কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(৩৮)

কিন্তু চমকের আরও বাকি ছিল। কয়েকদিন পর বিশ্রুত এসে একটা খবর দিল। মেট্রো স্টেশনে বিরাট হোর্ডিং দেখে এসেছে সে। সামনে পুজোয় নতুন সিডি বেরোচ্ছে। সমিধা আর আগ্নেয়র ডুয়েট। গানপগুলো লিখেছে আগ্নেয়। সমিধা সুর দিয়েছে।

হৃদয় তখন সমিধার ডকুমেন্টারি নিয়ে খুব খাটছে। হঠাৎ একদিন সমিধা জানতে চাইল, ফুল নিয়ে কয়েকটা গান দরকার। নিজেই সুর দেব আর গাইব। কিন্তু কে লিখবে গান?

হৃদয় বলেছিল, আমি লিখতে পারি।

তুই? হো হো করে হেসে উঠেছিল সমিধা। তারপর রীতিমতো তাচ্ছিল্য করেই বলে উঠেছিল, আজকের ছেলেমেয়েরা কী চায়, তুই তার কি বুঝিস?

সমিধা আগে কখনও এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেনি হৃদয়কে নিয়ে। একটু চমকে গেছিল হৃদয়। কিন্তু বল তো সমিধার কোর্টে। ও না চাইলে সে কী করতে পারে? হৃদয় তবু বলেছিল, কিন্তু গানগুলো তো ফুল নিয়ে।

তাতে কী? গানগুলো লিখতে হবে শ্রোতাদের কথা ভেবে। আমার শ্রোতা কোন সময়ের , কোন বয়সের, কী চায় তারা। শুধু অতলান্তকে এখন যদি পেতাম...

শেষ কথাগুলো একটু যেন অন্যমনপ্সকভাবেই বলে ওঠে সমিধা। বিশ্রুতর কথা শুনে হঠাৎ হৃদয়ের মনে হল, সমিধা চমৎকার অভিনয় শিখে গেছে। ইচ্ছে করেই ওকে শুনিয়ে সেদিন কথাগুলো বলেছিল। অতলান্ত এখন একজন সফল মানুষ। ওর নাম করে সাফল্যের একটা দৃষ্টান্ত টানতে চেয়েছিল সমিধা, যাতে হৃদয়ের ব্যর্থতাটা ওর নিজেরই চোখে আরও বড়ো হয়ে ওঠে।

নাঃ, আমি কোনও সফল মানুষ নই। তাই বলে আমাকে নিয়ে ও যা খুশি করতে পারে না। এখন আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারছি।

কী বুঝতে পারছিস তুই? বিশ্রুত জানতে চায়।

সে অনেক কথা। আমি সব বুঝতে পারছি। সেদিন ওরা আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিল। আসলে সেদিনই ওদের রেকর্ডিং ছিল। ওরা তাই নিয়েই সকাল থেকে একসঙ্গে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু সেকথা ওরা চেপে গেল। কেন এরকম করল ওরা? সমিধা আমাকে দিয়ে গানগুলো লেখাল না। আগ্নেয়কে দিয়ে লেখাল। অথচ কতদিন ধরে গান লেখার ইচ্ছা আমার। ও সেটা জানত। এর আগে আমাকে শুটিং-এ নিয়ে গেল না। কিন্তু ডকুমেন্টারিতে আগ্নেয়কে দিয়ে অভিনয় করাল। কতদিন ধরে অভিনয় করার ইচ্ছা আমার। ও দেখাতে চায় আমি আর আগ্নেয় দু-জনেই ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বরং আগ্নেয় সম্পর্কেই কখনও কখনও ওকে মুখ খুলতে দেখেছি। সবটাই আসলে ফাঁদ। ও আগ্নেয়কে ব্যবহার করেছে, আগ্নেয়র মেধাকে, আমার ওপর আগ্নেয়র বিদ্বেষকে। আর আগ্নেয় ওকে ব্যবহার করেছে, যেহেতু ও চায় আমাকে শাস্তি দিতে, প্রতিশোধ নিতে। ওরা একে অপরকে ব্যবহার করেছে, একে অপরের সহযোগী হয়ে উঠেছে। সমিধার অনেক টাকা। ও চাইলেই ডকুমেন্টারি বানাতে পারে, সিডি করতে পারে, কিন্তু আমাকে ও সুযোগ দেবে না। ও নিজে সফল হয়ে আমাকে দেখাবে। সেই সাফল্যই হবে আমার শাস্তি। ও আমাকে দেখাবে, একদিন ওকে আমি ফিরিয়ে দিয়ে কতবড়ো ভুল করেছি। সেটাই ওর গোপন উদ্দেশ্য। সেদিন ইচ্ছা করেই ও আগ্নেয়র কথাটা চেপে গিয়েছিল। কারণ তাহলে আমার সন্দেহ হত। সমিধা জানে, আমি ওকে বিশ্বাস করি, আগ্নেয়কে নয়। ওরা দুজনে রেকর্ডিং করে এল। কিন্তু সফল হওয়াই ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। আমাকে শাস্তি দিতে চায় ওরা। আমার বাড়িতে ওরা এল নিছক কৌতুক করতে, খাওয়াদাওয়া করল, গল্প করল, তারপর চলে গেল। আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমাকে প্রতারণা করে গেল। সেদিন ওদের সাফল্যের দিন। সেই সাফল্যকেই ওরা সেলিব্রেট করে গেল। আমাকে বঞ্চনা করল ওরা অথচ সেলিব্রেশনটা হল আমারই বাড়িতে, আমার চোখের সামনে, আমারই অজ্ঞাতে। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, সেদিন আমাকে নিয়ে কী হাসিঠাট্টাই না করেছে ওরা। যেদিন আমি সত্যিটা জানতে পারব, সেদিন কতটা দমে যাব, সেসব নিয়েও হয়ত মজা করেছে। হ্যাঁ, এতদিনে আমি সমধার সমস্ত আচরণের ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি। বন্ধুত্বে মুখোশ পরে দিনের পর দিন ও আমাকে ঠকিয়ে গেছে। আমাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছে। আর আমি ওকে বিশ্বাস করে গেছি। অনেকদিন আগেই ও আমাকে ত্যাগ করেছে। প্রত্যাখ্যান করেছে। আর আমি কি না ওকে আঁকড়ে ধরে আছি! নিয়তির কী পরিহাস!

দোষটা তোরই হৃদয়, হঠাত সাঁঝ বলে ওঠে। সেই মুহূর্তেই সে ঘরে প্রবেশ করে। বলে, তুই ওকে দুর্বল ভেবেছিলি। ওকে অবহেলা করেছিলি। ওকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিস নি। তুই ওর প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করেছিলি। ও তোড় বন্ধুত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এবার তুই ওকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবি। ও তোকে যথেষ্ট শাস্তি দিয়েছে।

হ্যাঁ, যথেষ্ট শাস্তি, হৃদয় বলে। দিনের পর দিন ওরা দল বেঁধে আমার মুণ্ডপাত করে গেছে। আমি ভেবেছি ওরা বন্ধুত্বের দায়িত্ব পালন করছে। বিশ্রুতকে দিশারীর কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছে কে, আমার বিরুদ্ধে কে উস্কানি দিয়েছে? মেহুলী একাই সব করেছে? সমিধার কোনও ভূমিকা নেই? দিশারী আমার বন্ধু ছিল। ফুলের বাগানেরও। মেহুলী চেয়েছে বিশ্রুত শুধু ওরই হোক। আমাকে বাদ দিয়ে। ফুলের বাগানকে বাদ দিয়ে। আমি সেই সমিধাকে চিনতাম যার মধ্যে শুধু ওর মা রয়েছে। কিন্তু সমিধা এখন পালটে গেছে। বাবা ছাড়া ওর মুখে এখন আর কোনও কথা নেই। কেন? কী পাবে ও বাবার কাছ থেকে? বিপুল অর্থ। সম্পত্তি। যা দিয়ে ও যশ কিনবে, ক্ষমতা কিনবে। ওর তাই বাবাকে চাই। সারাদিন মুখে বাবার ভজনা করছে। ও কি সত্যিই ওর বাবাকে ভালোবাসে? আমার মতোই ও হয়ত ওর বাবার সঙ্গেও প্রতারণা করছে। ওর বাবার স্নেহের সুযোগ নিচ্ছে। বৃদ্ধ বয়সে তাঁর অসহায়তাক্লে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে। বদলা নিচ্ছে। শাস্তি দিচ্ছে। শায়েস্তা করছে। যাকে ও সারা জীবন ঘৃণা করে এসেছে, তাকে হঠাৎ এত ভালোবাসার কারণ কি? এটাই কি যথেষ্ট সন্দেহজনক নয়? যখন ও ভালোবাসতে জানত, তখন ওকে কেউ সাড়া দেয়নি। এখন ওর মন জুড়ে শুধু ঘৃণা আর লোভ। নষ্ট হয়ে গেছে ওর ভেতরটা। ওর ব্যাপারে আমাদের সাবধানী হতে হবে। ওকে আর একটুও বিশ্বাস করা যাবে না।

কিছুদিন পর সমিধা ফোন করল। বলল, হৃদয় আমাদের একটা অনুষ্ঠান আছে। আমি আর আগ্নেয় একসঙ্গে গাইব। অতলান্তের কম্পানির ফাউণ্ডেশন ডে। তুই আসবি?

না। সংক্ষেপে জবাব দিল হৃদয়। আমার কাজ আছে।

হৃদয় বুঝতে পেরেছিল, নিজের আরও একটু সাফল্য, আরও একটু যশ, তারই সাক্ষী হৃদয়কে রাখতে চায় সমিধা। মৃদু শাস্তি।

হৃদয় তোকে আসতেই হবে। সমিধা বলল। টিকিটের দায়িত্বে থাকবে বিহান। ওকে বলে রাখছি। তুই ওকে একটা ফোন করে নিস। তোর কটা টিকিট লাগবে?

না, আমি আসতে পারছি না। হৃদয় দৃঢ়স্বরে বলে।

সমিধা হঠাৎ যেন ফেটে পড়ে। আমি জানতাম, তুই একথাই বলবি। কেন জানিস? তুই শুধু নিজেকে ভালোবাসিস। আর জকাউকে না। কোনও কিছুকে না। অসম্ভব স্বার্থপর তুই। আর তেমনই সঙ্কীর্ণ। কেন তুই ফুলের বাগান করেছিলি? নিজের জন্য। নিজের স্বার্থে। ওটা করে অনেক যশ পেয়েছিস তুই। লোকে তোকে চিনেছে। আর কার কী হয়েছে? আসলে তুই যা করিস, শুধু নিজের লাভের কথা ভেবেই করিস। যা ভাবিস, সবার আগে নিজের সুবিধার কথা ভাবিস। ওই জন্য তোর কোনও কিছুই দাঁড়ায় না। ফুল নিয়ে তোর কোনও স্কেচই তাই দাঁড়ায় নি। তোর প্রতিটি স্কেচ আমি আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। ফুল নিয়ে একটা শর্ট ফিল্ম বানাবো আমি। ভাবলাম, যদি কোনও কাজে আসে। সবই পণ্ডোশ্রম। সবই বৃথা। কিস্যু নেই। ফুলের ছবি আঁকতে গিয়েও আসলে তুই নিজের ছবিই এঁকেছিস। ফুল নয়, ওগুলো সব তোর আত্মপ্রতিকৃতি। তোর আত্মমুগ্ধতার ফসল ওইসব ছবি। শুধু এই কারণেই জীবনে তোর কিস্যু হয়নি। কিস্যু না। আর হবেওনা কিছু। হৃদয়, হৃদয়, তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? আঃ, হুইস্কি, হুইস্কি, এটাই এখন আমার জীবন...

পাচ্ছি। সংক্ষেপে বলল হৃদয়।

সমিধার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। নেশা করেছে। ও বলে যাচ্ছিল, তুই আসবি না কেন জানিস? কারণ এতে তোর কোনও ফায়দা নেই। আমি সব বুঝি। কোনও ফায়দা নেই তোর। তাই তুই আসবি না। তুই একটা স্কাউণ্ড্রেল। তোকে আমি কত ভালোবেসেছিলাম। কত ভালোবাসা। আমার মতো করে কেউ তোকে ভালোবাসতে পারবে না। কেউ না। আমি জানি। তুই কিছু ধরতেই পারলি না। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত সব সময়ে। এটাই তোর হওয়ার ছিল। তুই ব্যর্থ। লোককে জ্ঞান দেওয়াটা এবার একটু বন্ধ কর। অনেক তো লার্ন করলি। এবার একটু আনলার্ন কর। সব ভুলে যা। সব বোঝাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে দে। নিজের ছোট্ট পৃথিবীটা ছেড়ে বেরিয়ে পড়। খোলা পৃথিবীতে এসে দাঁড়া। দ্যাখ সেই পৃথিবী কত সুন্দর, কত অদ্ভুত, কত চমৎকার, আর কী আশ্চর্য! আমি সেই পৃথিবীকে দেখেছি। বিহানকে আমি বলে দিয়েছি, যদি ওকে বিয়েও করি, কোনও দিন মা হব না আমি। ওসব দায়িত্ব আমার পোষাবে না। আমি শুধু কাজ করে যাব। কাজ করার জন্য এইটুকু আত্মত্যাগ আমাকে করতেই হবে। তোকেও সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। ঝাড়া হাত-পা হতে হবে। তবেই তুই সফল হবি। নইলে তোর কিস্যু হবে না। কিস্যু না। এই তোকে বলে রাখলাম আমি। আমার মতো কেউ কখনও ভালোবাসেনি তোকে।

সমিধা এবার ফোন রেখে দিল। শেষের দিকে ওর গলা খুবই অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল। জড়িয়ে যাচ্ছিল গলা। কোনওদিন ওকে এভাবে কথা বলতে শোনেনি হৃদয়। একবার ছাড়া। সেবার ওকে নিজের ভালোবাসা জানিয়েছিল সমিধা। এবার ঘৃণা উগড়ে দিল। কিন্তু এই ঘৃণায় কোনও জ্বালা নেই। এই ঘৃণার কথাগুলোও ভালোবাসা দিয়ে আড়াল করা। তাই বুলেটের মতো শব্দগুলো বুকে এসে বিঁধলেও মনের মধ্যে কোনও অস্থিরতা জাগে না। তাছাড়া যে সম্পর্ক মৃত, তার ওপর দিয়ে যত জোরেই বাতাস বয়ে যাক, মৃতদেহে কোনও সাড়া জাগে কি? হৃদয়েরও অনুভূতি যেন অবশ হয়ে এল। শুধু এইটুকু। কোনও জ্বালা নেই। সে শুধু কিছুক্ষণ কোনও কাজ করতে পারল না। কোনও কিছুতে মন বসাতে পারল না।

(ক্রমশঃ)  

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন