ধারাবাহিক উপন্যাস
সত্যান্যাস
(পর্ব ৮)
অথবা
গোদার দেখে ৭৮৬টি মনোলগ
একটি বৈদান্তিক ভোগবাদ বিরোধী
উপন্যাস
A social media collage
যে বাজার থেকে মুক্ত সে মুক্ত
আমার
পাশ্চাত্য চিত্রকলার ইতিহাস সাম্বন্ধিক বালখিল্য ধারণাবলী
আমি
আমার শিষ্য (যেই আসলে আমার গুরু) দ্বারা আদিষ্ট হয়ে ওয়েস্টার্ন আর্ট হিস্ট্রি চর্চায়
বুঁদ হয়ে গেলাম। জোগাড় করলাম The Great Artist series-এর খান ৬০এক বই। করলাম Udemy
থেকে আর্ট হিস্ট্রি কোর্স। ইজমগুলো আমি আগেই জানতাম। ISMS বলে একটি বই আরো সাহায্য
করল। ধীরে ধীরে জানলাম এক এক শিল্পীর সিগনেচার (যদিও সিগনেচার শিল্পীর শেকল কিনা জানি
না)। একসময় কিচ্ছু না জানা অবস্থায় ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন হিরণ মিত্র। মূলত দীপক মজুমদারের “ছুটি”কে ভিত্তি
করে। পরে আলোচনা করলাম আর্টে মাস্টার্স করা অনুজবন্ধু শোভনের সঙ্গে। অত্রি আমার হাতে
ব্রহ্ম-অস্ত্র তুলে দিল BOSCH-এর পেইন্টিং-এর বই। আমি জানলাম প্রাইমারি কালার ব্যবহার
করা বারণ। আমি জানলাম টুকটাক খুঁটিনাটি। ওয়েস্টার্ন আর ইণ্ডিয়ান পারস্পেক্টিভের পার্থক্য।
তাদের জলবায়ুর পার্থক্যে কাজের তথাৎ। তবুও আমাকে ছবি দেখতে শেখালও ফেসবুক ফিডে আসা
প্রিয় শিল্পী ও অপরিচিত শিল্পীদের ছবিরা আর তার নিচের কমেন্ট আর AI explanation। এখানেও
আমাকে ছবির শিক্ষক ফেসবুক। জার্নি শুরু সেখান থেকেই। ছবির চর্চা আমি করলাম হরাইজেন্টালি,
ভার্টিকালি নয়। অর্থাৎ প্রচুর ছবি দেখলাম। দু চারটি নিয়ে গভীর গবেষণায় গেলাম না। এখনও
সে সময় আসেনি। এ উপন্যাসে ব্যবহৃত সব ছবি ফেসবুক থেকেই নেওয়া, বা বলা ভালো আমার ফিডে
এসেছে, আমি শেয়ার করে রেখেছি আমার ওয়ালে, পরে প্রয়োজনে ফিরে দেখব বলে, ডায়েরির মতো,
এখানে ব্যবহার করে দিলাম। এছাড়া আমি ছবি বিষয়ে আর কিচ্ছু জানি না। কিছু কিছু শিল্পীকে
আমার বাই ডিফল্ট ভালো লেগে এসেছে। কেন আমার চেতন জানে না। কিছু কিছু শিল্পীকে ভালো
লাগে না। যেমন পিকাসো! কেন লাগে না, লাগা তো উচিত, আমি জানি না। পিকাসো যে সর্বতোভাবে
যৌন এ আমি সোচ্চারভাবে মানি না। তার বহু কাজে আমি যৌনতা উগ্রভাবে কেন, সূক্ষ্মভাবেও
পাইনি, সাদার কোমল তন্দ্রায় তাকে পেয়েছি। আবার একেবারে কিছু কিছু কনটেম্পোরারি কাজও
চোখে পড়ে যেমন ফিডে আসে। কিন্তু সচেতনভাবে কোনো শিল্পীর কাজ গ্যালারিতে দেখতে আমি কখনও
যাইনি। কোনো শিল্পীকে চিনিও না। ইণ্ডিয়ান আর্ট হিস্ট্রির অ আ টুকুও জানতাম না, ইদানীং
অশোক মিত্রের ভারতীয় চিত্রকলা পড়া শুরু করলাম দশ বছর পিছিয়ে। বড় হয়ে প্রথম প্রথম শিখেছি
ওয়াটার কালার। তার এডিটিং নিয়ে কথা বলব পরের অংশে এডিটিং অধ্যায়ে। দেখেছি শুধুই অয়েল।
আর আমার মিডিয়াম বানিয়েছি কোলাজকে। এযাবৎ পাতে দেওয়ার মতো যতগুলি কাজ আমার, যা দেখিয়ে
ফেসবুক প্রমিলামহলে নতুন ফ্রেন্ড হলে ইমপ্রেস করানো যায় তার সবগুলিই কোলাজ। এই আমার
প্রকৃতই অশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত ছবি বোঝার বোঝা।
রেঁনোয়ার
(Renoir) (১৮৪১-১৯১৯) ছবি সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন। যেন ফরাসি বিপ্লবের পূর্বের স্বর্গের
নন্দনকাননের চিত্র সব। একটু পরেই ধুলোয় মিশে যাবে, যেতে বাধ্য এত এত আনন্দ আর রঙ আর
প্রেম। তাঁর ছবির রেখা যেন অদৃশ্য, সাদার ফোর কালারে ব্যাকগ্রাউন্ডের সাদায় মিল্যে
যায় যেমন অজন্তার শিল্পীদের করত। দালি (Dali) মহাকাব্য আঁকেন। বড্ড তীক্ষ্ণ ও অত্যুজ্জ্বল
হলুদে। হৃদয়হীন তাত্ত্বিক। তাঁর জীবনযাপন ঘিরে বিবিধ মিথ। শাগাল (Marc Chagall) ( ১৮৮৭-১৯৮৫)
আঁকেন রূপকথা। আঁকেন রাশিয়ার গ্রাম্য প্রেম, নীল, লালে উষ্ণতায়। সেখানে পাঁঠা, ছাগল,
ফুলের কেয়ারি, মেঘ, বেহালা, মোরগ, পরী, প্রেমিক প্রেমিকা সাদা বৈবাহিক গাউনে ভাসমান
সকলেই, হাস্যরত, উজ্জ্বল, আর কম্পোজিশনে আকারের রেশিওর হেরফেরে তাদের তিনি বানিয়ে তোলেন
শিশুদের জগত, স্বপ্নের রোমান্টিকতার চরম এক্সপ্রেশন। তাঁর অঙ্কন গ্রাভিটি নস্যাৎ করে
যখন প্রেমিক প্রেমিকা জড়াজড়ি করে আকাশে ভাস্মান হয়ে আমাদের মনের বাঁধন খুলে দেন। তার
ফুলেরা, তার পাখিরা, তার ক্লাউন জোকারেরা, অঙ্কনে সঙ্গীতেরা আমাদের বাস্তব থেকে মুক্তি দেয়। অথচ তিনি প্রখরভাবে
বাইবেলকেই শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে মনে করতেন। প্রেম, প্লেটোনিক প্রেম যা শাগালকে অনুপ্রাণিত
করেছে আজীবন সদর্থক ছবি আঁকতে।
আবার
দেখুন টার্নারের (Turner) (১৭৭৫-১৮৫১) (বৃটিশ রোমান্টিক) চরম ড্রামাটিক নিসর্গ আমার
সেজানের (Cezanne) (ফরাসি) শান্ত ইম্প্রেশনিজমের থেকে ঢের ঢের ভালো লাগে। রেমব্রার
(১৬০৬-১৬৬৯) (ডাচ) ম্যাজেস্টিক রয়্যাল সব পোর্টেট, তার ডিটেলিং, বলিষ্ঠতা, তার গাঢ়
কালচে রঙ নিয়ে তিনি এক একরাট’সুলভ শিল্পী, সুরের তানসেন। অন্যদিকে ভারমির
(Vermeer) (১৬৩২-১৬৭৫) (ডাচ), বেলাজকেসের (Velazquez) (১৫৯৯-১৬৬০) (স্পেন) থিয়েটারি
রোমান্টিক আলোছায়া, বিশেষত The Milkmaid ছবিটি জানিনা কেন আমায় অসম্ভব আকর্ষণ করে,
এমন অমোঘ তার টান। ভারমিরের “ওম্যান উইথ এ পার্ল রিং” আর বেলাসকেজের “লাস মেনিনাস”
এর রহস্য নিয়ে হাজার হাজার গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েও কম পড়ে গেছে। লাস মেনিনাস প্রকৃতই
এক গোলক ধাঁধাঁ যেখানে শিল্পী নিজকেও চিত্র অঙ্কনরত অবস্থাতে এঁকেছেন। কিন্তু এই ছবিগুলি
দেখে আপনি ছবি আঁকার কিছুই বুঝবেন না, যতক্ষণ না আপনি একটি খুঁতময় ছবি না দেখছেন! সেখান
থেকে, সেই খুঁত ধরা থেকে আপনার চিত্র সমালোচনার শুরু। নাহলে পার্ল রিংয়ে আপনার কোনো
উৎকর্ষতা সাধন হবে না।
The Milkmaid, Vermeer
হয়তো
Goya (১৭৪৬-১৮২৮) (স্পেন) আপনাকে চরমভাবে উক্তত্য করবেন, বীভৎস সেসব ছবিতে শয়তান তার
সন্তানকে চিবিয়ে খাচ্ছে, যুদ্ধক্ষেত্রের উপর মেঘের মতো বিশাল দৈত্য কলোশাসের ছায়া…
কিন্তু তবুও গ্যয়া রোমান্টিক মনে হয়েছে আমার, রোমান্টিসিজমের যে একটা আদার সাইড রয়েছে
দাদা! এছাড়া গ্যয়ার কাজ নেপোলিয়ানের ইতিহাসের এক তথ্যনিষ্ঠ নথি। নেপোলিয়নের স্প্যানিশ
ক্ষতের সত্যনিষ্ঠ চিত্রায়ন আমরা পাই গ্যয়ায়। তিনি স্পেনের রাজনৈতিক উত্থান পতনের সঙ্গে
রাজশিল্পী হিসাবে সরাসরি জড়িত হয়েও স্পেনের পরবর্তী শাসকের অনৈতিক শাসনের বিরুদ্ধে
এঁকেছেন মানুষের পিঠে গাধা, বা নেকড়ে বিচারসভার জজ। ডাইনি প্রথার জড়ে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন
বাইরে থেকে যুক্তি নয়, এর মধ্যের থেকে মানবিকতার উন্মেষের মাধ্যমেই এর ভয়বহতা ও একে
নির্মূল করতে যে গণহত্যা সেসব জীঘাংসা থেকে মুক্তি সম্ভব। তার সঙ্গে তার রয়্যাল পৃষ্ঠপোষিকার
মেলামেশার ফসল তৎকালীন যুগের পক্ষে অশালীন “মাহা”র ন্যুড ছবিটি। পরবর্তীকালে বধির গ্যয়া
আঁকেন ব্ল্যাক পেন্টিংস যা মানবসভ্যতা বিষয়ক তাঁর ঐকান্তিক নেতিবাচক ধারণাগুলির প্রকাশ
করে। তবুও গ্যয়া নিজ গুণে আমার মনে একজন রোমান্টিক শিল্পীই।
আমার
মনে হয়েছে ভ্যান গঘ (Van Gogh) (১৮৫৩-১৮৯০) (ডাচ) দারিদ্র্যের শ্রেষ্ঠ চিত্রকর। তাদের
মনের গহীনতম বেদনা ও তার মধ্যেও সুন্দর নিয়ে ভ্যান গঘ। Starry Night ম্যাডেনিং ইন্ডাস্ট্রিয়ালআইজেশনের
নেগেটিভিটিকে, কালো আগুনকে, ফুসফুস হন্তারক ধোঁয়াকে নিয়ে অমোঘ একটি রোমান্টিসিজম। ঐ
ধোঁয়ার কুণ্ডলী তো আমাদের ছায়াপথের বিস্তারের যে অ্যাঙ্গেল একেবারে তা মিলিয়ে আঁকা।
আর অ্যাসাইলামের ছবিতে পাগলের কুণ্ডলীর চারপাশে দেওয়ালের উচ্চতার যে রেশিও তাই বলে
দেয় আসলে কারা পাগল! লক্ষ্য করে থাকবেন সেই অন্তহীন চক্রবৃত্তের দুপাশে কিন্তু প্রায়
মানুষগুলির সংখ্যাগত ঘনত্ব অনেক কম। তারা যেন দেওয়ালে মিশে গেছে। তারা যেন দেওয়ালেই
আশ্রয় নিয়েছে। তারা মৃত। সেই হলুদ যা অবর্ণনীয় দারিদ্রকে সিগনিফাই করে, যা ৩ডি ব্রাশ
স্ট্রোকে জীবন্ত, গরীবের শিল্পী শ্রমিকের শিল্পী কৃষকের শিল্পী গঘ তা চিত্রায়িত করতে
পারেন একমাত্র। তাঁর একটি স্টিল লাইফ আছে। তারই ছেঁড়া জুতোজোড়া। এ কোনো স্টিল লাইফের
বিষয় হতে পারে বিশ্ব তা প্রথম জানল। আর হ্যাঁ, যতদূর জানা যায় কানটি তিনি কেটেছিলেন।
বাবা এই গল্প শুনে বলেছিল পাগল! তার পর পরই আমি রিহ্যাবে যাই! এবং অনুভব করি সেই দেওয়ালগুলি
যা গঘের পয়েন্টিঙয়ে দেখেছিলাম। অসহায়।
Prisoners, gogh
বস্ক
(Hieronymus BOSCH) (১৪৫০-১৫১৬) (ডাচ) হলেন দ্য আল্টিমেট বস। চতুর্দশ শতাব্দীতে ডাডা
স্যুররিয়ালদের থেকেও আক্রমণাত্মক ও তাদের পক্ষেও অকল্পনীয় ইমেজারি বানানোর ক্ষমতাময়
নেদারল্যান্ডের চার্চ শাসিত সমাজের ও সময়ের বাইবেল বিশ্বাসী ইউরোপের ঈশ্বর শিল্পী।
তার চিত্র ঐহিককে আক্রমণ করছে না সেইসময়ের অন্ধ ধর্মকে আঘাত করতে চাইছে সে বিষয়ে গবেষকরা
দ্বিধান্বিত। কেউ কেউ বলেন তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। তার Earthly Delight মনে হয়
যেন প্রচলিত সমাজব্যবস্থার প্রতিটি ব্যভিচারের বিরুদ্ধেই সর্বোচ্চতম স্তরের শৈল্পিক
অ্যাসিড বাল্ব। সেখানে ইঁদুরমুখো পোপ আমাদের ধর্মব্যবস্থাকে চরম ঘৃণা করতে বলে। সেখানে
তিনটি পার্ট। বাঁদিকের অংশে ইডেন, ঈশ্বর আদমের হাতে ইভকে তুলে দিচ্ছেন। সেখানেও আমরা
অদ্ভুত জীবদের পাই। মধ্য অংশে পৃথিবী। মানব মানবী সবাই নগ্ন ও পরস্পরের মধ্যে অস্ফূটে
কূটকাচালিতে মগ্ন। মাঝে মধ্যে বিরাট বিরাট পক্ষী ও ফলের দেখা পাওয়া যায়। তার মধ্য অংশে
পুষ্করিণীর মধ্যে নগ্না স্নানরতাদের আবর্তন করে বিচিত্র জীব সকলে আরোহী মানবদের পর্যটন।
বস্কে আমরা আজব সব জীবজন্তুদের পাই যা তিনি পান প্রাচীন মধ্যযুগীয় পুঁথিগুলির পাতায়
আঁকা ইলাস্ট্রেশন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। উর্দ্ধে আমরা ইডেনের মতোই পাই মধ্যযুগীয় চার্চের
চূড়াসদৃশ ফ্যান্টাসি। শেষত নরকের ডানদিকের প্যানেলে আমরা নরকের দেবতাকে মানব ভক্ষণ
ও রেচন করতে দেখি। দেখি সঙ্গীতকে নিয়ে ব্যঙ্গ।
আর দেখি নরকের জ্বালাময়ী দাবানল যা শিশুকালে বস্ক দেখেছিলেন।
The
last Judgement কিন্তু যাবতীয় মানবীয় নোংরামির উপর ভেদবমন করার পরও প্রভু যিশুর উপর
চরম আস্থা রাখে। বস্তুত বস্ককে বুঝতে হলে মধ্যযুগীয় ইউরোপের ধর্ম সংক্রান্ত ধ্যান ধারণা
সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে। তবে তার কাজ স্যুররিয়ালও লাগবে না, আধুনান্তিকও মনে হবে
না। যদিও দালি ও ডাডার শিল্পীরা খোলাখুলিভাবে বস্ককেই তাদের উত্তরসূরি মেনেছেন। তো
বস্ককে আমি আমার তরফ থেকে সেরার সেরা শিল্পী উপাধি দিলাম। অর্ঘ্যরত্ন। যতই তিনি ফ্ল্যাট
হোন না কেন, তিনি ইউনিকেস্ট শিল্পী। একজন চরমতম বাইবেল বিশ্বাসী গোঁড়াতম খ্রিস্টান
শিল্পীও বটে।
এরই
কাছাকাছি থাকবেন বাঙ্গালির ব্লেক। উইলিয়াম ব্লেক (Blake) (১৭৫৭-১৮২৭) (বৃটিশ)। স্বর্গ
ও নরকের বিবাহ… কিছু মনে পড়ছে? হ্যাঁ, তার আঁকা নিউটন ছবিটি আমি আমার ২৫ বছর ধরে লেখা
জীবনের সংকলিত ১৫টি গল্পের বইয়ের প্রচ্ছদ হিসাবে ব্যবহার করতে চলেছি। ব্লেক সম্পর্কে
মিথ্যে সব যৌন গুজব শোনা যায়। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ও অবিবাহিত ছিলেন (অন্তত গ্রেট
আর্টিস্ট অনুয়ায়ী)। ব্লেকের নিউটন যান্ত্রিক কোল্ড অপ্রকৃতিস্থ বিজ্ঞানকে ব্যঙ্গ করছে।
Newton,
Blake
অথচ
তার শিল্পী ছবিটি কবি শিল্পীর আদিম প্রস্তর দোষকে যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে
যাকে আমরা বলি স্যাভেজ ইন্সটিংক্ট। ব্লেক অতীব ধর্মভীরু খ্রিস্টান মানুষ ছিলেন। তার
উড কাট প্রায় আবিষ্কার করার মতো উৎকৃষ্ট। তাই দিয়েই তিনি তার কবিতার বইগুলি মুদ্রণ
করেন।
Blake,
painter
আর
আর আর এডভার্ড মাঙ্ক (Edvard Munch) (১৮৬৩-১৯৪৪) (নরওয়ে)। চিত্রজগতে আমার প্রথম প্রেম।
এ শিল্পী অবসাদগ্রস্ত দশায় আমাকে বহুদিন পর্যন্ত অজগরের মতো অবসাদে ধীরে ধীরে সম্মোহিত
করে গ্রাস করে ব্যথার চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ। পেসিমিস্টিক এক্সপ্রেশনিজমের চরম দশা।
তার বিখ্যাত ছবি The Scream-এ আকাশ অমন টকটকে লাল কেন তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে।
তার একটি ছবিতে নিবিড় প্রকৃতির মাঝে কোলে আশ্রয় নেওয়া প্রেমিকের গলা থেকে রক্ত চুষে
খাচ্ছে প্রেমিকা ভ্যাম্পায়ার। তার একটি ছবিতে মৃতপ্রায় প্রেমিকের শব খুঁটে খেতে আসে
শকুনরূপী প্রেমিকা। একটি ছবিতে একটি বৃদ্ধ একলা গভীর রাতে উঁকি মেরে তাকিয়ে আছেন, ম্যাড
গেজ, তার শূন্য করোটির চক্ষুর এক্সপ্রেশন বুক শুকিয়ে দেয়, আমাকে কান ধরে শেখায় কাকে
বলে এক্সপ্রেশনিজম! তার আছে মৃত্যু, আত্মহত্যা, যৌনতা ও মদ্যপানের পরের দিনের সকালের
ঘরের দৃশ্য। একই ছবি তিনি কুড়ি তিরিশ বার ড্রয়িং ও পেইন্ট করেছেন। তার আত্মপ্রতিকৃতিগুলিও
মিসারেবল। বেশিরভাগই মদ্যপানরত বা চরম অসুস্থ অবস্থার। ডার্ক ম্যাটম্যাটে তার নিসর্গ
আর কারো চিত্রে আমার চোখে পড়েনি। রবীন্দ্রনাথের আস্তিক্যের আচ্ছন্নতার মতো মাঙ্ক বিষাদনুড়িটিকে
অতলে তলিয়ে দেন। আমাদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেন। লিখতে লিখতে আবিষ্কার করলাম করোনাকালের
প্রেম, প্রথম প্রেম আমার এখন তার আবেগে অটুট। তার উত্তরসূরি এক্সপ্রেসনিজমের দিকপালরা,
বিশেষত আলোছায়ার পল ক্লী।
The night wonderer,
self-portrait, Munch
বেকসিনস্কি
(Beksinski) (১৯২৯-২০০৫) (পোলিশ)। তিনি আবার মিউজিক শুনে ছবি আঁকতেন। শব্দকে দেখতে
পেতেন। এটি একটি নাকি রেয়ার স্নায়বিক রোগ! কাপটা ভাঙল, শব্দটায় আমি একটা রঙ দেখতে পেলাম!
তিনি শুনতেন হার্ড মেটাল, হার্ড রক, পপ মিউজিক। তার ঘর থেকে হাজার হাজার গানের সিডি
পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত হয়েছে! এসব বাজতো আর তিনি আঁকতেন অবিশ্বাস্য সব ডার্ক হরর ছবি।
অকল্পনীয় সে সব ভৌতিক চিত্রায়ন। একটি কঙ্কাল কোট পরে স্যাক্সোফোন বাজাচ্ছে কোটি কোটি
আঙুলে! গানের মাধ্যমে তার মনে ছবি ভেসে উঠত, তা তিনি পরে আঁকার চেষ্টা করতেন মাত্র।
অদ্ভুত না! অদ্ভুত নয়! ভারতে তান্ত্রিকরা যতগুলি বর্ণ যতগুলি অক্ষর যতগুলি ধ্বনি ততগুলিই
রঙ দেখতে পেতেন। ৫১টি। তার থেকেই ৫১ সতী পীঠ। মোদ্দা কথা শব্দ আর রঙ আর উষ্ণতা আর অনুভূতি
আলাদা কিছু নয়। সবই ফ্রিকোয়েন্সি। এই থিয়োরি থেকেই কিন্তু ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত। সেখানেও
ধ্বনি ও আলোর খেলা।
Beksinski
শেষত
পিকাসো (Picasso) (১৮৮১-১৯৭৩)(স্পেন)। তার নীল পর্যায়ের ছবি আমাকে সবচেয়ে প্রভাবিত
করে। প্রভাবিত করে তার প্রিমিটিভিজিম ছবিগুলিও। ভালো লাগে না কিউবিজম মুখগুলো। তবে
জনমতে সর্বাপেক্ষা প্রতিভাময় পিকাসোই। সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বাধিক কাজও সম্ভবত
তারই। তার কল্পনার জটিলতার কাছে আমাদের সবাইকে নতজানু হতে হবে। তবে উল্লেখ্য প্রায়
৫০ হাজার কাজ করলেও পিকাসো একটিও অ্যাবস্ট্যাক্ট কাজ করেননি। আর তার সব কাজ আমার যৌনতাবিলাসও
লাগে না।
প্রসঙ্গত যুক্তি তক্কো
গপ্পের সংলাপে চিত্তপ্রসাদও পিকাসোর গুয়ের্নিকার মতো বাংলাদেশ যুদ্ধ নিয়ে এঁকে ফেলেছিলেন
একটা। ছবিটা আমি এখানে দিচ্ছি সবার অবগতির জন্যই।
আমার মনে হয় কিছু কিছু ইমেজ মানসকে, বিশেষত
অসুস্থ দুর্বল মানসকে দ্রুত প্রভাবিত করে। তিনটি চারটি প্রাণীর প্রতীক। লিজার্ড ( টিকটিকি,
গিরগিটি, গোসাপ, সাপ), পক্ষী (কাক, শকুন, বৃহৎ চঞ্চু রক্ত চক্ষু বিশিষ্ট), মৎস (বৃহৎ
মস্তিষ্কযুক্ত, চোখবিশিষ্ট), ইঁদুর ও কীট পতঙ্গ
ইত্যাদি। এরা অবচেতনের অন্ধকারের মানসের শ্যাডোয়ি অংশের প্রতীকায়ণ। অবদমিত বিকারত্ব
এদের সঙ্গে মিতালি করে, হ্যালুসিনেশন স্কিৎজোফ্রেনিয়া অবসাদ এদের ভাইব বুঝতে পারে।
সাদা আর কালো রঙের ছবি। এরা চরম বিপরীত মানসের অবস্থানে থাকে। এদের দ্বারা নির্মিত
সাইকাডেলিক চিত্র অবচেতনকে গলিয়ে ফেলে। আর খুব উগ্র লাল ও গাঢ় নীল রঙ। এরাও অবচেতনের
রঙ। মানসকে হিলিয়ে রেখে দেয়। তছনছ করে দেয়। এই সব ব্যবহার ছবি দেখে তত্ত্ব মিলিয়ে নেওয়া,
এসবের অভিজ্ঞতা আমার সাইকোতে বরাবরই ছিল। আমি নীলিমেশ নামক সন্তটির কাছে আবার আমার
ঋণ স্বীকার করছি যার উস্কানিতে আমার আর্ট দেখার শুরু। প্রণাম আমার নীলিম। আর ভালো থাকিস
শোভন। মা বিদ্বিষাবহৈঃ। সফর চলতে থাকুক। শুধু বাদ যাক সৌরভ।
জলরঙে
যেভাবে এডিটিং করতে হয় সেভাবে কিন্তু তেলরঙে নয়। আবার সেভাবে আরকিলিকেও নয়। কোলাজে
এডিটিং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। সেখানে সব ধরণের মিডিয়াম চলে। দুর্ভাগ্য কোনটাই গদ্য
এডিটিং এর মতো নয় একমাত্র তেলরঙ ছাড়া। কোলাজেও চলে ছলে কৌশলে। তবে কবিতা এডিটিং এর
তুল্য কাজ কোনো চিত্রশিল্পী পারবেন না। কোনো ঘরানার ওস্তাদ পারবেন না অতি কোমল রেখাবে
সুর লাগিয়েও। সেটা অন্য রকম। যদি পারি তেলরঙের মতো গদ্য লিখব, যদি পারি বন্দিশের বিস্তারের
তালে তালে লিখব গদ্য। এসব কাজে ভেবেছিও অনেকদূর। আগামীর কোনো সংখ্যায়।
#
#
#
#
ঋত্বিকের চলচ্চিত্রে রাগ সঙ্গীত,
আবার আমার নীলিমেশ,
করোনাকাল,
ছৌমিতা ও এভাবে আমার
মার্গসঙ্গীতযাত্রাকাহিনী
‘মেঘে ঢাকা
তারা’তে আসা যাক। শঙ্কর যখন জুতো নোংরা করে এসে ছোট ভাই মন্টুর কাছে গালাগালি খায়
তখন লিরিকটা ছিল “নিদিয়া না জাগায়ো রাজা, অগর নিদিয়া জাগায়ো তো রাজা গালি দোঙ্গি রে, নিদিয়া না জাগায়ো”। রাগ
খাম্বাজ। এই ঠুংরিটি গেয়েছেন এ টি কানন। ঋত্বিকের পয়সা নেই, কি করা যাবে। তিনি
রবিশঙ্কর দিয়ে ধুয়ে দিতে পারেননি। আবার বিনা পয়সায় কিশোরকে দিয়েও গাওয়াতে
পারেননি। ভরসা রেখেছেন আলাউদ্দিনের ভাইপো বাহাদুর খানে। তিনি নিজেও আলাউদ্দিনের
কাছে সরোদের তামিল নিয়েছিলেন বলে রটনা! ‘কোন গলি গ্যয়ো শ্যাম’, ‘যমুনা কিনারে মেরা ঘর’
ইত্যাদিও মিশ্র খাম্বাজ। সন্ধ্যাকালীন রাগ এটি।
নীতার চোখে আলো ফেলা সিনে শঙ্করের তানপুরা হাতে “হামরি দুঃখ দূর কিজিয়ে” মিয়া
কি মলহার। ভীমসেন যোশী শুনি এটি। “করিম নাম তেরো” ধীর লয়ে। এই রাগটির একটি আধুনিক
ইন্টারপ্রিটেশন শোনা যায় যশরাজের গলায় (অত্যাধুনিক রাগা ফিউশনের কথা বলছি না, তা অসহ্য, আধুনিক বলতে বোঝাতে
চাইছি সময়োপযোগী করে রাগের পরিবেশন, যাতে যশরাজ, অজয় ও কৌশিকী চক্রবর্তী লেজেণ্ড) “ঘন গরজত বরষন বুঁদ বুঁদ”।
প্রসঙ্গত সব মলহার রাগই বর্ষার রাগ। যেমন গৌড় মলহার, মেঘ মলহার ইত্যাদি। মেঘ মলহার বা মেঘ রাগে
গান “ঘননন ঘননন ঘন গিরি আয়ে বদরা” লাগান সিনেমার জনপ্রিয় গান। মলহার গ্রুপের রাগ
কিশোরী আমোনকরে খুব জমে। “জয় মা সরস্বতী তম প্রসিদ” আর “লাগি লগন” সবাই জানে
হংসধ্বনি রাগ। আমির খাঁ সাহেব। আর সেতারে এগুলি অবশ্যই শুনবেন নিখিল ব্যানার্জী।
কৌশিকী আর পার্থসারথির একটি আধুনিক পারফরমেন্স আছে, শ্রুতিমধুর।
সুবর্ণরেখায় ব্যবহৃত“মোরা দুখুয়া ম্যায় কা সে কহু” দেশী টোড়ি। লেট মর্নিঙের
রাগ। ভৈরবীর জায়গায় ব্যবহৃত। গেয়েছেন আরতি মুখোপাধ্যায়। প্রথম ব্রেক। ক্লাসিকাল! এটি আগ্রা ঘারানায়
ভালো লাগবে। এই গানটি খুঁজতে খুঁজতে আমি এই লিরিকে পৌঁছাই “দুখুয়া ম্যায় কা সে কহু মরি
সজনী” গুলাম আলির গজল। রাগ তিলক কামোদ। এই রাগটি অত্যন্ত ভালো লাগে সেতার আর
সরোদে। সন্ধ্যাকালীন রাগ। এই রাগ হংসধ্বনি, দুর্গা, ভৈরবী একই ধাঁচের রাগ। এরা সকলেই বর্ষার
সঙ্গে মানানসই। আমজাদ আলি খানের একটি অ্যালবাম আছে বিয়ন্ড দি স্কাই। ইউটিউবে
সার্চ দিয়ে শুনতে পারেন। স্ট্রেস রিলিভার মিউজিক থেরাপির কাজ করবে। তবে আমার মতে
যন্ত্র সঙ্গীতে যাওয়ার আগে যে কোনো রাগের আগে ঠুংরি বন্দীশ শুনে নিন। সুর চিনুন
আগে। পকড় চিনুন। মূল সুর। সেটাই স্টার্টিং পয়েন্ট। তারপর সারাজীবন সেই রাগ সব
ধরণের যন্ত্রসঙ্গীতে শুনুন। সব মুডে। সুবর্ণরেখাতে“ভোর ভৈয়ি” মাধবীর এন্ট্রি মনে
হয় ভৈরবী। এ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে এটিও আরতির গাওয়া বলে মান্না দে’তে চলে গিয়ে বলব
“লগা চুনড়ি মে দাগ" ও ভৈরবী! ঠুংরি স্টাইলে এই সেতারে এটি বাজিয়েছেন নিখিল
ব্যানার্জী। জীবনে আমি একটা অ্যাচিভমেন্ট পেলাম এটি আবিষ্কার করে। কলাবতী বারবার
ব্যবহৃত হয়েছে এই সিনেমায়। মূল সুর এই সিনেমার কলাবতী। প্রভা আত্রের কণ্ঠে “তন মন
ধন তোপে বরণ” মিলনের রাগ। “আজু কি আনন্দ" শাল বনে অভিরামের সঙ্গে এই রাগ।
বাগেশ্রী রাগ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। শুধু জানি রাতের মিলনের রাগ। কোমল গান্ধার
হল কোমল গা। ব্যবহৃত হয় ভৈরবী,
দরবারী
কানাড়া, টোড়ি আর মালকোশে। কোমল
গান্ধারের ব্যবহার এই সব রাগকে আধ্যাত্মিক করে তোলে, একাকীত্বের রাগ করে তোলে, শান্ত করে, শান্তি দেয়। এর মধ্যে
দরবারী ও মালকোশ গভীর রজনীর রাগ।
এছাড়াও আমার অত্যন্ত প্রিয় রাগ আনন্দের রাগগুলি। ভীমপলশ্রী (মধ্যাহ্নের
মিলনের রাগ), ইমন, বেহাগ, দেশ, রাগ শঙ্কর (যশরাজ, রবিশঙ্কর, সন্ধ্যাকালীন), রাগ আহির ভৈরব (আমির খাঁ, ৩টের রাগ), কাফি রাগ (ফোক রাগ, লোকসংগীত থেকে নাকি এই
রাগ নির্মিত, আবার তা ফিরে
প্রভাবিত করে বর্তমান লোকসংগীতকে,
যশরাজ), রাগ পলাশ কাফি (আমার
কলার টিউন, ভি জি যোগ
বিসমিল্লাহ খাঁ), রাগ জয়জয়ন্তী
(এই একটি রাগ আপনি ভাগ্যবান খোদ বাবা আলাউদ্দিনের বাজনা পেয়ে যাবেন, বেহাগেরও পাবেন, জয়জয়ন্তীর আধুনিক রূপ
রজন ও সজন মিশ্রা, ভিজি যোগ ও
বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেব,
রাতের
মিলনের রাগ), বৃন্দাবনী
সারঙ্গ (এটি রাধার রাগ মানা হয়,
প্রেমের
রাগ, এটি চৌরাশিয়া ও
ভীমসেন যোশী, দ্রুততে“যায়ু
ম্যায় তোপে বলিহারি, তুম হি মেরো মন
হরণী”, মধ্যাহ্নকালীন
রাগ), রাগ মধুবন্তী
(কৌশিকী, এই রাগের
বিশিষ্টতা হল যে কোনো অজ্ঞ লোকও প্রথমবার শুনেই রাগটি যে দুপুরবেলার আবহ তৈরি করছে
তা ধরতে পারবে, মিলন), রাগ সিন্ধি ভৈরবী ও নট ভৈরব (স্পেশাল
আলি আকবর রবি শংকর), পঞ্চম সে এগারা
ধুন (রবিশঙ্কর, আনন্দ, মিলন, পপ কার্নিভালে
বাজাচ্ছেন), চারুকেশী (মিলন)
ইত্যাদি। একটি রাগ আছে,
অদ্ভুত।
রাগ আলহাইয়া বিলাবল। এতে সকল স্বর শুদ্ধ। মানে মেজর স্কেল। কিশোরী আমোনকরের কন্ঠে
সকাল ৬টার দিকে এটি শোনা প্রায় সকালে শ্যাম্পেন খাওয়ার মতো। একটি বিশেষ রাগ আছে
পাহাড়ি। স্পেশাল পাহাড়ের জন্যই। ভীমসেন। পাহাড়ের আর একটি রাগ শিবরঞ্জিনী, শিবের উদ্দেশ্যে গীত, শিবরাত্রির রাগ, চৌরাশিয়া। আরো আছে দুর্গা।
বিশেষত মাতৃসাধনার রাগিনী।
বিশেষ করে বলতে হবে অবশ্যই দেশ আর ইমন রাগটির কথা। পথের পাঁচালিতে ব্যবহৃত রেন
সিকোয়েন্স দেশ রাগে। মিয়া কি মলহার আধ্যাত্মিক রাগ। দেশ সাধারণের আনন্দের রাগ। দেশ
রাতের মিলনের রাগ। “এসো শ্যামল সুন্দর” দেশ, যেখানে “নীল অঞ্জন ঘন কুঞ্জ ছায়ায়” বা
নচিকেতার “শ্রাবণ ঘনায় দূর আকাশে” মিয়া কি মলহার। দেশ আপনাকে ডিপ্রেশন থেকে বের
করে আনবে। দেশ চৌরাশিয়ায় শুনে আপনি কৃষ্ণের বংশীবাদন শ্রবণের অনুভূতি পাবেন। নিখিল
ব্যানার্জীর অনিন্দ্য চ্যাটার্জীর তবলার সঙ্গতে ৫০ মিনিটের যে দেশ রাগের ট্র্যাক
তা প্রথম থেকে শেষ অবধি জোর করে ধ্যান করার মতো করে শুনে আমার যাবতীয় সমস্যা আল ইজ
অয়েল হয়ে যায়। ধ্যান ও সঙ্গীত দিতে পারে যত সবচেয়ে বেশি যতটা আনন্দ তা আমার পাওয়া
হয়ে যায় নিখিল ব্যানার্জীর দেশ শুনে। শেষে আপনি কান পাততে পারবেন না তার তীব্রতায়, দ্রুততায় আর মুহূর্তে
আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন যে আধুনিক যুগে শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী অন্তত বাদ্য
যন্ত্রে হলেন নিখিল ব্যানার্জী। আর ইমন। ইমন মার্গ সঙ্গীতে সবচেয়ে রোমান্টিক রাগ।
এর চেয়ে প্রেমের রাগ আর নেই। ইমন=প্রেম। “পিয়া কি নজরিয়া জাদু ভরি", ভীমসেন। বা “আই লি সখি
রি পিয়া বিন”। গোল্ডেন এরার পর পরবর্তীকালে যার সঙ্গীত শুনি তিনি শাহিদ
পারভেজ। ইমনের লয়াকারি। দরবার ফেস্টিভাল খুব ভালোভাবে যুগোপযোগী করে পরিবেশন করছে
এই ধারাকে। আর না আমি কখনও ডোভার লেন যাইনি।
ভালোও লাগে না কিছু রাগ আমার। যেমন প্রথমেই মালকোশ। কেন জানি না। শুনেছি
মৃত্যু ঈর্ষা জড়িত এই গভীর রাতের রাগে। অথবা সকাল ৯ টা ১০ টার দিকের রাগগুলি। টোড়ি
বা ললিত বা রাতের রাগ খুব গভীর রাতের রাগ হামির, নায়কী বা কৌশি কানাড়া ইত্যাদি।
এগুলি বড্ড ডিভোশনের,
বড্ড
আধ্যাত্মিক, বড্ড একাকীত্বের
নির্জনতার রাগ। অথবা সকাল ১০ টা বা গভীর রাত ৩টে আমার প্রিয় সময় নয়। দুভাবেই
ব্যাখ্যা করা যায় একে। কিছু রাগ সস্তা। যেমন পিলু। ভালো লাগে না। এই সব।
রাগ মিউজিক গ্রামার না জানলে শুধু মাত্র সুরের নেশায় আর শ্রুতিমাধুর্যতায়
শুনতে গেলে লাগে যেটা হল মনঃসংযোগ, নিরবিছিন্ন তৈলধারার (জলের ধারায় বাব্ল থাকতে পারে) মতো
মনঃসংযোগ। এতে লক্ষ জপের কাজ হয়ে যায়, মনোরঞ্জনও হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। এক রাগ সঙ্গীত আমাকে অন্য
মানুষ করে দিল। It’s
a symbol of transformation for me. কিনে ফেললাম একটি কিবোর্ড, হারমোনিয়ামের মতো থিয়োরি
জেনে শুধু মার্গ সঙ্গীত বাজাবো বলে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ শুধুমাত্র হারমোনিয়ামে
রাগ সঙ্গীত শেখাতে আমায় রাজি হয়নি। ব্যান্ডের ছোকরা এসে কর্ড শেখাতে যায়, গায়ক সা রে গা মা সাধতে
বলে, ঠিক একদিন ক্লিক
করবে শুধুমাত্র হারমোনিয়ামে হংসধ্বনি আশা রাখি।
অথচ করোনা কালের আগে অবধি আমার সঙ্গীতের টোটাল জগত বলতে মেরে কেটে ছিল অঞ্জন, সুমন, নচিকেতা, চন্দ্রবিন্দু, কিছু কিছু করে বব ডিলান, জন লেনন, জন ডেনভার, পিটি সিগার, একটু গান্স অ্যান্ড
রোজেস আর পিঙ্ক ফ্লয়েড,
কিছু
কেনি জি, কিছু গজল, আর দেবব্রত, সুচিত্রা মিত্র, পীয়ূষকান্তি, মেরেকেটে কিছু বাউল, ব্যাস। করোনায় একাকীত্ব
কাকে বলে যখন আর আমার একটিও বন্ধু নেই, ডানলপ পণ করেছে আমাকে সে রাস্তার উন্মাদ বানাবেই, আমি শুরু করলাম
আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, অমর পাল, নির্মলেন্দু, বিজয় সরকার, ঝুমুর, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, গীতশ্রী ছবি
বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তন,
রামকুমারের
টপ্পা, সুধীন
দাশগুপ্ত-আরতি, সলিল-লতা জুটির
গান, ছৌমিতার সঙ্গে
প্রেম শুরু করে অবাক কাণ্ড আমার ভালো লাগতে শুরু করলো সন্ধ্যা মুখার্জী আর
সলিল-শ্যামল জুটির গান,
৫০-এর
দশকের শচীন কত্তা-দেব আনন্দ আমাকে বিমুগ্ধ করে দিল। হিন্দি লতায় ৫০এর ৬০এর লতায়
বুঁদ হয়ে থাকতে লাগলাম। শুনলাম অখিলবন্ধু ঘোষের কণ্ঠ, খুব মন দিয়ে শুনলাম লালন (অথচ বইকেন্দ্রিক
দেহতত্ত্ব আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম), অনেক অনেক অচেনা শ্যামা সঙ্গীত এমনকি কথামৃতের গানও নয়নবারি, এসময়ে
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীত অবধি গেছি, শুনেছিলাম কোরিয়ান চাইনিজ ফোক মিউজিক টানা
টানা টোন টিউন, সুফি শুনলাম
অনেক আবিদা পারভিন আর আরাবিক টিউন, উদাত্ত ওল্ড ইংল্যান্ডের ফোক মিউজিক সংগীত। শুনলাম
পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। সিম্ফনি কোনোদিনও আমার ঝ্যাং ঝ্যাং ছাড়া আর কিছু মনে
হয়নি। চেলো আর সোনাটা কনসার্ট ভালো লাগল। সবচেয়ে মিষ্টি লাগল মোৎজার্ট। ওয়াটার
মিউজিক, রয়াল
ফায়ারওয়াওর্কস, মসিহা(অ্যান্ডেল), ব্রান্ডেনবুর্গ(বাখ)
মোহিত করে দিল। মনকে শুদ্ধ করে দিল। জন কোলট্রেন আর মাইলস ডেভিস, লুইস অ্যামস্ট্রং-এর
স্যাক্সোফোন আর ট্রাম্পেট-এর পর আর কেনি জি কারো ভালো লাগতে পারে না। আর আর আর
শেষত রবীন্দ্র সঙ্গীত। আমি হেমন্ত, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, কণিকার মেলোডি শুনলাম। শুনলাম সুবিনয় রায় আর
অত্যাধুনিক ইমন, সুনিধি নায়েক, বিক্রম সিং ইত্যাদি।
আমার সর্বগ্রাসী ব্লটিং পেপার শুষে নিল মানবেন্দ্র, হৈমন্তী শুক্লা, স্বাগতালক্ষীদের রাগাশ্রয়ী পুরোনো দিনের
গানও। আমার বাড়িতে হোম এফ এম চলতে থাকে থাকে, মহাকাল একাকীত্ব ও সমাজের নির্মম টর্চারের
আরোগ্যকারী শক্তি হিসাবে আমি বেছে নিই এই নমস্য শিল্পীদের কাজ। সবই ইউটিউব থেকে
শোনা হত এবং প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন সহ আর দিনে পাঁচবার ইউটিউব বলতো ব্রেক নিতে আর
আমার করোনার আগে আগে কেনা ৭ হাজার টাকার সোনির স্পিকার খারাপ হয়ে গেল। তবে বিদেশ ও
তার রক, পপ, মেটাল, আমাকে সেই শান্তিটি ও
আনন্দটি কোনোদিনও দিতে পারেনি,
এই
পর্বেও দিতে পারলো না। সব ছাড়িয়ে জিতে গেল ভারতীয় রাগ সঙ্গীত তার আধ্যাত্মিকতায়
উপযোগিতার গুণে। যদিও নীলিমেশ বলেছিল চারুকেশী শুনেই তুমি চলে যাবে দেখো বোহেমিয়ান
র্যাফসডিতে… আমার উল্টো হল। আমার ছৌ আমায় পরিচিত করালো বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে।
এখানেও বিরোধ। আমার ওর প্রিয়তম মান্না দে ভালো লাগে না। আর ভালো লাগে না গজল।
শুধুই মদ আর বিরহ নিয়ে কাব্য ভালো লাগে না।
এখন তো স্তোত্র শুনি। শঙ্করের মোহ-মুগদর (মোহকে মুগুর দিয়ে মারা!) স্তোত্র, নির্বাণষটকম্ (
চিদানন্দরূপঃ শিবোহম), ভবানী অষ্টকম্, বিবেকানন্দের অম্বা
স্তোত্রম, শ্রী শ্রী
চণ্ডীর অর্গলা স্তোত্র,
দেবী
কবচম্, মহিষাসুর
মর্দিনী স্তোত্র ( জয় জয় হে মহিষাসুর মর্দিনী রম্য কপর্দিনী শৈল সুতে, সুন্দর চুল বিশিষ্টা
পর্বত কন্যা), রামকৃষ্ণ মিশনে
গীত “শুদ্ধ ব্রহ্ম পরাৎপর রাম/কালাত্মক পরমেশ্বর রাম/ শেষ তল্প সুখ নিদ্রিত
রাম/ব্রহ্মদ্যামর প্রার্থিত রাম” ইতি সপ্তকাণ্ড, ৩২ অক্ষরী নাম বীজ ইত্যাদি। ভালো লাগে, শুনি, কলিতে ভক্তিই সার, আর জীবনের লক্ষ্য
ঈশ্বরলাভ নিশ্চিত করেছি তাই শুনি। এগুলি সংস্কৃত সাহিত্যের এক একটি মাস্টারপিস
বললে খুব খুব কম বলা হবে।
‘মেঘে ঢাকা তারা’তে আসা যাক। শঙ্কর যখন জুতো নোংরা করে এসে ছোট ভাই মন্টুর কাছে গালাগালি খায় তখন লিরিকটা ছিল “নিদিয়া না জাগায়ো রাজা, অগর নিদিয়া জাগায়ো তো রাজা গালি দোঙ্গি রে, নিদিয়া না জাগায়ো”। রাগ খাম্বাজ। এই ঠুংরিটি গেয়েছেন এ টি কানন। ঋত্বিকের পয়সা নেই, কি করা যাবে। তিনি রবিশঙ্কর দিয়ে ধুয়ে দিতে পারেননি। আবার বিনা পয়সায় কিশোরকে দিয়েও গাওয়াতে পারেননি। ভরসা রেখেছেন আলাউদ্দিনের ভাইপো বাহাদুর খানে। তিনি নিজেও আলাউদ্দিনের কাছে সরোদের তামিল নিয়েছিলেন বলে রটনা! ‘কোন গলি গ্যয়ো শ্যাম’, ‘যমুনা কিনারে মেরা ঘর’ ইত্যাদিও মিশ্র খাম্বাজ। সন্ধ্যাকালীন রাগ এটি।
নীতার চোখে আলো ফেলা সিনে শঙ্করের তানপুরা হাতে “হামরি দুঃখ দূর কিজিয়ে” মিয়া
কি মলহার। ভীমসেন যোশী শুনি এটি। “করিম নাম তেরো” ধীর লয়ে। এই রাগটির একটি আধুনিক
ইন্টারপ্রিটেশন শোনা যায় যশরাজের গলায় (অত্যাধুনিক রাগা ফিউশনের কথা বলছি না, তা অসহ্য, আধুনিক বলতে বোঝাতে
চাইছি সময়োপযোগী করে রাগের পরিবেশন, যাতে যশরাজ, অজয় ও কৌশিকী চক্রবর্তী লেজেণ্ড) “ঘন গরজত বরষন বুঁদ বুঁদ”।
প্রসঙ্গত সব মলহার রাগই বর্ষার রাগ। যেমন গৌড় মলহার, মেঘ মলহার ইত্যাদি। মেঘ মলহার বা মেঘ রাগে
গান “ঘননন ঘননন ঘন গিরি আয়ে বদরা” লাগান সিনেমার জনপ্রিয় গান। মলহার গ্রুপের রাগ
কিশোরী আমোনকরে খুব জমে। “জয় মা সরস্বতী তম প্রসিদ” আর “লাগি লগন” সবাই জানে
হংসধ্বনি রাগ। আমির খাঁ সাহেব। আর সেতারে এগুলি অবশ্যই শুনবেন নিখিল ব্যানার্জী।
কৌশিকী আর পার্থসারথির একটি আধুনিক পারফরমেন্স আছে, শ্রুতিমধুর।
সুবর্ণরেখায় ব্যবহৃত“মোরা দুখুয়া ম্যায় কা সে কহু” দেশী টোড়ি। লেট মর্নিঙের
রাগ। ভৈরবীর জায়গায় ব্যবহৃত। গেয়েছেন আরতি মুখোপাধ্যায়। প্রথম ব্রেক। ক্লাসিকাল! এটি আগ্রা ঘারানায়
ভালো লাগবে। এই গানটি খুঁজতে খুঁজতে আমি এই লিরিকে পৌঁছাই “দুখুয়া ম্যায় কা সে কহু মরি
সজনী” গুলাম আলির গজল। রাগ তিলক কামোদ। এই রাগটি অত্যন্ত ভালো লাগে সেতার আর
সরোদে। সন্ধ্যাকালীন রাগ। এই রাগ হংসধ্বনি, দুর্গা, ভৈরবী একই ধাঁচের রাগ। এরা সকলেই বর্ষার
সঙ্গে মানানসই। আমজাদ আলি খানের একটি অ্যালবাম আছে বিয়ন্ড দি স্কাই। ইউটিউবে
সার্চ দিয়ে শুনতে পারেন। স্ট্রেস রিলিভার মিউজিক থেরাপির কাজ করবে। তবে আমার মতে
যন্ত্র সঙ্গীতে যাওয়ার আগে যে কোনো রাগের আগে ঠুংরি বন্দীশ শুনে নিন। সুর চিনুন
আগে। পকড় চিনুন। মূল সুর। সেটাই স্টার্টিং পয়েন্ট। তারপর সারাজীবন সেই রাগ সব
ধরণের যন্ত্রসঙ্গীতে শুনুন। সব মুডে। সুবর্ণরেখাতে“ভোর ভৈয়ি” মাধবীর এন্ট্রি মনে
হয় ভৈরবী। এ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে এটিও আরতির গাওয়া বলে মান্না দে’তে চলে গিয়ে বলব
“লগা চুনড়ি মে দাগ" ও ভৈরবী! ঠুংরি স্টাইলে এই সেতারে এটি বাজিয়েছেন নিখিল
ব্যানার্জী। জীবনে আমি একটা অ্যাচিভমেন্ট পেলাম এটি আবিষ্কার করে। কলাবতী বারবার
ব্যবহৃত হয়েছে এই সিনেমায়। মূল সুর এই সিনেমার কলাবতী। প্রভা আত্রের কণ্ঠে “তন মন
ধন তোপে বরণ” মিলনের রাগ। “আজু কি আনন্দ" শাল বনে অভিরামের সঙ্গে এই রাগ।
বাগেশ্রী রাগ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। শুধু জানি রাতের মিলনের রাগ। কোমল গান্ধার
হল কোমল গা। ব্যবহৃত হয় ভৈরবী,
দরবারী
কানাড়া, টোড়ি আর মালকোশে। কোমল
গান্ধারের ব্যবহার এই সব রাগকে আধ্যাত্মিক করে তোলে, একাকীত্বের রাগ করে তোলে, শান্ত করে, শান্তি দেয়। এর মধ্যে
দরবারী ও মালকোশ গভীর রজনীর রাগ।
এছাড়াও আমার অত্যন্ত প্রিয় রাগ আনন্দের রাগগুলি। ভীমপলশ্রী (মধ্যাহ্নের
মিলনের রাগ), ইমন, বেহাগ, দেশ, রাগ শঙ্কর (যশরাজ, রবিশঙ্কর, সন্ধ্যাকালীন), রাগ আহির ভৈরব (আমির খাঁ, ৩টের রাগ), কাফি রাগ (ফোক রাগ, লোকসংগীত থেকে নাকি এই
রাগ নির্মিত, আবার তা ফিরে
প্রভাবিত করে বর্তমান লোকসংগীতকে,
যশরাজ), রাগ পলাশ কাফি (আমার
কলার টিউন, ভি জি যোগ
বিসমিল্লাহ খাঁ), রাগ জয়জয়ন্তী
(এই একটি রাগ আপনি ভাগ্যবান খোদ বাবা আলাউদ্দিনের বাজনা পেয়ে যাবেন, বেহাগেরও পাবেন, জয়জয়ন্তীর আধুনিক রূপ
রজন ও সজন মিশ্রা, ভিজি যোগ ও
বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেব,
রাতের
মিলনের রাগ), বৃন্দাবনী
সারঙ্গ (এটি রাধার রাগ মানা হয়,
প্রেমের
রাগ, এটি চৌরাশিয়া ও
ভীমসেন যোশী, দ্রুততে“যায়ু
ম্যায় তোপে বলিহারি, তুম হি মেরো মন
হরণী”, মধ্যাহ্নকালীন
রাগ), রাগ মধুবন্তী
(কৌশিকী, এই রাগের
বিশিষ্টতা হল যে কোনো অজ্ঞ লোকও প্রথমবার শুনেই রাগটি যে দুপুরবেলার আবহ তৈরি করছে
তা ধরতে পারবে, মিলন), রাগ সিন্ধি ভৈরবী ও নট ভৈরব (স্পেশাল
আলি আকবর রবি শংকর), পঞ্চম সে এগারা
ধুন (রবিশঙ্কর, আনন্দ, মিলন, পপ কার্নিভালে
বাজাচ্ছেন), চারুকেশী (মিলন)
ইত্যাদি। একটি রাগ আছে,
অদ্ভুত।
রাগ আলহাইয়া বিলাবল। এতে সকল স্বর শুদ্ধ। মানে মেজর স্কেল। কিশোরী আমোনকরের কন্ঠে
সকাল ৬টার দিকে এটি শোনা প্রায় সকালে শ্যাম্পেন খাওয়ার মতো। একটি বিশেষ রাগ আছে
পাহাড়ি। স্পেশাল পাহাড়ের জন্যই। ভীমসেন। পাহাড়ের আর একটি রাগ শিবরঞ্জিনী, শিবের উদ্দেশ্যে গীত, শিবরাত্রির রাগ, চৌরাশিয়া। আরো আছে দুর্গা।
বিশেষত মাতৃসাধনার রাগিনী।
বিশেষ করে বলতে হবে অবশ্যই দেশ আর ইমন রাগটির কথা। পথের পাঁচালিতে ব্যবহৃত রেন
সিকোয়েন্স দেশ রাগে। মিয়া কি মলহার আধ্যাত্মিক রাগ। দেশ সাধারণের আনন্দের রাগ। দেশ
রাতের মিলনের রাগ। “এসো শ্যামল সুন্দর” দেশ, যেখানে “নীল অঞ্জন ঘন কুঞ্জ ছায়ায়” বা
নচিকেতার “শ্রাবণ ঘনায় দূর আকাশে” মিয়া কি মলহার। দেশ আপনাকে ডিপ্রেশন থেকে বের
করে আনবে। দেশ চৌরাশিয়ায় শুনে আপনি কৃষ্ণের বংশীবাদন শ্রবণের অনুভূতি পাবেন। নিখিল
ব্যানার্জীর অনিন্দ্য চ্যাটার্জীর তবলার সঙ্গতে ৫০ মিনিটের যে দেশ রাগের ট্র্যাক
তা প্রথম থেকে শেষ অবধি জোর করে ধ্যান করার মতো করে শুনে আমার যাবতীয় সমস্যা আল ইজ
অয়েল হয়ে যায়। ধ্যান ও সঙ্গীত দিতে পারে যত সবচেয়ে বেশি যতটা আনন্দ তা আমার পাওয়া
হয়ে যায় নিখিল ব্যানার্জীর দেশ শুনে। শেষে আপনি কান পাততে পারবেন না তার তীব্রতায়, দ্রুততায় আর মুহূর্তে
আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন যে আধুনিক যুগে শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী অন্তত বাদ্য
যন্ত্রে হলেন নিখিল ব্যানার্জী। আর ইমন। ইমন মার্গ সঙ্গীতে সবচেয়ে রোমান্টিক রাগ।
এর চেয়ে প্রেমের রাগ আর নেই। ইমন=প্রেম। “পিয়া কি নজরিয়া জাদু ভরি", ভীমসেন। বা “আই লি সখি
রি পিয়া বিন”। গোল্ডেন এরার পর পরবর্তীকালে যার সঙ্গীত শুনি তিনি শাহিদ
পারভেজ। ইমনের লয়াকারি। দরবার ফেস্টিভাল খুব ভালোভাবে যুগোপযোগী করে পরিবেশন করছে
এই ধারাকে। আর না আমি কখনও ডোভার লেন যাইনি।
ভালোও লাগে না কিছু রাগ আমার। যেমন প্রথমেই মালকোশ। কেন জানি না। শুনেছি
মৃত্যু ঈর্ষা জড়িত এই গভীর রাতের রাগে। অথবা সকাল ৯ টা ১০ টার দিকের রাগগুলি। টোড়ি
বা ললিত বা রাতের রাগ খুব গভীর রাতের রাগ হামির, নায়কী বা কৌশি কানাড়া ইত্যাদি।
এগুলি বড্ড ডিভোশনের,
বড্ড
আধ্যাত্মিক, বড্ড একাকীত্বের
নির্জনতার রাগ। অথবা সকাল ১০ টা বা গভীর রাত ৩টে আমার প্রিয় সময় নয়। দুভাবেই
ব্যাখ্যা করা যায় একে। কিছু রাগ সস্তা। যেমন পিলু। ভালো লাগে না। এই সব।
রাগ মিউজিক গ্রামার না জানলে শুধু মাত্র সুরের নেশায় আর শ্রুতিমাধুর্যতায়
শুনতে গেলে লাগে যেটা হল মনঃসংযোগ, নিরবিছিন্ন তৈলধারার (জলের ধারায় বাব্ল থাকতে পারে) মতো
মনঃসংযোগ। এতে লক্ষ জপের কাজ হয়ে যায়, মনোরঞ্জনও হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। এক রাগ সঙ্গীত আমাকে অন্য
মানুষ করে দিল। It’s
a symbol of transformation for me. কিনে ফেললাম একটি কিবোর্ড, হারমোনিয়ামের মতো থিয়োরি
জেনে শুধু মার্গ সঙ্গীত বাজাবো বলে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ শুধুমাত্র হারমোনিয়ামে
রাগ সঙ্গীত শেখাতে আমায় রাজি হয়নি। ব্যান্ডের ছোকরা এসে কর্ড শেখাতে যায়, গায়ক সা রে গা মা সাধতে
বলে, ঠিক একদিন ক্লিক
করবে শুধুমাত্র হারমোনিয়ামে হংসধ্বনি আশা রাখি।
অথচ করোনা কালের আগে অবধি আমার সঙ্গীতের টোটাল জগত বলতে মেরে কেটে ছিল অঞ্জন, সুমন, নচিকেতা, চন্দ্রবিন্দু, কিছু কিছু করে বব ডিলান, জন লেনন, জন ডেনভার, পিটি সিগার, একটু গান্স অ্যান্ড
রোজেস আর পিঙ্ক ফ্লয়েড,
কিছু
কেনি জি, কিছু গজল, আর দেবব্রত, সুচিত্রা মিত্র, পীয়ূষকান্তি, মেরেকেটে কিছু বাউল, ব্যাস। করোনায় একাকীত্ব
কাকে বলে যখন আর আমার একটিও বন্ধু নেই, ডানলপ পণ করেছে আমাকে সে রাস্তার উন্মাদ বানাবেই, আমি শুরু করলাম
আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, অমর পাল, নির্মলেন্দু, বিজয় সরকার, ঝুমুর, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, গীতশ্রী ছবি
বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তন,
রামকুমারের
টপ্পা, সুধীন
দাশগুপ্ত-আরতি, সলিল-লতা জুটির
গান, ছৌমিতার সঙ্গে
প্রেম শুরু করে অবাক কাণ্ড আমার ভালো লাগতে শুরু করলো সন্ধ্যা মুখার্জী আর
সলিল-শ্যামল জুটির গান,
৫০-এর
দশকের শচীন কত্তা-দেব আনন্দ আমাকে বিমুগ্ধ করে দিল। হিন্দি লতায় ৫০এর ৬০এর লতায়
বুঁদ হয়ে থাকতে লাগলাম। শুনলাম অখিলবন্ধু ঘোষের কণ্ঠ, খুব মন দিয়ে শুনলাম লালন (অথচ বইকেন্দ্রিক
দেহতত্ত্ব আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম), অনেক অনেক অচেনা শ্যামা সঙ্গীত এমনকি কথামৃতের গানও নয়নবারি, এসময়ে
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীত অবধি গেছি, শুনেছিলাম কোরিয়ান চাইনিজ ফোক মিউজিক টানা
টানা টোন টিউন, সুফি শুনলাম
অনেক আবিদা পারভিন আর আরাবিক টিউন, উদাত্ত ওল্ড ইংল্যান্ডের ফোক মিউজিক সংগীত। শুনলাম
পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। সিম্ফনি কোনোদিনও আমার ঝ্যাং ঝ্যাং ছাড়া আর কিছু মনে
হয়নি। চেলো আর সোনাটা কনসার্ট ভালো লাগল। সবচেয়ে মিষ্টি লাগল মোৎজার্ট। ওয়াটার
মিউজিক, রয়াল
ফায়ারওয়াওর্কস, মসিহা(অ্যান্ডেল), ব্রান্ডেনবুর্গ(বাখ)
মোহিত করে দিল। মনকে শুদ্ধ করে দিল। জন কোলট্রেন আর মাইলস ডেভিস, লুইস অ্যামস্ট্রং-এর
স্যাক্সোফোন আর ট্রাম্পেট-এর পর আর কেনি জি কারো ভালো লাগতে পারে না। আর আর আর শেষত
রবীন্দ্র সঙ্গীত। আমি হেমন্ত,
চিন্ময়
চট্টোপাধ্যায়, কণিকার মেলোডি
শুনলাম। শুনলাম সুবিনয় রায় আর অত্যাধুনিক ইমন, সুনিধি নায়েক, বিক্রম সিং ইত্যাদি। আমার সর্বগ্রাসী ব্লটিং
পেপার শুষে নিল মানবেন্দ্র,
হৈমন্তী
শুক্লা, স্বাগতালক্ষীদের
রাগাশ্রয়ী পুরোনো দিনের গানও। আমার বাড়িতে হোম এফ এম চলতে থাকে থাকে, মহাকাল একাকীত্ব ও
সমাজের নির্মম টর্চারের আরোগ্যকারী শক্তি হিসাবে আমি বেছে নিই এই নমস্য শিল্পীদের
কাজ। সবই ইউটিউব থেকে শোনা হত এবং প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন সহ আর দিনে পাঁচবার
ইউটিউব বলতো ব্রেক নিতে আর আমার করোনার আগে আগে কেনা ৭ হাজার টাকার সোনির স্পিকার
খারাপ হয়ে গেল। তবে বিদেশ ও তার রক, পপ,
মেটাল, আমাকে সেই শান্তিটি ও
আনন্দটি কোনোদিনও দিতে পারেনি,
এই
পর্বেও দিতে পারলো না। সব ছাড়িয়ে জিতে গেল ভারতীয় রাগ সঙ্গীত তার আধ্যাত্মিকতায়
উপযোগিতার গুণে। যদিও নীলিমেশ বলেছিল চারুকেশী শুনেই তুমি চলে যাবে দেখো বোহেমিয়ান
র্যাফসডিতে… আমার উল্টো হল। আমার ছৌ আমায় পরিচিত করালো বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে।
এখানেও বিরোধ। আমার ওর প্রিয়তম মান্না দে ভালো লাগে না। আর ভালো লাগে না গজল।
শুধুই মদ আর বিরহ নিয়ে কাব্য ভালো লাগে না।
এখন তো স্তোত্র শুনি। শঙ্করের মোহ-মুগদর (মোহকে মুগুর দিয়ে মারা!) স্তোত্র, নির্বাণষটকম্ (
চিদানন্দরূপঃ শিবোহম), ভবানী অষ্টকম্, বিবেকানন্দের অম্বা
স্তোত্রম, শ্রী শ্রী
চণ্ডীর অর্গলা স্তোত্র,
দেবী
কবচম্, মহিষাসুর
মর্দিনী স্তোত্র ( জয় জয় হে মহিষাসুর মর্দিনী রম্য কপর্দিনী শৈল সুতে, সুন্দর চুল বিশিষ্টা
পর্বত কন্যা), রামকৃষ্ণ মিশনে
গীত “শুদ্ধ ব্রহ্ম পরাৎপর রাম/কালাত্মক পরমেশ্বর রাম/ শেষ তল্প সুখ নিদ্রিত
রাম/ব্রহ্মদ্যামর প্রার্থিত রাম” ইতি সপ্তকাণ্ড, ৩২ অক্ষরী নাম বীজ ইত্যাদি। ভালো লাগে, শুনি, কলিতে ভক্তিই সার, আর জীবনের লক্ষ্য
ঈশ্বরলাভ নিশ্চিত করেছি তাই শুনি। এগুলি সংস্কৃত সাহিত্যের এক একটি মাস্টারপিস
বললে খুব খুব কম বলা হবে।










0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন