হৈমন্তী আলো
কোজাগরী চাঁদের আলোয় ধানজমিতে কুয়াশা জমাট হয়ে নামলে অশরীরী ছায়া দোলে বাঁশবাগানের মাথায়। ডোবার পাড়ের অর্জুনগাছের হাওয়ায় বাঁশবনটা মাথা দুলিয়ে গান শোনায়। আমাদের বাঁশতলার অন্ধকার পেরিয়ে, বারদুয়ার পেরিয়ে, শঙ্খলতা পদ্মলতা বেয়ে লক্ষ্মীর চরণ এসে থামে আল্পনা আঁকা পিঁড়িটির পাশে। বেতের পাইয়ে চুড় দেওয়া ধানশিষে সুখ, সিঁদুর কৌটোয় সোহাগ ভরে রাখে গেরস্তর বৌ, ঝি। লক্ষ্মীপুজোর ভরসন্ধেয় পেয়ারাকুচি, আখের কুচি, নারকেল আর কদমার গন্ধটা উড়ে বেড়ায় অর্জুন গাছের গোড়ায়। ডোবার জলে তখনই ঘুপ করে ঘাই মারে একটা দশসেরি রুই, আর ঝুরঝুর ঝরে যায় অর্জ্জুনের ফল। মনখারাপ চারিয়ে যায় ঘাই দেওয়া জলের ঢেউয়ে।
উঁচু জমিনের ওপর দেড় বিঘৎ ফণা তুলে আছে সাপটা। চোখের পাতা পড়ে না, চিকন সবুজ গায়ে পিছলে পড়ছে সকালের প্রথম আলো। চকচক করছে শরীর। পাঁচিলের বাইরে কাপাস তুলোর গাছে গুটি ধরেছে, পেকে গিয়ে ফাটছে একটা দুটো।
আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, নীল
ক্যানভাস।
জানলার গারদ পেঁচিয়ে ধরে ঘরে ঢুকে
পড়ছে সবুজ পাতার মতো হিলহিলে শরীর।
-উঃ মা!
ছিটকে দু পা পিছিয়ে আসে চারুকেশী।
সাপ, লাউডগা সাপ!
বিন্তিপিসির মাটির উনুনে দাউদাউ জ্বলছে আগুন; সিদ্ধ ধানের গন্ধ ওড়ে উঠোনে। বুক ভরে হাওয়া টানে বিন্তিপিসি, ধানের গন্ধে ভরে ওঠে শরীর। উঠোনের কোণে কামরাঙা গাছের ছায়া, কাঠবেড়ালী ছুটে বেড়ায় ডালে, মাটির পাঁচিলে।
চারু... অ চারু...
খড়ের চালে বসা কাকদুটো ডানা ঝাপটায়, উড়ে যায় হুশ করে।
পিটুলিগোলা আল্পনা উঠোনে, আঙুলের শুকিয়ে যাওয়া সাদা দাগ ঘষে ঘষে তোলে চারুকেশী। ফুল পাতা আঁকাবাঁকা লতানো নকশার গায়ে। সাপের মতো, হিলহিলে লাউডগার শরীরের মতো নকশা… পায়ের ছাপ, পদ্মকলি।
আলগোছে নিজের দিকে তাকায় চারুকেশী। মাঠের পর মাঠ ভরে আছে ধান। সবুজ গুছি, সবজে হলুদ শীষ, হলুদ সোনার মতো ধান। ঝুড়িতে ধপধপে সাদা আলোচাল (আতপ), কুবীর (কুবের) পুজোর ভাঙা নারকেল। বিনবিনে হাওয়া লাগছে গায়ে, নাকের পাটা ফুলে ফুলে ওঠে - উঠোনজুড়ে আল্পনা আঁকে চারুকেশী।
বিন্তিপিসির চুলে দাবার ছকের পাক, খিলখিল
হাসে পিসি।
-'সাপ হল গে সম্পদ, ইঁদুর খেয়ে ফসল আগলায়,
লতা ডাকি রাতে।'
উঠোন জুড়ে লতাপাতার নকশা, আদিম
অরণ্যের হাওয়া এসে লাগে চারুকেশীর আঁচলে, এলোমেলো চুল।
-'ঠাকুদ্দা কইতো আদিম মানুষ বালিতে
সাপের চিহ্ন খুঁজতে খুঁজতে যেত, সাপ মানে খাবারের খোঁজ, পাখির পায়ের ছাপ পড়ত
বালিতে। শিকারের সন্ধান ছিল সেসব।'
চোখ বুজে বিড়বিড় করে বিন্তি ঠাকরুণ।
পাশে এসে বসে চারুকেশী।
-'তারপর তো চাষাবাদ শিখে গেল মানুষ, ফসল মজুদ করল ঘরে। মাঠেঘাটে সাপের ভয়ে ইঁদুর এল না, আর পেঁচার ভয়ে।'
বিন্তির গলা জড়িয়ে বলে চারু। জর্দা পানের গন্ধ আসে, শাঁখ বাজছে দূরে। উঠোন থেকে পায়ের ছাপ হেঁটে হেঁটে ঢুকেছে ঠাকুরঘরে, লক্ষ্মীর পটের সামনে কর্পূরের শিখা। পদ্মকুঁড়ি'র আল্পনা, মরাইয়ের বেড়। পটের সামনে সিঁদুরকৌটো, কড়ি।
জলছাপ ফুলছাপ ছবি। সমুদ্রের ভাসছে ঝিনুক, রূপবতী কন্যা জন্মেই পাড়ি দিয়েছে তীরের দিকে, ডাঙ্গার দিকে। পশ্চিমা হাওয়া ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঝিনুকের নৌকা, পত্র পুষ্পে ঢেকে যাচ্ছে রূপসী নারীটি।
ভেনাস।
বতিচেল্লির আঙুলে জন্ম নিচ্ছে
ভেনাস, বার্থ অব ভেনাস...
ছলাৎছল ঢেউ ওঠে নামে।
রংছাপ জলছাপ ঝিনুকের ভেলা, ভেসে
যাচ্ছে চারুকেশী সমুদ্রমন্থনের দেশে, পদ্মগন্ধ লেগে আছে চুলে।
ঝিনুকের নৌকা এসে দাঁড়াল ঘাটে, বিবসনা নারীটি নেমে মিলিয়ে গেল লক্ষ্মীর শরীরে।
আলপনা দেয় চারুকেশী – পেঁচা, মরাই, পদ্মকুঁড়ি। উঠোনে চাঁদের আলো। ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে অবয়ব। গুনগুন পাঁচালি পড়ে বিন্তিপিসি।
লক্ষ্মীপুজো ফুরোলেই শুরু হয়ে যায় ব্যাগ গোছানোর তোড়জোড়। ধরণী লোহারের বুড়ো রিক্সা এসে থামে দরজায়। টুং টাং ঘন্টিতে ছুটি ফুরোনোর শোক উঠলে ওঠে প্রতিবার। উঠোনের পেঁপে গাছটা ছেড়ে যেতে বড্ড মনখারাপ হয় সেসময়। পেঁপে দুটো ডাঁসিয়ে উঠেছে এই কদিনে।
দুটো লক্ষ্মীছাড়া কাঠবিড়ালি, যারা সারাদুপুর দাপিয়ে বেড়ায় উঁচু পাঁচিলটার গায়ে তারা কুরেকুরে খাবে টুকটুকে পেকে যাওয়া পেঁপে। কদিন আগেই যে কুসি শশাগুলো ধরেছিল জমির গায়ে, তাদের বড় হয়ে ওঠার আগেই খুলে যাবে স্কুল। কোঁচড়ে কুসুমবীজ ছড়ানো হলুদমুড়ির সাথে খাওয়া হল না সেসব। খাটের তলায় রাখা পাকা কৎবেলের ভুরভুর গন্ধ অন্ধকার মেঝেয় লাট খাওয়ার আগেই চলে যেতে হয়। পড়ে থাকে মোরামের রাস্তা, ক্যানেলের পাড়, ঝুপঝুপে বাঁশবন। দুপাশের ধান জমিতে পোকার দল ইড়িং পিড়িং উড়তে উড়তে পিছু নেয় বেশ খানিকটা। দেখতে দেখতে শালবন ছাড়িয়ে দূরে, আরও দূরে চলে যাই আমরা। হিমপড়া রাতে কাঠকুটো আর আকাশ প্রদীপ জ্বেলে গ্রাম পড়ে থাকে পেছনে, একা।
প্রতিবারের মতো সেবার অবশ্য গেলাম না আমরা। লক্ষ্মীপুজো পার করে পুজো ফুরোলো। কার্তিকের ভোরে ঘরে ঘরে নাম দিতে এল আমাদের গোবিন্দ গোঁসাই। আবছা ভোরে আমাদের দোতলার বারান্দায় থৈ থৈ কুয়াশা আর এল একদল হরিয়াল পাখি। হেমন্তের হলুদ রোদ সবজে হলুদ ধানশিষ আর কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে পিছলে গেল শিশিরের গায়ে। তিরতির করে শীত ঢুকতে শুরু করল আমাদের কলাপাতার ফাঁক গলে, বারান্দার গ্রিল পেরিয়ে ঘরে।
ভর সন্ধেয় চিলেকোঠার ছাদে ঠাকুমা লন্ঠন ঝুলিয়ে দেয় বাঁশের আগায়। ঘরে ঘরে, সব ঘরে একে একে জ্বলে ওঠে টিমটিমে আলো আকাশের গায়ে। বনবাদাড় ধানক্ষেত ঝেঁটিয়ে শ্যামাপোকা এসে বসে আলোর গায়ে আর আমাদের অশরীরী পূর্বপুরুষ সব আলোপথ ধরে একে একে নেমে আসে ছাদে, ঘর চিনে। দাদুর কোলের কাছে জড়োসড় হয়ে বসে এসব কথা শুনতে শুনতে রাত হয়ে যায়।
বিকেলের রোদ একফালি হয়ে আমাদের পেয়ারাতলায় ডিগবাজি খেয়ে উঠে যায় সেজদাদুর অ্যাসবেস্টসের ছাদে। সেই ছাদঘরের মাটির সিঁড়ি টপকে কলার বাকসো কাটতে আসে সুমিপিসি। লালুদের খামারের পেছনে যে টোপা কুলের গাছ সেখান থেকেই পটপট কটা কুলপাতা ছিঁড়ে আনে রোজ। আকন্দ, নয়নতারা, কুন্দফুলের জোগাড় করে মণি। সন্ধে নামার ঠিক আগে একহাত লম্বা বাসকোর দুধারে ফুল, দুব্বাগাছি, কুলপাতা সাজিয়ে, কলার ছোট্ট ছোট্ট চৌকো খোলে কুলপাতার ওপর দুটো সলতে জ্বেলে দেয় সুমি পিসি। দুজনে সাজিয়ে গুছিয়ে কলার বাসকো নিয়ে দাঁড়াই সদর দরজায়। একে একে মনি আসে, টুসি আসে, চন্দনা আসে। আমরা মিশে যাই দলটার সাথে। সুর করে গানের মতো গাইতে গাইতে এগিয়ে যায় আলোগুলো
"কুলকুলতি কুলের বাতি
তোমার তলায় দিয়ে বাতি
অরণ ঠাকুর বরণে
ফুল ফুটেছে চরণে..."
একে একে ফুলের মতো ফুটে ওঠে তারা, বিন্দু বিন্দু আলোর ফুটকি আকাশের গায়ে। অর্জুন গাছের মাথায় পাখিরা মুখ বাড়িয়ে দেখে আলোর ফোঁটাগুলো, এখন ওরা কিচমিচ করে না আর ।
পুকুরঘাটে হাঁটুজলে নামতে হয় সাবধানে। জামা ভিজে গেলে বকুনি জুটবে ঠিক। কলার বাসকোগুলো ভাসিয়ে ঢেউয়ের গায়ে ঢেউ সইয়ে দিলে ধাক্কা খেতে খেতে ভেলাগুলো ভেসে যায় দূরে। আলো পড়ে চিকচিক করে ওঠে জল। ভেলাগুলো আলো নিয়ে ভেসে যায় মৃত মানুষের কাছে। বাবলার ঝোপ আর হেলেঞ্চায় ছাওয়া শ্মশানঘাটে জেগে ওঠে আমাদের পূর্বপুরুষ।
তাল, বট, অর্জুনের ছায়ায় ঢাকা গ্রাম আর তার পুকুরপাড়ের থেকে দূরে কলার মান্দাস ভেসে যায় জলে, আলো নিয়ে। মৃত আত্মাদের উদ্দেশে আলোর খবর নিয়ে। তাইল্যানডের লয় ক্রাথংয়ের সাথে কুলকুলোতির প্রদীপগুলো মিশে যায় স্বর্গের ওপারে, মৃতদের দেশে, হিমপড়া রাতের আঁধারে।
গাঁয়ের ওপারে দীঘির পাড় ছুঁয়ে, শাল সেগুনের জঙ্গল থেকে শীতের খবর আনে হাওয়া। কৎবেল-মাখা জরিয়ে নেওয়া রোদে ফিনফিনে ঠান্ডা লুটোপুটি খায় সারাদুপুর। নুন লঙ্কা কাঁচা তেল আর গুড় মাখানো কৎবেল খেতে খেতে টাকরায় টকাস করে শব্দ উঠলে লেজ উঁচিয়ে ছুট্টে পালানোর আগে কাঠবিড়ালিগুলো পুটুস পুটুস চায়।
আমাদের ঘরের পিছনের বাগান আর উঠোন
জুড়ে তখন শুধুই কিচকিচ কিচকিচ...

0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন