কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

প্রশান্ত গুহ মজুমদার

 

সমকালীন ছোটগল্প


সাদাকালো জোব্বা

 

কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সীমা। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির একমাত্র সন্তান হওয়ায় সীমা প্রায় দুধেভাতে মানুষ। বসিরহাটের স্কুলজীবন তার কাছে এখনো এক অমূল্য স্মৃতি। আর তারপরই ফাদার। লেখাপড়া, বিশেষ করে ইংরেজি আর বাংলায় ও বরাবরই ভালো। সময়মতো সার্ভিস কমিশনের কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরের মধ্যমানের আধিকারিকএখনো কিছু বছর তাকে চাকরি করতে হবে। এর মধ্যে হবে হয়তো আরও পদোন্নতি কিংবা সদর দপ্তরে পোস্টিং। একা থাকার পক্ষে সঞ্চয় তার ইতিমধ্যেই যথেষ্টকোন দায়-ও নেই। মা-বাবা দুজনেই চলে গেছেন। বসিরহাটের পৈতৃক বাস উঠিয়ে কলকাতা বলতে আজ যা বোঝায়, তার প্রত্যন্ত দক্ষিণে দুই বেডরুমের একটা বাড়ি। সামনে পিছনে সামান্য জায়গা।

এমন সচ্ছল নির্ভার এক জীবনে দিন কাটালেও ইদানীং তার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। গত কয়েকদিন ধরেই। কেন, সেটাই বুঝতে পারছে না। সীমা জানে, তার বয়স হচ্ছে। ও অবশ্য পাত্তা দেয় না। কিন্তু সত্যি তো সত্যিই! বিয়েথা করার কোন ঝঞ্জাটে যায় নি। কিছু পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা আর চাকরি নিয়েই তার দিনকাল। আর একটা প্যাশন তার আছে। রবিঠাকুরের গান। শরীরে কোন অসুবিধে নেই। মেনোপসের পর তার মনে হয়েছে, আপদ গ্যাছে। ৫ ফুট ইঞ্চির ঝকঝকে কমপ্লেক্সন। ওজন ৫৬-৫৭। সুশ্রী মুখের আদলে সে এখনো যেন সদ্য চল্লিশ। বাড়িতেই নিয়মিত শরীরচর্চা করে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অনলাইনে। সময়ে সামনের ছোট্ট বাগানে মরশুমি ফুল করে। একটুখানি কিচেন গার্ডেনও করেছে। এদিকটায় সবই প্রায় বহুতল। প্রত্যেকেই চাকরিবাকরি ব্যবসায় তুমুল ব্যস্ত। কিছু বাঙালী অবাঙালী প্রতিবেশির সঙ্গে তার হ্যালো হাই-য়ের মতো সৌজন্য বিনিময়টুকু রয়েছে। এইসব সীমাকে যথেষ্ট ভালো রেখেছেতবু সীমার আজকাল মনে হয়, সবকিছুই বড়ো ফ্র্যাজাইল, বাহুল্য।  বড়ো নিরর্থক মনে হয়। এমন না যে, পুরুষ সঙ্গীর অভাব সে বোধ করে। তবু। কেমন যেন শিকড়ছেঁড়া,   মিনিংলেস

কিন্তু তুলি! প্রায় নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র মেয়ে। কিন্তু মেধা বা রূপে তুলি মোটেই মধ্যবিত্ত ছিল না কোনদিন। হ্যাঁ, একটা ব্যাপার ওর ছিল। সেটা হচ্ছে ছেলেদের বিষয়ে বিচিত্র কিছু সংস্কার, ভয়। ওর প্রেমে পড়ার জন্য কলেজ ইউনিভার্সিটিতে যেন প্রতিযোগিতা। অথচ ওর কোনো তাগিদ ছিল না। ছেলেদের সব বিষয়েই কেমন যেন নিস্পৃহ। সীমার বেশ ঈর্ষা হতো। রাগ হতো। সে কেন এমন! সে কেন তুলির মত নয়! কেন নয় সে সো কল্‌ড্‌ সুন্দরী! মেধা বা পরীক্ষার ফলাফলে অবশ্য ওরা দুজনেই কাছাকাছি থেকেছে সবসময়ে। তা হলেও। বাড়িতে ও মাঝে মধ্যেই মা বাবার ছবি দেখতো। আর নিজেই লজ্জা পেতো। ছি ছি, ও এত নিচে নেমে গ্যাছে! এমন একটা টানাপোড়েনের মধ্যে তুলি আর ও যে কখন কাছাকাছি এসে গিয়েছে, সীমা জানে না। বোধহয় তুলি-ও। আর তারপর পরিচিত সবাই বুঝতো, তুলি মানেই সীমা, সীমাকে ডাকলে তুলি-ও আসবে। অথচ কি আশ্চর্য, ওরা কিন্তু নিজেদের স্পেসটা ঠিক বজায় রাখতো। এখনো। পরস্পরের কাছে সব দরজাজানলা খুলেও একটা ঘরের দরজা বন্ধ রেখেছে দু’জনেই সব সময়ে। ব্যাপারটাকে দুজনেই ওরা সম্মান করতো, মান্যতা দিয়ে এসেছে চিরদিন।

কিছুদিন হল, তুলির কথা খুব মনে পড়ছে। আরও সব উল্টোপাল্টা কথা। এখন চায় না, তবু পুরোনো কথা সব হাজির হচ্ছে। এলোমেলোভাবে। অনেক কিছু হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় মানে আর দেখা যায় না। কিন্তু তারা কোথাও তো যায়। ভিড়ের মধ্যে, দৈনন্দিন কোলাহলের মধ্যে হয়তো হারিয়ে যায়! তখন কি সেই বিশেষ মানুষ, সেই বিশেষ ঘটনা সব অতীতটুকু নিয়ে ক্রমে আরও গভীর অরণ্যে চলে যায়! স্মৃতির মানুষ আর ঘটনাকে তখন বুঝি আলাদা করা যায় না আর! ফলে ভ্রম হয়, হারিয়ে গেল। প্রকৃত জঙ্গলে যেমন। বহুতর ঘটনার অরণ্যে আর তারা বিশেষ থাকে না। যেন বিভিন্ন আলোর প্রক্ষেপণে আর রঙে বিধুর হতে হতে নিছক স্মৃতি হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে কল্পনার ছায়া এসে বসে, নানান গল্পের সূত্রধার হয়ে ওঠে যেন তখন সে সব মানুষ। এখন তার শৈশব, মা বাবা- সবই প্রায় তেমনই। বহু বর্ণের প্রলেপে হয়তো আসলটাই হারিয়ে গিয়েছে।

আজ মা বাবার চলে যাওয়ার দিন। ফাদারের কাছে শুনেছে। কি আশ্চর্য! যাচ্ছিলো তো তারা সিকিমে! যেমন অনেকেই যায়। নতুন গাড়িতে। একটা বাঁকের মুখে উল্টো দিক থেকে আসা এক মটোরবাইককে পাশ দিতে গিয়ে পাহাড়ের খাদে গড়িয়ে পড়লো বাবার শখের গাড়ি। গাড়ির সবাই বোধহয় মুহূর্তেই নিছক বডি হয়ে গিয়েছিল। কেবল সীমা ছাড়া। কিভাবে যে সে বেঁচে গেল, সে-ও এক বিচিত্র বিস্ময়! তারপর ফাদারের কাছে, কলেজ ইউনিভার্সিটি চাকরি জীবনে কেটে গেল প্রায় তিরিশটা বছর! এখন কেবল স্মৃতি। তেরো বছরের সঙ্গে এতদিনের জীবনের নানান বাঁকে চলতে চলতে নানান গল্পকথা মিশে গেছে সেখানে। বসিরহাটের ঘর থেকে কিছু ছবি, কিছু খেলনা, কিছু বই ফাদার নিয়ে এসেছিলেন। দিয়েছিলেন তাকে। সে সবের মধ্যে দুটো সাদাকালো ছবি ওর কাছে এখনো। একটায় বাবা সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। একপাশে মুখ, ঠোঁটে সামান্য হাসি। আর অন্যটায় মা তাকে কোলে নিয়ে জানলার সামনে। রোদ এসে আলো দিচ্ছে ওদের দুজনকে। আজ ফ্রেমের মধ্যে মা বাবার ছবি দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে পড়লো, একটা মাকড়সা খুব যত্ন করে বাসা টানছে দুটো ফ্রেমের উপর। ‘বাসা’! কী ভঙ্গুর শব্দ! তুমুল বৃষ্টির শব্দে, সীমার মনে হ’ল, ওই শব্দটাও ভিজে যাচ্ছে নিঃসাড়ে।

নানান কাজের মধ্যেও কয়েকদিন ধরে কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। ফাঁকটা টের পাচ্ছে, কিন্তু কোথায়, সীমা বুঝে উঠতে পারছে না। তার উপর গত তিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি। বিরক্তিকর! এখানে এমন আর কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না ওর। চাকরিসূত্রে যখন কোচবিহারে ছিল, ওষুধের দোকানে একদিন প্যারাসিটামল আর অ্যান্‌টাসিড কিনতে গিয়েছিল। সেদিন আকাশে ঘনঘোর মেঘ। বৃষ্টি নামবে, এমনই মনে হচ্ছিল সীমার। সেদিন দোকানের ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘এবার বৃষ্টি নামবে। ঘরে কিছু চাল ডাল আনাজপত্র রেখে দিন। আপনাদের পশ্চিমবঙ্গে তো এমন হয় না। এখানে হয়এ কবে যে ধরবে, বলা মুশকিল।’ ‘আপনাদের পশ্চিমবঙ্গ’! কথাটা শুনে হাসি পেয়েছিল সীমার। কিন্তু সত্যিই হয়েছিল সেবার। চারপাশে জলে একেবারে থইথই! পাশের মরা দিঘিটা উপচে উঠে ডাঙ্গায় কইমাছ! আর উঠোনের জামরুল গাছটা থেকে সাদা জামরুল উঠোন জুড়ে, যেন ফুল! এই অঞ্চলে এবারও যেন তেমন বৃষ্টি

এখন আর বৃষ্টি ভালো লাগে না সীমার। এক সময়ে লাগতো। যখন ফাদারের কাছে। যখন ফাদার বড়ো স্নেহে, মমতায় তার পাশেই একটা ঘরে সীমার থাকার ব্যবস্থা করে একজন সিস্টারকে তার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তখন তার নিজস্ব একটা বেশ বড়ো জানলা ছিল। পূব দিকে। তাকালেই অনেকটা ফাঁকা জমি। কতো না গাছপালা সেখানে! তারপর উঁচু পাঁচিল। বৃষ্টির মরসুমে লেখাপড়ার ফাঁকে ও সেই সবুজ দেখতো। কোথাও একটা হারিয়ে যেতে খুব ইচ্ছে হ’ত। এরকমই এক দুপুরে, সীমা তখন ক্লাশ এইটে। বৃষ্টিতে সমস্ত সবুজ মিলেমিশে একাকার। ফাদার শহরে গিয়েছেন। সিস্টার বোধহয় সেদিন অসুস্থ ছিল। দুপুরের খাওয়ার পর সীমা তন্ময় হয়ে বৃষ্টি দেখছিল। খোলা-ই ছিল দরজাটা। ম্যানেজারকাকু কখন যে এসে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, সীমা টের পায় নি।

-কী! বৃষ্টি দেখছো?

সীমা চমকে উঠেছিলমানুষটার মুখে অদ্ভুত এক হাসি। সরাসরি এসে কাঁধে হাত রাখলেন। সীমা তখন নেহাতই ঘরের পোশাকে। নীল-সাদা একটা ঢোলা গেঞ্জিবাড়ন্ত শরীর নিয়ে তার তখন কিরকম এক বিমূঢ় অবস্থা।

-কী, বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে?

-না না। এখান থেকেই খুব ভালো লাগছে।

-চলো। দেখবে ভালো লাগবে।

-না না। ফাদার বকবেন।

কিন্তু মানুষটা ছাড়ার পাত্র নন। সীমার হাত ধরে নিয়ে এসে সেই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিলেন। প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগলেও ক্রমে ভালো লাগছিল। হঠাৎ কাকু তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন। জামাটা লেপ্টে আছে শরীরে।

-আর ভিজতে হবে না। ঘরে চলো। জ্বর এলে ফাদার আবার আমাকেই বকাবকি করবেন।

ঘরে নিয়ে এসে দ্রুত হাতে খুলে দিলেন গেঞ্জিটা। তাড়াহুড়োয় ছিঁড়ে গেল কাঁধের কাছে। নামিয়ে দিলেন প্যান্টটাও। আদুল গায়ে সীমা একেবারে হতচকিত। কাকু তাকে টেনে নিলেন কোলে। সীমার শরীরটা তখন যেন একটা রাবারের পুতুল। প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে সীমা শুধু একবার চিৎকার করে উঠতে পেরেছিলসে শব্দে ভয়, ব্যথা, ঘৃণা, হাহাকার সব মিলেমিশে যেন একাকার। মানুষটি ওই অবস্থাতেই তাকে বিছানায় রেখে প্রায় দৌড়ে চলে গেলেন ঘর থেকে। কোনক্রমে সীমা সেদিন দরজাটা লাগাতে পেরেছিল আর পেরেছিল কাঁদতে। হাসপাতালে শুয়ে মা বাবার জন্যেও বোধহয় এমন কাঁদে নি। অনেক রাত্রে ফাদার এসে ডাকাডাকি করায় সীমা দরজা খুলেছিল। ওর মুখচোখ দেখে ফাদার কি কিছু আন্দাজ করেছিলেন! ভিজে ছেঁড়া গেঞ্জিটা দেখে? এরপর আর কোনদিন সীমা ম্যানেজারকাকুকে দেখে নি। বৃষ্টি ওর কাছে চিরকালের জন্য বড়ো দূরের হয়ে গেল! আর সীমা সেদিন তার শরীরের সব ঐশ্বর্যকেও বোধহয় জানতে পেরেছিল।

যদিও ভোর এখনো ওর কাছে ভোর। আশ্বিনের সন্ধ্যার আকাশ এখনো ওকে টানে। তুলি, যার জীবনে এমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই, যে পারিবারিক অর্থনৈতিক কারণে যথেষ্ট সচ্ছল নয়, অথচ যে প্রায় উর্বশীতুল্য সৌন্দর্যে ভরপূর, তারও এমন বোধহয় মনে হয়েছিল। তাই তো দুটো অসম শরীরী সম্ভার নিয়েও ক্রমে একটাই প্রাণ।

তুলি এখন কী করছে! কতো দূরে! একা একাই চলে গেল। কুয়েতে  বেশ নামী স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞআন্তর্জাল এখন তাদের দুজনের মধ্যে একমাত্র সেতু। আর সপ্তাহান্তে সীমার জন্য নানান উপহার। প্রতিটিতে যেন তুলির আশ্লেষ, উষ্ণতা। ব্যবহার করে না একটাও। বড়ো যত্নে সাজিয়ে রাখে ঘরের বিভিন্ন র‍্যাকে। বুঝি বা অমূল্য মেমোন্টো। নিশ্চিত এক আলো-অন্ধকার ভোরে তুলি তাকে গভীর এক চুম্বন শেষে ঘরের ইন্টারলকটা লাগিয়ে চলে গেলে সীমা তুলির বালিশে হাত রেখেছিল। উষ্ণ, নরম। সেই শেষ। সীমা জানতো। ও উঠে পড়েছিল। এতো কান্না নিয়ে কি শুয়ে থাকা যায়! ঐ অবস্থাতেই টেনে নিয়েছিল খাতাটা। ‘একটা অদ্ভুত ব্যাপার! কমবেশি ১৩ বছরে একবার করে পাল্টে গিয়েছে আমার জীবনের ধারা। নতুন একটা খাত যেন তৈরি হয়েছে। তা হলে কি এবার শেষ পরিবর্তনের phase-টা শুরু হ’ল! আমার জীবনের শেষ পর্ব!’

রীতা, ওর সব সময়ের মেয়ে, বলে, দিদি, তুমি এতো সুন্দর! কেন যে বিয়ে করলে না। সীমা হাসে। অবরেসবরে দিনের কথা লেখে। ওর একটা নীল মোটা খাতা আছে। সেখানেই মাঝেমধ্যে লিখে যায় তুলির কথা, অধুনা দিনযাপন, ক্রোধ, হতাশা আর ভালো লাগার কথা। জাগতিক কোন মূল্য নেই সে সবের। সীমা-ও সে কথা জানে। তবু লেখে। এই কাগজকলম যেন ওর বন্ধু। যেন শুশ্রূষা।

খানেই একদিন লিখেছিল ‘ঠিক মনে পড়ছে না। কোন্‌ চিন্তা আমাকে এসব লিখতে উসকে দিয়েছিল। সে কি কনফেশনের কোন ইচ্ছা! নাকি জানিয়ে যাওয়া, দেখো, কী ভাবে কেমন তাপেউত্তাপে, তুলির সাহচর্যে বেঁচে ছিল এই সাড়ে পাঁচ ফুটের প্রবল অভিমানী আদ্যন্ত আবেগপ্রবণ কল্পনাবিলাসী মেয়েটা! যে সারা জীবন ভালবাসা চেয়েছে, বিশ্বাস চেয়েছে। আর বারবার তার ভালবাসাকে  বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে জীবন তাকে নিয়ে লোফালুফি খেলেছেউল্টোদিকে আবার সে যেন জীবনের কাছে, মানুষের কাছে চেয়েছে অনেক কিছুই, দেয় নি কিছুই। দেওয়ার ক্ষমতাই যেন সে আজীবন অর্জন করতে পারে নি! অথচ তুলি তাকে সবটুকু দিয়েছিল। যতোটা ওর পক্ষে সম্ভব। তুলি যখন তার উপরে অথবা সীমা। গভীর সে আলিঙ্গনের মধ্যে কী যে সমর্পণ, নিঃশেষ হতে হতেও কী যে আনন্দ, শুধু তাঁরাই সেটুকু টের পেতোশীতের রাত্রে তথাকথিত অসামাজিক সেই ভালোবাসায় তাদের দিনরাত্রি তখন পূর্ণ, নির্ভার।  তবু কী বিচিত্র! কী বিচিত্র! যদি সত্যিই বহুদিন পর কেউ এসব পড়ে, ইমোশনালি শক্‌ড্‌ হবে না তো!’

সীমার শুধু মনে হয় ইদানীং, কোন কিছুই কিছু দেয় না। শুধু নিয়ে যায়। শূন্য করে যায়। কিন্তু সেই কিশোরীবেলা আর সোনালী রেশম তাদের শরীরে যখন এক বিচিত্র আবিষ্কারের খেলা শুরু করেছে, তখন! সে-ও কি মিথ্যা ছিল! সীমা তুলিকে পেয়ে যেমন বেঁচে থাকার এক অর্থ খুঁজে পেয়েছিল, তুলিও কি তাই! শরীরের প্রতিটি রোমকূপে যে এমন আর্তি, এমন অশেষ সমর্পণ, কে জেনেছে তার আগে! পরস্পরের কাছে সে ছিল কেবল  বিস্ময়ের, পুলকের, আশ্লেষের দুপুরসন্ধ্যা! একলা ঘরে, ভার্সিটির লেডিস হোস্টেলে। তখন কি ওদের দখল নিয়েছিল শয়তানের মতো এক আশ্চর্য সূর্য! ওদের মগজ খুলে যেতো, হৃদয় উন্মাদ, উন্মুক্ত। ভিজে যেতে যেতে, ডুবে যেতে যেতে পরস্পরের কাঁধে মুখ রেখে কাঁদতো। ফিসফিস করে দু’জনেই যেন দু’জনকে বলতো, কাঁদো, আরও কাঁদো, পবিত্র হয়ে ওঠো।

একবার ডুয়ার্সে গয়েরকাটা ফরেস্টে। চমৎকার কাঠের বাংলোয়নির্জন সন্ধ্যা, দূরে হাতির ডাক আর রাত্রি কেবল ছিল নিজেদের খোঁজা। তন্নতন্ন। সে চেনার যেন শেষ নেই। সেই আশ্লেষের ভেজা জলে কেবল অপূর্ব এক স্নান, পরস্পরের ঠোঁট ক্রমশ গভীরেসেই রাত্রির খেলায় ডুবে যেতে যেতে কোনো অশেষ অন্ধকারের কথা কি ভেবেছিল দুজনেই! অঘ্রাণের কোনো অলৌকিক এক তারা- মাটিতে নেমে আসার কথা!

সেই কাল থেকেই কি শুরু হয়েছিল অবসানের, বিসর্জনের বাজনা! সীমা আজ সে রকমই ভাবে। সে খেলায় তো কোন জয় ছিল না! সে ছিল নিশ্চয়ই ফুরিয়ে যাওয়ারই শুরু। দূরে যাওয়ার।

সন্ধ্যায় ব্যালকনিতে বসে সীমা অফিসের একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিল। ব্যাপারটা আর কিছুই না। নতুন এক জুনিয়ার অফিসারের জয়েন করা নিয়ে। সে আগের অফিস থেকে আসছে কিছু আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে। ভদ্রলোক সম্পর্কে সীমা খোঁজখবর নিয়েছে। বিশেষ কিছু সুবিধের নয়। স্টাফেদের সঙ্গেও নাকি সেখানে খারাপ ব্যবহার করতো। এর মধ্যে রীতা আজ আর কাল ছুটি নিয়েছে। ওর বোনটা হাসপাতালে। বাচ্চা হবে। গুমোট গরম। গাছের একটা পাতাও যেন কাঁপছে না। এইসব মিশিয়ে সীমার কিছু ভালো লাগছে না। কোনো কাজে যেন মন নেই। যন্ত্রের মতো দিন পার করে দিচ্ছে শুধু। পশ্চিমের ব্যালকনির দেয়াল ঘেঁসে রেখে দেওয়া জেড প্ল্যান্টটাও বোধহয় টের পেয়েছে সীমার অস্থিরতার কথা। ও কেবল একা একা অপেক্ষা করে। যেমন করতো সীমার মা বাবা চলে যাওয়ার পর ফাদারের জন্য। যেন ও জানতো, ফাদার এসে তাকে নিয়ে যাবেন আবার সীমার কাছে, সেই উচ্ছল অভিমানী সীমার কাছে। যেন ও জানে, সীমা একদিন অসীম জলের কাছে যাবে।

এমন এক অস্থিরতার মধ্যে অফিসে বসেই সীমার মোবাইলে হঠাৎ একটা মেসেজ! তুলি লিখেছে, ও আসছে। প্রায় পরে পরেই এক লম্বা ই-মেল। কেঁপে উঠেছিল সারা শরীর। চিঠির পাতায়, কালো কালো অক্ষরের মধ্যে সেই পরিচিত গন্ধটা সীমা যেন টের পাচ্ছিল। সেই সঙ্গে এক বনজ বাতাস

দিনকাল-ই যেন হঠাৎ পাল্টে গেল সীমার। রীতাও এসে অবাক।

-দিদি, কেউ আসছে নাকি!

-আমার বন্ধু।

-তাই তো ভাবি, দিদির মেজাজ এমন ফুরফুরে কেন! কেনই বা এতো বাজারহাট। এদিকে ফ্রিজ আর ফ্রিজার যে ভর্তি হয়ে এলো, সে খেয়াল দিদির আছে তো?

-তুই একটু চুপ করবি!

হাসি মুখে সীমা রীতাকে চোখ পাকায়

-সে তুমি যাই বলো, আমার কিন্তু খুব আনন্দ হচ্ছে। তোমার বন্ধু কিছুদিন থাকবে তো?

তুলি কি খেতে ভালবাসে, সীমা জানে। বিশুদ্ধ বাঙালীখানা। সেই মতো কচুর ডাটা থেকে ইলিশ, কুচো মাছ, বিলিতি আমড়া, চালতা-সব একটু একটু করে এনে ফেলেছে। রীতা রাঁধে ভালোআর দুদিন। গতকাল মল থেকে তুলির জন্য দুটো নাইটি আর বাথ টাওয়েল কিনে এনেছে। শুক্রবার রাত্রি এগারোটায় তুলির প্লেন দিল্লি হয়ে নামবে দমদমে। সীমা যাবে এয়ারপোর্টে। রীতাকেও নিয়ে যাবে।

প্লেনটা দিল্লি এয়ারপোর্টে কোনদিন আর ল্যান্ড করে নি। মাঝ আকাশেই।

কোভালমের রিসোর্টের ব্যালকনির রেলিং ছুঁয়ে সূর্যাস্তের আলো গড়িয়ে যাচ্ছে। সীমার ভালো লাগা, আনন্দিত হওয়া, উচ্ছল হওয়ার পর্ব বুঝি শেষ হ’ল। সূর্য আস্তে আস্তে পাটে। সীমা একাই নেমে এলো বীচে। রীতা ঘরে ঘুমোচ্ছে।

নোনা বাতাসে শীত এখন টের পাওয়া যায়। অস্তের রঙে লালসাদা নোনা ফেনা ওর পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। ফিরে যাচ্ছে। দূরে ভেজা বালির উপর এক জোড়া মেয়ে। বাঁ দিকে লাইটহাউস। সীমা এখন শুধু মাঝেমধ্যে রীতাকে ইমিটেশন হার কিনে দেয়, দুল দেয়, চুড়ি, সিন্থেটিক শাড়ি, চুড়িদার। কোনো আলোর বিন্দু সীমা এখনো ওকে দেয় নি।

ইদানীং ওর মনে হচ্ছে, কোন কিছুরই কোন মানে হয় না। এই কোভালমে এসে ওর প্রথম দুদিন মন্দ লাগে নি। তুলির সঙ্গে সঙ্গে ওর অতীত বর্তমান-সবটাই যেন হারিয়ে গিয়েছে। ঘরে আর থাকতে পারেনি। রীতাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিল। লম্বা ছুটিতে। নানান জায়গা ঘুরে গত দু’দিন এখানে। এখন এই সন্ধ্যায় সমুদ্র তাকে দেখছে। সীমা তুলিকে।

অন্ধকার হয়ে আসছে। স্বাভাবিকদু'পাশে তাকালো সীমা। নির্জনই প্রায়। অথচ সামনে অনন্ত যেন। একা খেলা করে যাচ্ছে তটের সঙ্গে। সীমা জলে পা রাখলো। তারপর আরও একটু। কোনো গার্ড হুইসল বাজাচ্ছে। বোধহয় চেতাবনি। কিন্তু সীমা এখন অন্য মনে। তার মনে হচ্ছে, অন্ধকার এতো অর্থবহ! কতো কিছু বুঝি এখনো অপেক্ষা করছে ওইখানে তার জন্য। সীমা যেন জেনে যাচ্ছে, বেঁচে থাকা এক অলীক ভাবনা মাত্র। ছেঁড়াখোঁড়া বহু স্বপ্নের তালি দেওয়া বুঝি বা এক সাদা-কালো জোব্বা। শেষ অবধি সবই গড়িয়ে যায় নিশ্চিত এক অনন্তের দিকে।

নোনা জলে হালকা অন্ধকার ঠেলে ঠেলে সীমা এমন এক নির্লিপ্ত বোধে এখন ক্রমে ভিজে যাচ্ছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন