কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

হে নেপথ্যচারিণী

 


(১৫)     

বিক্ষেপ

বিসর্জন বিজয়া উৎসবপর্বে কিছুদিন যে সামান্য স্লথ জীবনযাত্রা সাধারণত আচ্ছন্ন করত বাঙালিকে একদিন, আজকাল আর তেমন করে না। প্রযুক্তিজগতের মানুষের জীবনের ঘড়ির কাঁটা চলে পাশ্চাত্য দেশের ঘড়ি মিলিয়ে। একধরনের প্রচ্ছন্ন অনুদাসপ্রথা। অবশ্য আমার পেশাও কি সেই দোষ মুক্ত! সমাজে সব অনুঘটকের বিরতি ঘটে। তবু হিংসার শেষ হয় না। তার এক অন্যতম কারণ এই হিংসার জড় মানুষের অবচেতনে। আর সেই হিংসার সঙ্গে শব, আর শবের সঙ্গে আমার আর অত্রির জীবন অতোপ্রতভাবেই জড়িয়ে রয়েছে। এর এক বিকল্প বিশ্বে অবস্থান করে আশুদা। ঘটনা ক্রম ও সিস্টেমের প্রত্যাশার ঘূর্ণাচক্র থেকে সে ছিন্ন হয়েছে সদিচ্ছায়। কিন্তু নিজস্ব বিবেকের প্রত্যাশা থেকে ছিন্ন হতে পেরেছে কী?টলিপাড়ায় মধুরাদেবীর অস্বাভাবিক ত্রিনেত্র মৃত্যুর পর আশুদাকে অস্বাভাবিক গম্ভীর দেখছিলাম কিছুদিন। বসার ঘরে নিজস্ব কালার স্ফিয়ারের সামনে বসে নিজের মনেই কী যেন ভাবছে। তবে কী রহস্যভেদের সেই চরম মুহূর্ত ক্রমশ এগিয়ে আসছে?কে সেই হন্তারক? হুড পরা আগন্তুক? নাকি সোহরাব নিজে! অথচ মধুরার সামনে সোহরাব যেভাবে ভেঙে পড়ল, তাতে মনে হল না নিজের প্রেয়সীকে অমন নৃশংসভাবে খুন করতে পারে সে!কিন্তু আমার সে ধারণা তো ভুল হতেও পারে! আমিও কি এক অদৃশ্র যুক্তিতর্কের রঙিন গোলকের অনুদাস নই!নাকি অত্রি!তার ঘুমের ভিতরের সত্তা আর জেগে থাকা অস্তিত্বের ভিতরেই কি সেই নৃশংস আততায়ী লুকিয়ে আছে।

লক্ষ্মীপুজোর আবহ লেক রোডের ধারে। ফুটপাথে ফুলমালার পসরা বসেছে। সেসব আমাদের উঁচু বাড়ির কাঁচের শার্সি দিয়ে নীচে তাকালে দেখা যায়। আজ কাজ কম আমার। আজ কলেজে ডিপার্টমেন্ট সামলাচ্ছে জয়ন্ত। ডাঃ জয়ন্ত সরকার। কফি মেশিনে কফি সেট আপ করে আশুদাকে বললাম, "কিছু বুঝতে পারলে?" আশুদা কালার স্ফিয়ারের থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, "রঙ আর মানুষের মন, পরস্পর পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য। বুঝলি অর্ক!"

-কী রকম?

-বলছি। কফিটা নিয়ে এদিকে আয়। বলছি সব। বোস আগে।

কফি নিয়ে রঙের গোলকের সামনে বসে দেখলাম গোলকের ভিতর বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। গোলকের মাঝ বরাবর একটা উলম্ব রড অক্ষর মতো উঠে গেছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তার দেহ থেকে নানান স্তরে নব্বই ডিগ্রির মাপে বেরিয়ে এসেছে কয়েকটা শাখা প্রশাখা। প্রতিটি শাখা বা প্রশাখার শীর্ষে একটা ছোট রঙহীন প্লাস্টিকের বল লাগানো হয়েছে। তার ওপর একটি করে অক্ষর বসানো। অনুমান করলাম অক্ষর গুলি হয়তো এক একটি রঙের আদ্যোক্ষর। যেমন 'ল' মানে 'লাল'। তেমনই 'হ' হলুদ, 'স' সবুজ, 'ন' নীল আর 'ব' বেগুনি। সম্পূর্ণ এই স্থাপনা দেখলে মনে হবে গোলকের ভিতর যেন এক কৃত্রিম গাছ স্থাপন করেছে কেউ। আশুদা বলল।

-স্ফিয়ারের ভিতরে যেটা দেখছিস, ওটার নাম 'কালার ট্রি'।রঙের গাছ। প্রতিটি শাখা প্রশাখা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বের করা হয়েছে। এই প্রতিটি অবস্থান যুক্তিপূর্ণ ভাবেই স্থাপিত। যুক্তি ছাড়া রঙের এই গাছ তৈরি অসম্ভব। ঠিক আমাদের মনের অবচেতনের মতো। বাইরে থেকে তা যতোই এলোমেলো অযৌক্তিক দেখতে লাগুক, ভিতরে ব্যবচ্ছেদ করে ঢুকে গেলে দেখবি প্রতিটি চিন্তা, আচরণ ও বিন্যাসের একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে। কোনও ছোট্ট শিশুকে এই রঙের মিশ্রণ দেখালে যে অনুভূতি তৈরি হয়, তাও অনেকটা এই রহস্য সমাধানের অনুভূতির মতো। একটা বিভা দেখতে পারছি। অথচ আলাদা আলাদা করে রঙগুলির তরঙ্গদৈর্ঘ এখনও মেপে উঠতে পারছি না।

-এই ত্রিনেত্র রহস্যটা তো এবার বেশ ভাবনার বিষয় হচ্ছে কী বল আশুদা? উৎসবের ভিতর খোদ টলিপাড়ার মতো জায়গায় খুন! বোঝা যায় আততায়ী কতো বেপরোয়া।

-ঠিক বলেছিস অর্ক। ‘ব্রাভো বেপরোয়া' ইজ দ্য ওয়ার্ড। ঠাণ্ডা পরিকল্পিত মাথার খুন যে এগুলো নয়, এই সম্ভাবনা  আমার মনেও নিশ্চয়তা পাচ্ছে ক্রমশ। আততায়ীর আচরণে অবচেতনের প্রভাব মারাত্মক!

-কোনও ক্লু পেলে?

-কয়েকটা ইনফরমেশন দরকার। যেহেতু অত্রিও এই রহস্যের সঙ্গে খানিকটা জরিয়ে, তাই তার নেপথ্যচারিণীও আমার ভাবনার বিষয়। সর্বানন্দ ঝাকে ফোন করেছিলাম কাল। বাঙ্গালোর থেকে একটা ইনফরমেশন দিতে বলেছি। দেখি কি বলে!

-আর?

-আর তথাগতকে বলেছি অন্য একটা অ্যাঙ্গেল দেখে রাখতে। আর মনসুর গাজিকে খুঁজে বের করতে হবে।

-তাকেও কী সন্দেহে রাখছ তুমি?

--কী শিখিয়েছে এতোদিন এই অপরাধজগত তোকে?

-জানি। কেউই সন্দেহের উর্ধ্বে নয়।

--গুড। আপাতত আমি একটু গড়িয়াহাট হকার মার্কেট যাবো। একটা জিনিস অর্ডার করেছি। আজ দেবে বলেছে। তুই যেতে চাইলে চল।

-বেশ তো। চলো।

তৈরি হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হকার মার্কেটের বেসমেন্টে বাঁদিকে আশুদার এক পরিচিত লোক আছে জানি। দু একবার আশুদার আঁকা ছবি উনি বাঁধাই করে দেন। নাম নিলয়দা। আমরা সেই নিলয়দার দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম।

নিলয়দা ছবি বাঁধাইয়ের কাজে ব্যস্ত ছিল। আমাদের আসতে দেখে উঠে এল। আশুদা বলল, "যেটা বানাতে দিয়েছিলাম, সেটা তৈরি?" নিলয়দা ঘাড় নেড়ে বলল,"একদম রেডি। এখনই আনছি।" ভিতরের ঘর থেকে নিলয়দা একটা মুখোশ এনে বলল,"যেমন ছবি পাঠিয়েছিলেন তেমনটাই রেখেছি।" আশুদা সপ্রশংস চোখে বলল, "দারুণ হয়েছে নিলয়দা।" পেপার পাল্পের তৈরি একটি মুখোশ। মুখোশের একটা দিক রত্তির। আরেকটা দিক মিত্তির। ঠিক যেমনটি জগদলপুরে দেখেছিলাম।মুখোশটা সযত্নে আবার কাগজ মুড়ে প্যাক করে রাখল আশুদা। গাড়িতে উঠতে উঠতে বললাম, "এটা নিয়ে কী করবে আশুদা?" আশুদা মুচকি হেসে বলল, "খুব শিগগিরই জানতে পারবি। যাবার পথে একবার তথাগতর সঙ্গে দেখা করে যাই চল।ও বলল ও লেক থানাতেই আছে।"

         আশুদার কথামতো আমরা লেকথানায় চললাম। তথাগত অধিকারী যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। আসতেই আশুদাকে বলল, "সেদিন টলিপাড়ার গার্ডটার সন্ধান পাওয়া গেছে। নাম রফিক আহমেদ।"

-ধরতে পারলে?

-না। আজ রাতে আশা করছি পেয়ে যাব। ঘটনাটা ঘটার খবর পেতেই বসিরহাটে পালিয়েছে। ওখানকার থানা সব জানে।

-গুড। ওকে ধরতে পারলে আমাকে ডেকো। একটু কথা বলতে চাই।

-কিছু ধরতে পারলেন?

-প্রায় পেরে গেছি। একটা কথা। ওই সোহরাব চক্রবর্তী ছেলেটার ওপর নজর রাখুন। জরুরি।

-ওকে স্যার।

              ফ্ল্যাটে পৌছে বেসমেন্টে গাড়ি পার্ক করতে যাবো, হঠাৎ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমাদের গাড়ি পার্কের পাশের জায়গায় একটা কালো রেঞ্জরোভার দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়িটা মিস্টার কেডিয়ার। আমাদের ফ্ল্যাটেই থাকেন। ওকালতি করেন। সেই গাড়ির আড়াল থেকে হঠাৎ একটা লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল আশুদার ওপর। আশুদাও নিমেষের ঝটকায় লোকটিকে ধরাশায়ী করল। ঝটাপটির আওয়াজে বেসমেন্টে পাহাদারী গার্ড ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এল। ততক্ষণে ধ্বস্তাধ্বস্তিতে আততায়ীর মুখের উপর থেকে কাপড় সরে গেছে। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,"মনসুর গাজি!!"

আশুদা শান্ত হয়ে পাহাদারকে বলল, "আপনি যান। সব ঠিক আছে। এ আমাদের চেনা লোক।"

মনসুর ধুলো ঝেড়ে উঠতে উঠতে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করে বলতে লাগল, "কাজটা ভালো করলেন না আপনারা। আমার পিছনে পুলিশ লাগিয়েছেন। কোনও কাজ করতে দিচ্ছে না। ঘর থেকে বের হতে পারছি না।" আশুদা শান্ত হয়ে বলল, "ওপরে চলো মনসুর গাজী। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ওপরে গিয়ে কথা বলি। এসো।"

            সোফাতে সন্ত্রস্ত হয়ে বসে আছে মনসুর। প্রথমদিনের আলাপে তার ভিতর যে তুমুল আত্মবিশ্বাস দেখেছিলাম, আজ তার চোখেমুখে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। আশুদা মুখোমুখি মনসুরের সামনে বসে বলল।

-রেশমী কেমন আছে মনসুর?

-ভালো। কী জানতে চান বলুন? আমি ওই খুনের ব্যাপারে কিছু জানি না।

-কোন খুন?

-ওই যে যে খুনটা নিয়ে কাগজে লিখালিখি হচ্ছে এখন।

-বেশ তো। যে খুনের ব্যাপারে জানো তার ব্যাপারেই না হয় বলো।

-কোন খুন?

-শকুন্তলা ম্যাডামের খুন।

মনসুরের চোখমুখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে। যেন যে কোনও মুহূর্তে সে উত্তেজনায় বিস্ফারিত হবে। আমি তাকে এক গ্লাস জল এনে দিতেই সে সেটুকু ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল। তারপর বলল, "ওই খুনের বিষয়ে আমি কিছু জানলে খুনি এতোদিন জিন্দা থাকত না।"

-বেশ। বলো মনসুর। তুমি তো অলোককৃষ্ণকে চিনতে। অত্রির বৌ সুচন্দ্রার সঙ্গে তোমার কী কথা হয়েছে বলো।

-সুচন্দ্রাদিদিকে ছোটবেলা থেকে দেখছি। ওর বাবা ইনসান নয়, ফরিস্তা ছিল। একবার আমার আপার উদুরি হলো। ডাক্তার বলল ইঞ্জেকশন দিতে হবে। এক এক ইঞ্জেকশন দাম পঁচিশ হাজার টাকা। কিন্তু অলোক স্যারকে বলামাত্র উনি এগিয়ে এলেন। আজ আমার আপা বেঁচে আছে ওনার জন্য। আর ওর মা, শকুন্তলা ম্যাডাম। কী অপূর্ব তার গলা! ওদের পরিবারের সঙ্গে অমন হবে কখনও ভাবিনি। তাই সুচন্দ্রাদিদি বড় হয়ে কলকাতা ফিরে এলে আমি ওর সঙ্গে দেখা করি। ওকে কথা দিই, ওর মা আর বাবাকে যে খুন করেছে তাকে আমি বের করবোই। কিন্তু দেরি করে ফেললাম। ততোদিনে ওই মুরারী ডাক্তারের ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। আমি মুরারী ডাক্তারের ব্যাপারে আগেই সতর্ক করতে চেয়েছিলাম অলোকবাবুকে। কিন্তু সময় পেলাম না।

-কিন্তু পুলিশের খাতায় তো অভিনন্দন শিকদার ধরা পড়েছে। তাকে রাগের বশে খুন করেই তো অলোককৃষ্ণর জেলহাজত। অলোককৃষ্ণকে খুন করেছ বলছ কেন? আর এতে ডাক্তার মুরারী পালচৌধুরীরই বা অপরাধটা কোথায়?

মনসুর গ্লাসের বাকি জল ঢকঢক করে খেয়ে বলল, "আছে আছে। আপনারা জানেন না কিছুই। যেদিন শকুন্তলাদেবী মার্ডার হলো, সেদিন ঘরে অভিনন্দন ছাড়াও অন্য কেউ ছিল। সুচন্দ্রাদিদি আমাকে বলেছে।"

-তোমাকে বলেছে সুচন্দ্রা? অথচ পুলিশের কাছে তো কিছুই বলেনি। আশ্চর্য!

-বলেনি। কারণ দিদি কারোকে বিশ্বাস করত না। আমি দিদিকে জাদু দিয়ে বেহুঁশ করে জেনেছি। সজ্ঞানে দিদি কিছু বলবে না।

আশুদা নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলল, "আই সি।ডিনায়াল!"তারপর মনসুরকে বলল, "আর ডাক্তার মুরারী পালচৌধুরী এখানে জড়িয়ে আছে তার প্রমাণ?"

-প্রমাণ আছে। বলেই মনসুর এদিক ওদিক তাকিয়ে চুপ করে গেল। আশুদা তার কাঁধে হাত দিয়ে নীচুস্বরে বলল, "শোনো মনসুর। তোমার আর আমাদের মূল লক্ষ্য কিন্তু এক। তোমার মতো আমরাও চাই অপরাধী কে খুঁজে বের করতে। তোমার অনুমান ঠিক। শকুন্তলাদেবীকে একা অভিনন্দন খুন করেনি। ওর সঙ্গে আরও কেউ ছিল। তার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। কিন্তু ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সুচন্দ্রার মনের ভিতর সেই ভয়ানক স্মৃতি এখন অবচেতনে লুকিয়ে আছে। তাকে বের করতে গেলে তোমার সাহায্যর আমাদের প্রয়োজন মনসুর। কী প্রমাণ আছে বলো?

-একটা অ্যালবাম। অলোকস্যার নিজে দিয়েছিল আমাকে। বলেছিল পুড়িয়ে ফেলতে। আমি ফেলিনি। রেখে দিয়েছিলাম।

আমি আর আশুদা চোখ চাওয়াচাওয়ি করি।

-আমাদের একবার দেখাতে পারবে ওই অ্যালবামটা মনসুর?

মনসুর একটু ভেবে বলল,"ঠিক আছে। কাল নিয়ে আসব। বিকেলবেলা।"

-তোমার আরও একটা ছোট্ট হেল্প আমাদের লাগবে মনসুর।

--কী হেল্প?

--কাল এসো। বলে দেব। হাতে একটু সময় নিয়ে এসো। আর রেশমিকে সঙ্গে আনতে ভুলো না।

-আচ্ছা। তাই হবে।

মনসুর অনেকটা শান্ত হয়ে এইবার সোফা থেকে উঠে পড়ল। দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, "এইবার আমার পিছন থেকে ওই টিকটিকিগুলো তুলে নেবেন তো?"

আশুদা হেসে বলল, "নেব।"

মনসুর চলে যেতেই আশুদা বলল, "চল। বেরোতে হবে। তবে তার আগে অত্রিকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর কাল সন্ধ্যায় ওরা বাড়ি থাকবে কিনা। থাকলে আমরা যাব।"

-কোথায় বের হবে?

-দত্তপুকুরে অতোগুলো ওষুধ ডিস্ট্রিবিউটর মিট করলি সেদিন। একবার খোঁজ করে দেখবি না ডাক্তার সবিতা আগরওয়ালের সেই ওষুধটা এবার বাজারে পাওয়া যাচ্ছে কিনা?

মনসুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। মনসুরের অ্যালবামটায় কী আছে ভাবতে ভাবতে উত্তেজনায় তর সইছিল না আমার। এক ঝটকায় যেন রহস্যের মোড় ঘুরিয়ে দিল লোকটা। গাড়িতে বসে আমার  মনের দোলাচল লক্ষ্য করেই আশুদা আপনমনে বলল,"এতকাল চলে গেল, এতকাল শুধু আয়োজনে। / সকলেই সচেতন হতে চায় পরিসরে, ক্ষুধার মতন / নিরন্তর উত্তেজনা নাড়িতে নাড়িতে পেতে চায়।"

-বিনয় মজুমদার?

-স্পট অন অর্ক। ঠিক চিনেছিস। এখন আমরা অস্মিতাকে চিনতে পারি কিনা দেখি।

দত্তপুকুর বারাসাতের জ্যাম পেরিয়ে পৌছোতে দু ঘন্টা লেগে গেল। যে ওষুধ কাউন্টারগুলোতে সেদিন রাতে গিয়েছিলাম, সেখানে সবিতা আগরওয়ালের 'অস্মিতা' কেনার জন্য আগে থেকেই আমার নিজস্ব প্যাডে আশুদার কথা মতো কয়েকটা অন্য নামে প্রেসক্রিপশন করে রেখেছিলাম। সেগুলো দিয়ে একে একে বেশ কয়েক পাতা ওষুধ জোগাড় হলো। দেখলাম অন্যান্য ঘুমের ওষুধের তুলনায় এই 'অস্মিতা' ওষুধের দশটি বড়ির দাম প্রায় চার গুণ। তার ওপর একটি দোকানের থেকে আরেকটি দোকানে একই ওষুধের দামের সামান্য তারতম্য রয়েছে। একটি দোকানে এই বিস্ময় প্রকাশ করতেই দোকানের মালিক বিরক্ত হয়ে বলল, "কী বলেন মশাই! নেহাত কোম্পানি সাপ্লাই দিতে পারছে না ঠিক মতো, তাই। নাহলে এই ট্যাবলেট দশগুণ বেশি দাম হলেও লোকে কিনে নিয়ে যেত।"

লোকটা সবজান্তা গোছের। গলা নামিয়ে তারপর বলল, "এখন মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী জানেন?" আশুদার দিকে তাচ্ছিল্যভরা চাহনিতে একবার তাকিয়ে দেখল লোকটি। আশুদা হাবেভাবে বেশ নার্ভের রোগে কাবু রোগী সেজে রয়েছে। তারপর আমাকে বলল, "ঘুম। এই ঘুম পাবার জন্য পুরো ফার্মা সেক্টর এখন দৌড়ে চলেছে। এই ওষুধ সেখানে মৃতসঞ্জীবনীর মতো।"

গাড়িতে বসতে বসতে আশুদা বলল, "লোকটা বেড়ে বলেছে। মৃতসঞ্জীবনী।"

-তা এতোগুলো পাতা ওষুধ কেনালে যে, খাবে কে?

-লাগবে অর্কবাবু, ঠিক কাজে লাগবে। সবুর করো।

আশুদার ফোনটা বেজে উঠল। গাড়ি চালাতে চালাতে বুঝলাম ফোনের ওপারে তথাগত অধিকারী। ফোন কেটে আশুদা বলল, "টলিপাড়ার নিধিরাম সর্দার রফিক আহমেদ পুলিশের জালে ধরা পড়েছে।"

-এখন যাবে থানায়?

-না। আজ আর নয়। কাল যাবো।

হঠাৎ মনে পড়ল আমার। অত্রি মেসেজ করেছে। আশুদাকে বললাম।

-অত্রি জানিয়েছে গো। কাল ওরা সন্ধ্যায় আছে।

-গুড।

-তাহলে বাড়ি তো এখন?

-একদম।

বলতে বলতেই আশুদা হাই তুলে বলল, "আজ অস্মিতাকে পরখ করা যাক। কী বলিস?"

আমি ঘাড় নাড়াতেই আশুদা গদগদ হয়ে চোখ বন্ধ করে গুণগুণ করতে লাগলো। "তারে ভুলিতে পারিনি, তারে ভুলিতে পারিনি...।" আশুদা কাকে ভুলতে পারেনি কে জানে!

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন