ধারাবাহিক উপন্যাস
স্বর্গ এসেছে নেমে
(৭)
কয়েক বছর তো কেটে গেছে তারপর। বৈশ্বানরের মা নিশ্চিন্ত, ভগবানের মত কর্তাদাদা তার ছেলেকে নিজের সন্তানের মতই মানুষ করছেন। তাঁর দয়ায় নিজের জীবনটাও এখন সুস্থির হয়েছে। লোকের বাড়ি কাজ করার যে মানসিক উদ্বেগ তা থেকে মুক্ত সে। মন দিয়ে কর্তাদাদার বাড়ির দেখাশোনা করে। ভাবে, মনিব খুশি থাকলে আর চিন্তা কি। প্রতি মাসেই তো আসেন তিনি, বিশুর খবরটাও পাওয়া যায় তাঁর কাছেই।
‘বিশু’র মা’! একটা গাছের
বাড়তি ডালগুলো কাটছিল বিশুর মা। চমকে উঠলো ডাক শুনে। এ তো কর্তাদাদার ডাক। বিশ্বাস
হয় না। মাসের প্রথম দিকেই তো এসেছিলেন, যেমন আসেন তিনি। তবে? গেটের দিকে একটু এগোতেই
বিস্ময়ে আনন্দে প্রায় কেঁদে উঠল সে। তার বিশুকে সঙ্গে নিয়ে কর্তাদাদা। মায়ের মন। কিছুক্ষণ
অপলক তাকিয়ে রইল সে ছেলের দিকে, তারপর কি যেন একটা আন্দাজ করে বলে উঠলো, ‘অ কত্তাদাদা,
আমার বিশুর শরিলডা কেমোন শুকাই গেছে। অ বালো আচে ত’? অনঙ্গ সান্যাল কিছু বলার আগেই
মাকে জড়িয়ে ধরে বলল বৈশ্বানর, ‘আমার কিচ্ছু হয়নি মা, পরীক্ষার জন্য রাত জেগে পড়ি তো,
তাই মনে হচ্ছে তোমার’। এবার খেই ধরলেন অনঙ্গ সান্যাল, ‘চিন্তা করো না বিশুর মা, আমি
আছি তো! পরীক্ষার পর বিশ্রাম পাবে, খাওয়া দাওয়া করবে, সব দেখবে আবার আগের মত হয়ে যাবে’
। বিশুর মা যেন বড় ভুল করে ফেলেছে এমন ভাব করে বলল, ‘কিছু মনে কইরেন না গো কর্তাদাদা,
তুমি থাকতে আমার বিশুর কোন বেপদ হইতেই পারে না, তবে কি ওই মায়ের মন তো’!
অনেকদিন পর ছেলেকে পেয়ে
তাকে কি খাওয়াবে ভেবে কূল পায় না বিশুর মা। কত্তাদাও আছেন যে। ভালমন্দ রেঁধে খাওয়াবার
মত সাধ্যও যে নেই তার। অগত্যা বাড়ির বাগানের শাক কুমড়ো বেগুন মূলো দিয়ে তরকারি, ডাল
আর ভাত, সাথে পড়শীর ঘর থেকে সংগ্রহ করে আনা একবাটি করে দুধ। হ্যাঁ, মহা তৃপ্তিতে খেলো
দু’জন। দেখে মন ভরে গেল বিশুর মায়ের। অনঙ্গবাবু বললেন, ‘এখন ফিরতে হবে আমাদের, ছেলে
অনেকদিন দেখেনি তোমাকে তাই নিয়ে এসেছিলাম’। বিদায় দিতে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারল
না বিশু’র মা।
ফিরে এল বৈশ্বানর তার
অনঙ্গকাকুর সাথে। অনঙ্গবাবু বললেন, ‘তুই আমায় বাঁচিয়েছিস বাবা। আমি তো ভেবেই পাচ্ছিলাম
না, তোর মাকে কি জবাব দেবো’। বৈশ্বানর একটু হেসে জবাব দিল, ‘মায়ের মন থেকে ভাবনাটা
সরিয়ে দেবার জন্যই এই মিথ্যেটা বললাম। আমি কি কিছু অন্যায় করেছি কাকু’? অনঙ্গবাবু সস্নেহে
তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘না, তুমি কোন অন্যায় করোনি বৈশ্বানর, যে মিথ্যে
বলাতে মানুষের মন্দ হয় না সে মিথ্যেতে কোন অপরাধ নেই’।
ফেরার পথে দেখা হয়ে
গেল অনঙ্গবাবুর শ্যালিকা, কুন্তলার মাসতুতো বোনের সঙ্গে। এই মহিলাকে অনঙ্গবাবু ঠিক
ভাল চোখে দেখেন না। ইনি কুন্তলার পরামর্শদাত্রী। স্বামী বা মেয়ের বেলায় কোন সিদ্ধান্ত
নেবার আগে দুই বোনের আলোচনা অত্যন্ত জরুরী বলেই মনে করে কুন্তলা। এর কারণ আর কিছুই
নয়, ওই দুজনের মতিগতির কোন খেই পায় না সে, আর তাই বোনের স্মরণাপন্ন হয় মাঝে মধ্যেই।
বৈশ্বানর সম্পর্কে দুই বোনের চিন্তা ভাবনা একই ধারায় চলে। অনঙ্গবাবু মনে মনে কোন একটা
শঙ্কার আঁচ পেলেন যেন। কি হতে পারে এ দু’জনের পরবর্তী কার্যকলাপ? ভালমন্দ যা-ই হোক
কুন্তলার মাথা খেলে না কোনটাতেই। আন্না, ছয়টি কন্যার পর সপ্তম জনের নাম রাখতে গিয়ে
এর থেকে আর কোন যথার্থ নাম মনে আসেনি মা বাবার। চেহারার সাথে আচরণের এমন সামঞ্জস্য
সচরাচর দেখা যায় না। স্বামীর উপার্জন দেখলে, সংসার চলাই দুষ্কর। অন্যক্ষেত্রে কুন্তলার
উদারতার পাশে একটি প্রশ্নচিহ্ন অবধারিত কিন্তু আন্না’র বেলায় সে মুক্তহস্ত। আন্নার
পরামর্শে এমন কিছু বিপত্তির সৃষ্টি করেছিল কুন্তলা যে তা থেকে মুক্তি পেতে অনেক কাঠখড়
পোড়াতে হয়েছে অনঙ্গ সান্যালকে কিন্ত কুন্তলাকে কিছুতেই নিরস্ত করতে পারলেন না তিনি।
ঘরে ফিরতেই অগ্নিবর্ষণ
শুরু হল। ‘আবার কুষ্মাণ্ড ছেলেটাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! একা গেলে না কেন? নীলেখেলাটা
তো তবে জমতো ভালো’। অনঙ্গ সান্যাল নিরুপায়, নিরুত্তর। তাঁর জীবনে এমন একজন সঙ্গী! স্থিতধী
অনঙ্গবাবু ভাগ্য ব্যাপারটাকে মানতে পারেননি কোনদিন। তিনি পুরুষকারে বিশ্বাসী। কুন্তলার
সাথে তাঁর বিবাহ, তিনি মনে করেন, সেটাও ভাগ্যবলে নয়। তিনি বিশ্বাস করেন, সেখানেও কোন
যুক্তিসম্মত কারণ সক্রিয় ছিল। তিনি সাধারণত কুন্তলার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন
না। এখনও করলেন না। যে চিন্তাটা তার সমস্ত মস্তিষ্ক অধিকার করে আছে, সে হলো, আন্নার আগমন। মনে মনে ঠিক করলেন সজাগ থাকবেন তিনি। কিছুতেই
আন্না কুন্তলার পরিকল্পনা সফল হতে দেবেন না। কুন্তলা বোনকে ডেকে পাঠিয়েছিল সুযোগ বুঝে,
যখন অনঙ্গবাবু আর মনস্বিনী দু’জনই ঘরে অনুপস্থিত।
মনস্বিনী ফিরে এসেছিল
সেই সময় যখন দুই বোনের মধ্যে কথা হচ্ছে মনস্বিনীকে নিয়েই। আন্না মাসীকে দেখে তার বাবার
মত তার একই প্রতিক্রিয়া। শুনতে পেল মনস্বিনী, আন্নামাসী বলছে, তার হাতে একটি খুব ভাল
ছেলে আছে। জমিজমা আছে, আছে একটি মুদি দোকানও। কিছু টাকাপয়সা হাতে এলেই দোকানটা সুন্দর
করে গুছিয়ে নেবে। তা বিয়ের পর যদি তালইমশায়ের মত জামাইবাবুও জামাইকে দেখে তবে মনি’র
ভাগ্যও তার মায়ের মতই সুখশান্তিতে ভরে উঠবে।
কুন্তলা সম্ভবত আন্দাজ
করতে পারেনি, মেয়ে এত তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসবে, তাই বোনের সঙ্গে কথা বলার সময় কোন সতর্কতার
কথা মাথায়ই আসেনি তার। আড়ি পেতে কথা শোনার মত মেয়ে মনস্বিনী নয়, তাই সোজা ঘরে ঢুকে
মা মাসীর মুখোমুখি দাঁড়ালো সে। যেন মন্ত্রবলে দু’জনের মুখেই তালা পড়ে গেছে। কুন্তলা
চোখ কপালে তুলে বললো, ‘এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে মনি’? এবার মুখে কথা এলো আন্নার। একটু
খেজুরে হেসে বললো সেও, ‘ভাল করেছিস ফিরে এসে, না হলে তো তোর সঙ্গে দেখাই হত না’। সরব
হল মনস্বিনী, ‘তুমি তো মাঝেমধ্যে আসছই মাসী, আজ না হয় দেখা হত না, ক’দিন পরেই তো আবার
ডাক পড়বে তোমার, তখন—। কথাটা শেষ করতে পারলো না মনস্বিনী। কুন্তলা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘আমার
বোনকে আমি যতবার ইচ্ছে ডাকবো তাতে তুই বাধা দেবার কে’? মনস্বিনীর কাছে তো নতুন কিছু নয় মায়ের এই মেজাজ।
সে অতি ধীরকন্ঠে বলল, ‘মাসী আসুক না যতবার ইচ্ছে। হতেই পারে দু’বোনের মধ্যে সুখদুঃখের
কথা। কিন্তু মা, তার মধ্যে যেন আমাকে নিয়ে কোন কথা না থাকে’। ‘তোকে নিয়ে আবার কি কথা
হবে, আমরা বলছিলাম আমাদের কথা’, পাশ কাটানোর মত করে বলল কুন্তলা। ‘কেন, মাসী তার বোনঝির
জন্য একজন যোগ্য পাত্রের সন্ধান দিয়েছে না তোমায়’? কুন্তলা তেড়ে উঠল, ‘বেশ করেছে, আমার
বোন আমার কথা ভাববে না তো কি পাড়ার লোকের কথা ভাববে? ‘তোমায় কে বোলেছে মা, মাসী কোন
পাত্রের খোঁজ এনে দিল আর আমি সুড়সুড় করে বিয়ের পিড়িতে গিয়ে বসে পড়লাম’! আবার ঝাঁঝালো
কন্ঠ কুন্তলার, ‘না না, তা কেন, তোমরা বাপ মেয়ে মিলে কোন পাত্রের সন্ধানে আছ, সে কি
আমি জানিনে ভেবেছ? তবে আমিও বলে রাখলাম, আমার অমতে আমার মেয়েকে বিয়ে দেওয়া আমি কোনমতেই
মেনে নেবো না, দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দেবো’। বেগতিক দেখে আন্না বোন বিদায় নিল, তবে যাবার
আগে আঁচলের খুঁটে বেঁধে নিল কিছু। বিনে পয়সায় পরামর্শ দেবার দায় পড়েনি তার। মনস্বিনী
তার বইপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অনঙ্গবাবু বেরিয়ে গেছেন নিজের কাজে। নিরুপায় কুন্তলা
বোনকে বিদায় দিয়ে ঢুকে পড়ল রান্নাঘরে। আন্না বেশ গলা উঁচিয়েই বলে গেল, ‘দরকার পড়লে
আমায় ডাকিস দিদি’।
ডাকতে হল না, নিজের
তাগিদেই একদিন আন্না হাজির হল কুন্তলার বাড়িতে। সঙ্গে তার বর। তিনি আবার একটি রাজনৈতিক
দলের দাদা গোছের। মনস্বিনী ফেরেনি তখনো কলেজ থেকে। অনঙ্গ সান্যাল ঘরেই ছিলেন সে সময়।
আন্না আর তার বর দুজনেই প্রাণপণ চেষ্টা চালালো
অনঙ্গবাবুকে বুঝিয়ে তাঁর সম্মতি আদায় করতে
যাতে তাদের পছন্দ অনুযায়ী ছেলের সঙ্গে মনির বিয়েটা ঘটিয়ে দেওয়া যায়। বারবার তারা একই
কথা বলে তাদের কথার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইল যে, বৈশ্বানর আর মনস্বিনীকে নিয়ে
যে কথা কলেজ ক্যাম্পাসে চাউড় হয়েছে তার কিছুটা হলেও তো সত্যি। আজকের ছেলেমেয়েদের মনের
খবর দেবতারাও জানেন না, মা-বাবা তো দূরের কথা। অনঙ্গবাবু তাদের বোঝালেন, মনস্বিনী তেমন
মেয়েই নয়, তা ছাড়া কে কি বলে বেড়ালো তাতে কান না দিলেই হল! তিনি একথাও বললেন, ‘মনি
এখন প্রাপ্তবয়স্কা, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে দিয়ে জোর করে কিছু করাতে গেলে সেটা হবে আইনের চোখে অপরাধ’। কথাগুলো
বলেই অনঙ্গবাবু বেরিয়ে গেলেন কোন কাজে। কুন্তলার সারা শরীর তখন জ্বলে যাচ্ছে রাগে।
ঝাঁজিয়ে মনের আক্ষেপ প্রকাশ করল কুন্তলা, ‘দেখ তোরা, কি মানুষ নিয়ে ঘর করি আমি, মেয়ে
যখন অজাত কুজাতের কারো গলায় মালা দিয়ে বলবে, বাবা, এই তোমার জামাই, আশীব্বাদ করো, তখন
বুঝবে, কাঙালের কতা বাসি হলে খাটে’। আন্না মাথায় টোকা মেরে বলে উঠল, ‘এই দিদি, মাথায়
একটা ফন্দি এসেছে, শুনবি চল’। বরকে চোখ মটকে
বলল, ‘এই তুমি বস একটু, আমি আসছি ভিতর থেকে’।
ফন্দির কথা সবিস্তারে
শুনে তো কুন্তলা আহ্লাদে আটখানা। বলল, ‘কবে, কি করে করবি ঠিক করে নে, আমার পুরো সায়
আছে’। আঁচলের খুঁটে নোটদুটো বাঁধতে বাঁধতে বলে গেল আন্না, ‘দেখিস দিদি, মনি আর জামাইবাবু
যেন ঘুণাক্ষরে না জানতে পারে’।
(ক্রমশ)

0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন