পুরুষের হয় না। নারীর মুসলমানি হয় না, পৈতে হয় না। উচ্চবর্ণে বিয়ে হলে নারী উচ্চবর্ণ লাভ করে।”আকাশলীনা উচ্চশিক্ষিত সমাজ যে এই বিষয়ে অতিরিক্ত অবগত তার জ্বলন্ত উদাহরণ অমর্ত্য সেনের স্ত্রী নীপা শীলের প্রতি সান্যাল বাড়ির অবহেলিত, অমানবিক আচরণ। আসলে নাপিত বংশীয় সহপাঠিনীর সঙ্গে প্রেম করলেও তাঁকে বিয়ে করাটা ‘সান্যাল বাড়ির’ পক্ষে অসম্মানজনক, তাই বিয়ের পরে পুত্রবধূকে শাস্ত্রমতে তাঁকে ‘শুদ্ধ’ প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে নিয়েও ক্ষান্ত হননি প্রভাতরঞ্জন সান্যাল। বাড়ির একজন ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্রাহ্মণ হওয়ার দরুণ যেটুকু অধিকার পায়, যেটুকু সম্মান পায় তার সিকিভাগও নীপাদেবীর প্রাপ্য নয়। প্রভাতবাবুতাই বলেন, “অমাবস্যা লেগে গেছে। এই সময় সিঁড়ি স্পর্শ করা কি ঠিক হল বউমা?”। অথচ প্রফেসর সেনের কাছে এটি অন্যান্য বিষয়ের মতনই সাধারণ একটি বিষয়। কারণ পাঁচ বছর আগে প্রভাতবাবুই ‘initial hesitation’-এর পরেও অমর্ত্য ও নীপার বিয়েটা মেনে নিয়েছিলেন।

তাই প্রভাতবাবুর এহেন সংস্কারের সঙ্গে আপোষই তাদের একমাত্র কর্তব্য বিষয়। কিন্তু শুধুমাত্র এখানেই সমাপ্তি পায় না কুসংস্কারের ঘেরাটোপ। তার রক্তচক্ষু ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে নীপা দেবীর ব্যক্তি-স্বাধীনতাকেও। প্রফেসর সেনের উক্তিতে সুস্পষ্ট হয় বিষয়টি, “সান্যাল বাড়ির একটা ঐতিহ্য আছে, আমার বাবা প্রভাতরঞ্জন সান্যাল এখনও জীবিত। তিনি বলেন, বাড়ির বউরা কখনও বাইরের কারোর কাছে আবেদন করে না। তোমার যা টাকা লাগবে মাসে মাসে তা তুমি নিয়ে যাও কিন্তু। প্লিজ, সান্যাল বাড়ির বউ হয়ে...।” “আসলে, প্রাচীন-মধ্যযুগীয় নারী কেন্দ্রিক ধর্ম-মনুবাদী পৈছিক ফতোয়ার সম্প্রসারণ হিসেবেই যেন উনিশ শতকীয় নব্য নীতিবাগীশতা গড়ে উঠলো। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও খ্রিস্টীয় ভিক্টোরিয় মতাদর্শ নির্মিত নব্য নৈতিকতা নতুনভাবে মেয়েদের স্বভূমি নির্মাণে বিধিনিষেধ আরোপ করে। পাশ্চাত্য শিক্ষা একাধারে সেদিন বদ্ধ সমাজের অন্দরের দরজা খোলার প্রক্রিয়া যেমন শুরু করেছিল; তেমনই পোশাকবিধি, শ্লীলতা, শুচিবাই ইত্যাদি নব্য আইডিয়া দিয়ে মহিলাদের মানবিক ও শারীরিক চাহিদাগুলি নিয়ন্ত্রণ করা হতে থাকে। ভদ্রলোক বাঙালির ‘গৃহলক্ষ্মী’ আর ভিক্টোরিয়া ‘অ্যাঞ্জেল ইন দ্য হাউস’ মিলেমিশে একাকার হতে চায়। এরই ফলশ্রুতিতে ঔপনিবেশিক বাতাবরণে বাঙালি ভদ্রলোকেরা অন্দরমহলের সহজ চলাফেরাগুলি অবরুদ্ধ করতে থাকেন।” একদিকে পিতৃতান্ত্রিক স্টিরিওটাইপ রমণী নির্মাণের প্রক্রিয়ায় স্ত্রী শিক্ষাকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে নস্যাৎ করার প্রবণতা যেমন ছিল ঠিক তেমনিভাবেই নারীদের জন্য নারী সম্পাদিত পত্রিকাগুলিতেও পিতৃতন্ত্র নির্ধারিত নৈতিক চিত্রায়ণ স্পষ্ট রূপে দেখা গিয়েছিল। সময়-কাল-যুগ পটভূমি অতিক্রম করে যার সুচিহ্নিত রেখা আজও সমাজে বিদ্যমান।

“ওই দেখ বেশ্যা যায়

বেশ্যার শরীর অবিকল মানুষের মতো,

মানুষের মতো চোখ, ঠোঁট,

মানুষের মতো হাত, হাতের আঙুল,

মানুষের মতো তার হাঁটা, পোশাক-আশাক

মানুষের মতো হাসে, কাঁদে, কথা বলে—

তবুও মানুষ না বলে তাকে বেশ্যা বলা হয়।

বেশ্যারা সকলে নারী, কখনো পুরুষ নয়!!”

পাঠককে প্রশ্নে আবারও ভাবিয়ে তোলে জাহানারা খাতুন ওরফে ইসলামপুর বস্তির জুলির কর্মজীবন। সমাজের কিছু হিংস্র জানোয়ারের জৈবিক প্রবৃত্তি মেটানোর জন্য এবং অন্নসংস্থানের জন্য বাধ্য হয়ে কিছু নারীকে বেছে নিতে হয় বেশ্যাবৃত্তিকে। কিন্তু তারাও যে অন্যান্য মানুষের মতই রক্ত-মাংসের জীব এই ধারণা সমাজ ভুলে যায়। কারণ “গোটা দুনিয়া শুধু শরীর চায়। নারী শরীরেরমাংস চায়।” শাপেমাচন তাকে রক্ষা করার ক্ষমতা সমাজের নেই, সে কেবল নারী মনের বলপরীক্ষা করতে সচেষ্ট। “ঋগবেদের যুগে অবশ্য নারীর অবস্থান কিছুটা উন্নত ছিল। লোপামুদ্রা, অপালা, মৈত্রেয়ী, যমী, বসুন্ধের পত্নী, সূর্যা, উর্বশী, পৌলমীদের কথা মনে পড়বে। পারিবারিক কাঠামোয় কর্তৃত্ব সে পূর্বে পুরুষের হাতে থাকলেও নারীরাই ছিল একান্তবর্তী পরিবারের অভ্যন্তরীণ কর্ত্রী। কিন্তু, উত্তর পর্বে ব্যবস্থাটির পরিবর্তন ঘটে। কৌম সমাজ ভেঙে গিয়ে গোষ্ঠীগুলি পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হয়ে গেল। এবং এই সময় থেকেই সমাজে নারীয়া অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুষের ওপর একান্ত নির্ভরশীল হতে শুরু করলো। স্বভাবতই নারীর সামাজিক অবমূল্যায়ন পর্বেরও সূত্রপাত ঘটেছে। বস্তুত, যাযাবর সমাজ কৃষিজীবী স্থিতিশীল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পারিবারিক সম্পদের সুরক্ষার জন্য পুত্র সন্তানের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে।

পুরুষ প্রধান সামন্ততান্ত্রিক সমাজে নারীরা শ্রমিক অবনমন তাই অনিবার্য হয়ে ওঠে। শতপথ ব্রাহ্মণের দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখানো যায়—সেখানে নিজের শরীর বা উত্তরাধিকারে মেয়েদের কোনো অধিকার নেই। যাঙ্কমল্ক্য (বৃহদারণ্যক উপনিষদ) তো নারীকে দমন ও উপভোগ করার নানাবিধ উপায়ের কথা বলেছেন। রামায়ণ-মহাভারতেও নারীর অসম্মানের দৃষ্টান্ত কম নেই। পাশা খেলায় দ্রৌপদীকে পণরূপে উপস্থাপনা কিংবা সীতার প্রতি রামচন্দ্রের উচ্চারণ--- ‘নৈউৎসহ পরিভোগায়’...অর্থাৎ, নারী হল পুরুষের ভোগ্যা।...আসলে প্রাগাধুনিক পর্বে আমাদের সমাজ মেয়েদের তো কেবলমাত্র পুরুষের ‘বিনোদিনী’ এবং ‘রমণী’ রূপে দেখেছে। ‘লক্ষীমন্ত মেয়ে’ কিংবা ক্রীড়ানন্দের সেই সামাজিক নির্মাণের হাত ধরেই তাই একুশ শতকেও ‘সুন্দরী’, সুকেশী, রুচিশীলা গৃহকর্মে নিপুণা মেয়েদের চাহিদাই সর্বাধিক। স্বাধিকারপ্রমত্ত মেয়েরা তাই এখনও ‘দজ্জাল’ এবং ‘নারীবাদী’ নঞর্থকতায় অভিহিত(?) হয়।”

কিন্তু যেসব মেয়েদের পরিচয়টাই অস্তিত্বের সংকটাধীন, সমাজ যাদের ‘ধর্ম’-এর রাঙতা দিয়ে আবৃত করে বাধ্য করেছে অন্ধকারের পথ নির্বাচন করতে, তাদের ক্ষেত্রে সমীকরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। সময়ের স্রোতে তাদের জীবনে শ্যাওলার মত বাসা বাঁধে সুযোগ-সন্ধানীরা। নিত্যনৈমিত্তিক চাহিদাসহ জীবধারণের জন্য সেই ভার বহন করে তারা এগিয়ে চলে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, আত্মবলিদান দিয়ে সামিল হয় আত্মজার স্বপ্নপূরণ কিংবা পারিবারিক চাহিদা নিবারণের পটভূমি রচনায়। নাটকে জাহানারা ওরফে জুঁই ব্যানার্জীর জীবন-সোপানের আরেকপ্রান্তে রয়েছে ইচ্ছেমৃত্যু বা মার্সি কিলিং-এর পরোক্ষে থাকা জুলির যন্ত্রণা-দগ্ধ জীবনকথা। এ যেন একই মুদ্রার দুই পিঠের গল্প। জাহানারার বাবা কান্তি মজুমদার আসলে কাশেম আলি মজুমদার। তার মা এটা জেনেই বিয়ে করে, “কিন্তু পরে জেনেছিল, কাসেমের যত গুণ পকেটে ততটা ঝুল নেই। রেগে কম, ব্যাস মুখার্জী বাড়ির মেয়ে ভুল শুধরাতে সময় নিল না। মুশিকল হল মেয়েটার। তার বাবা ঘৃণায় অপমানে আত্মহত্যা করল। মেয়েটা মাকে ছেড়ে চলে এল, প্রিয় বাবার অপমানের শোধ নিতে। ইচ্ছে করেই অনির্দিষ্টের জীবন ঝাঁপ দিল।”জাহানারা জীবন সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে জাহানারা এমন এক কূলে আশ্রয় নিল, “যে তার পেট করে দিয়ে নিজের পেট সামলাতে কোথায় চম্পট দিল। মেয়েটা এখন একাই বদলা নিচ্ছে।” এতৎসত্ত্বেও বস্তির ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরে যেখানে কিনা সূর্যের আলোর প্রবেশ বিধিবদ্ধ, সেখানে বসে জুলির ভিতরে থাকা মা জাহানারা স্বপ্ন দেখে মেয়ে বিনীতাকে নিয়ে। সমাজের বেড়াজালে তার জীবনটা নিঃশেষিত হলেও সে চায় বিনীতার প্রাতিষ্ঠানিক তথা সমাজসিদ্ধ স্বীকৃতিকে। সিনেমা গল্প- উদ্ভাসের ডকুমেন্টারী শুভঙ্করের জবানীতে, “বিনির স্কুলের খুব নামী...খরচা খুব বেশি...তুই কারোর সাহায্য নিবিনা এই ধনুকভাঙা পণ করেছিস...জানোয়ারেদের ঘরে ঢুকিয়ে শরীরটাকে খাবলাতে দিচ্ছিস।” সেইজন্যই জাহানারা বেছে নেয় এই ইচ্ছেমৃত্যুর পথকে, “ সারারাত্রি নেড়ে গেঁড়ের মধ্যে একডজন হাফ শুঁড়ো মাতাল তার বডি খাবলাবে...সেই টাকা শুদ্ধ হয়ে বিনির সরস্বতী পুজোয় লাগবে...।”জাহানারাজৈবিকভাবে তাদের মধ্যে  নাড়ীর টান থাকলে বাস্তবের দর্পণে “.জাহানারা খাতুন...আর ওই ১২ বছরের মেয়েটা বিনি-বিনি...বিনীতা মজুমদার ” দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর দুইজন। ‘জাহানারা-জাহানারা’ নামকরণে নাট্যকার যেন দুই সত্তার মুখোমুখি সাক্ষাৎ ঘটিয়েছেন।

“আধুনিক নারীবাদী দৃষ্টিকোণ নির্মিত হওয়ার বহু পূর্ব থেকেই বঙ্গীয় সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিতে নারীর নিজস্ব কণ্ঠস্বর এসেছে। সমাজ-শাস্ত্র লাঞ্ছিত মেয়েরা কখনো সরাসরি অথবা বক্রভঙ্গিতে তাদের দ্বিতীয় ভুবন গড়ে নেন। চর্যার বহুড়ীর বিধর্মী পদচারণা, রাধার প্রতিদ্বন্দিতা, মঙ্গলকাব্যের নারীদের পতিনিষ্ঠা মনে পড়ে।...মেয়েলি গান, কথকতা, প্রবাদ, ছড়া, হেঁয়ালির জগত একসময় মেয়েদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর নির্মাণের মাধ্যম ছিল। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় এগুলির মাধ্যমে নারীরা নিজেদের অবরুদ্ধ কামনা, যৌন প্রত্যাশা তথা চাহিদা ব্যক্ত করত। অশ্লীতার দোহাই দিয়ে উনিশ শতকের শিষ্ট সুশীল সমাজ পুরুষতন্ত্রের লিঙ্গ নির্মাণ প্রণালীর নিয়ম মেনে মেয়েদের সেই স্বাধীন ক্ষেত্র থেকে উৎখাত করল। একইসঙ্গে তাদের নিজস্বমানসিকতা ও শারীরিক স্বীকৃতিহীন ব্যবস্থাপনা মেনে নিতেও বাধ্য করা হয়। একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত সমাজে উত্তরাধিকার সূত্রে সেই চিন্তাধারার প্রবাহই বর্তমান। আজও একজন সন্তানের সামাজিক স্বীকৃতির জন্য তার পিতৃপরিচয় থাকা বাধ্যতামূলক। সামাজিক নিয়মের এই বেড়াজালে একজন মা কে বিসর্জন দিতে হয় তার মাতৃসত্তা কে। জৈবিকভাবে বিনি এবং জাহানারার মধ্যে নাড়ীর টান থাকলে বাস্তবের দর্পণে “জাহানারা খাতুন... আর ওই ১২ বছরের মেয়েটা বিনি-বিনি...বিনীতা মজুমদার” দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর দুইজন। কিন্তু এখানেই থেমে থাকে না স্রোতের বিপরীতে হেঁটে চলা জাহানারাদের লড়াই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তাদের জীবন খাতায় লিখিত হতে থাকে মার্সি কিলিং-এর পাশে দাঁড়ানো এক যন্ত্রণা দগ্ধ-কথাও।

নবজাগরণের আলোকপ্রাপ্ত সমাজ আজও জাতপাত-বর্ণভেদের অন্ধকূপে নিমজ্জিত। ফলস্বরূপ জাহানারাদের নিত্যনৈমিত্তিক চাহিদা পূরণের জন্য পরিচয় বদলের আশ্রয় নিতে হয়। কেবলমাত্র প্রান্তিক শ্রেণির মহিলারাই নন, সমাজের উপরিভাগে থাকা নারীরাও এহেন পরিস্থিতির শিকার। তাই নীপা দেবীর মত নারীদের প্রতি মুহূর্তে সামাজিক বঞ্চনার শিকার হতে হয়। নারী মাত্রই যেন পুরুষের পদতলে লুণ্ঠিত থাকা এক জড়বস্তুযে নিজের অধিকারে নয়, অন্যের দাসত্বে, অন্যের ইচ্চাধীন হয়ে কালযাপন করে চলাই কি তাদের জীবনের মূলমন্ত্র? পাঠক কে এই প্রশ্নে আর একবার ভাবিত করে চন্দন সেনের ‘জাহানারা-জাহানারা’ নাটকের কাহিনি। যেখানে একাধারে বর্তমান সমাজে প্রেক্ষিতে জায়মান পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, সামাজিক বৈষম্য তথা জাতপাতের বেড়াজাল এবং প্রতিটি চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এছাড়াও সামাজিক বিধি-নিষেধের বিপরীতে হেঁটে চলা নারীদের সংগ্রামের কথাও নাট্যকার তুলে ধরেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন নাটকের মধ্য দিয়ে লোকশিক্ষা হয়। শ্রী চন্দন সেন তাঁর নাটকে অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই বিচরণ করেন, উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে প্রান্তিক শ্রেণি সকলেই তাঁর নাটকে পরিষ্কার চেহারা পায়। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক আনুগত্য ছাড়াই শ্রেণি-সংগ্রাম চরিত রচনায় চন্দন সেনের কলম বহমান। সেজন্যই তাঁর নাটকে জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত নানা শ্লোগানের ভাষ্যরূপ প্রতিফলিত হয়। নাট্যকারের নতুন ধরনের লেখনী পাঠককে শুধু ভাবিয়ে তোলে না, চিন্তার অতলান্ত গভীরতায় পৌঁছে দেয়। সময় উপযোগী বিষয়ের সঙ্গে চন্দন সেনের শৈলী পরিবর্তনের এই প্রবাহমানতা একুশ শতকের মোহনায় এসে মিলিত হয়।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন