কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

শুভ্র মৈত্র

 

সমকালীন ছোটগল্প


মানুষটির পকেটে চাঁদের আলো ছিল

 

-- যারা যারা দেখেছে, কথা বলেছিল ওর সাথে, তাদের তালিকা প্রস্তুত?

-- সে তালিকা বড় দীর্ঘ। প্রস্তুতির কাজ চলছে।

-- ওরা জানে না বিনা অনুমতিতে বহিরাগত কারও সাথে সাক্ষাত আইনবিরুদ্ধ?

-- সাময়িক বিস্মৃত হয়েছিল এই নিয়ম।

-- প্রথম দেখা গেছিল কখন?

-- কী করে বলি, খিদিরপুরের নসু শেখ যখন দেখেছিল, তখনও নাকি সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েনি।

-- তাহলে দুপুর বলো!

-- হতে পারে, কিন্তু নসুর কি মাথার ঠিক আছে! কী দেখতে কী দ্যাখে! বলে কিনা লোকটার মাথার ঝাঁকড়া চুলে নাকি সব রোদ শুষে নিয়েছিল। দুপুরও কেমন মোলায়েম হয়ে নেমেছিল পাকুড়ের গা বেয়ে।

-- আর কেউ ছিল না?

-- ছিল না আবার? সুলতানার মা তিন বাড়ির কাজ সেরে আঁচলের তলায় ভাত-তরকারি নিয়ে যাওয়ার সময় তো স্পষ্ট দেখলো।

-- সে তো অনেক মানুষই থাকে সে সময় রাস্তায়।

-- কী যে বলেন, এই চত্ত্বরের মানুষ যে সে নয়, তা তো একনজরেই বোঝা যায়।

-- কিছু বলেছিল সে?

-- সে শুনেছিল রথিপুরের কমল বৈরাগী। সে যখন আচমন সেরে খেতে বসবে তখনই নাকি মানুষটা যাচ্ছিল ওর উঠোন দিয়ে। আর বলেছিল, চলো এবার উঠি।

-- ডেকেছিল তাকে?

-- না, কমলের কথায় সে নাকি ডাক নয়, মন্ত্র উচ্চারণের মতো।

-- বেপাড়ার মানুষ দেখে ডেকে ওঠেনি সারমেয়র দল?

-- আটগাঁয়ের বিমান পালের রাস্তার কুকুরকে খাওয়ানোর শখ। মানুষটিকে দেখে নাকি সেই কুকুরের দল শুধু আনুগত্যের ভঙ্গিমা করেছে, লেজ নেড়ে জানিয়েছে তাদের স্বীকৃতি।

-- কীরকম বয়স হবে ওর?

-- বোঝা যায় না। মাটি-কাদা আর আকাশের সাথে দীর্ঘ সহবাসে শরীরে আর বয়সের দাগ নেই। সকলেই তাঁকে বন্ধু ভেবে বসেছিল।

-- পোশাক?

-- পরনে ছিল তুঁত রঙের জামা।

-- ভিখারী? কিছু চাইতে এসেছিল?

-- লোকটা যে গরীব তা বোঝার উপায় কী? লোকমান চাচা তো স্পষ্ট দেখেছে জামার পকেটে সে চাঁদের আলো নিয়ে ঘুরছে।

-- বহিরাগতদের জন্য যে এ নগরে নিষেধাজ্ঞা আছে, জানতো না ও?

-- চলনে কোনও অনাহুতের সংকোচ ছিল না। অবলীলায় পার হয়েছে সড়ক, মাঠ, জলাশয়। দুই একটি পাখি যারা এখনও এই নগরে ভাগশেষের মতো পড়ে আছে, এসে বসেছিল ওর কাঁধে, ওর রাস্তার ধারে।

-- আর কেউ দেখেছে?

-- বসাক বাড়ির মেয়েটা এখনও নিয়ম করে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। স্বরলিপি দেখে গাইছিল ‘সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো...’। লোকটা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আকাশ জুড়ে এই ভরা ভাদ্রেও শ্রাবণ এলো। বৃষ্টিতে ভিজে গেল গীতবিতানের আবছা পথ।

-- এই সুরক্ষাবলয় ভেদ করে প্রবেশ করলো কীভাবে?

-- জানি না, তবে প্রহরীর দল ব্যস্ত হয়েছিল খবরে কান পাততে, --‘সোমবার বৃষ্টি হবে না, কারও মনখারাপ হবে না, বলেছে আবহাওয়া অফিস’। ভাড়া চাইবার কথা ভুলেছিল গাছের ছায়া। ওদের বিস্মৃতি ক্ষমার অযোগ্য।

-- পরিচালনের নীতি নির্ধারিত হয়েছে দীর্ঘ অনুশীলনের শেষে। সামগ্রিক মঙ্গলকামনার দায় শুধু শাসকের। অনুকম্পা প্রার্থনা আর স্তাবকতা ছাড়া নগরবাসীর কোনও অভিব্যক্তি রাজদ্রোহের সামিল। বহিরাগত কেউ শুধুই অনুপ্রবেশকারী। তার সান্নিধ্যে কলুষিত হয় সমাজ। ওরা জানে না তা?

-- জানে। দীর্ঘ অভ্যাসে জানে। কিন্তু যারা ওই মানুষটাকে দেখেছিল, বা দ্যাখেনি, শুধুই শুনেছিল ওর আসার কথা, তাদের শরীরে, কী আশ্চর্য, কোনও সংকোচের কাদা লেগে ছিল না। ভয়, যা ছিল তাদের অচ্ছেদ্য অলঙ্কার, সহসাই তা অন্তর্হিত।

-- কী বলছে তারা?

-- বলছে, ওদের সমবেত উচ্চারণে, চলো এবার উঠি, উপসংহারের পাশে দাঁড়াই চলো!

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন