![]() |
| সমকালীন ছোটগল্প |
যেভাবে ঘুম ভাঙ্গে
পীতাম্বরদা একবার আমাদের বলেছিলেন,
মানুষ যদি মানুষকে না চেনে খুব একটা ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না। তবে খেয়াল রাখতে হবে কুকুররা
যেন মানুষকে ভালোভাবে চেনে। কুকুরের যদি মনে হয় এই মানুষটি অচেনা, তাহলে সে মানুষের কপালে দুঃখ আছে।
কেন বলেছিলেন, কিসের পরিপ্রেক্ষিতে,
আজ আর মনে নেই। কিন্তু কথাটা যে কতো বড়ো সত্যি সেটা কিছুদিন আগে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।
বন্ধুদের সাথে আড্ডা একটি অসম্ভব
আঠালো বস্তু। কাঁঠালের আঠার মতো লাগলে পরে ছাড়ে না। সেদিনের আড্ডাটা সেরকমই ছিল। তাই
অতিকষ্টে যখন সে আঠা ছাড়িয়ে বের হলাম, রাত অনেক গভীর হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে
নির্ঘাত অনেক দেরি হবে! ততক্ষণে খাবারদাবার ফ্রিজ বন্দী হয়ে যাবে। বউ বলেছিল কী একটা
ব্যাপারে যেন, রাত দখল কর্মসূচিতে যাবে। তার মানে ঠান্ডা খাবার মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেতে হবে। এবং সেটা করতে হবে নিঃশব্দে। ঘরের
অন্যন্য ঘুমন্ত মানুষকে না জাগিয়ে। আড্ডায় বসে সন্ধ্যে থেকে বত্রিশ কাপ চা খাওয়া
হয়েছে। বাথরুম গেছি মাত্র চারবার। চায়ের নিশ্চয় পুষ্টিগুণ আছে। কম হলেও আছে। একটা
রাত চায়ের পুষ্টিগুণের ভরসায় কাটিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। এসব অগ্র পশ্চাত ভাবতে ভাবতে
দেখলাম পথ ভুল করেছি। এটাকে কি গোদের ওপর বিষফোঁড়া বলে? তবে এটা নতুন কিছু নয়। চিরকালই
আমি পথ বিভ্রমের পাল্লায় পড়েছি। কিন্তু শেষমেশ
তাতে খুব একটা ক্ষতি কিছু হয়নি। বরং কখনো কখনো বেশ লাভই হয়েছে। অজানা কোনো লক্ষ্যে
পৌঁছে গেছি। যেটা খুব একটা মন্দ নয়। সূতরাং সেই রাতে ভুলপথে চলেছি টের পেয়েও অকুতোভয়ে
এগিয়ে চললাম। তখন হঠাৎ উনি আবির্ভুত হলেন। তিনি একটি কেঁদো কুকুর। উনি একবার আমাকে
আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে বুঝে গেলেন, এ ব্যাটা অচেনা লোক। সুতরাং একে তাড়া
করা যায়। এবং নাগালে পেলে ঘ্যাক করে কামড়ে দেওয়াও যায়। তার মনোভাব আমিও টের পেয়ে
গেলাম। সুতরাং একই সঙ্গে আমরা দুজনে ছুটতে শুরু করলাম। একটু ছোটার পরেই বোঝা গেল বত্রিশ
কাপ চায়ে যথেষ্ট পুষ্টিগুণ নেই। অচিরেই আমি কুকুরের নাগালে এসে গেলাম। এবং কুকুর আমার
পায়ে ঘ্যাক করে কামড়ে দিল। একবার? দু বার? নাকি বারংবার?
কামড় খেয়ে আমি পড়ি কি মরি করে
ছুটতেই থাকলাম। ছুটতে ছুটতে আছাড়ও খেলাম। আর মনে মনে মহান পীতাম্বরদার সেই আপ্তবাক্য
মনে করতে থাকলাম, "কুকুর যেন মানুষকে কক্ষনো অপরিচিত মনে না করে। করলে বিপদ আছে।"
বিপদে পড়লে মানুষ আশ্রয় খোঁজে। আমিও খুঁজতে থাকলাম। তিনটে বাড়ির কড়া নেড়ে একফোঁটা লাভ হলো না। বরং একটা বাড়ির কড়া নেড়ে কড়া কথা শুনতে হলো। কিন্তু চতুর্থ বাড়ির দরজা খুলে গেল।
- ওমা। আপনি তো ইয়ে, মানে গলা
শুনে আমার তো মনে হয়েছিল আপনি মহিলা!
হতে পারে। বেদম মানুষের কন্ঠস্বর
বিকৃত হয়ে যায়। আজ জানলাম সে বিকৃতিটা মহিলা সুলভও হয়। আমি কন্ঠস্বর যথাসম্ভব সংশোধন
করে বললাম,
- কুকুরে তাড়া খেয়ে দেড় মাইল
ছুটেছি । চার পাঁচটা কামড় খেয়েছি।
- আই সি! কুকুর কোথায় কোথায় কামড়েছে।
- দুই পায়ে।
- তাহলে আপনার কনুই থেকে রক্ত পড়ছে
কেন?
- কুকুরের কামড়ের সাথে সাথে আছাড়ও
খেয়েছি তো! সেটাও চার পাঁচবার।
- তার মানে একসাথে রাবিস আর এন্টি
টিটেনাস।
- রাবিস মানে?
- আরে জলাতঙ্কের ইঞ্জেকশন।
- ও বাবা। তাহলে কী হবে?
- হাসপাতালে যেতে হবে।
- এই রাত্তিরে লেংচে লেংচে হাসপাতালে?
সেটা কোথায়? কতো দূরে?
- দূর আছে। রিক্সাতে আধ ঘন্টার
পথ।
- একটা রিক্সা কি...
- অসম্ভব। এতো রাতে এখানে রিক্সা
পাবেন কোথায়! মিনিট পনেরো আগে হলে আমি যে রিক্সায় এসেছি সেটাতে যেতে পারতেন। এখন
তো সে চলে গেছে।
ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে আমি হাহাকার
করে উঠলাম-
- সব্বোনাশ!
- সব্বোনাশ! কেন সব্বোনাশ? আমি
আছি তো!
- আপনি ডাক্তার?
- না নার্স। তবে ডোন্ট কল মি সিস্টার।
আমি সিস্টার টাইপ নার্স নই। তবে একটাই সমস্যা।
- কী?
কঁকিয়ে উঠলাম আমি,
- এই ঘরে আমি একা থাকি। আপনি একজন
অপরিচিত মানুষ।
আবার মনে পড়ে গেল পীতাম্বর দার
কথা, "মানুষ যদি মানুষকে না চেনে তাতে খুব একটা ক্ষতি নেই!"
সেটাই আউড়ে দিলাম আমি।
- তা বটে। তবে আর কি আসুক অপরিচিত
মানুষ ঘরে। কিন্তু আমার তো একটা ফিস আছে!
- ফি বলতে চাইছেন কি?
- হ্যাঁ তাই।
- দেবো খন। ক্যাশপয়সা তো নেই।
অনলাইনে দেবো। চলবে?
- চলবে। আসুন। এখানে বসুন। আগে
পড়ে গিয়ে ছড়ে যাওয়া যায়গাগুলোতে লাল ওষুধ লাগাই।
- লাল ওষুধ মানে মারকিওক্রোম?
- ওমা। আপনি তো অনেক কিছুই জানেন!
তা আজকের তারিখটা জানেন?
- না মানে ঠিক...
- আজ 9th August. মনে রাখার দিন।
- ও হো।
- কী বলতেন আপনার সেই দাদা? মানুষ
যদি মানুষ না চেনে কোনো ক্ষতি নেই? কথাটা উনি ঠিক বলতেন না। ক্ষতি আছে। অপূরণীয় ক্ষতি।
- সে আবার কী?
- বুঝিয়ে দেবো খন। আপাতত আপনি
এখানে শুয়ে পড়ুন। চটপট ইঞ্জেকশনগুলো ফুঁড়ে দিই।
এরপরের কথা আমার আর মনে নেই। কারণ
আমি চোখ মেলে দেখলাম আমি একটা ধপধপে সাদা চাদরে ঢাকা বিছানায় শুয়ে আছি একা একা। এটা
কি হাসপাতাল? যদি হাসপাতাল হয় তবে কেউ কোথায়ও নেই কেন? আমি অনায়াসেই উঠে বসতে পারলাম।
মাথার কাছে আমার একটা কার্ড বোর্ড ঝুলছে। তাতে আমার কেস হিস্ট্রি লেখা আছে একটা কাগজে।
"Highly scocked. Some
bruises on various parts of the body. Mild sleeping pills given. Kept under
observation."
একি ব্যাপার! অতোগুলো কুকুরের কামড়!
তাদের কথা তো লেখেনি?
একটু পরে অনেক পায়ের শব্দ শোনা গেল। একসাথে অনেকে এগিয়ে আসছে। একজন নার্স ঘরে ঢুকে বললো,
- ওমা আপনার ঘুম ভেঙ্গে গেছে? এতো
তাড়াতাড়ি মানুষের ঘুম তো ভাঙ্গে না!
- আমার তো ভেঙ্গে গেছে।
- এতো খুব ভালো কথা। ঘুম ভাঙ্গুক
আপনার। শুধু আপনার না আপনার, আমার আমাদের সবার - এটাই তো চাই। সে জন্যই তো গেছিলাম
জমায়েতে। আপনাকে একা ফেলে। ভেরি সরি ফর দ্যাট।
আমার আবারও ঘুম পাচ্ছিল। এবং আমি আবারও ঘুমিয়েও পড়লাম। ঘুম এসে জড়িয়ে ধরার সময় শুনতে পাচ্ছিলাম কোনো তিলোত্তমার কথা। তার বিভৎস মৃত্যুর কথা। বিচারহীন বছর পেরিয়ে যাওয়ার কথা। প্রতিবাদে মানুষের রাত দখলের কথা।
আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম,
পীতাম্বরদা আফশোস করছেন। আবার যখন আমার ঘুম ভাঙ্গল, তখন আমার শিয়রের কাছে আমার স্ত্রী
বসে।
- কি গো? ঐ আঘাটায় গেছিলে কেন?
ভুতে ধরেছে শুনলাম!
- ভুত নয় তো, কুকুর? আঁচড়ে কামড়ে
আমাকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে।
- বাজে কথা। শুনলাম এই বাজে কথাটা
তুমি ওনাদেরও বলেছো।
- বাজে কথা?
- তা নয়তো কি? কুকুরে কামড়ালে
গায়ে দাগ থাকতো না!
বিস্ফারিত চোখে আমার নার্সটি বললেন,
বাজে কথা নয় দিদি। বাজে কথা নয়। কখনো কখনো ঘুম ভাঙ্গাতে কামড় খেতে হয়। সেটা কুকুরের
কামড় হলেই বেশি কার্যকর হয়।

0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন