কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৪১

নিঃশুল্ক চক্ষু প্রতিস্থাপন

 

চোখদুটো গ্যাছে। ভালো দেখতে পাই না। দুটোকেই বদলাতে হবে।

চোখ সারানোর দোকানে গেলাম। দোকানের আই-স্পেশালিষ্ট লোকটা হেসে বললো, 'আপনাকে চোখ দেয়া যাবে না। স্টকে নেই।'

আমি আঙ্গুল দিয়ে দোকানের সেলফে রাখা কয়েকটা কাঁচেরপাত্র দেখিয়ে বললাম, 'ওই তো দেখছি, কাঁচের জারে নীলজলে ডোবানো কয়েকটা চোখ, ওগুলো কি দেয়া যাবে না?'

আই-স্পেশালিষ্ট দোকানদারটি বললো, 'নীল সলিউশনে ডোবানো? ওগুলো নিরপেক্ষ চোখ। আপাতত ওগুলো বিক্রি করার অনুমতি নেই।'

কী আজীব ব্যাপার! আমার চোখদুটো বদল করা গেলো না।

পরের দিন গোকুলবাবু আমার ঘরে এলেন। সব শুনে বললেন - এ তো সহজকথা। রেলের মাঠের কাছে নিঃশুল্ক চোখ সারানোর ক্যাম্প বসেছে। ওরা বিনা পয়সাতে চোখের অপারেশন করিয়ে দিচ্ছে।

গেলাম। তাই তো! বিশাল ক্যাম্প। ক্যাম্পের বাইরে পার্টির পতাকা। একজন এজেন্ট আমাকে ধরে নিয়ে গেলো চক্ষুঘরে। দেখলাম, অসংখ্য কাঁচেরপাত্র। তাতে হলুদ সলিউশনে ডোবানো অসংখ্য চোখ।

এজেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এগুলো কি নিরপেক্ষ চোখ?’ কয়েকদিন আগের সেই নীল-চোখের দোকান উপলব্ধ আমার অভিজ্ঞতা! এই জ্ঞানটুকু লোকটার সঙ্গে শেয়ার করলাম।

এজেন্ট বললো – এ-জামানায় নিরপেক্ষ চোখ অবসোলেট! নীল কেমিক্যালে ডোবানো চোখগুলো সেকেলে!  অচল! ওতে আজকাল কাজ চলে না! এখানে সেই চোখই পাবেন, যা আজকাল মার্কেটে চলছে, হলুদ রসায়নে ডোবানো চোখ। ঐ যে হলুদ কেমিক্যাল দেখছেন, ওতে চোখটাকে ডুবিয়ে রাখলে আপনার দেশভক্তি,  ধর্মসত্ত্বা সবকিছুই বজায় থাকবে। এজন্যেই পার্টি থেকে নিঃখরচায় আমরা জনগণের চোখ বদল করিয়ে দিচ্ছি। আজকেই দুটো চোখ বদলে নিন!

আমি একটু ইতস্তত করছি। এজেন্টটা নিঃশুল্ক চোখ বদলে দেয়ার জন্যে তাড়া দিচ্ছে, - ‘আপনি কী ভাবছেন, নীলচোখ? ওসব জামানা চলে গেছে।’

অগত্যা অন্য কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না। রাজী হয়ে গেলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এই চক্ষু প্রতিস্থাপন ক্যাম্পে একটা যন্ত্র-লাগা টেবিলে আমাকে শুইয়ে দেয়া হলো। একজন চিকিৎসককর্মী কিছু দেখলো, চেক-আপ করলো। তারপর উন্নত টেকনোলজিতে দশ-মিনিটের মধ্যেই আমার চোখদুটোকে বদলে দিলো।

এজেন্টের সাথে চক্ষু-শিবিরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমি চারপাশের সবকিছুই খুব স্পষ্ট দেখছি। নিঃশুল্ক  চোখ বদলের চিহ্ন হিসেবে আমার কাঁধে একটা হলুদ নিশান চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। খুশি মনে হলুদ ঝান্ডাটা নিয়ে হাঁটছি। রাস্তাঘাট, গাছপালা, ল্যাম্পপোস্ট, আকাশের মেঘ সবই খুব স্পষ্ট, কিন্তু হলুদাভ দেখাচ্ছে।

হঠাৎ দেখি সামনেই বাজারের রাস্তাটায় একটা সোরগোল! অনেকে চ্যাঁচাচ্ছে - ‘হলুদ আমাদের প্রিয় রঙ! দোকানে সবুজ সাজানো চলবে না!’ একটা গাছের দোকানে কিছু গাছ সাজানো ছিল। ক্যাম্প ফেরত চক্ষু-বদলানো মানুষগুলো হলুদডান্ডা দিয়ে সবুজ টবগুলো ভেঙেচুড়ে ফেললো। উত্তেজিত সেই লোকগুলো দোকানদারটির নীল দুচোখে হলুদ আইড্রপ ঢেলে দিলো।

ঘরে ফিরে দেখি, আমার বউ হলুদশাড়ি পড়ে বসে আছে। টিভির কালার-ব্যাকগ্রাউন্ড হলুদ। খবর-পড়া যে  মেয়েটি নিরপেক্ষ সংবাদ উপস্থাপনের কথা ভেবেছিল, তার পরনেও হলুদশাড়ি। বিশেষ সংবাদ মাধ্যমে পার্টির মেয়েটা এখন জনগণকে শোনাচ্ছে, নিঃশুল্ক আই-ক্যাম্পে চোখ বদলের উপকারিতা! শোনাচ্ছে, চক্ষুতে হলুদ রসায়নের গুণগান!

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন