বর্ণমালার সাতকাহন
পর্ব ১৮
মায়াকাননের জিন
দিন কাটে, কখনও কাটে না। যতিচিহ্ন পড়ে লেখায়, ভাবনায়। এলোমেলো হয়ে যায় স্মৃতি। নিজেকে চিনতে অসুবিধে হয়। এমনই কি ছিলাম একদিন? এমন কমলা আলোয়? বর্তমানের ধূসর মেঘ এসে ঢেকে দেয় বহু পাতার মর্মে, ঝর্ণা কলতান ফুলফোটার শব্দ। অবসাদ আর ক্লান্তির নিচে ফসিল হয়ে যাওয়া স্মৃতি চিনে চিনে চলা। এক জীবন। অনেক প্রবঞ্চণা। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া ফিকে আলো।
গান বাঁচিয়ে রাখে। আমার রবি। ভানু।
তাঁর গানের ভেতর সব বেদনা সমর্পণ করি। ভাবি,মনের গভীরে সে কী করে এমন প্রবেশ করতে পারে!
আমার গুরু মায়া সেন। কঠিন ব্যক্তিত্বের
নিচে কোমল হৃদয় একজন মানুষ। ভয় পেতাম সবাই আমরা। কিন্তু তারপর ভীষণ ভালোবেসে ফেলা।
সুর এদিক থেকে ওদিক হবার যো নেই।
গানের খাতা বন্ধ। নেই স্বরলিপি। হারমোনিয়াম তাঁর হাতে। আমরা পায়ের কাছে বসে। যেদিন
নতুন গান শেখাতেন সেদিন আমাদের খুব আনন্দ। যার গানে খুশি তাকে সেদিন জিজ্ঞেস করতেন
কোন গান। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সে যে কী আনন্দ সেদিন! ছোটো ছোটো প্রাপ্তির মধ্যেই
নিহিত থাকে প্রকৃত আনন্দ। যত বয়স বাড়ে তত যেন অনেক পেয়েও মনভরা শূন্যতা।
ভয়হীন ছিল অধীরদা, অধীর বাগচীর কাছে গানের তালিম নেওয়া। হাসি ঠাট্টা, মজার মজার গল্প করতে করতে শিখিয়ে দিতেন কঠিন সব গান। অধীরদার কাছে নজরুলগীতি, রাগপ্রধান, টপ্পা। জামির লেনে বালিগঞ্জ মিউজিক ইনস্টিটিউটে অতুলপ্রসাদ, ডি.এল.রায়, বাউল, ভাটিয়ালি... যেন গান শেখা নয় গানের আসর এমন ছিল অধীর বাগচীর গানের ক্লাস।
জীবন থেকে গান চলে গেছে এখন শুধু
চিৎকার শুনতে পাই। জনৈক পাঠক বলবে এ তোমার বড় একপেশে কথা।
জীবনে প্রথম গানের শিক্ষক সৌমেন
জেঠু। গ্রামের গানের মাস্টার। তখন হাত পৌঁছয় না হারমোনিয়ামের বেলোয়। পাকা চুল, সাদা
পাঞ্জাবি, সাদা আলিগড়ি পাজামা, সাইকেল করে এপাড়া ওপাড়া সারাদিন। টিনের ছাউনি ছোট্ট
ঘরে বসবাস সামনে একটু উঠোন। সব গুরুর আগে তাঁর জায়গা।
মায়ের হাতে মার খেয়েছি সুরে সুর
না লাগলেই। আমাদের মা আমাদের শক্ত হাতে মানুষ করেছিলেন। আমরা ভাইবোন ভাবতাম সিনেমার
মায়েরা সব সময় কী স্নেহশীলা। আমাদের মা কেবল রাগী। সেসময় মায়েরা জনপ্রিয়তা হারানোর
ভয় পেতেন না সন্তানের কাছে, ভয় পেতেন না শাসন করলে সন্তান প্রাণঘাতী হবে। আমরাও জানতাম
মা মারবে বকবে এটাই স্বাভাবিক। আত্মহত্যা অথবা পালানো দুটোই সাব স্ট্যান্ডার্ড বলে
মনে হতো। ক্লাস কনশাশনেস মানেই যে খারাপ তা নয়। আমাদের শেখানো হয়েছে যা শুধুই ভালো।
আমাদের বংশপরম্পরা সম্পর্কে সচেতন করা হতো। তাই অনেক কাজই আমরা নিচু চোখে দেখতাম,শত
দুঃখেও শোক থেকে পালাইনি কর্ম থেকে পালাইনি সহ্য করেছি অসহ্যকেও। মা এক অসীম শক্তি
ছিলেন। অথচ সেসব শাসনের দিন ফিরে পেতে মন এখন আঁকুপাঁকু। পরাজয়ের রাত বারবার এসেছে
ফিরে। যতবার আঁকড়ে ধরতে গেছি ভালোবাসা ততবার সে প্রবঞ্চনা করেছে কখনও মৃত্যু রূপে
কখনও আলেয়ার মত স্বপ্ন শুধু।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক আমার পড়া অন্যতম সেরা উপন্যাস। প্রকৃতি ঈশ্বর। এই মহাপৃথিবীর এত রূপ এত ভারসাম্য এত সূক্ষ্ণ হিসেব আর সমীকরণ কিভাবে যে সৃষ্টি হয়ে চলেছে তা বিজ্ঞান আজও বলতে পারে না। রঙের ছড়ায় উদ্ভাসিত ম্যাকাও অথবা কৃষ্ণ কাক, রজনীগন্ধার আমোদিত গন্ধ অথবা লজ্জাবতী লতা, উত্তাল ঝর্ণা আবার শান্ত সরোবর কে সৃষ্টি করল কিভাবেই বা এত নিপুণ, হাজার পিঁপড়ে সারিবদ্ধ চলেছে এক পথে কেউ পথভ্রষ্ট নয়, অথচ পৃথিবী জয় করা সুচতুর সুপণ্ডিত মানবজাতি মাঝেমধ্যেই পথভ্রষ্ট নবকুমার।
এই হিমালয়, এই সাগর, এই আমাজনের
জঙ্গল, মানুষের প্রত্যেকটি শিরা উপশিরা, হরমোন, পিত্তরস, কাম, নিয়ম মতো কাজ করে চলেছে
অদৃশ্য এক চালকের দ্বারা। এই মহান ঔদার্য কার নিপুণ হাতের সৃষ্টি? কেউ জানে না এই জাদুকর
কে।
আরণ্যক আমাকে প্রকৃতির এই রহস্য
শুনিয়েছে। বড় হয়ে একা পথে নামার পর থেকে অন্য একটি নেশা চাগাড় দিল। নিজের সঙ্গে
নিজের সময়। শিয়ালদহ থেকে চড়ে বসতাম দক্ষিণ শাখার কোনো ট্রেনে গন্তব্যহীন। উদ্দেশ্যহীন।
মন উদাস। বিষণ্ণ। একের পর এক স্টেশন, শহর আর শহরতলি পেরিয়ে যাওয়া, মুড়ি ঘুঘনি, রুমাল
সেন্টিমিটার, ফটাস জল আর কানের দুলের পড়ার, নামা আর ওঠা, তারপর ক্ষীণ হয়ে আসে ভিড়।
দুপাশে অনন্ত সবুজ আল নীলের জোটবন্ধন, খেতের মাঝে একটা দুটো ছাগল, গরু। কতবার এভাবে
অচেনা স্টেশনে নামা। মাটির প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে পথ চলে গেছে আলপথে। কোথাও পানের বরোজ।
সব্জী খেত, মাটির বাড়ি, নিকোন উঠোন। তাদের দাওয়ায় মুড়ি বাতাসা খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি
বেলা। কখনও সরকারি সমীক্ষা কর্মী কখনও সাংবাদিক সেজে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত কয়েকটি
গ্রামের এভাবেই ঘোরা হয়ে গিয়েছিল। একবার
আমি আর মধুমিতা এভাবেই কলেজের পথ বদল করে চলে গেছি ধপধপি। ধপধপির দক্ষিণ রায়ের মন্দির,
সুন্দরবনের বনবিবির মতোই ইয়া গোঁফওলা দেশি মহাদেব হাতে বন্দুক। মেলা হয় মঙ্গল শুক্রবার।
অজ গাঁয়ের মেলা ঠিক যেন তারাশঙ্কর কিম্বা বিভূতিভূষণের বইয়ের পাতা। আলতা আর শাঁখা
পলা কাঁচের চুড়ি পরা মেয়েরা মন্দিরের সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে, দণ্ডি কাটছে মন্দির
ঘিরে, চাঁদোয়া করে বসেছে পসার। জিলিপি, নিমকি, মনিহারি দোকান, অস্থায়ী, দুটো তিনটে
গ্রাম থেকে আসছে কত লোক, বেশিরভাগ মেয়েরা। বউরা বেশি লাল শাড়ি, জল, ফুল, বেলপাতা...।
আমরা মেলা বেরিয়ে মন্দির ছাড়াতেই এসে পড়েছি রোদ ফটফটে খেতে। সিঁথির মতো আলপথ, আমাদের
সামনে একটা হিলহিলে সাপ পানের বোরজের ভেতর লুকিয়ে পড়ছে। টিনের,টালির, খড়ের ছাউনি
মাটির ঘর। এইভাবে খুব কাছ থেকে স্পর্শ করেছি আমাদের দেশ, জমি। সেই সময় দেশ ডিজিটাল
ইণ্ডিয়া নয়, সেই সময়েই ডি পি নিয়ে মাথা ঘামাতো না কেউ। গ্রামের গরিব মানুষেরা নিজেদের গরিব নয়
গেরস্থ ভাবত তেমন বড়ো কোনও কামনা বাসনা ছিলো না বলে তারা হাসিখুশি ছিল খুব। অতিথিবৎসল।
আমরা কাঁসার ঘটি থেকে জল খেলাম বাতাসা খেলাম,
মুড়ি। আমরা সেদিন সরকারি পর্যবেক্ষক অভাব অভিযোগ শুনতে এসেছি। যদিও সেভাবে কোনও অভাবের
কথা তারা বলতে পারেনি। সেদিন অল্পবয়সে উপলব্ধি করেছিলাম আসলেই অভাব মনে। সেই অভাববোধ
জাগিয়ে তুলতে হয় সৃষ্টি করতে হয় রাজনৈতিক কারণে, বাণিজ্যিক কারণে। আসলে সামাজিক
নৈতিকতা আর অর্থনৈতিক প্রসার এই দুটোর সঠিক
মিলমিশ আমাদের এখানে হয়নি। এভাবেই এপাশ থেকে ওপাশ চলে গেল সূর্য। মরা বিকেলে মাটিরপথ
ধরে ফিরব। কথায় কথায় কাঁচা পথ ছেড়ে পিচ পথে উঠলাম। আমরা খেয়ালই করিনি কখন আকাশ
ঢেকেছে কালো মেঘে। আমাদের অল্প বয়েসের চোখ দিয়ে আমরা গোগ্রাসে গিলে নিচ্ছি সৃষ্টির
অপূর্ব চিত্রকলা। বিরাট একটা বটগাছের কাছে আসতেই ঝড় উঠল। হঠাত কোনও জাদুবলে জনহীন
হয়ে গেল চতুর্দিক। ঝোড়ো বাতাসের জোয়ারে হলুদ আর আধা হলুদ পাতি হাঁসের বাচ্চাদের
মতো ছুটে ছুটে যাচ্ছে অনেক দূরে। বিদ্যুৎ চমকাল আকাশ সাদা হয়ে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের
মাথায়। চারিদিক অন্ধকার। এবং তারপর যেটা হলো, আমরা পথ হারিয়ে ফেললাম। পথ, অর্থাৎ
যেপথ গিয়ে থেমেছে রেলপথে। যে পথে ভ্যানরিকশ এখন আর কোথাও নেই, কিছু নেই সামনে পেছনে
শুধু প্রবল তুফান। অনেক দূরে দেখা গেল টিনটিন আলো। একটা ছোট্ট চা-দোকান। আমরা সেদিকেই
এগোলাম। এর কয়েক বছরের মধ্যে আমার প্রণয়হীন পরিণয় সম্পন্ন হয়ে যাবে, বাঁক বদলে
বদলে নদী প্রবাহিত হবে ঘাট থেকে ঘাটে, তবু, সেই সন্ধ্যার কালবৈশাখি, সেই ঝড় আর অস্পষ্ট পিচের
রাস্তা মেলা আর ভাঙা এক বিন্দু আলোয় চা দোকানের আশ্রয় সারাজীবনের মতো বুকের ভেতর
আঁকা থাকল। সেই চায়ের দোকানে একটি লম্ফ জ্বলছিল। সামনে কাঠের বেঞ্চে আমরা দুজন। লম্ফের
ভেতর আগুন ঝড়ের দাপটে একবার রেগে উঠছে একবার নিভু নিভু। পথ হারানোর ভয় নয় আমাদের
প্রধান আতংক ছিল সন্ধ্যার মধ্যে ঘরে না ফিরলে মায়ের কাছে, "প্রহারেণ ধনঞ্জয়"।
পথ হারানোর একটা আশ্চর্য মজা আছে সেদিন বুঝেছিলাম। আজ যখন বারবার জীবনের গোলকধাঁধায়
ঘুরে মরছি, ফিরে আসছি ব্যর্থ ভগ্নদূতের মতো কানাগলি থেকে সহসাই মনে পড়ে সেই সন্ধ্যার
অন্ধকার, সেই ঝড় আর আবছা অস্পষ্ট একাকি চা-বিক্রেতা লোকটির কথা।
এভাবেই একবার একা ক্যানিংএ এসে
নৌকো চড়ে প্রবল জলস্রোতে ভেসে দেখেছি ওপারের গাঢ় সবুজ, পাটাতনে ফুলছাপ শাড়ি কাঁচের
চুড়ি মেয়েরা, মাটির গন্ধওলা লুঙ্গি পরা জেলে, সব দেখে ফিরেছি শহরে।
পিতৃদেবের অনুপ্রেরণায় দুটি অভ্যাস
আজও আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সুস্থ রেখেছে। প্রথমত বই পড়া এবং দ্বিতীয়ত সিম্প্লিসিটি,
সাধারণ যাপনশৈলী। ক্লাস সেভেনে বাবা হাতে তুলে দিয়েছেন ‘মহাস্থবির জাতক’, সতীনাথ ভাদুরীর জাগরী, বনফুলের জঙ্গম। পরে, বুদ্ধদেব
গুহর মাধুকরী, পরপর দেশ পত্রিকার সমরেশ মজুমদারের অনিমেষ ট্রিলজি, শীর্ষেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের
দূরবীন আমাকে পাকিয়ে তুলল। সেই সময় আমার প্রিয় কবি শেলী। কিন্তু তারপর বাবার উপদেশে
রাশিয়ান সাহিত্য ডুবিয়ে দিয়েছিল যা এখনও শ্রেষ্ঠ, দস্তয়ভস্কি, তুর্গেনিয়েভ, গোগল,
পরপর পড়ে গেছি পড়াশুনা তখন মনে হতো সাব স্ট্যান্ডার্ড! বইপোকার মতো একই সঙ্গে আগাথাক্রিস্টি
শার্লক হোমস থেকে রবিন কুক শিডনি শেলডন।
আরেক ধরনের বই ছিল। আজও পাওয়া যায়,
সব সময়ই যা ফুটপাথ থেকে ভাড়ায় পড়া এবং বন্ধুদের মধ্যে হাতে হাতে ঘুরত সে হলো মিলস
এণ্ড বুনস সিরিজের বইগুলি। সব গল্পই এক, তেমন কোনও সাহিত্য মূল্য নেই, কিন্তু মন খুশি
করা।
তবু, বন্ধুহীন জীবন, স্বামীর অকৃতজ্ঞ
আচরণ, দারিদ্র্য মনকে তিতিবিরক্ত করে তুলল। বারবার পিঞ্জরবন্দী প্রাণ খাঁচা ভেঙে আলোর
দিকে উড়তে চাইত। লেখা ও পড়া যদি অবসাদ দূর করতে পারত, পৃথিবীর ইতিহাসে বহু শ্রেষ্ঠ
লেখক-কবিরা তবে যশ প্রতিষ্ঠা লাভ করেও আত্মহননের পথ বেছে নিতেন না। সময় পরিবর্তনশীল
কিন্তু কখনও তার লয় মন্দগতি। যে সয় সে রয়, যে না সয়, সে নাশ হয়। দিনের পর দিন,
বছরের পর বছর সেই সহন চলেছে। শুধুই নেতি। "যে পথে যেতে হবে, সে পথে তুমি একা,
নয়ন আঁধার রবে ধুয়ে আলোকরেখা..."এভাবেই
তীরবিদ্ধ হরিণার মতো ছটফট করতে করতে ছুটে বেড়ানোর দিন সেসব জীবনের ঘন অরণ্যে। এই কষ্ট থেকে মুক্তির যে কটা উপায় আছে তার মধ্যে নির্লিপ্তির পথ একটি। মনকে তুলে নেবার এই সাধনা ছিল কঠিনতম। ক্রমশ একটি কথা উপলব্ধি হয়েছে যে, লৌকিক জীবনে থাকতে গেলে ছল জেনেও ধরে রাখা জরুরী কিছু আকর্ষণ। মা যতক্ষণ কাজ করেন শিশু যেমন খেলনাবাটি নিয়ে মেতে থাকে, ঠিক তেমন।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন