কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩০ |
ল্যাণ্ডফল
কাঁদুনে বাচ্চার মতো ঘিনঘিন করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে অবশেষে। সাড়ে চারটের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে এলো আর শুরু হয়ে গেল শনশন করে হাওয়া। যেন দানব আসবে। রাস্তার আলোগুলো দপদপ। সমুদ্রের ঢেউ এখন বাড়বে অনেক উঁচু হবে আকাশ ছোঁয়া হবে। এসবই জানে ওরা। এসবই ছোটো থেকে দেখে বড় হয়েছে নিতাই ফরিদ সুজয় সুমন আর রফিক, নদীর ধারে যাদের বাস।
এসব দেখতে দেখতে প্রতি বছর হারিয়ে
গেছে জমিয়ে রাখা গোপন কত বস্তু, প্রয়োজনের দলিল... মিনতি, রোজিনা, ভারতী, বীণা কিম্বা
সাহানারা সকলেই জানে।
সকাল থেকেই পোঁটলা বাঁধা শুরু। চাঙড় চাঙড় মাটি খাবে নদী। ছুঁচের মতো বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দেবে সব। ওরা জড়োসড়ো বর্ডার পার করা গরুর পালের মতো গাদাগাদি করবে ইস্কুল বাড়িতে। আসবে ভিক্ষের মতো শুকনো চিঁড়ে, কাঁসিতে থাবড়া করে খিচুড়ি। যেন জেলের কয়েদি। যেন ভিখারী। কিন্তু ওরা অতটাও নিরন্ন নয়। নদীর ধারে টালি, খড়ের ছাওয়া ঘর। সামনে মাটির উঠোন কঞ্চির বেড়া। সেসব ভেসে যাবে। ওদের বাপ দাদার আমল থেকেই দেখে আসছে। এই নদী ওদের জীবন। রফিকুলের জীবন, মিনতির জীবন... এইটুকুই জমি তাদের। উঁচু উঁচু তালগাছ, নারকেল গাছ নুয়ে যাচ্ছে তীব্র হাওয়ার বেগে। গোঁগোঁ করে আওয়াজ হচ্ছে না গতবারের মতো, কিন্তু বৃষ্টির দাপটে সব সাদা। যেন এক ভিন্ন গ্রহ আর তারা মানুষের মতো দেখতে অসহায় অজানা পশু, স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাবে এবার।
কাল সকালে আসবে ত্রিপল। ত্রাণ। ওরা হিসেব জানে না। বেশি হিসেব জানা ভুল। অঙ্ক জানা ভুল। এই যে একেকটি ঘূর্ণাবর্ত আসে, তারপর অপ্রতুল খিচুড়ি আর প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম ত্রিপল প্লাস্টিক আসে, এই যে স্টেশন অঞ্চলে গিয়ে কেউ কেউ খবরের কাগজ কিনে আনে, দেখা যায় দেশে সরকার কতো কী যে তাদের দিয়েছে! কতো ভেবেছে, কতো ব্যয় করেছে, সে এক হেঁয়ালি মনে হয় সুজয় সুমন ফরিদের। ছোটো অশিক্ষিত মাথায় সেই জটিল হিসেব ওরা বুঝতে পারে না। কিন্তু সময় অস্থির। একসময় আকাশ পরিষ্কার হয়। হাতে হাতে আবর্জনা সরায় ওরা। নতুন করে ঘর বাঁধে, তার মধ্যে দু একজন অসুখে পড়ে। মরে। কেউ ভেসে গিয়ে নিঁখোজ হয় নদীতে। কয়েকটা ট্রলার ডুবে যায় জেলেদের নিয়ে।
হরিহরকাকা লাঠি ভর দিয়ে বসে থাকে
একফালি রোদে চাটাই পেতে।
চমৎকারের মতো কয়েকমাস পরে পঞ্চায়েত সর্দারের ঘর একতলা থেকে দোতলা হয়ে যায়, কিম্বা দোতলা থেকে তিনতলা, হরিহর যৌবন থেকে এসব দেখে আসছে। ভাঙা প্রেম জোড় লাগার মতো নাতি-পুতি বাপধনেরা তখন ভেজা খড় শুকোয়, নতুন করে কঞ্চির আগল দেয় ডবকা মেয়েমানুষ যেমন করে রাতের শেষে ঢেকে নেয় আব্রু।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন