কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

মধুবন চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


দানবিক

 

রাত বারোটা হয়ে গেল, অমৃতাংশু এখনও বাড়ি ফিরল না। বুবাই আর মামনি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। কাল সোমবার। সকালে বুবাইয়ের স্কুল। পরীক্ষার প্রিপারেশন মোটামুটি ভালই হয়েছে। ক্লাস সিক্সের ফাইনাল। বুবাইকে নিয়ে অপর্ণার টেনশনের শেষ নেই। সারাদিন খেলা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকে। পড়তে বসতে চায় না। সব টিচারদের অভিযোগ অরিত্র একেবারেই মনোযোগী নয়। হাফইয়ারলিতে অঙ্কে  একেবারে ডাহা ফেল। সংসারে সবটা সামলে অরিত্রকে নিয়ে তাই ভাবতেই হয়। অমৃতাংশুর সময় নেই। সকালে বেরিয়ে যায়, রাতে আসে। 'নাইটলান্ড' নার্সিংহোমের এখন ডেপুটি ডিরেক্টর। দায়িত্ত্ব অনেক বেশী। বাড়িতে আসা যাওয়ার কোন ঠিক নেই। কখনোও সকালে বের হলো তো ফিরতে ফিরতে অনেক রাত্রি। আবার কোনওদিন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকলে জানিয়ে দেয় দেরি হবে। আবার কখনো মর্গ পরিদর্শন করতেও নাকি যেতে হয়!

আজ প্রায় রাত্রি বারোটা বেজে গেল। অমৃতাংশুর কোনও ফোন নেই। ফোন করলেও বলছে সুইচড অফ। অপর্ণা কিছুই বুঝতে পারছে না, এমনকি হসপিটালেও ফোন করছে রিং হয়ে যাচ্ছে। অমৃতাংশুর আন্ডারে যেসব জুনিয়র ডাক্তাররা আছেন তাদের একজনকে চেনে অপর্ণা। শঙ্খ সেন। ফোনে সেভ করা ছিল ভাগ্যিস। মনে পড়তেই শঙ্খকে ফোন করল অপর্ণা।

হ্যালো...

আমি বৌদি বলছি। মানে আমৃতাংশুদার স্ত্রী।

হ্যাঁ বৌদি বলুন। এত রাতে?

আসলে অমৃতাংশু তো এখনও বাড়ি ফেরেনি... খুব চিন্তা হচ্ছে। তোমাকে কিছু বলেছে?

না বৌদি। সকালবেলা দেখা হয়েছিল, কথা হল, আমরা মিটিং করলাম... তারপর উনি বললেন উনার একটা জরুরী কাজে উনি বেরিয়ে যাবেন।

সেটা কোথায় তুমি কি জানো?

আমি ঠিক জানি না, তবে কেষ্টপুরের কাছাকাছি কোনও একটা নার্সিংহোম বা হসপিটালে উনার যাওয়ার কথা আছে।

সেই সকালে কথা হলো, তারপর আর যোগাযোগ হয়নি। আমিও ব্যস্ত ছিলাম সংসার নিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। ফোন করতে পারিনি। এত রাত্রি হচ্ছে দেখে এবার খুবই চিন্তা হচ্ছে। ফোন বলছে সুইচড অফ। কী করি বলো তো?

বৌদি, কাছাকাছি কোনো থানায় একবার জানিয়ে রাখুন।

এত রাতে থানায় যাওয়া! দেখছি কী করা যায়! ধন্যবাদ তোমাকে। কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব আছে যাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে প্রেসক্লাবে চলে যায়, তাদেরকে ফোন করবে কিনা বুঝতেও পারছি না।

কারোর বাড়িতে চলে যায়নি তো?

তাহলে তো একবার জানাতো। অনেক সময় হসপিটাল থেকে বেরিয়ে রিলাক্সেশনের জন্য বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে চলে যায়। কিংবা কফি হাউজে বসে আড্ডা দেয়। তবে এখন তো আর আড্ডা দেওয়ার মত সময় নয়। কফি হাউসও খোলা থাকবে না। নিশ্চয়ই কিছু অসুবিধায় পড়েছে।

কী করবে অপর্ণা! সাতপাঁচ ভেবেই চলেছে। রাত একটা। মামনি অনেকক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। অপর্ণার শরীরটাও আর দিচ্ছে না। ক্লান্ত শরীরে বুবাইয়ের পাশে শুয়ে পড়লো অপর্ণা। অপেক্ষার প্রহর গোনা শেষ হল না। হতে মোবাইলটা নিয়ে চোখ দুটো ক্লান্তিতে চিন্তায় বুঝে এলো অপর্ণার। আচমকা দরজার ধাক্কার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তড়িঘড়ি দরজার কাছে গিয়ে বলল-

কে? কে? অমৃতাংশূ?

একটা অস্ফুট গোঙানির শব্দ যেন।

সেইসঙ্গে শুনতে পেল ক্ষীণ গলায় কী যেন বলছে অমৃতাংশু।

দরজাটা খোলো!

তড়িঘড়ি দরজাটা খুলে দিয়ে তাকিয়ে দেখলো, অমৃতা়ংশু দাঁড়িয়ে। মাথাটা নীচু। হাত দুটো যেন নেতিয়ে আছে। ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে ঢুকে বেডরুমের বিছানায় এলিয়ে দিল শরীরটা। চোখমুখের একিই চেহারা হয়েছে ওর? সারা মুখ ভর্তি আঁচড়ের দাগ। গলাতেও। কাছে যেতেই চোখ পাকিয়ে বলল-

সরে যাও!

কিছু বোঝার আগেই বেডরুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

ধীরে ধীরে বুবাইদের ঘরে চলে এল অপর্ণা। ঘরের আলোগুলো নিভিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে শুয়ে পড়ল ওদের পাশে।

এরকম হয়নি কখনোও আগে। কেউ কি মেরেছে ওকে? কোনোও গন্ডগোল হয়নি তো অফিসে? এমনিতে বরাবরই রগচটা অমৃতাংশু। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সময় মাথার ঠিক থাকে না।

একবার বুবাই অঙ্কে ফেল করল। কী সমস্যা হচ্ছে না বুঝেই, সপাটে এক চড়। খাওয়া বন্ধ করে দিল বুবাই। এমনকি কথাও। ছেলে যে বড় হয়েছে, সে কথাও খেয়াল থাকে না ওর। অপর্ণা বোঝার চেষ্টা করে অন্য কোথাও কোন সমস্যার মধ্যে ফেঁসে আছে কি অমৃতাংশু? ঠিক বুঝতে পারে না। আসলে ওদের সম্পর্কটা এখন শুধুমাত্র প্রয়োজনের থেকে বেশি কিছু নয়। অমৃতাংশুর সেই সময় কোথায় অপর্ণাকে দেওয়ার মতো?

বিয়ের চোদ্দবছর পরে শুধুই ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। সময় নেই একে অপরকে খোঁজার বা একটু হাতে হাত রেখে দুটো কথা বলার। সংসার সামলানোর পর, নিজের জন্য যতোটুকু সময় থাকে সেই অবসরে বই পড়া সেলাই করা, আর ওয়েব সিরিজ দেখা অপর্ণার অভ্যস্ত জীবনের একফালি সুখ যেন। অবশ্য এসবের মধ্যেই মায়ের সঙ্গে কথা বলতে একদিনও ভুলে যায় না অপর্ণা।

খুব দরকার ছাড়া অমৃতাংশুর সঙ্গে খুব কথা হয় না অপর্ণার। যদিও এরকমটা হয়নি কোনদিন। এত রাতে বাড়ি ফেরা, নিজের ঘরে চলে যাওয়া কথা না বলে। অপর্ণাকে খুব ব্যাকুল করে তুলেছে। এখন কিছু করার  নেই আপাতত ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া। সকালে জিজ্ঞাসা করতে হবে কী হয়েছে।

রাত তিনটে সোয়া তিনটে হবে। অদ্ভুত একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় অপর্ণার। শব্দটা ঠিক গোঙানির নয়, দরজা ধাক্কানোরও নয়, খাবার চিবোনোর সময় যে আওয়াজটা হয়, সেরকম একটা আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। চোখটা খুলেই রান্নাঘরের দিকে দৃষ্টি পড়ে অপর্ণার। রান্নাঘরের দরজাটা খোলা! কী করে হয়? ও তো ভেজিয়ে দিয়েছিল! তাহলে খুলল কে? নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল দু’ফোঁটা রক্ত। আওয়াজটা এবার রান্নাঘর থেকে ক্রমশ অপর্ণার ঘরের দিক থেকে আসতে শুরু করল। অপর্ণা তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ড্রেসিং টেবিলের ঠিক পাশেই আলনা, তার পাশে বড় একটা আলমারি। পূব দিকে জানলাটা বন্ধই আছে। পশ্চিম দিকে আরেকটা বাথরুম। বাথরুমের দরজাটা বন্ধ। তাহলে আসছে কোথা থেকে আওয়াজটা?

কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে বিছানার উপরে বসে থাকল অপর্ণা। পাশে তাকিয়ে দেখল, বুবাই মামনি অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

আওয়াজটা কি শুধুই আমি শুনতে পাচ্ছি? ওরা কি পাচ্ছে না? ওদের ঘুম ভাঙছে না কেন? অমৃতাংশুর ঘরে গিয়ে দেখব? ডাকবে ওকে? ভাবতে ভাবতেই ওর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল অপর্ণা।

অবাককান্ড!  দরজা তো খোলা! বিছানায় অমৃতাংশু তো নেই? তাহলে? কোথায় গেল? আবার নিজের ঘরের দিকে দৌড়ে গেলো অপর্ণা। এবার ভয় লাগতে শুরু করেছে অপর্ণার। সাধারণ ভয় নয়। একটা অস্বস্তি। শব্দটা যেন ক্রমশ ওপর থেকে আসছে মনে হল। এবার বিছানার সামনে দেয়ালের দিকে তাকলো অপর্ণা। আলোআঁধারিতে প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলো না। মস্ত বড় কালো মত কী যেন একটা বসে আছে।  আর সেখান থেকেই চিবনোর আওয়াজটা যেন আসছে।

একী! কী দেখছে অপর্ণা? অমৃতাংশুর গোটা শরীরটা দেওয়ালের একটা অংশ জুড়ে। দুটো পা বেঁকে পেছনের দিকে আটকে আছে। আর অমৃতাংশু হাত দিয়ে কী করছে যেন! অন্ধকারে ওর চেহারাটা বীভৎস  লাগছে। চোখ দুটো যেন ঘোলাটে লাল। সারা শরীর জুড়ে কীরকম লোম গজিয়ে উঠেছে। এ কাকে দেখছে অপর্ণা? কী নৃশংস! চিবিয়ে চিবিয়ে কী যেন খাচ্ছে। এ তো আস্ত একটা হাত! কার হাত? সেখান থেকে  রক্ত ঝরে ঝরে পড়ছে!

'মা গো!’ বলে চিৎকার করে উল্টো দিকে পালানোর চেষ্টা করল অপর্ণা। শুনতে পেল আওয়াজটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। পাশ থেকে হঠাৎ বুবাইয়ের আর্তনাদ-

মা আমাকে ছেড়ে যেও না মা! কোথায় যাচ্ছ এদিকে এসো!

অপর্ণা দেখল, বুবাইয়ের একটা হাত কাটা। যন্ত্রণায় চিৎকার করছে বুবাই। আর একটা হাত চেপে ধরেছে অমৃতাংশু। ওকে ধরে নিয়ে ওপরে ছাদের দিকে উঠে যাচ্ছে। দৌড়ে মামনিকে জড়িয়ে ধরল অপর্ণা।

একি! কাকে জড়িয়ে ধরেছে অপর্ণা?

মামনির শরীরে তো কোনোও মাংস নেই! শুধু হাড়!

সকাল সাতটা। রোজকার মতো আজও পেপার দিতে এসেছে জগা। তিনটে মৃতদেহ সাদা চাদরে ঢেকে নিচে শববাহী গাড়িতে তোলা হচ্ছে। পুলিশ সবার সঙ্গে কথা বলছে। বিল্ডিংয়ের লোকজনের চোখে মুখে বিস্ময়। কেউ বুঝতে পারছেন না কী হয়েছে। জগা জিজ্ঞাসা করতে পুলিশ বলল তদন্ত করা হবে। পারিবারিক শত্রুতা হতে পারে। অথবা অন্য কোনোও কারণ। এতটাই শত্রুতা যে বীভৎসভাবে খুন করা হয়েছে। মাংস খুবলে নেওয়া হয়েছে। কিছু বোঝার আগেই ডেডবডি নিয়ে পুলিশ চলে গেল।

সকল নটার নিউজ। জগা দমদম পার্কের নতুনপল্লীর সাত নম্বর পাড়ায় কাগজ দিতে গিয়ে শুনেছে, টেলিভিশনের নিউজ শুরু হয়েছে-

সকল নটার' চ্যানেল ইলেভেন নিউজে' আপনাদের স্বাগত। প্রথমেই হেডলাইন স্টোরি। গতকাল রাত বারোটাটা নাগাদ কেষ্টপুর খাল থেকে উদ্ধার হলো পচা গলা মৃতদেহ। দেহের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতের চিহ্ন। সারা শরীরে বড় বড় গর্ত আর রক্তের দাগ। এত বীভৎসভাবে কে বা কারা খুন করেছে, সে বিষয়ে তদন্ত  শুরু করেছে পুলিশ। পুলিশ সূত্রের খবর, মৃত ব্যক্তির নাম অমৃতাংশু সরকার। রাত এগারোটার সময় হাসপাতালের মর্গে থাকাকালীন তাঁর মৃত্যু হয়।

সারাদিনের কাজের পর সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে এসে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিল জগা। আচমকা একটা থাবা গলার কাছে নখ ঢুকিয়ে গোটা শরীরটা তুলে নিয়ে একেবারে ছাদে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘর। দূর থেকে ভেসে আসছে কীর্তনের বোল। কাল যে জন্মাষ্টমী!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন