কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

ডেভিড ড্যাবিডিনের কবিতা

 

প্রতিবেশী সাহিত্য

ডেভিড ড্যাবিডিনের কবিতা

(ভূমিকা ও ভাষান্তর: গৌরাঙ্গ মোহান্ত)

 


কবি পরিচিতিঃ গায়ানার মৃত্তিকারসে পুষ্ট ব্রিটিশ কবি, ঔপন্যাসিক ও সমালোচক ডেভিড ড্যাবিডিন উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের এক কালজয়ী কণ্ঠস্বর। তাঁর কবিতায় প্রতিভাসিত হয়েছে দাসত্ব, চুক্তিবদ্ধ শ্রম আর নির্বাসনের এমন এক ইতিবৃত্ত যা ভাষার তীক্ষ্ণতা ও মানবমনের অনুসন্ধিৎসার প্রভাবে নতুন কাব্যরসে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। ঔপনিবেশিক নথির নির্দয় বন্ধনে লুপ্ত অনেক কণ্ঠের পুনর্জাগরণ তিনি নিশ্চিত করেছেন—তাদের মর্যাদা, প্রেম, ক্রোধ ও মানবিক যন্ত্রণা স্বরময় হয়ে উঠেছে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ Slave Song (১৯৮৪) একাধারে প্রতিবাদের, স্মরণের এবং পুনর্জন্মের কাব্য।

ড্যাবিডিন আশ্চর্যের সাথে লক্ষ করেছেন যে ক্রেওল ভাষায় প্রায় কোনো কবিতা লিপিবদ্ধ হয়নি। তাই তিনি গায়ানার ইক্ষু খেতে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ শ্রমিকদের অকৃত্রিম কণ্ঠস্বরকে পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গায়ানিজ ক্রেওল ভাষায় রচিত Slave Song-এর সাথে তিনি যুক্ত করেন ইংরেজি অনুবাদ। আফ্রিকান, ফরাসি, স্প্যানিশ, ভারতীয় এবং ইংরেজির মিশ্রণে উৎপন্ন হয়েছে গায়ানিজ ক্রেওল ভাষা যা তাঁর কবিতার ছন্দ, অনুপ্রাস ও সংবেদনাময় শক্তিকে গভীরতা প্রদান করে। এ ভাষা এমন এক বিরোধপূর্ণ ক্ষেত্রকে উপস্থাপন করে যেখানে উপনিবেশিক ক্ষমতা ও সাংস্কৃতিক স্বর পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায়।

এ কাব্যে আফ্রিকান শ্রমিকদের ঘাম, রক্ত ও স্ফূর্তির ভেতর দিয়ে ক্যারিবীয় অতীত ভূদৃশ্য প্রকট হয়ে ওঠে।স্থানীয় ভাষার মাটির গন্ধ, মৌখিক ঐতিহ্যের ছন্দ, আর অন্তর্লীন শোকগাথার রাগে Slave Song বিস্মৃত স্বদেশ ও সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের আখ্যান হিসেবে উন্মোচিত হয়। ড্যাবিডিনের কবিতা কেবল দাসত্ব ও নির্যাতনের ইতিবৃত্ত নয়, টিকে থাকার অন্তরঙ্গ ইচ্ছা, ভালোবাসার ক্ষণস্থায়ী স্পর্শ, আর অন্ধকারের ভেতর জেগে থাকা মানবিক দীপ্তির কাব্য। Slave Song সযত্নে শোনায় সেই দূর অতীতের সুর, যেখানে শৃঙ্খল-ধ্বনির ভেতর অনুরণিত হয় অস্তিত্বের গভীরতর সঙ্গীত। কবিতাত্রয় এ কাব্য থেকে সংগৃহীত।

 

কুলি জননী

জাজমতি থাকে এক জীর্ণ কুটিরে,

যা বাটা জুতার বাক্সের মতো বড়।

সে কাপড় কাচে, উঠোনের আগাছা সাফ করে, কাঠ কাটে, মুরগিকে খেতে দেয়

এর জন্য, ওর জন্য, সবারই জন্য

সে জল আনে—সারাদিন ধরে জল আনে,

যেন পুরো ধীর-গতি কানজি নদীটি

ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন শুধু তার বালতির জন্যই।

 

তার পা ফেটে গেছে আর

হাত কেটে গেছে,

আর তার মুখ থেকে অভিশাপ ঝরে লাল পিঁপড়ের মতো

সে কাশি দিয়ে মাটিতে রক্ত ফেলে ,তবে তা ঘষে মিশিয়ে দেয়—

কারণ জাজমতির হৃদয় কঠিন,

তার মন শক্ত হয়ে গেছে।

 

সে রোজগারের চেষ্টা করে, একটি একটি করে পয়সা জমায়,

কারণ ময়লার প্রতিটি অংশ কানজির ওপর গড়ে তোলে বাঁধ।

তার ছেলে হরিলাল অবশ্যি পড়তে যাবে জর্জটাউনের স্কুলে।

তাকে পরতে হবে ঝকঝকে, মাড় দেওয়া প্যান্ট—

না হলে তাকে নিয়ে সবাই হাসবে।

তার পায়ে থাকবে চামড়ার জুতো, সে অবশ্যি পড়বে বই,

ঠিকঠাক কথা বলতে শিখবে, পরীক্ষা দেবে,

ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে,

কিন্তু এখন সে পরিণত হয়েছে তার রামখোর, চামার বাবার মতো।

 

কুলি পুত্র

(টয়লেট অ্যাটেনডেন্ট বাড়ির উদ্দেশ্যে লিখছে)

তানা ছেলে, কেমন আছো?

শান্তি কেমন আছে?

আর সুখু?

 

মশারা কি এখনও তোমাদের কামড়ায়?

 

জুনচা কি সত্যিই মারা গেছে?

 

মালার ভাঙা পা সেরেছে কি?

 

তোমাদের সকলের জন্য যথেষ্ট খাবার আছে তো?

 

ইংল্যান্ড সুন্দর—তুষার পড়ে আর নানান দৃশ্য,

বলা হয় এ নাকি রাজার উপযুক্ত দেশ!

গাছে গাছে আপেল, পাখিরা গান গায়—

এটাই নাকি তাদের বসন্তের শুরু।

 

আমি এখানে ভালোই খাচ্ছি, আমাদের সবার জন্য যথেষ্ট,

আর অনেক বইও পড়ছি।

 

কিন্তু বলো তো—মাতামের বউ কেন অসুস্থ হলো?

আর সোনেলের গাভির দুধ কি এঁটুল চুষে শেষ করেছে?

 

শিগগিরই আমি আইনজীবী বা ডাক্তার হয়ে যাব,

তবে এখন একটু পথের খরচ ফুরিয়ে গেছে।

 

তাই ছোট একটা কাজ নিয়েছি—

আমি ডেপুটি স্যানিটারি ইন্সপেক্টর!

বড় বড় অফিস, ছেলে!

আমার গলায় টাই ঝুলে আছে!

একদম নতুন ইউনিফর্ম, আর চাবির একটা গোছা!

মা যদি এখন আমাকে দেখতেন,

কী আনন্দই না তার হতো!

 

দাসের গান

বেঁধে দাও আমার হাত।

খুঁচে বের করো আমার চোখ।

টেনে তোলো দাঁতগুলো—

যেন আমি কামড়াতে না পারি।

গলায় পরিয়ে দাও শিকল।

শক্ত করে বাঁধো আমার পা

তোমার কুকুরগুলোকে রাখো আমার পাহারায়

সমস্ত রাত ধরে।

 

কিন্তু তুমি থামাতে পারবে না সোনার খনিতে আমার বীজের স্রোত,

থামাতে পারবে না সূর্যালোকে আমার বীজের ঔজ্জ্বল্য!

 

চাবুক মারো যতক্ষণ না রক্ত ঝরে,

যতক্ষণ না আমি অনুনয় করি।

আমাকে জন্তু বলে ডাকো—

আফ্রিকার ওরাংওটাং,

বলো আমি নরখাদক,

যার উপযুক্ত পরিণতি কসাইখানা বা ফাঁসি।

কেটে নাও একটি ঠোঁট,

একটি কান, একটি পা

 

কিন্তু মধুপাত্রে নিমজ্জিত হতে তুমি থামাতে পারবে না আমার বীজকে,

ডগায় টপটপ করে ঝরছে, হটেনটটের মতো আনন্দে উচ্ছ্বসিত !

 

দেখো কেমন লাফায় সে, ঝোপ থেকে ঝোপে— কালো ব্যাঙের মতো,

জলাশয় খোঁজে,

সূর্যের ঝলকে অন্ধ, জিভ তার ধুলোর বাটি—

দেখো কীভাবে সে পান করে দীর্ঘ সময় ধরে, ধীরে, গভীরভাবে,

যতক্ষণ না ফুলে ভারী হয়ে ওঠে, একগুঁয়ে, বোকা ও ঘুমন্ত,

যেন কুমির গিলে ফেলেছে এক বাছুর, ঘাসের ওপর প্রসারিত,

তৃপ্ত হয়ে শুয়ে আছে, পূর্ণ প্রশান্তি নিয়ে জবা ফুটেছে, ঠান্ডা বাতাস বইছে,

এবং পাহাড় থেকে জলধারা নামছে,

আর ক্যানারি পাখি গাইছে কোমল, নিচু স্বরে।

 

এমনই হয় যখন তুমি স্বপ্নে দেখা শেষ করো তার গোলাপি স্তন

তার যৌনতার টোটেম-খুঁটি,

তার গলায় রেখে যাও উল্কির মতো তোমার দাঁতের দাগ!

 

সে দিয়েছে আমাকে ভাবনা,

সে দিয়েছে স্ত্রী,

তাই ছিঁড়ে ফেলো আমার যকৃত,

অথবা বিদ্ধ করো আমার হৃৎপিণ্ড

এখনও রয়েছে আমার জীবন!

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন