কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

অমিতাভ চৌধুরী

 

যতনে রতন চিনি

 


সেই নিষ্ঠা, সেই যত্ন

যতন অর্থাৎ যত্ন কথাটার মানে কেয়ার বা তত্ত্বাবধান। তবে আরেকটা মানেও আছে। সেটা হল প্রচেষ্টা কিংবা উদ্যম। রতন টাটার মহাপ্রয়াণের পর whatsapp, facebook, youtube, instagramএ এত খবর প্রকাশ পাচ্ছে যে মানুষের আর কিছু অজানা নেই। সুতরাং এই মহা-চরিত্রের উপরে কিছু লিখতে যাওয়া মানে সেটা নির্ঘাত পুনরাবৃত্তি হবে। লোকে বলবে, ও হরি, এ তো আমি কবেই পড়ে ফেলেছি, তুমি নতুনটা আর কি শোনালে? তাই আমি আমার কিছু একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এখানে লিখছি, জীবনের এক গর্বিত কৃতিত্ব বা proud accomplishment— যে কৃতিত্ব হাসিল করতে গিয়ে আমাকে এবং আমার মত আরও কয়েকজনকে প্রচণ্ড পরিমাণ প্রচেষ্টা, পরিশ্রম আর উদ্যমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। অবশেষে সেই ‘পেশাদারী যতন’ আমাদের এক বিশাল রতনের কাছাকাছি এনে দিল। একটা বিরাট প্রাপ্তি – রতন টাটার নিমন্ত্রণ। হ্যাঁ, ঠিকই পড়লেন, রতন টাটা নিমন্ত্রণ, যেখানে উনি হোস্ট, এবং আমরা গেস্ট!

আন্তর্জাতিক পটভূমি

খানিকটা International Background বলে নি, তাহলে ব্যাপারটা বোঝাতে সুবিধা হবে। ৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে 80 দশকের গোড়ায় জাপান আক্রমণ করল আমেরিকাকে! অবশ্য সেই আক্রমণে কোন সৈন্য সামন্ত দরকার হল না। তারা আক্রমণ করল আমেরিকার ব্যবসাকে, এবং কম্পিটিশন বা প্রতিযোগিতায় এতটাই সাফল্য লাভ করল যে আমেরিকার অবস্থা নাজেহাল। তিন Automobile giants— Ford, General Motors and Chrysler অন্তর্জলি যাত্রায় চলে গেল। জাপানি গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ি আর বিক্রিই হয় না আমেরিকানদের নিজের দেশে। গাড়ি এক্সপোর্ট করা তো অতীতের স্বপ্ন! Nicon, Canon, Fuji, Pentax, Olympus এইসব ক্যামেরার ব্রান্ডগুলো রাতারাতি বাকি সব ক্যামেরা কোম্পানিকে কবরে পাঠিয়ে দিল, শুধু আমেরিকাতে নয়, সারা বিশ্বে। চারটি মোটরাইক কোম্পানি, Honda, Kawashaki, Suzuki আর Yamaha-র ঠেলায় পৃথিবীর বাকি সব মোটরসাইকেল কোম্পানিকে বন্ধ। পৃথিবীর চারভাগের তিন ভাগ Photocopier এর মার্কেট ছিল Xerox কোম্পানির সাথে। Photocopier মেশিনের ডাকনামই হয়ে গেছিল জেরক্স মেশিন। হঠাৎ দেখা গেল, যে সব ‘জেরক্স’ মেশিন বাজারে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো Japanese Canon Photocopier!  আমেরিকার নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য ঠেকল একেবারে তলানিতে গিয়ে।

দিগগজ মার্কিন ইকোনোমিস্টরা বুঝতেই পারছিলেন না এই আক্রমণ কি করে ঠেকানো যায়। এদিকে দেশের অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেই চলেছে। আমেরিকার এই কান্নাকাটির সময় আবির্ভূত হলেন একজন মহাপুরুষ, যার নাম Malcolm Baldrige, তৎকালীন US Secretary of Commerce. জাপানি আক্রমণকে ঠেকাতে তিনি দেশব্যাপী  কোয়ালিটি উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু করলেন। তাঁর পলিসিকে অনুসরণ করে পরপর কোম্পানিরা আবার একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলো। অন্তত তারা বুঝতে পারল কিভাবে জাপানি কোম্পানিকে টক্কর দেওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ ইন্দ্রপতন হল। অত্যন্ত দুঃখজনক-ভাবে Malcolm Baldrige একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তার নামে ইউ.এস. গভর্নমেন্ট Malcolm Baldrige National Quality Award ঘোষণা করে, যাতে কিছু বিশেষ মানদণ্ডের নিরিখে প্রতিবছর পুরস্কৃত করা হত ৫টি শ্রেষ্ঠ আমেরিকান কোম্পানিকে (ইদানিং কালে বেড়ে ১৮টি হয়েছে)।

রতন টাটার চিন্তাধারা এবং বানেশ্বরনের আবির্ভাব

JRD Tata এক অসাধারণ নৈতিক মানদণ্ড বা ethical standard তৈরি করে গেছিলেন।  কিন্তু তিনি বিশ্বাস রাখতেন প্রত্যেক টাটা কোম্পানির স্বতন্ত্র উৎকর্ষতা অথবা individual excellence এ। সেই সময় টাটা কোম্পানিগুলোর নিজস্ব আলাদা আলাদা লোগো ছিল, নিজের ব্যবসা নিজের মতো চালানোর অধিকার ছিল প্রত্যেকের। এমনকি গ্রুপ-এর নৈতিক মানদণ্ডকে, অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে হলেও, নিজের নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতো বিভিন্ন কোম্পানি।  ৯০ দশকের গোড়ার দিকে টাটা সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে রতন টাটা প্রথমেই চাইলেন ৮০টি টাটা কোম্পানিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে পরপর নানা ধরনের কাজ করা হল। পুরো গ্রুপ উপহার পেল নতুন একটা লোগো। টাটার নৈতিক মানদণ্ডকে নথিবদ্ধ করা হল, জন্ম নিলো ‘টাটা কোড অফ কন্ডাক্ট’ (Tata Code of Conduct)। এমনকি ব্যবসায় নিজেদের বাজারে সব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছু কিছু লক্ষ্য স্থির করা হল। কিন্তু এত কিছুতেও রতন টাটার মনের মধ্যে অপূর্ণতা থেকেই যাচ্ছিল।

সেই সময় তাঁর বন্ধু Mr. S. A. Vaneswaran আমেরিকার থেকে ভারতবর্ষে চলে আসতে রাজি হলেন। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার Malcolm Baldrige Award Committee-র একজন মান্যতা-প্রাপ্ত মূল্যায়নকারী (certified assessor), যিনি শ্রেষ্ঠ আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে মূল্যায়ন করে তাদেরকে পুরস্কৃত করতেন। বানেশ্বরন আইডিয়া দিলেন যে Malcolm Baldridge-এর অনুসারে টাটা গ্রুপের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা শুরু করতে এবং শ্রেষ্ঠ কোম্পানিগুলোকে পুরস্কৃত করতে। রতন টাটা বুঝতে পারলেন যে এই পদ্ধতিতে সবকটা টাটা কোম্পানির একটা মূল্যায়ন হয়ে যাবে এবং তাদেরকে “আন্ডার ওয়ান আমব্রেলা” নিয়ে আসা যেতে পারে। ব্যাস! শুরু হল বানেশ্বরনের তত্ত্বাবধানে TBEM (Tata Business Excellence Model) এবং সেটা হল হুবহু Malcolm Baldrige এর মানদণ্ড অক্ষুণ্ণ রেখে। টাটা কোম্পানিদের মূল্যায়নের পরে প্রত্যেক বছর যে পুরস্কার দেওয়া হবে তার নাম রাখা হল JRD QV Award (QV মানে Quality Value).





(রতন টাটার সঙ্গে বানেশ্বরনের একটা 30 বছর পুরনো একটা ছবি, TBEM লোগো, আর রতন টাটার মহাপ্রয়াণের কিছুদিন পরে বানেশ্বরন তাঁর সম্বন্ধে যা বলেছিলেন সেগুলো উপরে দেওয়া হল উৎসাহী পাঠকদের জন্যে}

এদিকে আমরা, পাতি ভারতীয়রা, নাকানিচোবানি খাচ্ছিলাম আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ standard এর পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে— সত্যি বলতে কি এই 1000-point স্কেলের নির্ণায়ক গোড়ার দিকে আমাদের মাথাতেই ঢুকছিল না। অন্যদিকে, রতন টাটার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এতগুলো টাটা কোম্পানিকে মূল্যায়ন করবে কে? ভারতবর্ষে Baldrige assessor তো কেউ নেই। আমেরিকা থেকে assessor আনতে হচ্ছিল, যারা প্রতিদিন দুই থেকে তিন লাখ টাকা নিতো সেই সময় (আজ থেকে তিরিশ বছর আগে)। অর্থাৎ একটা কোম্পানির জন্য অন্তত কুড়ি তিরিশ লাখ টাকা!! এইভাবে আশিটা কোম্পানিকে মূল্যায়ন করতে হলে তার পেছনে পেছনে কি বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং বানেশ্বরন শুরু করলেন স্বদেশী TBEM Assessor তৈরি করা। আমেরিকা থেকে Baldrige এর মান্যতাপ্রাপ্ত ট্রেনর নিয়ে এসে টাটা গ্রুপের উৎসাহী executive-দের তালিম দেয়া শুরু হল। একেই তো সেরকম উৎসাহী লোক গ্রুপে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার ওপরে যারা এগিয়ে এলো, Baldrige criteria হৃদয়ঙ্গম করতে তাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সত্যিকারের কারণটা ছিল একটা বিশাল সাংস্কৃতিক ব্যবধান বা cultural gap. একের পর এক তিনটে স্টেজে ট্রেনিং এবং পরীক্ষা হতো। প্রথম স্তরেই, ৬০/৭০ ভাগ উৎসাহী অফিসার অসফল হয়ে বিদায় নিত। বাকিদের দ্বিতীয় স্টেজ দিয়ে এগোতে হতো, সেখান থেকে অর্ধেক এগোতে পারত তৃতীয় স্তরে! তৃতীয় স্টেজে যারা পৌঁছল, তাদের মধ্যে প্রায় অনেকেই ফাইনাল পরীক্ষায় পাশ করে Certified TBEM Assessor খেতাব পেত, a proud recognition!

এত পড়াশুনা করলে জীবনে কি হতে পারতাম সেসব চিন্তা করে লাভ নেই। তবে তিনটে স্তর পেরিয়ে এই সার্টিফিকেট হাসিল করার জন্য অপরিসীম মেধা এবং পরিশ্রম দরকার হয়েছে। তাই এই খেতাব পেয়ে আমাদের গর্বে বুক ফুলে উঠলো। স্বাভাবিক কারণেই। কিন্তু এখানেই তো শেষ নয়, এরপর শুরু হল সত্যিকারের TBEM Assessment। দুনিয়াদারির নানা পর্যায় পেরিয়ে এসে আজ আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, TBEM-এর assessments-গুলোই আজ পর্যন্ত আমার পেশাদারী জীবনের সবচেয়ে সুকঠিন এসাইনমেন্ট। প্রত্যেক টাটা কোম্পানিকে সার্বিকভাবে মূল্যায়ন বা assess করার জন্য আট থেকে দশজনের একটা গ্রুপ একটা গ্রুপ তৈরি করা হতো, যার সঙ্গে থাকতো একজন করে সার্টিফাইড্ আমেরিকান Baldrige Assessor. অতঃপর দিবারাত্রির কাব্য! প্রত্যেককেই পনেরো দিনের বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে এই দুরহ কর্ম সঠিকভাবে এবং সুচারুরূপে সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জ।

একজন অসাধারণ ভদ্রলোক

আগেই বলেছি, TBEM Assessor হিসেবে আমাদের মানসিক ও কায়িক পরিশ্রমের এবং আমাদের পেশাদারী যত্নের ফল যা পেয়েছিলাম তা সত্যিই অভাবনীয়। সেই যতন আমাদের রতনকে চিনিয়ে ছিল একদম কাছাকাছি থেকে। প্রত্যেক বছর ফাইনাল TBEM Assessors পরীক্ষার শেষ হবার এবং allotted টাটা কোম্পানিদের assessment শেষ করার পরে, ২৯ জুলাই (JRD-র জন্মদিনে) রতন টাটার ‘পার্সোনাল ইনভিটেশনে’আমরা যেতাম প্রথমে বোম্বেতে এবং তারপর গোয়াতে। সেখানে আমরা সম্মানীয় অতিথি আর  রতন টাটা নিজে হোস্ট। উনি বারবার একটাই কথা বলতেন, তোমরা হচ্ছ Tata group এর intellectual assets. তোমরা না থাকলে আমরা কোটি কোটি টাকা আমেরিকান Assessor-দের দিতে বাধ্য হতাম। ওই দিনই আমাদের পরীক্ষা পাশের সার্টিফিকেট দিতেন রতন টাটা নিজের হাতে। (এখানে বলে রাখা ভালো, ইঞ্জিনিয়ারিং, ওকালতি, ডাক্তারির মত একবার পাস করলেই সারা জীবনের মতো সার্টিফিকেট পায় না TBEM-এর মূল্যায়নকারী বা Assessors-রা। এখানে প্রত্যেক বছর পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হয়, সার্টিফিকেট মাত্র এক বছরের জন্য বৈধ। তার কারণ, Baldrige criteria বছরে বছরে চেঞ্জ হতে থাকে)। সান্ধ্য Boozing sesson এর পর ডিনারে উনি ততক্ষণ নিজের প্লেট তুলতেন না যতক্ষণ না আমরা প্রত্যেকে খাওয়া শুরু করেছি। তাছাড়াও  ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে টেবিলের কাছে গিয়ে খানিকক্ষণ আড্ডা মারতেন একদম ব্যক্তিগতভাবে। রতন টাটার professionalism, vision, philanthropy এইসব নিয়ে প্রচুর তথ্য বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা নিজের চোখে যাকে দেখেছি তিনি একজন নিখাদ ভদ্রলোক। পর্বতের খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে তার বিশালতাটা বোঝা যায় না, কিন্তু প্রত্যেকটা পাথর, সবুজিমা, ছোট ছোট বাঁক আর মাটির গন্ধ হৃদয়ে লেগে থাকে। সেই রকম ভাবেই আমরা এই বিশাল চরিত্রের মানুষটিকে দেখেছি কয়েকবার। এত কাছে থেকে।

আজও স্মৃতিতে সেই দিনগুলো জ্বলজ্বল করছে … কোনদিন ম্লান হবে না।

প্রথম পংক্তিতে (উপবিষ্ট): Mr. Ratan Tata, Dr. J J Irani এবং Tata Sonsএর গণ্যমান্যরা।

 দ্বিতীয় পংক্তিতে অন্যান্য Assessor-দের সঙ্গে আমি, second from the left



Tata Refractories এর সহকর্মীদের
 
সাথে JRD QV ট্রফি গ্রহণ মিরতন টাটার থেকে    I am on the extreme left



 




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন