কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

ছেঁড়া শেকড়ের অন্তরাখ্যান


 

(৮)

এপার ওপার স্মৃতিময় একাকার সাঁকোটা দুলছে

‘প্রভাতে যোস্মরেন্নিত্যং মা দুর্গা দুর্গাক্ষরদ্বয়ম্।

আপদাস্তস্যনশ্যন্তি তমোসূর্যোদয়ে যথা।

আবৃত্তি করছিলেন কালীকিঙ্কর, রোজই করেন। প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙে, ব্রাহ্মমুহূর্তে। রাতের অন্ধকার কাটে না তখনও। এই অভ্যাস তাঁর বরাবরের। পূর্ববঙ্গে দেশের বাড়িতেও এমনই সময় জাগতেন। তারপর বেরোতেন বাগান পরিদর্শনে। তখন সূর্য আকাশে সদ্য দু-চারটে আঁচড় কাটতে শুরু করেছে। পাখপাখালি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দিনের সংগ্রহে। সুপুরি গাছগুলো সোজা হয়ে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ভোরের অপেক্ষায়। কালীকিঙ্কর খড়ম ঠুকঠুক করে চলে যেতেন বাগানের শেষপ্রান্তে, ইঁদারায়। জায়গাটির অল্প অংশ গোল করে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। কপিকল ঘুরিয়ে বালতিতে জল তুলে স্নান করতেন। যেদিন ইচ্ছে হত চৌহদ্দি পেরিয়ে চলে যেতেন বাড়ির পশ্চিমদিকের পুকুরে। এজমালি পুকুর খুব বড়ো নয়। ঘাটের কাছটা কাদা কিচকিচ করত। আগাছার ঝাঁক, জোঁক, পোকামাকড়, জলফড়িং। সেসব পেরিয়ে দু-হাতে কচুরিপানা সরাতে সরাতে চলে যেতেন মাঝখানে যেখানে টলটলে আরামদায়ক জল। তরুণ সূর্যের লাল প্রতিফলন এসে পড়েছে জলে। তিনি আর্দ্র শরীরে চোখ বুজে স্তবপাঠ করতেন,‘ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্। ধ্বন্তারিং সর্বোপাপোঘ্নম্ প্রণতোহস্মি দিবাকরম্। তারপর নিজের দক্ষিণ তর্জনী দিয়ে কপালে দুর্গানাম লিখে নিতেন। মনে হত সারাদিনের মতো সবরকমের দুঃখ-দুর্দশা থেকে রক্ষাকবচ আঁকা হয়ে রইল। স্নান সেরে ঘরে যেতেন, পুজো করতেন। জলখাবার খেয়ে গিয়ে বসতেন তাঁর নিজস্ব চেম্বারে।

দেশ ছেড়ে আসার পর সব ভেসে গেল, হারিয়ে গেল বরাবরের মতো। এশহরে আসার আগে কল থেকে জল পড়া দেখেননি। কিছু বিশিষ্ট অঞ্চল বাদ দিলে তাঁর জন্মভূমিতে তখনও তেমনভাবে প্রচলিত হয়নি। এখানে কলে টাইমের জল আসে, উঠোনের মস্ত চৌবাচ্চা ভরে ওঠে। যে যার বালতিতেও ধরে রাখে। আর একটু বেলা বাড়লে বাড়ির বাইরে রাস্তার কলে জল আসে। সেখানে লম্বা লাইন, চেঁচামিচি, ঝগড়া, হাতাহাতিও। এসব কানে গেলে বিরক্তির উদ্রেক হয়। মাথায়-গায়ে জল ঢেলে ভেজা শরীরে অন্ধকারে সূর্য খোঁজেন কালীকিঙ্কর। শীতকালে সূর্য উঠতে দেরি, তাছাড়াও বড়ো বড়ো ইমারতের পেছনে আড়াল হয়ে যায়। অস্থির মন শান্ত করে তিনি পুবমুখী হয়ে দাঁড়ান। প্রণামের ভঙ্গিতে মন্ত্রপাঠ করেন মৃদুস্বরে, আগের মতো গলা ছেড়ে নয়। কপালে দুর্গানাম লেখেন, চিরকালের অনড় বিশ্বাস নিয়ে। সমস্ত অন্ধকার সরে গিয়ে আসবে সুদিন। তাঁর ওঠার সামান্য পরে দিবাকর ওঠে। তাকে সকালে বেরোতে হয় কারখানার জন্য। কনকপ্রভাও ওঠেন ছেলের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। ছোটো একটা পাম্পস্টোভ কেনা হয়েছে। কালীকিঙ্কর অবশ্য একেবারে এই স্টোভের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁর ক্লিনিকে দু-চারটে পাম্পস্টোভ অ্যাকসিডেন্টের কেস এসেছে। কনকপ্রভা খুব জেদী। এত ভোরে উনুনের ধোঁয়ায় প্রতিবেশীকে জানান দিয়ে জোগাড়যন্ত্র করতে তাঁর রুচিতে বাধে। হিন্দুস্থানী পরিবারের মানুষজনও ভোরে ওঠে। পরনের কাপড় গুটিয়ে চৌবাচ্চা  থেকে জল তুলে স্নান করে। তারপর ছাতু আর আচারের পোঁটলা নিয়ে বেরিয়ে যায় কাজে। কনকপ্রভা ছেলেকে গরম ভাত বেড়ে দেন আলুভাতে, ঘী, আগের দিনের মাছ বা তরকারি দিয়ে। দিবাকরের মুখের দিকে তাকালে বুক ভেঙে যায়। প্রতিদিনই মনে হয় ছেলে বুঝি রোগা হয়ে যাচ্ছে। সেই অনুযোগ করে দু-হাতা ভাত বেশী দিতে চান, সে হেসে উড়িয়ে দেয়। মেধাবী ছেলে তাঁদের, অনেক স্বপ্ন ছিল চোখে। সব ভেঙেচুরে গেছে। দিবাকর বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে গলির মুখ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ান দু-জনে। বড়ো মায়া কালীকিঙ্করের একমাত্র ছেলের জন্য। তিনি জানেন, পিতা হিসাবে ভবিষ্যতে শুধু মনের জোর আর লড়াইয়ের শক্তিটুকু দিয়ে যাওয়া ছাড়া ছেলের জন্য প্রায় কিছু রেখে যেতে পারবেন না। বরং দিবাকরকেই তাঁদের দায়িত্ব নিতে হবে। একের পর এক বিপর্যয়ে বেশ কয়েক বছর নষ্ট হয়েছে। তার মনও লেখাপড়া থেকে সরে গিয়েছিল। সে চাকরি পাওয়াতে তিনি আপাত-নিশ্চিন্ত। ছেলের গায়ের রঙ, গড়ন-গঠন প্রায় তাঁর মতো, মুখের ভাব কনকপ্রভার। গত ক-মাস ধরে কনকপ্রভার আগ্রহে বেশ ক-টি বিবাহের সম্বন্ধ আসছে দিবাকরের জন্য। দিবাকরের মত নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। সে নির্লিপ্ত, হ্যাঁ বা না কিছুই জানায় না। বিয়ের ব্যাপারে অনেক ভাবনাচিন্তার দরকার। পশ্চিমবঙ্গীয় পরিবারের মেয়ে পরিবারে আসার প্রশ্ন নেই। খাওয়া-দাওয়া, রীতকর্ম, চলনবলন সমস্ত আলাদা। তারাও নিজেদের আলাদাই রাখে। তাদের দেশ কাটা পড়েনি, তাদের ভাগ্যে অনিশ্চিতের আঁচড় পড়েনি। বাস্তুভিটে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরের জিম্মায় ছেড়ে যেতে হয়নি কোনও অচেনা শহরে। পূর্ববঙ্গ, যাকে দেশভাগের পর বলা হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান, সেখানেও অনেকগুলো জেলা। খাওয়া-দাওয়া ও ভাষার বিভিন্নতা আছে। তা সত্বেও যেন একপ্রকার সমব্যথায় জারিত নাড়ির টান। দু-একটা কথার পর ‘আপনের কুন জিলা আছিল?’ প্রশ্নের মধ্যে উঠে আসে আন্তরিকতা। তারপর মশগুল হয়ে যাওয়া, কী কী ছিল, কী ফেলে এসেছেন। সঙ্গে এখানে, এশহরে মাটি কামড়ে পায়ের নীচে জমিটুকু তৈরি করার প্রয়াস করতে করতে ভবিষ্যতে সেখানে ফিরে যাওয়ার সঞ্চিত ক্ষীণ আশা। ‘কেডা জানে, গিয়া কী দ্যাখতে অইব? আমিনুল্যারে কইয়া আইছিলাম, দেইখ্যা রাইখ্য। অহন আসি গিয়া, তয় ফিরা আমু নিশ্চয়।

সম্বন্ধের খোঁজ আসছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। মন্দিরের পুরোহিত, বাড়ির দালাল, মুদীখানার মালিক, বাড়ি-বাড়ি গিয়ে শাড়ি-বিক্রেতা – এমন অনেকের কাছে জানাশোনা পাত্রপাত্রীর খোঁজ থাকে। অনেকে শুধু ঘটকালি করে, সঙ্গে কোষ্ঠীবিচারের কাজও সারে। তেমন এক ঘটক কালীকিঙ্করকে বেশ ক-টি সম্বন্ধের খোঁজ দিয়েছেন। চিঠি বা চিরকুট প্রথমে কনকপ্রভাকে দিয়েছেন, তারপর স্বামী-স্ত্রী মিলিতভাবে বাছাই করছেন। দেশ, জাতি, বংশ, পারিবারিক পেশা কী ছিল, বাবা কী করতেন, ভাইবোন ক-জন ইত্যাদি মুখ্য বিষয়ের তথ্য সন্তোষজনক হলে, কন্যার বয়স, চেহারা, শিক্ষা। সে অংশ মনঃপুত হলে রাশি, নক্ষত্র, গণ মিলিয়ে পাত্রপাত্রীর কোষ্ঠীবিচার। সকলের না হলেও অনেক পিতা তাঁদের কন্যার স্টুডিয়োতে বসে তোলা সাদা-কালো ছবি পাঠিয়েছেন। দিবাকর এত খবর জানে না। তার যে কোষ্ঠী করিয়েছিলেন তার মাতামহী, সেই খবরও জানেনা। কোষ্ঠী, ভাগ্যরেখা ইত্যাদিতে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই।

কালীকিঙ্করের চেম্বারে একজন অর্শের রোগী আসে, চূনীলাল সাহা। বড়বাজারে সোনার ব্যবসায়ী, পাথর-টাথর ধারণ করে ব্যবসা বেশ উঠতির দিকে। কালীকিঙ্করের চিকিৎসায় অর্শের যন্ত্রণাও খানিক নিয়ন্ত্রণে। কালীঘাটের ভোলা চক্কোত্তি নামে এক পাণ্ডার সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছিল। সম্প্রতি ভোলা চক্কোতি একটি পাত্রীর সন্ধান দিয়েছে। পারিবারিক বর্ণনার চিরকুটের সঙ্গে কন্যার একখানা ফোটোও এসেছে। একঝলক দেখলেন ফোটোখানা, সরল, সুন্দর, লাবন্যমাখা মুখ। তারপর কনকপ্রভার কাছে জমা দিলেন।

‘উপনিবেশ ইংরাজিতে কলোনি। Oxford English Dictionary লিখিয়াছে, "colony" referred to a body of people who settled in a distant, foreign country while maintaining ties to their homeland, and the territory or community they established…।

উপুড় হয়ে শুয়ে ডায়েরি লিখছিল দিবাকর। কারখানা থেকে দিনদুই ছুটি নিতে হয়েছে, জ্বর হয়েছিল। কালীকিঙ্কর ওষুধ দিচ্ছেন। শরীর এখনও সম্পূর্ণ সারেনি। অলস সময়ে তোড়ের মতো আসা ভাবনাগুলো সে দ্রুত লিখে ফেলতে থাকে। বাড়ির বাইরে কথা বলার সময়ে জন্মভূমির কথ্যভাষার টান থেকে অনেকটা মুক্ত হতে পারলেও লেখার ভাষাতে সাধু-চলিত মিশে যায়। সে অবশ্য এবিষয়ে সতর্ক থাকার চেষ্টা করে।

‘এই শব্দের অর্থ ক্রমাণ্বয়ে রাজনীতিক ও সমাজচিত্র বদল হইবার সঙ্গে বদল হইয়াছে। ইয়োরোপীরা একদা পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের অঞ্চলসমূহ জয় করিয়া তাদের ক্ষমতার নিশান দাখিল করেছিল। তারা কখনও বিজিত দেশের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয় নাই। নিজেদের বিজেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়া, নিজের দেশের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার অনুকরণে নিজেদের সুবিধার্থে বিজিত দেশের বনজঙ্গল কেটে, ভূমির সংস্কারাদি করিয়া, বাড়িঘর, পথঘাট, যানবাহন, কলকারখানা তৈরি করেছিল। বিজিত দেশের নিয়ন্ত্রণ রহিল বিজেতা দেশের হাতে। সে দেশ হইতে মানুষ আসিল খবরদারি করিতে আর বিজিত দেশের মানুষ পরাধীন হয়ে তাদের পায়ের জুতোর নীচে আর্তনাদ করতে করতে শ্রমসাধ্য কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। ইতিহাসের এই ছবির ব্যতিক্রম হয় নাই।

বিদেশী শাসকের দখলমুক্ত আমাদের এই দেশ কী পেল? স্বাধীনতা আমাদিগকে কী দিল? শান্তি? আশ্রয়? আর্থিক উন্নতি? না কি আরও দুঃখ তথা দারিদ্র? সহায়সম্বলহীন যে সকল মানুষ এই বৃহৎ মহানগরীতে আসিয়া পৌঁছাল, তাহাদিগের জন্য কেহ আরামের শীতলপাটি বিছাইয়া রাখে নাই। না কেন্দ্রীয় সরকার না রাজ্যের সরকার – কাহারও শিরোবেদনা নাই। মানুষগুলি উদ্বৃত্ত, তারা দেশের বোঝাস্বরূপ। ইহাদের কতজন দেশত্যাগ করিয়া আসতে চাহিয়াছিল? যতই দরিদ্র হোক, মাথার উপরে একখানা ছাদ, পায়ের তলায় পিতৃপুরুষের আশীর্বাদে একটুকরা জমি ছিল। গাছের সবজি, ফলফলাদি, পুকুরের মাছ – সঞ্চয় করিতে না পারিলেও পেট ভরিয়া দুইবেলা খাদ্য জুটিতে অসুবিধা হয় নাই। আর যাহারা সচ্ছল ছিল, পৈতৃক সংস্থান ছিল, মেধা ছিল, অধ্যয়ন ছিল, তাঁহারা যথেষ্ট সুখী ছিলেন। জানিতেন সমস্ত দেশ তাঁহার দেশ, ইচ্ছা হলে আসা-যাওয়া করিতে পারিবেন এমন মনোভাব নিয়া ছিলেন। আমার মাতাপিতা তাঁদের পৈতৃক বাসা ছাড়িয়া আসবার চিন্তা কদাচ করেন নি। তাঁদের সচ্ছলতা ছিল, জনবল ছিল, আভিজাত্য ছিল। আমি পিতার অনুমতিসাপেক্ষে উচ্চশিক্ষার নিমিত্ত স্বেচ্ছায় এসেছিলাম। বাবার অর্থবল ছিল, আমার অর্থের যোগানে ঘাটতি পড়ে নাই। আমার পূর্বেও বহু শিক্ষার্থী এই শহরে আসিয়াছে। নতুন কলকারখানা, কর্মসংস্থান, প্রতিষ্ঠার সুযোগ পূর্বতরপ্রান্তের মেধাবীদের আকর্ষণ করিয়াছে। তাহারা অনেকে স্বেচ্ছায় ফিরিয়া যায় নাই। নিজের দেশ ভাবিয়া বিভিন্ন প্রান্তে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু কেহই ভাবিতে পারে নাই, ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা আসিয়া আমাদের নিশ্চিন্ত সুখটুকু এইভাবে কাড়িয়া লইবে।

গত কয়েক বৎসর ধরে যে ‘কলোনি গড়িয়া উঠিয়াছে তাহা কোনো অর্থেই গৌরবময় উপনিবেশ নয়। বিনা অর্থে জমি দখলদারির দ্বারা ঠাসাঠাসি করিয়া মাথা গুঁজিবার আলোহীন, অপরিষ্কার, অনুন্নত আবাসের সমষ্টি। এখানে দৈনন্দিন সংগ্রাম তুলনাহীন, আমাদের তুলনায় অনেক ভারী। আমার মাতাপিতা ‘কলোনি’তে সুবিধাদরে জমি পাইলেও তত্র বাস করা সম্মানজনক বলিয়া মনে করেন না। তাঁদের নিকটে বরং ভাড়া গণিয়া বাসা লওয়া শ্রেয়। এই আশা পোষণ করেন যে অদূর ভবিষ্যতে সম্মানের সহিত স্বীয় বাসগৃহ নির্মাণ করিতে পারবেন।

লেখা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে শুল দিবাকর। পরের দিন এমনিই ছুটি, ভোরে ওঠার তাড়া নেই। শরীর কিছুটা ভালো লাগলে পার্টির ছেলেদের সঙ্গে গোপনে দেখা করে আসার পরিকল্পনা মাথায় ঘুরছে। অতিকষ্টে পার্টির ক্যাডার লিস্ট থেকে নিজের নাম সরাতে পেরেছে। কিন্তু নিজের পরোক্ষ সমর্থন ও যথাসম্ভব সাহায্য করার গোপন প্রতিশ্রুতি রেখেছে নিজের কাছে। তার ভবিষ্যতের সঙ্গে তার বাবা-মার স্বাচ্ছন্দ্য যুক্ত। মার আগ্রহে কিছুদিনের মধ্যেই নতুন একজন তার জীবনে আসবে। তার প্রতিও দায়বদ্ধতা আছে।

নিঃশব্দে শুয়ে থাকে সে। রাত বেশী নয়। তাদের এজমালি ভাড়ার বাড়ির মানুষজন ফিরছে কাজ সেরে। বাড়ি এখন সরব। ঠাসঠাস করে জানালা-দরজা খোলাবন্ধ হওয়ার শব্দ, রাতের রান্নার ঝাঁঝ, হাসাহাসির মিলিত শব্দ। এসবে তার মা অত্যন্ত বিরক্ত হন। কিন্তু তার বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয় না। সে নিজে অবশ্য আরও খানিক দেরীতে ফেরে, তখন এই হট্টগোল অনেক থিতিয়ে যায়। কলকাতায় সে এসে প্রথমে মেসে থেকেছে, পরে কিছুদিন দূর সম্পর্কের কাকার বাড়িতে। বছরদেড়েক প্রেসিডেন্সি জেলে কাটানোর অভিজ্ঞতা সে মা-বাবাকে বলেনি।

দিনদুয়েক আগে আধো-জাগ্রত অবস্থায় কনকপ্রভা ও কালীকিঙ্করের নিভৃত কথোপকথনে বুঝেছে আবার নতুন সম্বন্ধ এসেছে। এর আগে অনেকগুলো নাকচ করা হয়েছে। কয়েকটি দেখতে গিয়েছিলেন ওঁরা, কয়েকটি না দেখেই কোনও কারণে বাতিল করেছেন। কনকপ্রভার খুঁতখুঁতুনি অনেক বেশী। ধনী পরিবারের কন্যা, সচ্ছল পরিবারের বধূ। জাতি, রাশি, বর্ণ মিলে গেলেই হতদরিদ্র পরিবার থেকে পুত্রবধূ আনার মতো উদার হতে পারেন না। তবে সম্প্রতি যে সম্বন্ধ এসেছে, ফোটো দেখে আগ্রহ জেগেছে তাঁরও। কালীকিঙ্কর বলছেন,

মুখখান য্যান লক্ষ্মীপ্রতিমা। রঙও গৌরবর্ণই মন লয়।

হ, তুমারে কইয়া দিছে। ফটোক দেইখ্যা গোরা-কালা বোঝন যায়? না লক্ষ্মী পেত্নী চিনন যায়?”

হের লাইগ্যাই কইতাছি, চল গিয়া দেইখ্যা আসি।

কুন জাগাত য্যান বাসা কইলা? কেমন যাইবা অদ্দূরে? বাসে বইয়া? বাসে বইলে আমার প্যাট পাকাইতে থাকে। ভাতগুলা বমি অইয়া যায়। তুমি হরলাল ঠাউরপোরে লইয়া যাও। মাইয়ার বাপে কী করে?”

শিক্ষক আছিল লেখছে। পাত্রীর দুইভাই চাকরি করতাছে। দিদির বিয়া অইয়া গ্যাছে। ছুট পরিবার।

মাইয়া লিখাপড়া শেখছে? বয়সটা য্যান একটু বেশী লাগে!”

বি-এ পরীক্ষায় বইছিল। একটা বিষয়ে ব্যাক পাইয়া আর পরীক্ষা দিল না।

রিপুজি কুলোনিতে বাসা কইলা! হেই জাগাত নি ভদ্দরলুকে বাসা করে? শুনছি বনজঙ্গল, হাওয়াবাতাস নাই! মাইয়ার স্বভাবচরিত্র ক্যামনে জানবা?”

রও এক কাম করি, আগে কুষ্ঠী মিলাইয়া লই। মিল্যা গ্যালে মাইয়া দ্যাখতে যামু। তুমি বাসে না যাইতে পার, ট্রামে যাইবা। ট্রামে প্যাট পাকাইব না। হরলাল আর বউমারে সঙ্গে লমু।

কথাগুলো মনে করে চোখ বুজে মুচকী মুচকী হাসছিল দিবাকর। গতকাল কনকপ্রভা তাকে পাত্রীর ফোটো দেখিয়ে আবার নিয়েও গেছেন। সে মুখখানা মনে করার চেষ্টা করতে করতে ঘুম এসে গেল।

(ক্রমশঃ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন